চরাচর-ঐতিহাসিক বিক্রমপুর by আজিজুর রহমান
খ্রিস্টপূর্ব প্রায় দেড় হাজার বছর আগে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার অজয় নদীর দক্ষিণ তীরে একটি উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। পণ্ডিতরা মনে করেন, বৃহত্তর বাংলা ভাষাভাষী ভূখণ্ডের এটিই প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন। সেকালে এই ভূখণ্ডে একক কোনো বৃহৎ রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি।
পুরো ভূখণ্ডে স্বাধীন রাষ্ট্রের মতো ছোট ছোট অনেক পৃথক অঞ্চল ছিল। এগুলোকে তখন বলা হতো জনপদ। প্রাচীন বইপত্র থেকে এমন ১৬টি জনপদের নাম পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে : বঙ্গ, সমতট, গৌড়, রাঢ়, পুন্ড্র, হরিকেল, সূক্ষ্ম, বরেন্দ্র, কর্ণসুবর্ণ, আম্রলিপ্তি, পুষ্করণ ইত্যাদি। বর্তমান বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ছিল বঙ্গ জনপদের অবস্থান। প্রাচীন শিলালিপি থেকে বঙ্গের দুটি এলাকার নাম পাওয়া যায়। এর একটির নাম বিক্রমপুর, অন্যটি নাব্য। প্রাচীন বঙ্গের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকার বিশাল ভূখণ্ডজুড়ে ছিল বিক্রমপুর। বিক্রমপুরের অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমান মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ জেলা, সোনারগাঁও উপজেলা, দোহার ও নওয়াবগঞ্জ উপজেলা, চাঁদপুর জেলার অংশবিশেষ, বৃহত্তর ফরিদপুর অর্থাৎ শরিয়তপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও ফরিদপুর জেলা (এসব জেলার নিচু জলাভূমি ছাড়া), পটুয়াখালীর উঁচু অংশ এবং ঢাকার উত্তর সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। বঙ্গের অপর অংশ নাব্য নামে কোনো জায়গার অস্তিত্ব এখন আর নেই। ঐতিহাসিকদের ধারণা, বর্তমান ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ ও পটুয়াখালীর নিম্ন জলাভূমি নাব্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। বঙ্গরাজদের বিশাল হস্তিবাহিনী ছিল। বঙ্গসেনারা অনেক দুঃসাহসী যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছিল বলে জানা যায়। রামায়ণ ও মহাভারত গ্রন্থে বঙ্গ সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। বাল্মীকির রামায়ণের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দ আর মহাভারতের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী। এ দুটি গ্রন্থে বিক্রমপুরকে বঙ্গের অঞ্চল হিসেবে অনেকবার উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বিক্রমপুরের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। চন্দ্ররাজ বংশের শাসনকালে বিশ্বখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর ৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। চন্দ্ররাজবংশের পর বর্মরাজবংশ ও সেনরাজবংশীয় নৃপতিরা ১২৪৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিক্রমপুরে রাজত্ব করেন বলে ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ তাঁর 'তাবাকাত-ই-নাসিরী' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ত্রয়োদশ শতকে মুসলমানদের রাজক্ষমতা দখলের পর শুরু হয় বাংলার মধ্যযুগের কালপর্ব। বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে বিক্রমপুরের গৌরবোজ্জ্বল সূর্য ক্রমেই অস্তমিত হতে থাকে। এ সময় মূলত ছোট ছোট সামন্ত ভূস্বামীরা বিক্রমপুর শাসন করতেন। ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে মোগল বাহিনীর কাছে স্বাধীন ভূপতি চাঁদবায়-কেদার রায়ের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বিক্রমপুর সম্পূর্ণভাবে দিলি্লর অধীনস্থ হয়ে পড়ে এবং সোনারগাঁওয়ের অধীন একটা মহাল বা পরগনায় পরিণত হয়। অতঃপর মোগল শাসকদের নিয়োগকৃত বিক্রমপুরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান বা ফৌজদার মুন্সী হায়দার হোসেনের নামে ঐতিহাসিক বিক্রমপুরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মুন্সীগঞ্জ। বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার মুন্সীগঞ্জ, টঙ্গিবাড়ী, লৌহজং, শ্রীনগর ও সিরাজদিখান_এ পাঁচটি উপজেলা নিয়ে এখনকার লোকায়ত বিক্রমপুর।
আজিজুর রহমান
আজিজুর রহমান
No comments