জাতীয় সংসদ-ওএসডি এমপি by শাহ্দীন মালিক
এবার শিরোনাম ইংরেজিতে। সংশ্লিষ্ট আর একটা ইংরেজি শব্দ হলো অ্যাব্রিভিয়েশন। অর্থ শব্দ সংক্ষেপ। বাংলা একাডেমীর অভিধানে আছে, ইংরেজি অ্যাব্রিভিয়েশন অর্থ কোনো শব্দ, পদবি ইত্যাদি সংক্ষিপ্ত করা। কেন জানি না, আমরা বাংলায় শব্দ সংক্ষেপ ব্যবহার করি না।
যেমন, সংসদ সদস্যের বদলে সংক্ষেপে সস লেখা বা ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু ইংরেজির মেম্বার অব পার্লামেন্টের বদলে বহুল ব্যবহূত ও প্রচলিত শব্দ সংক্ষেপ এমপি। এমপি সবাই বুঝবে, কিন্তু সস তো কেউ বুঝবে না।
শব্দ সংক্ষেপ ওএসডির বিস্তারিত পদবির সঙ্গে কমবেশি সবাই, বিশেষত সরকারি চাকরিসংশ্লিষ্ট লোকজন পরিচিত, অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি। পদবিটাতে একটা বিরাট গাম্ভীর্য আছে। উচ্চপদস্থ কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হলে পত্রপত্রিকায় সাধারণত থাকে, বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ওমুকের চাকরি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছে। ভাবখানা এমন, তাঁকে একটা বিশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বা অচিরেই হবে।
ওএসডি হওয়ার ‘সুসংবাদে’ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার চোখে পানি আসে কি না, তা বলতে পারব না। তবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্তির উত্ফুল্লে নতুন স্যুট-টাইয়ের খোঁজে দর্জি বা কাপড়ের দোকান বা নারী কর্মকর্তা হলে শাড়ির দোকানে ঢুঁ মারেন না। না মারারই কথা।
অর্থাত্ আসল অর্থের সঙ্গে পদবির মিল নেই। ওএসডি সাহেবের বিশেষ দায়িত্ব হলো, কোনো দায়িত্ব না পাওয়া বা দায়িত্বহীন হয়ে যাওয়া।
সরকারের কোনো বিভাগের প্রধান বা অতিরিক্ত সচিব, আর সচিব যখন ওএসডি তখন তাঁর কাজ সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে হাজিরা দেওয়া। কোনো কাজকাম নেই। কাজকাম-দায়িত্ববিহীন পদটার নাম ওএসডি—অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি।
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। আপনার আগের সরকারের সঙ্গে দহরম-মহরম ছিল একটু বেশি। তাই নতুন সরকার এসেই আপনাকে করল ওএসডি। অফিসে যাবেন-আসবেন, বেতন-ভাতাদি পাবেন, সরকারি বাড়িটাও থাকবে। তবে ওই পর্যন্তই। ফাইল-নোটে সই করা, প্রকল্প গ্রহণ-অনুমোদন, অধস্তনদের ওপর সরদারিসহ কিছুই আর করা লাগবে না।
ধারণা করছি, ওএসডিদের মধ্যে হয়তো প্রচণ্ড রকমের একটা এতিমবোধ কাজ করে। ইদানীং পত্রপত্রিকায় খবর দেখেছি যে অমুক সরকারের আমলে কত শত কর্মকর্তা ওএসডি ছিলেন। আর তাও মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। বর্তমান সরকারের আমলে এ সংখ্যার তারতম্যসংক্রান্ত খবর চোখে পড়েছে বলে মনে পড়ছে না। তবে নিঃসন্দেহে ধরে নিতে পারি, গত সরকারের আমলের অনেক ওএসডি এ সরকারের আমলে দায়িত্বে ফিরে এসেছেন, আর গত সরকারের কিছু হোমরাচোমরা এখন হয়েছেন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
২.
আসলে বিচিত্র এই আমাদের দেশ। কোনো কাজকাম না দিয়ে, বসিয়ে রেখে বছরের পর বছর বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিধি অন্যান্য দেশ কেন যে এখনো রপ্ত করছে না, তা ভেবেই পাই না।
কপাল মন্দ। ওএসডি-সংক্রান্ত এই অতি উত্তম ব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলে শুধু যে সরকারি চাকরিরই চেষ্টা-তদবির-পরীক্ষা দেওয়া ইত্যাদিতে মগ্ন হতাম তা-ই নয়, চাকরিটা পেয়ে গেলে এমন রাজনৈতিক দল-নেতার সঙ্গে ওঠাবসা, চাই কি দহরম-মহরম রাখতাম, যারা কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তাহলে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সব সময়ই বলতে পারত যে ওই ব্যাটা আমাদের না। অতএব বানাও তাকে ওএসডি। বছরের পর বছর ওএসডি থেকে সকালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে এক চক্কর ঘুরে এসে, বাকি দিন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতাম। বিকেল হওয়ার আগেই আড্ডা মারতে বেড়িয়ে পড়তাম। মাস শেষে বেতন ঠিকই পেতাম। ওএসডিদের দল পাকাতাম। দাবি হতো, বিনা কাজে বেতন-ভাতা ন্যূনতম ১০ বছর দিতে হবে। একবার ওএসডি পদবি পেলে ১০ বছরের আগে কোনো কাজ বা দায়িত্ব দিতে পারবে না। আন্দোলনটা বেগবান বা জোরদার করতে পারলে ওএসডি পদকটা আঁকড়ে থাকতাম অন্তত আরও পাঁচ বছর।
কাজটাজ করা লাগবে না। অথচ বেতন-ভাতাদি বজায় থাকবে। এমন সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে সরকারি কর্মকর্তারা কেন মনঃক্ষুণ্ন হন, সেটা আমার বোধগম্য নয়।
ওএসডি হওয়া সরকারি কর্মকর্তারা বিনা কাজে বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার মোক্ষম সুবিধাটা হেলায় হারাতে চেয়ে যে ভুল করেন, সেটা আমাদের বিরোধীদলীয় এমপি সাহেবরা নিঃসন্দেহে উপলব্ধি ও আত্মস্থ করেছেন। মারহাবা!
৩.
বিরোধীদলীয় এমপিরা, যত দূর জানি, সংসদে মাঝেমধ্যে হাজিরা দিলেও অত্যন্ত কঠোরভাবে ওএসডি হয়ে গেছেন।
এমপি সাহেবরা তো নিছক সরকারি কর্মকর্তা নন। তাঁদের মান ও স্থান অনেক ওপরে। তাঁদের আদেশ দেওয়ার কেউ নেই, থাকার কথাও নয়। অর্থাত্ তাঁদের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা নেই। তাই তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ওএসডি বানিয়ে বসে আছেন।
আদেশ দেওয়ার কেউ না থাকলেও, সহজেই বোধগম্য, তাঁরা তাঁদের নেত্রীকে অনুসরণ করবেন। নেত্রী অবশ্যই অনুকরণীয়। নেত্রী নাকি কুল্লে তিন দিন সংসদে গমন করেছেন, অর্থাত্ কাজে হাজিরা দিয়ে বক্তিমা ঝেড়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্য এমপিরা অবশ্য কাজ করেছেন, অর্থাত্ সংসদ অধিবেশনে যোগদান করে কয়েক দিন বেশি দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য পাঠকমাত্রই জানেন, সেটা এই সংসদের প্রথম দিকের ঘটনা, তার পর থেকে উনারা নিজেরাই নিজেদের ওএসডি বানিয়ে বসে আছেন।
একটা ব্যাপারে সরকারি কর্মকর্তা ওএসডির সঙ্গে তাঁদের ভীষণ মিল। ওএসডি হয়ে সুখে-শান্তিতে বেতন-ভাতাদি ভোগ করার পরিবর্তে তাঁরা প্রায়ই ব্যস্ত থাকেন দায়িত্ব ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় অর্থাত্ দায়িত্বশীল পদে আসীন হওয়ার জন্য। সে জন্য ওখানে-এখানে চেষ্টা-তদবির, ওপরওয়ালাকে বোঝানো যে তাঁকে সবাই ভুল বুঝছে, তিনি তাঁর দায়িত্ব পালনে একপায়ে খাড়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমাদের ওএসডি এমপি সাহেবরাও প্রতিনিয়ত প্রায় একই সুরে গীত গাইছেন। সংসদে যেতে তাঁরা সদা প্রস্তুত। দরকার একটু ছোটখাটো সাহায্য-সহযোগিতা। ওএসডি কর্মকর্তাকে দায়িত্বে ফেরত নেওয়া যেমন সরকারের ইচ্ছায় হয়, তেমনি সরকার ও সরকারি দল ইচ্ছে করলেই তাঁদের দায়িত্ব প্রত্যর্পণ করতে পারে, অর্থাত্ তাঁরা সংসদে যেতে পারেন। হাজার হলেও এমপি সাহেবরা তো আর মামুলি সরকারি কর্মকর্তা নন। তাই তাঁদের শুধু চেয়ার-টেবিল হলেই চলবে না। বলে রাখা দরকার, লোকমুখে শুনেছি, ওএসডির সংখ্যাধিক্য হলে অনেক সময় নাকি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে ওএসডি সাহেবদের বসার জন্য পর্যাপ্ত চেয়ার-টেবিলেরই নাকি সংকুলান হয় না। এমপি সাহেবরাও তাই চেয়ার-টেবিলের নিশ্চয়তা চাইছেন। ফার্স্ট বেঞ্চে বসতে হবে।
যখন স্কুলে পড়তাম তখন নিয়ম ছিল, ক্লাসের ফার্স্ব-সেকেন্ড বয়রা ফার্স্ট বেঞ্চে বসত। এমপি সাহেবরা স্কুলজীবনে ফার্স্ট বেঞ্চে বসতে পারেননি বলে সেই দুঃখ এখন পুষিয়ে নিতে চাইছেন, নাকি সব সময় ফার্স্ট বেঞ্চে বসতেন বলে এখনো তাই চাইছেন, সেটা তো বলতে পারব না।
তাঁদের আরেকটা হক দাবি আছে। এমপি সাহেবদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা থাকা ভীষণ অন্যায়। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। চুরি-ডাকাতি-সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-অস্ত্র-খুন-জখম, নদী দখল ইত্যাদি মামলা হবে আমার-আপনার মতো দজ্জাল-জালেম নাগরিকের বিরুদ্ধে। এমপি সাহেবদের বিরুদ্ধে মামলা চলবে এমন মগের মুলুক তাঁরা কেমনে বরদাশত করবেন।
সরকারি দলের এমপির বিরুদ্ধে সব মামলা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক আর বিরোধী এমপিদের বিরুদ্ধে মামলা চলবে—এটা হতেই পারে না। অতএব ওএসডি না হয়ে তাঁদের তো গত্যন্তর নেই। তা ছাড়া সংসদে বসে সময় নষ্ট করলে তদবির, ব্যবসা-বাণিজ্য কখন করবেন।
৪.
একটা আইনগত সুরাহা দরকার। ইদানীং সংবিধান সংশোধন একটা বহুল প্রচলিত আলোচিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে। মতৈক্যের প্রত্যাশা মরীচিকাসম। তবে একটা সংশোধনের ব্যাপারে আমার আশা, সরকারি ও বিরোধী দলের মতৈক্যের অভাব নাও হতে পারে।
ক্রমাগত ৯০ কার্যদিবস সংসদে উপস্থিত না থাকলে সংসদ সদস্যপদ বাতিল হওয়ার যে বিধান আছে, সেটার সংশোধন করতে হবে। আপাতত ৯০ থেকে বাড়িয়ে অনুপস্থিতির অর্থাত্ ওএসডির মেয়াদকাল অন্তত নয় মাস করা দরকার।
আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা পাঁচ-ছয় বছর একনাগাড়ে ওএসডি ছিলেন। নিছক ও নিতান্ত সরকারি কর্মকর্তারা যদি দায়িত্ব-কর্তব্য পালন না করে এত দীর্ঘকাল বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন, তাহলে এমপি সাহেবদের অন্তত নয় মাস ওএসডি রাখার বিধান নিশ্চয়ই অযৌক্তিক বিবেচিত হতে পারে না। এই সুবিধা সব প্রজাতির এমপিদের প্রাপ্য হতে হবে। অন্যথায় সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে মতৈক্যে আসবেন না তাঁরা।
আমাদের বিরোধ-বিদ্বেষ, সংঘাত-হানাহানির রাজনীতিতে মতৈক্যের এমন একটা সম্ভাবনার দুয়ার এমপিরা দড়াম করে বন্ধ করবেন না—নতুন বছরের শুরুতে অধমের এই প্রত্যাশা পূরণ হবে আশা করি। ওএসডির সময়সীমা নয় মাসের পরিবর্তে ১৮ মাস করে সংবিধান সংশোধন করলে পুলকিত হব অত্যধিক।
হাজার হলেও নতুনত্বের মাপকাঠি বা আবিষ্কারের ঔজ্জ্বল্যে আমাদের সংসদ কখনো মলিনতায় ভোগে না। তত্ত্বাবধায়ক সংশোধনী দিয়ে অল্প সময়ের জন্য হলেও নির্বাচিত সরকারকে বিদায় দিয়েছিল এবং সেটা ছিল মতৈক্যের ভিত্তিতে, যদিও একদলের জোরজবরদস্তি ছিল একটু বেশিই। উপজেলা থেকে উপজেলা চেয়ারম্যানকে বিদায় দেওয়া হয়েছে মতৈক্যের ভিত্তিতেই। ট্যাক্স-ফ্রি থেকে শুরু করে গাড়ি বরাদ্দের ৭০০ কোটি টাকার ব্যাপারে শতভাগ একমত। তাই ওএসডি সংশোধনের ব্যাপারে আমি অত্যন্ত আশাবাদী।
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট; ডিরেক্টর, স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments