বিচারের বাণী-বাংলাদেশের আদি সংবিধানের ক্ষমতা by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী

পশ্চাত্পট ২৬ মার্চ, ১৯৭১, রাত ১২টা। ‘দোজখের সব কটি ফটক খুলে দেওয়া হলো। যখন প্রথম গুলিটি ছোড়া হলো, শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল পাকিস্তানের সরকারি বেতারের কাছাকাছি তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে। এটি নিশ্চয়ই এবং সে মতোই শোনা গেল পূর্ব টেপরেকর্ডকৃত বাণী—শেখ সাহেব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করছেন।


ঘোষণাটি পূর্ণ পাঠ ভারতের বৈদেশিক মন্ত্রণালয় কর্তৃক “বাংলাদেশ ডকুমেন্টস”-এ প্রকাশিত হয়েছে। সেটায় (ইংরেজি ভাষায়) বলা হয়েছিল: এটা সম্ভবত আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাই, যে স্থানেই আপনারা থাকুন, এবং যা কিছু আপনার আছে, তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করুন। আপনাদের লড়াই চলতে থাকবে যে পর্যন্ত না পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্য বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত হয় ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হয়।’ (সিদ্দিক সালিক, উইটনেস টু সারেন্ডার, করাচি, ১৯৭৭)।

জন্মকথা
মুজিবনগর, বাংলাদেশ। ১০ এপ্রিল, ১৯৭১। একটি প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে পাঠ করা হলো ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ যার অনূদিত তিনটি অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিচ্ছি: ‘ঘোষণা দিতেছি ও প্রতিষ্ঠা করিতেছি যে, বাংলাদেশ হইবে সার্বভৌম জনগণের প্রজাতন্ত্র এবং এতদ্বারা ইতঃপূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে নিশ্চিত করিতেছি, এবং এতদ্বারা নিশ্চিত করিতেছি ও সিদ্ধান্ত লইতেছি যে, সংবিধান যে সময় পর্যন্ত প্রণীত না হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপরাষ্ট্রপতি থাকিবেন, ইংরেজি ভাষায় লিখিত আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হইতে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া বিবেচিত হইবে।’
অতঃপর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাক্ষরিত ‘বাংলাদেশের সাময়িক সংবিধান’ ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি জারি হয় এবং তার ৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ইতিপূর্বে বাংলাদেশের এলাকা থেকে (পাকিস্তানের) জাতীয় সংসদে ও (পূর্ব পাকিস্তানের) প্রাদেশিক সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠিত হবে। ১০ মার্চ বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ৩৪ জন সাংসদের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সর্বশেষ গণপ্রজাতন্ত্রের সংবিধান প্রণয়ন ও গৃহীত হয় যার উল্লেখ সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ ভাগে করা হয়: ‘এতদ্বারা আমাদের এই গণপরিষদে, অদ্য তেরশত ঊনআশী বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের আঠার তারিখ, মোতাবেক ঊনিশ শত বাহাত্তর খ্রীস্টাব্দের নভেম্বর মাসের চার তারিখে, আমরা এই সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম।’

সংবিধান সংশোধন
উপরিউক্ত শিরোনামে আদি সংবিধানে ১৯৭৩ সালে সংশোধনের পরে ১৪২ অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি এই: ‘১৪২। (১) এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও
(ক) সংসদের আইন-দ্বারা এই সংবিধানের কোনো বিধান সংশোধিত হইতে পারিবে; তবে শর্ত থাকে যে,
(অ) অনুরূপ সংশোধনীর জন্য আনীত কোনো বিলের সম্পূর্ণ শিরোনামায় এই সংবিধানের কোন বিধান সংশোধন করা হইবে বলিয়া স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকিলে বিলটি বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা যাইবে না; (আ) সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত না হইলে অনুরূপ কোন বিলে সম্মতিদানের জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে না;
(খ) উপরি-উক্ত উপায়ে কোন বিল গৃহীত হইবার পর সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট তাহা উপস্থাপিত হইলে উপস্থাপনের সাত দিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিবেন, এবং তিনি তাহা করিতে অসমর্থ হইলে উক্ত মেয়াদের অবসানে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’

স্বৈরশাসকদ্বয়ের কর্মকাণ্ড
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, সংবিধানের উদ্ধৃত ১৪২ অনুচ্ছেদটি পড়ে আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, সংশোধনযোগ্য হচ্ছে সংবিধানের যেকোনো বিধান। আইনমতো হচ্ছে বিধান অর্থ ওই নিয়মগুলো যাদের অনুসরণে কোনো বিষয় নির্বাহ করা হয়। সুতরাং সংবিধানের প্রস্তাবনা কিংবা সংবিধানের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগ (যাদের শিরোনাম যথাক্রমে ‘প্রজাতন্ত্র’, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ ও ‘মৌলিক অধিকার’) সংশোধনযোগ্য নয় এ কারণে এদের অন্তর্ভুক্ত অনুচ্ছেদগুলো ১৪২ অনুচ্ছেদের আওতায় আসে না। এ জন্য এক সামরিক স্বৈরশাসক ১৯৭৮ সালে সংবিধানের প্রস্তাবনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ভাগে অন্তর্ভুক্ত ৮ অনুচ্ছেদ ও আরও কতিপয় অনুচ্ছেদ সংশোধনযোগ্য করা যাবে উল্লেখে ১৪২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে তিনটি দফা ১(ক), ১(খ) ও ১(গ) যোগ করেন। অতঃপর ওই স্বৈরশাসক ১৯৭৮ সালের সামরিক আইন দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন দ্বারা সংবিধানের প্রস্তাবনা ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করেন ও তারই ধারাবাহিকতায় আরও কতিপয় অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংবিধানের মূল চরিত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র নষ্ট করেন এবং পরবর্তী স্বৈরশাসক সংবিধানে ২ক অনুচ্ছেদ ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ যোগ করে ওই নষ্টামিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে আনেন।

আদালতের রায়
‘প্রস্তাবনা কিংবা ৮ অনুচ্ছেদ গণরায় ছাড়া সংশোধন করা যায় না। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ প্রস্তাবনা ও ৮ অনুচ্ছেদের মাঝখানে দণ্ডায়মান মুক্তির প্রতিমূর্তি-স্বরূপ এবং এটি আমাদের সংবিধানের ধ্রুবতারা।’ [পড়ুন, ৪১ ঢাকা ল’ রিপোর্ট (আপিল বিভাগ) পৃষ্ঠা ১৬৫] সংবধািনের ৭ অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি এই: ‘৭(১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে। (২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইবে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সময়ের ঘোষণা, সামরিক আইন প্রজ্ঞাপন ও সামরিক আইন আদেশগুলো বেআইনি, বাতিল ও ত্রুটিযুক্ত এবং সেহেতু ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধন) আইন, ১৯৭৯-ও বেআইনি ও সরাসরি বাতিল এবং তার ভিত্তিতে প্রদত্ত সকল প্রজ্ঞাপপ ও আদেশসমূহ বেআইনি ও বাতিল ঘোষণা করা হলো।’ [পড়ুন হাইকোর্ট বিভাগের একটি দ্বৈত বেঞ্চের রায়—১৪ বাংলাদেশ ল’ টাইমস (স্পেশাল ইস্যু), ২০০৬]

ক্ষমতার সূত্রাবলি
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, এতক্ষণ যা জানলাম, তার ভিত্তিতে আমরা অনায়াসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারি, অর্থাত্ বাংলাদেশের সংবিধানের ক্ষমতার সূত্রাবলি খুঁজে পেতে পারি। কাজটি শুরু করার আগে এ ব্যাপারে আরেকটি ঐতিহাসিক উদাহরণ জানা যাক। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের পক্ষে ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণীত ও পঠিত হয়। যেখানে বলা হয়, বর্তমান রাজার কর্মকাণ্ড হচ্ছে, অবিরত অন্যায় ও ক্ষমতার অপব্যবহার সেহেতু ইংরেজশাসিত এই উপনিবেশের বাসিন্দারা স্বাধীন ও মুক্ত হওয়ার অধিকারী। অতএব প্রথম সূত্র: পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর ‘একটি অনৈতিক ও বিশ্বাসহন্তা যুদ্ধ ঘোষণা করায়’ (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র থেকে উদ্ধৃত) বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যার ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মারফত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পত্তন হয়। দ্বিতীয় সূত্র: বাংলাদেশের সাময়িক সংবিধান জারি হয় ও তার ৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গণপরিষদ গঠিত হয়। তৃতীয় সূত্র: গণপরিষদ কর্তৃক বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়। চতুর্থ সূত্র: বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ দেশের শেষ সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী সংবিধানের প্রস্তাবনা কিংবা ৮ অনুচ্ছেদ (রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিসমূহ) সংশোধন করা যায় না। পঞ্চম সূত্র: সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের মৌলিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সামরিক আইন প্রজ্ঞাপন-আদেশ বেআইনি ও বাতিল। উপরিউক্ত সূত্রাবলি খুঁজে পাওয়ায় আপনি সহজেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেন যে, বাংলাদেশের সংবিধানের ক্ষমতা একক এবং সে চিন্ময় অজর অমর অক্ষয় অব্যয়।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, অতঃপর আপনি একটি সাধারণ সূত্রের মুখোমুখি হচ্ছেন এবং সেটা হচ্ছে এ দেশে কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তাড়িত হতে পারেননি হেতু উপরিউক্ত পাঁচটি সূত্রের বিপরীতে অযৌক্তিক অযোগ্য সূত্র তৈরি করে যাচ্ছেন। ক্ষতবিক্ষত সংবিধান
ভেবেচিন্তে রেখেঢেকে সংশোধন করতে হবে, এমন ধারণা ভ্রান্ত ও আত্মঘাতী; বরং সঠিক ধারণা হবে, আদি সংবিধান থেকে সব কটি বেআইনি পরিবর্তন সংশোধন করা নয়, বাদ দিতে হবে; সংবিধানকে আদি মহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংবিধান সব দেশেরই নাগরিকদের আদরের ধন, বংশপরম্পরায় পবিত্র দলিল, যাকে ঘিরে তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা সাধ-আহ্লাদ মূর্ত হয়।
বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট।

No comments

Powered by Blogger.