শিশু শ্রমিকদের মজুরি ‘কাজ শেখা’ by মাজেদুল নয়ন

শুধুমাত্র শেখার বিনিময়ে কাজ করে যাচ্ছে দেশের বিরাট সংখ্যক শিশু শ্রমিক। কয়েক মাস বা বছর পর মালিকের যদি মনে হয়, কাজ শিখেছে সে ক্ষেত্রেই দেওয়া হচ্ছে মজুরি।

রাজধানীর মোটর ওয়ার্কশপসহ শিশুশ্রমের বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই চিত্র এটাই। তবে খাবারের হোটেলগুলোতে প্রথমদিকে খাবার আর থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় শিশুদের। কিন্তু ‘কাজ শেখা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় সব ক্ষেত্রেই।
রাজধানীর বংশালের একটি মোটর ওয়ার্কশপের দোকানে কাজ করছে ৮ বছরের শিশু রফিক। মালিক রাশিদুল ইসলামের বাড়ির দারোয়ান আব্বাসউদ্দিনের ছেলে এই শিশু। রংপুরের আব্বাসউদ্দিনকে যে বেতন রাশিদুল দেয়, তাতে আর পড়াশোনা চালানো সম্ভব হয়নি রফিকের। দু’ক্লাস পড়া শেষেই ওয়ার্কশপের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয় রফিককে। বাবার সঙ্গে রাশিদুল সাহেবের গ্যারেজেই থাকে সে। আর তার নিজের মজুরি হচ্ছে ওয়ার্কশপে ‘কাজ শেখা’।

রাশিদুল ইসলামের মোটর ওয়ার্কশপে রফিকের মতোই কাজ করে আরও দুই শিশু রাফি ও নাদিম।

রাশিদুল ইসলাম বলেন, ‘অরা অহন কাম শিখতাছে, অহন টাকা পয়শা দিলে নস্ট হইয়া যাইবো। এট্টা নাট-বল্টুই তো ঠিকমতো খুলবার পারে না। কাম শিখলে নিজেরাই ইনকাম করবার পারব।’

পুরান ঢাকার চানখারপুর, বংশাল, নবাবপুর, বাংলাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, নাট-বল্টুর কারখানা, প্লাস্টিকের কারখানা, লোহা-লক্করের কারখানা, মোটর ওয়ার্কশপ, পুরোনো জিনিসপত্র বিক্রির দোকান, ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের দোকান ও গুদাম, গলির ছোট কারখানা ও দোকানপাটে অনেক শিশুশ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে।
এসব কর্মস্থলে নিয়োজিত বেশীরভাগ শিশু শ্রমিকই শুধু, ‘কাজ শেখার বিনিময়ে অথবা থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে কাজ করে যাচ্ছে।

এখানে কর্মঘণ্টার কোনো বালাই নাই। চায়ের দোকান ও হোটেলগুলোতে শিশুরা কাজ করছে সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা অবধি। আবার ওয়ার্কশপগুলো খোলা থেকে শুরু করে বন্ধ করা পর্যন্ত কাজ করছে শিশুরা।

এসব মোটর ওয়ার্কসপ ও কারখানাগুলোতে দেখা গেছে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুরা নিয়োজিত রয়েছে ঝুকিপূর্ন কাজে। ভারী ও বিপদজনক যন্ত্রাংশ তাদের নাড়াচাড়া করতে হচ্ছে এবং অতিরিক্ত সময় কাজ করছে।

নবাবপুরে পাইপের কারখানায় কাজ করে ১৩ বছরের রাব্বি।

রাব্বি বাংলানিউজকে জানায়, কারখানার মালিক, ওস্তাদ ও অন্যান্যরা আসার আগেই আসতে হয় তাকে ও সহশিশুশ্রমিক লালনকে। রাব্বি আর লালন সকাল ৭টার দিকেই এসে কারখানা খোলে, মেশিন পরিস্কার করে, পানি দেয়, অন্যান্য টুকটাক কাজ করে। আবার রাতে সবাই চলে সবকিছু গুছিয়ে রেখে, দোকান বন্ধ করে বাড়ি যায় তারা দু’জন।

তাদের দু’জনেরই কোনো পারিশ্রমিক নেই। ‘কাজ শেখা‘র বিনিময়েই কাজ করছে তারা। তাদের চেয়ে দু’তিন বছরের বড় যারা তারা নাম মাত্র বছরে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা বেতন পান।
  
এদিকে শিশুশ্রমিকদের বেলায় শ্রম আইন দূরে থাক, কোনো আইনই মানা হয় না।

কয়েকটি কারখানার মালিকের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, মালিকদের পছন্দের শ্রমিক শিশুরাই। শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নেওয়ায় বেতন দিতে হয় না, কথা মতো কাজ করানো যায়, ভুল করলে ধমক ও মার দেওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, যা বোঝায় তাই বুঝে।

কাজ শেখানোর নাম করে এভাবে শিশুদের বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করানোর ব্যাপারে ‘পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুরা নিজে থেকেই ওই শর্তে রাজি হয়ে এসেছে। শিশুর পড়াশোনার খরচ মেটাতে না পারা, ঠিকমতো খেতে দিতে না পারা এবং ভবিষ্যতে শিশু উপার্জন করবে এ আশায় দরিদ্র বাবা-মা নিজেরাই অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগ দেন শিশুদের। এ জন্যে অতিদারিদ্রতাকেই দায়ী করেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) করা সর্বশেষ (২০০৬ সাল) সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকায় এক লাখ ৪২ হাজার শিশু গৃহকর্মী কাজ করছে। সারা দেশে শিশু গৃহকর্মীর সংখ্যা চার লাখ ২১ হাজার ২২৬।

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ঢাকায় পথশিশু রয়েছে তিন লাখ ৩৪ হাজার ৮০৭টি। এরা কেউ না কেউ কোনো ধরণের শ্রমে নিয়োজিত। গৃহকর্মী ও পথশিশুদের বিভিন্ন ধরণের নির্যাতন এবং হয়রানির শিকার হওয়া সাধারণ ব্যাপার।

সমীক্ষা মতে, সারা দেশে পথশিশুর সংখ্যা চার লাখ ৪৫ হাজার ২২৬। আর সারা দেশে ২৪ লাখ শিশু কোনো না কোনো ধরণের কাজের সঙ্গে জড়িত। এভাবে দেশে পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুশ্রমিকের মোট সংখ্যা ৭৪ লাখ।

এ ব্যাপারে আইন ও শালিস কেন্দ্রের শিশু অধিকার ইউনিটের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক গীতা চক্রবর্তী বলেন, শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। তাই প্রকৃত সংখ্যা বিবিএসের গবেষণা ও জরিপের ফলকে ছাড়িয়ে যাবে। এখন সারা দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি হকে বলে ধারণা দেন তিনি।

শিশু শ্রমে নিয়োজিদ শিশুদের ব্যাপারে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী সোমবার রাতে বাংলানিউজকে বলেন, দারিদ্রতার কারণে শিশুদের শ্রম দিতে হবে, এ যুক্তি মেনে নেওয়া কষ্টকর। আমরা বারবার আইনের মাধ্যমে শিশুদের জন্যে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার কথা বললেও করা হচ্ছে না। দেশে শিক্ষার হার বাড়লেই শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমবে বলে জানান তিনি।

অশিক্ষিত শিশু ও তাদের অভিভাবকদের মিথ্যা যুক্তি দিয়ে প্রতারনার মাধ্যমে শিশুদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন এক শ্রেণির লোভাতুর মালিকরা। শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি। 

এ ব্যাপারে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শিরীন শারমিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘শিশুশ্রম কমানোর ব্যাপারে সরকারের বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলছে। আরও কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এগুলো বেশ ফলপ্রসূ হবে বলে আমাদের আশা। ঝুকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োগ বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.