কৃষিশ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা by আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
কৃষিভিত্তিক আমাদের এই বাংলাদেশ। জিডিপিতে সরাসরি কৃষির অবদান ২১ ভাগ। আর পরোক্ষ অবদান তো রয়েছেই। বাংলাদেশের মোট জনশক্তির প্রায় ৫০ ভাগ কৃষিকাজে নিয়োজিত। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণীর সর্বাধিক এ খাতটি প্রতিবছরই মে দিবসে থেকে যায় উপেক্ষিত।
কৃষিশ্রমিকদের নেই কোনো সংগঠন, সমিতি বা কারখানার শ্রমিকদের মতো ট্রেড ইউনিয়ন। আর তাই তাদের মৌলিক মানবিক ও সামাজিক অধিকার, সুযোগ-সুবিধা ও নানা সমস্যা থেকে যায় অতল অন্ধকারে।
জাতীয় কৃষি জরিপ ২০০৮ থেকে দেখা যায়, দেশে ক্রমেই কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এ চিত্রকে দেশের কৃষির জন্য নেতিবাচক লক্ষণ বলে মন্তব্য করেছেন। উচ্চ মূল্যের কৃষি উপকরণ, কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, কৃষিতে মধ্যস্বত্বভোগী ও মহাজনের দৌরাত্ম্য, কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে কৃষকদের খাপ খাওয়াতে না পারা প্রভৃতি কারণে স্বাধীনতা-উত্তর সময় থেকে ক্রমান্বয়ে প্রান্তিক কৃষকরা ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হচ্ছে এবং একইভাবে কৃষিশ্রমিকের সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৮৩-৮৪ সালের শুমারিতে দেখা গেছে, মোট গ্রামীণ পরিবারগুলোর মধ্যে ৭২.৭০ শতাংশের কৃষিখামার রয়েছে। ১৯৯৬ সালে তা কমে ৬৬.১৮তে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০০৮ সালের শুমারিতে দেখা গেছে, এ সংখ্যা আরো কমে ৫৬.৭৪ শতাংশে নেমে এসেছে। শুমারিতে উল্লেখ করা হয়, দ্রুত নগরায়ণের ফলে বিপুলসংখ্যক কৃষিশ্রমিক অকৃষি খাতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে, যা কৃষি-অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক কিছু নয়।
কৃষিতে শ্রম দিয়ে যারা জীবিকা অর্জন করে তাদের কৃষিশ্রমিক বলা হয়। দেশের মোট গ্রামীণ অধিবাসীর প্রায় ৩৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৮৮ লাখ ৫০ হাজার পরিবার শুধু কৃষিশ্রমের ওপর নির্ভরশীল। ১৯৮৩-৮৪ সালে কৃষিশ্রমের ওপর নির্ভরশীল পরিবার ছিল ৩৯.৭৭ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে তা কমে ৩৫.৯০ শতাংশে নেমে আসে। ১৯৮৩-৮৪ ও ১৯৯৬ সালের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে দেখা গেছে, সব বিভাগে কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। ২০০৮ সালের জরিপে দেখা যায়, দেশের মোট পরিবারসংখ্যার ৩১ দশমিক ১৩ শতাংশ কৃষিশ্রমিক পরিবার। যার মধ্যে ০ দশমিক ২৭ শতাংশ শহরে এবং ৩০ দশমিক ৮৬ শতাংশ গ্রামে বাস করে। রাজশাহী বিভাগে সবচেয়ে বেশি এবং ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে কম কৃষিশ্রমিক বাস করে।
লেবার ফোর্স সার্ভে ১৯৯৯-২০০০ অনুযায়ী, ১৫ বছরের ওপরে দেশের মোট সক্রিয় জনগোষ্ঠী বা শ্রমশক্তির পরিমাণ ছিল ৪০.৭ মিলিয়ন, যা ২০০২-০৩ সালে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৪৬.৩ মিলিয়ন। সর্বশেষ ২০০৫-০৬ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশের এই শ্রমশক্তির পরিমাণ ছিল ৪৯.৫ মিলিয়ন। ১৯৯৯-২০০০ সালে এই শ্রমশক্তির সর্বাধিক ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ নিয়োজিত ছিল কৃষিকাজে, যা ২০০২-০৩ সালে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৫০ দশমিক ৭ শতাংশে এবং ২০০৫-০৬ সালে আরো কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৪৮ দশমিক ১ শতাংশে। এ সমীক্ষা থেকে দেশের ক্রমবর্ধমান মোট শ্রমশক্তির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিতে ক্রমহ্রাসমান শ্রমশক্তির বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
প্রত্যেক কৃষকই একজন কৃষিশ্রমিক। নানা কারণে দেশের এই কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। দেশের খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে যা বেশ উদ্বেগজনক। বর্তমানে ফসল উৎপাদন মৌসুমে কৃষিশ্রমিকের অপ্রতুলতার কারণে দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে মজুরির হার; যা উৎপাদন খরচের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে ফসল উৎপাদন ব্যয়। অনুসন্ধানে কৃষিশ্রমিক ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ার যে কারণগুলো খুঁজে পাওয়া যায়, সেগুলো হলো_নগরায়ণের প্রভাবে কৃষিশ্রমিকদের শহরের দিকে ধাবিত হওয়া। শিল্পায়নের প্রভাবে কৃষিশ্রমিকের ক্রমান্বয়ে শিল্পশ্রমিকে পরিণত হওয়া। বছরজুড়ে নিরবচ্ছিন্ন কৃষিকাজ না থাকা। কৃষিশ্রমে মজুরির হার কম হওয়া। তুলনামূলকভাবে পরিশ্রম বেশি হওয়া। প্রান্তিক কৃষকদের ক্রমান্বয়ে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হওয়া। গার্মেন্ট-শিল্পে কৃষিশ্রমিক, বিশেষ করে নারীশ্রমিকের নিয়োজিত হওয়া। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া। ফসল উৎপাদনে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় কোন শস্য বীমা না থাকা। কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কার্যকর সরকারি পদক্ষেপ না থাকা।
কৃষিশ্রমিকদের এখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। অথচ আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে কৃষিকর্মী বা কৃষিশ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য স্বতন্ত্র আইন রয়েছে। ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কৃষকদের অধিকার সংবলিত আইন প্রণয়নের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে এবং এ জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা কৃষিশ্রমিক বা কৃষিকর্মী হিসেবে নারীদের ভূমিকার স্বীকৃতি প্রদানের জন্য সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তাই আমাদের দেশেও অবিলম্বে কৃষিশ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী তাদের কাজের স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। আর তাদের এসব দাবি আদায়ের জন্য গ্রামে গ্রামে কৃষক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকের নিম্নলিখিত অধিকারগুলোর ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া উচিত_মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণে কৃষকদের অগ্রাধিকার প্রদান করা। কৃষকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে বিনা মূল্যে ইউনিয়নভিত্তিক স্যাটেলাইট ক্লিনিক গড়ে তোলা। প্রতিটি গ্রামে কৃষক ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে সেখানে তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা করা। ফসল মৌসুমে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা। ন্যায্য মূল্যে কৃষকদের জন্য মানসম্মত বীজ, সার, কীটনাশক ও সেচের ব্যবস্থা করা। সুদখোর মহাজনের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করা। ফড়িয়া ও দালালদের হাত থেকে কৃষকদের সুরক্ষা প্রদান করা। কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা। অফ মৌসুমে কৃষকদের জন্য বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করা। কৃষি উপকরণে ভর্তুকি প্রদান করা। কৃষকদের ক্ষমতায়নের জন্য কৃষক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা। জলবায়ু পরিবর্তনসহ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকদের সুরক্ষা প্রদান করা। কৃষিশ্রমিকদের, বিশেষ করে অবহেলিত নারী কৃষিশ্রমিকদের স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এক লাখ ৪৭ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট একটি দেশ বাংলাদেশ। প্রতিদিন প্রায় ১৫ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করছে এ দেশের কৃষক সমাজ। তাদের নেই কোনো নির্ধারিত কর্মঘণ্টা বা নেই কোনো নূ্যনতম মজুরি। তার পরও ফসল মৌসুমে উদয়-অস্ত পরিশ্রম করে এরাই সচল রাখছে দেশের অর্থনীতির চাকা। তাই কৃষকদের অধিকার নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের সবাইকে। খাদ্যে নিরবচ্ছিন্ন স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কৃষিশ্রমিক তথা কৃষকদের ক্ষমতায়নের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
No comments