কল্পকথার গল্প-অস্ত গেল হরতালের চাঁদ by আলী হাবিব
আরেক দফা হরতাল হয়ে গেল। না, ইতিহাসের শেষ হরতাল এটা নয়। আমাদের এখানে হরতাল না করার ঘোষণা দিয়ে হরতালের ডাক দেওয়ার ইতিহাস আছে। যেন নিতান্তই দায় ঠেকে ওটা করতে যাওয়া। তো এই হরতাল জিনিসটা কী, সেটা আমরা সবাই জানি।
একটি শিশুও বলে দিতে পারবে, হরতাল মানে কিছু গাড়িঘোড়া পোড়ানো, রাস্তায় ইটপাটকেল ছোড়া, মানুষের বিরক্তি ও বিড়ম্বনার একশেষ, কোথাও কোথাও (সুবিধাজনক জায়গাতে) পিকেট ইত্যাদি। দিনের শেষে হরতাল সফল ও ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ধন্যবাদ জ্ঞাপন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটাই এখন হরতাল। জনগণের দাবি আদায়ের জন্য একসময়ের সবচেয়ে কার্যকর ও স্বীকৃত রাজনৈতিক পন্থাটি এখন সবচেয়ে বিরক্তিকর একটি ব্যাপার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গুজরাটি থেকে বাংলায় অনুপ্রবেশকারী এই শব্দটি নিয়ে মানুষের বিরক্তির শেষ নেই। এখন অনেকের মনে হতে পারে, বাংলায় শব্দটিতে জায়গা না দিলেই বোধ হয় ভালো হতো; কিন্তু একবার যখন ঢুকে পড়েছে, তখন তো আর বের করে দেওয়া যাচ্ছে না, বয়কট করা যেতে পারে। বাংলাদেশে তো অনেক কিছুই হয়, একটা সিনেমা হলে বেশ হতো। সিনেমার নাম হবে, ডাক দিয়ে যাই। একবার ডাক দিলে যখন অনেক কিছুই হয়, তখন এমন একটা সিনেমা নির্মাণের চিন্তা কেউ না কেউ করতে পারেন। ডাক দিয়ে আবার যে হরতালটি হয়ে গেল, এটা বিএনপির নিয়ম রক্ষার হরতাল। আগের সপ্তাহে বলা হয়েছিল, কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। সেই কঠোরতা কতটা দেখতে পেল দেশের মানুষ? তার আগে বুঝতে হবে কঠোরতার সংজ্ঞা কী? হ্যাঁ, আগের চেয়ে বেশি ককটেল ফেটেছে, কিছু গ্রেপ্তার হয়েছে। কোথাও কোথাও লাঠিপেটা হয়েছে। এ সবই কি কঠোরতা? সাধারণ মানুষের কাছে অবশ্য কঠোরতার অন্য সংজ্ঞা আছে। দীর্ঘ পথ কখনো রিকশায়, কখনো ভ্যানে, কখনো হেঁটে পাড়ি দিয়ে অনেককে অফিস করতে হয়েছে। অসুস্থ অনেককে হাসপাতালে নেওয়া যায়নি। রাজধানীর মোড়ে মোড়ে গণপরিবহনের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। চেনা যানজট থেকে মুক্ত ছিল রাজধানী। বড় রাস্তার পাশের দোকানপাট খোলেনি। এটাও হয়তো কঠোরতা। যা-ই হোক না কেন, হরতালের একটি মহৎ উদ্দেশ্য কিন্তু থাকে। আগেও ছিল। সেই উদ্দেশ্য এখন কতটুকু সাধিত হচ্ছে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
কেন এমন হয়? সর্বসাধারণের ধারণা আমাদের রাজনীতিতে অশুভ শক্তি ভর করেছে। রাজনীতিতে গুণগত মানের পরিবর্তন হবে, এমনটি আশা ছিল আমাদের, সেই আশা পূরণ হয়নি। হ্যামিলনের বাঁশিঅলা গল্পটি জানা আছে সবার। তেমন কোনো বাঁশিঅলা এসে যদি অশুভ শক্তিকে কোথাও নিয়ে গেলে বেশ হতো। পুরাণের একট গল্প বলা যাক। অগস্ত্য মুনি একবার সাগরের সব পানি খেয়ে ফেলেছিলেন। ফলটা দাঁড়াল এই, দীর্ঘদিন সাগর শুকনো পড়ে থাকল। এই সাগরে পানি এনেছিলেন যিনি, পুরাণে তাঁর নাম ভগীরথ। তিনি আবার সগর রাজার বংশধর। এই সগর রাজার দুই স্ত্রীর কারো পুত্র না থাকায় রাজা কৈলাস পর্বতে গিয়ে তপস্যা শুরু করলেন। এরপর এক রানির ষাট হাজার, আরেকজনের এক পুত্র জন্ম নিলো। এই ষাট হাজার পুত্রের অত্যাচারে পৃথিবীর মানুষ অতিষ্ঠ। সগর রাজা একসময় অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেই যজ্ঞের ঘোড়া এই ষাট হাজার ছেলে সেই ঘোড়াকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানোর সময় কোথায় হারিয়ে গেল। রাজা বলে দিলেন, ঘোড়া খুঁজে বের করতে না পারলে রাজপুত্ররা রাজার সামনে আসতে পারবে না। এই ছিল তাঁর হুকুম। ষাট হাজার রাজপুত্র গেল ঘোড়ার সন্ধানে। তারা সমুদ্রের ধারে গিয়ে একটা গর্ত দেখতে পেয়ে সেখানে খুঁড়তে শুরু করে দিল। খুঁড়তে খুঁড়তে পাতালে প্রবেশ। পাতালে বসে ধ্যান করছিলেন কপিল মুনি। ঘোড়াটি পাশেই ছিল। রাজপুত্ররা কপিল মুনিকে দেখেনি। ঘোড়া ধরতে যেতেই মুনি রেগে আগুন। তিনি চোখ তুলে তাকাতেই রাজপুত্ররা পুড়ে ছাই। অন্যদিকে রানি শৈবার পুত্র অসমঞ্জা। সে আবার ছোট ছোট ছেলেদের ধরে পানিতে ফেলে দেয়। এই নিয়ে রাজার কাছে নালিশ যেতেই রাজা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। এই অসমঞ্জার ছেলে অংশুমান। অংশুমানের ছেলে দিলীপ। দিলীপের ছেলে ভগীরথ। ভগীরথ গেলেন গঙ্গার কাছে। তাঁকে পৃথিবীতে আসতে অনুরোধ জানালেন। গঙ্গা রাজি। কিন্তু স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে পড়ার সময় পৃথিবী কি তাঁকে ধারণ করতে পারবে? ভগীরথ গেলেন মহাদেবের কাছে, মহাদেব গঙ্গাকে ধারণ করতে রাজি হলেন। ত্রিভুবন কাঁপিয়ে গঙ্গা পড়লেন পৃথিবীতে। মহাদেবের জটা সাদা হয়ে গিয়েছিল। এবার ভগীরথ গঙ্গাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। ভগীরথ আগে আগে যান, পেছনে গঙ্গা। এভাবে যেতে যেতে সমুদ্রের ধারে উপস্থিত হলেন ভগীরথ। গঙ্গার পানিতে সাগরে আবার পানি এসে গেল। পুরাণে বলা আছে, সাগরের পানি একসময় মিষ্টি ছিল। পরে সমুদ্র বিষ্ণুকে অবহেলা করায় বিষ্ণু তাঁর শরীরে ঘাম দিয়ে সমুদ্রের পানি লোনা করে দেন।
আমাদের রাজনীতির পানি ঘোলা হলো কেমন করে? কেমন করে দূষিত হলো আমাদের রাজনীতি? অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, হরতালের মতো রাজনৈতিক অধিকারও আজ একটি তামাশায় পরিণত হয়েছে। হরতাল যেন আমাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল সোশ্যাল নেটওয়ার্ক তো খুব শক্তিশালী। সেই যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস তুলে ধরতে চাই। কথাটা সবার মুখে মুখে ঘুরছে। ফেসবুকে লেখা হয়েছে, 'আজ শনিবার হরতালের চাঁদ উঠেছে। রবিবার ও সোমবার পবিত্র হরতাল। হরতাল মোবারক।' শনিবার দেখা দেওয়া হরতালের চাঁদ গতকাল সন্ধ্যায় অস্ত গেছে। আবার কবে উঠবে সেটা জানেন হরতালের ঈশ্বর। না উঠলেই বাঁচোয়া।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
কেন এমন হয়? সর্বসাধারণের ধারণা আমাদের রাজনীতিতে অশুভ শক্তি ভর করেছে। রাজনীতিতে গুণগত মানের পরিবর্তন হবে, এমনটি আশা ছিল আমাদের, সেই আশা পূরণ হয়নি। হ্যামিলনের বাঁশিঅলা গল্পটি জানা আছে সবার। তেমন কোনো বাঁশিঅলা এসে যদি অশুভ শক্তিকে কোথাও নিয়ে গেলে বেশ হতো। পুরাণের একট গল্প বলা যাক। অগস্ত্য মুনি একবার সাগরের সব পানি খেয়ে ফেলেছিলেন। ফলটা দাঁড়াল এই, দীর্ঘদিন সাগর শুকনো পড়ে থাকল। এই সাগরে পানি এনেছিলেন যিনি, পুরাণে তাঁর নাম ভগীরথ। তিনি আবার সগর রাজার বংশধর। এই সগর রাজার দুই স্ত্রীর কারো পুত্র না থাকায় রাজা কৈলাস পর্বতে গিয়ে তপস্যা শুরু করলেন। এরপর এক রানির ষাট হাজার, আরেকজনের এক পুত্র জন্ম নিলো। এই ষাট হাজার পুত্রের অত্যাচারে পৃথিবীর মানুষ অতিষ্ঠ। সগর রাজা একসময় অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেই যজ্ঞের ঘোড়া এই ষাট হাজার ছেলে সেই ঘোড়াকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানোর সময় কোথায় হারিয়ে গেল। রাজা বলে দিলেন, ঘোড়া খুঁজে বের করতে না পারলে রাজপুত্ররা রাজার সামনে আসতে পারবে না। এই ছিল তাঁর হুকুম। ষাট হাজার রাজপুত্র গেল ঘোড়ার সন্ধানে। তারা সমুদ্রের ধারে গিয়ে একটা গর্ত দেখতে পেয়ে সেখানে খুঁড়তে শুরু করে দিল। খুঁড়তে খুঁড়তে পাতালে প্রবেশ। পাতালে বসে ধ্যান করছিলেন কপিল মুনি। ঘোড়াটি পাশেই ছিল। রাজপুত্ররা কপিল মুনিকে দেখেনি। ঘোড়া ধরতে যেতেই মুনি রেগে আগুন। তিনি চোখ তুলে তাকাতেই রাজপুত্ররা পুড়ে ছাই। অন্যদিকে রানি শৈবার পুত্র অসমঞ্জা। সে আবার ছোট ছোট ছেলেদের ধরে পানিতে ফেলে দেয়। এই নিয়ে রাজার কাছে নালিশ যেতেই রাজা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। এই অসমঞ্জার ছেলে অংশুমান। অংশুমানের ছেলে দিলীপ। দিলীপের ছেলে ভগীরথ। ভগীরথ গেলেন গঙ্গার কাছে। তাঁকে পৃথিবীতে আসতে অনুরোধ জানালেন। গঙ্গা রাজি। কিন্তু স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে পড়ার সময় পৃথিবী কি তাঁকে ধারণ করতে পারবে? ভগীরথ গেলেন মহাদেবের কাছে, মহাদেব গঙ্গাকে ধারণ করতে রাজি হলেন। ত্রিভুবন কাঁপিয়ে গঙ্গা পড়লেন পৃথিবীতে। মহাদেবের জটা সাদা হয়ে গিয়েছিল। এবার ভগীরথ গঙ্গাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। ভগীরথ আগে আগে যান, পেছনে গঙ্গা। এভাবে যেতে যেতে সমুদ্রের ধারে উপস্থিত হলেন ভগীরথ। গঙ্গার পানিতে সাগরে আবার পানি এসে গেল। পুরাণে বলা আছে, সাগরের পানি একসময় মিষ্টি ছিল। পরে সমুদ্র বিষ্ণুকে অবহেলা করায় বিষ্ণু তাঁর শরীরে ঘাম দিয়ে সমুদ্রের পানি লোনা করে দেন।
আমাদের রাজনীতির পানি ঘোলা হলো কেমন করে? কেমন করে দূষিত হলো আমাদের রাজনীতি? অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, হরতালের মতো রাজনৈতিক অধিকারও আজ একটি তামাশায় পরিণত হয়েছে। হরতাল যেন আমাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল সোশ্যাল নেটওয়ার্ক তো খুব শক্তিশালী। সেই যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস তুলে ধরতে চাই। কথাটা সবার মুখে মুখে ঘুরছে। ফেসবুকে লেখা হয়েছে, 'আজ শনিবার হরতালের চাঁদ উঠেছে। রবিবার ও সোমবার পবিত্র হরতাল। হরতাল মোবারক।' শনিবার দেখা দেওয়া হরতালের চাঁদ গতকাল সন্ধ্যায় অস্ত গেছে। আবার কবে উঠবে সেটা জানেন হরতালের ঈশ্বর। না উঠলেই বাঁচোয়া।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments