মে দিবস-শ্রমিকশ্রেণী ও গণমানুষের সংগ্রাম by ওয়াজেদুল ইসলাম খান
মে দিবস প্রতিটি দেশে শ্রমজীবী মানুষের জন্য নতুন নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে আসে। কিন্তু এ দিন বা অন্য যেকোনো দিন এখনো আমাদের দেশে শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ, কষ্ট, বেদনা নিত্য দিনের সঙ্গী। অর্থাৎ উন্নত জীবনধারণের যে প্রত্যয় মে দিবস সৃষ্টি করেছিল, তা আমাদের তাদের জীবনে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।
এই শোষণ-বঞ্চনা নিরসন ও ন্যায্য মজুরি এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন লড়াই-সংগ্রাম। লড়াই-সংগ্রামের ক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণীর অতীত ঐতিহ্য এখন প্রায় মিয়ম্রাণ। এর জন্য দায়ী বর্তমান প্রজন্মের শ্রমিকশ্রেণীর সচেতনতার অভাব। আমাদের দেশে নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে একজন শ্রমিক যে শ্রম বিক্রি করে গায়ের রক্ত পানি করে দিচ্ছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে এ দেশের শ্রমজীবী মানুষের গড় আয়ু কমে যাবে। পৃথিবীর সব সভ্যতা গড়ে ওঠার ইতিহাসের মূল কারিগর হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। অথচ সেই শ্রমিকেরা তাদের ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না। পাচ্ছে না ন্যায্য মজুরি, যা দিয়ে দুই বেলা দু-মুঠো মোটা ভাত-কাপড় জোটাতে পারে। শোষণ-বঞ্চনা এখন এক নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পৃথিবী শোষক ও শোষিতের শ্রেণীতে বিভক্ত, এই শোষণের বিরুদ্ধে এক শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে তার ভ্যানগার্ড—শ্রমজীবী মানুষ। শ্রমজীবীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়, যেসব সংগঠন সেই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও মুখ্যত দুই ধারায় বিভক্ত। একটি পুঁজির শোষণ সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে যাঁরা নেতৃত্বে দিচ্ছে, সেই বিপ্লবী ধারার ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ও আন্দোলন; অন্যদিকে মালিক ও সরকারের লেজুড়বৃত্তি, সুবিধাবাদী ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন। দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে সুবিধাবাদী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। এরা শুধু সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং ওয়ার্কশপের মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে আন্দোলন সংগ্রামের স্পৃহাকে নির্জীব করে দেয়। সামান্য অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়ের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ শ্রমিকদের সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা তথা সামাজিক মুক্তি এবং সমাজ বদলের লড়াইতে শ্রমিকশ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ করার বিকল্প নেই।
এই সুবিধাবাদ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন প্রকৃতপক্ষে আপসের মাধ্যমে শ্রমিকদের দাবি আদায়ের নামে মালিক ও সরকারের কাছ থেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে থাকে। শ্রমিকদের মধ্যে তার বেঁচে থাকার তাগিদে যে আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলতে থাকে, তা আপসকামিতার মাধ্যমে ভোঁতা করে দেয়। এরা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ব পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং দেশীয় লুটেরা ধনিকের পক্ষে নানা কৌশলে অবস্থান নিয়ে শ্রমিকদের শ্রেণীগত অবস্থানকে দুর্বল করে দেয়।
অন্যদিকে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিপ্লবী ধারার বিরাট শক্তি আছে। আজ একইভাবে বিভিন্ন দেশেও সেই শক্তির সমাবেশ আছে, যারা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ও আন্দোলনকে শ্রেণীগত অবস্থানে বিবেচনা করে, শ্রমিকশ্রেণীকে শ্রেণীগত অবস্থানে সংগঠিত করে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও আপসকামিতার বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে দাবি আদায়ের আন্দোলনকে বেগবান করে মানুষের ওপর মানুষের শোষণের অবসান করে একটি শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম করার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে। এই শ্রেণীর ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন বিপ্লবী অবস্থান থেকেই শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে একটি শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম করতে বদ্ধপরিকর। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর প্রগতিশীল শ্রমিক সংগঠন বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের শক্তি খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু পুঁজির আগ্রাসন তথা পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের স্বরূপ বের হয়ে পড়েছে। সমপ্রতি বিশ্বমন্দা তথা ইউরোপ আমেরিকার বেকারত্ব সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ভর্তুকি হ্রাস ইত্যাদির ফলে সারা পৃথিবীর মেহনতি মানুষ তথা সাধারণ মানুষের নতুন বোধোদয় হচ্ছে যে পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন শেষ কথা নয়। এই বিশ্বায়ন মেহনতি মানুষকে শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি দিতে পারে না।
শ্রমজীবী মানুষের লড়াই নিকট অতীতে দুর্বল হয়ে পড়লেও পুনরায় বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের নেতৃত্বে এই শক্তি শ্রেণী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আফ্রিকা উপমহাদেশে, ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের এবং এশিয়াসহ অন্যান্য দেশের শ্রেণীভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলো আজ বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী শোষণকে পর্যুদস্ত করার আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে শ্রেণীভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ও সংগঠন হচ্ছে আন্তর্জাতিকতাবাদ শ্রমিক আন্দোলনে বিশ্বাসী, আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি ও একাত্মতা প্রকাশের সংগঠন। প্রত্যেক মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, জনগণের মধ্যে শান্তি ও বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজির শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা এবং রাষ্ট্রায়াত্ত খাতকে কোনোভাবেই ব্যক্তিমালিকানায় না দেওয়ার দাবি আদায়ই ট্রেড ইউনিয়নের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এই অবস্থায় আজ সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির জন্য প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম এবং এই সংগ্রামে গরিব, মেহনতি মানুষ, কৃষক, ভূমিহীন ও মধ্যবৃত্ত বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশ ঘটাতে হবে। ট্রেড ইউনিয়নে একত্রিত করতে হবে যুবক, নারী ও অভিবাসী শ্রমিকদের। শ্রমিকদের জীবনযাত্রার পরিবেশগত মান উন্নয়নে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার অগ্রাধিকার দিতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিকাশের স্বার্থে দুর্নীতি আমলাতন্ত্র এবং ব্যক্তি স্বার্থের পূজারিদের বিরুদ্ধে আঘাত হানতে হবে।
একই সঙ্গে শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য তাদের মৌলিক অধিকার তথা সামাজিক নিরাপত্তা, বিনা মূল্যে চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থান এবং জীবনযাত্রার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ মজুরি/বেতন ও পেনশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ব্যবস্থার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
আজ মহান মে দিবসে নতুন উদ্দীপনায় শপথ নিতে হবে। শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক শ্রম আইন, বাঁচার মতো ন্যায্য মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা, শ্রমজীবী মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে বর্ণবাদ, নব্য ফ্যাসিবাদ এবং লুটেরা ধনিকের সকল প্রকার শোষণ-নির্যাতনসহ শ্রমিক স্বার্থবিরোধী যেকোনো কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
জয় হোক শ্রমজীবী মানুষের।
ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।
No comments