পাণ্ডিত্যে প্রজ্ঞায় সাহসে নমস্য by নাসির আহমেদ

জীবনের সকল ক্ষেত্রে সবাই সাহসী ভূমিকা রাখতে পারেন না। কেউ কেউ পারেন। চাওয়া-পাওয়ার মোহকে পরাস্ত করেই সেটা সম্ভব। তারা বস্তুগত ঐশ্বর্যের চেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানকে অধিকতর মূল্যবান বিবেচনা করেন। তাদের জীবনে আদর্শ একটা উজ্জ্বল সূর্য, যা পথ দেখায় আজীবন।


তাই জীবনের নানা বাঁকে তারা নিজেরাও আলোর উদ্ভাসন ছড়াতে থাকেন। পাণ্ডিত্যে, প্রজ্ঞায়, সাহসে অনেকের ভিড়ে বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন এমন মানুষই। বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু লিখব ভাবতেই মনে এলো এই কথাগুলো। ১ মে (আজ) তার ৮৫তম জন্মদিন। রবীন্দ্রানুরাগী এই পণ্ডিত গবেষক-লেখক বয়সের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করেছেন। এটা আমাদের জন্য বড় আনন্দের। ১৯৪৫ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষেই মেধার স্বাক্ষর রেখে প্রবেশিকা সম্পন্ন করেছেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ইন্টারমিডিয়েট। অবিভক্ত ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণকারী (১৯২৮) হাবিবুর রহমান তরুণ বয়সেই পিতামাতার সঙ্গে বাংলাদেশে আসেন দেশভাগের ফলে। এই শ্যামল মৃত্তিকার প্রতি তীব্র আনুগত্য পোষণ করে বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডকে যথার্থ জননী জ্ঞানও করেছেন। না হলে কী করে ১৯৫২র ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে থেকে (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কর্মসূচিতে অংশ নিলেন! সেখানেই তো প্রাণ দিয়েছেন আমাদের ভাষাশহীদরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে হাবিবুর রহমান শেলী (শেষাংশ তার ডাকনাম) মেধার স্বাক্ষর রেখে এমএ ডিগ্রি অর্জনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে যোগদানও করেছিলেন। সেখানেও ঘটে এক দ্রোহী ঘটনা। যোগদানের চারদিন পর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ। সদ্য ভাষা-আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এই ভাষাসংগ্রামীর ঢা.বিতে যোগদান তৎকালীন (পঞ্চাশ দশকের প্রথমার্ধে) পাকিস্তানি শাসকচক্র হয়তো ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলেও কিছু বলতে রাজি হলেন না। বললেন, কাউকে বিব্রত করতে চাইনি। শুধু তা-ই নয়, বন্ধুরা জানতে চেয়েছিলেন, তাহলে কী করে চলবে? মানে পেশা...। জবাবে আরও দুঃসাহসী। বিশ্ববিদ্যালয়ে সিগারেট বিক্রি শুরু করলেন ভাষাসংগ্রামী শেলী। সেকালের অবজারভার, ভারতের যুগান্তরসহ বহু পত্রিকায় শিরোনাম হলেন তিনি। 'শেলী সেলস সিগারেট'_ এ খবর তোলপাড় সৃষ্টি করল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছাড়ার প্রতিবাদ?
ইতিহাসে অনার্স, এমএ এই ভাষাসংগ্রামী পরে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড থেকেও স্নাতক হলেন। তার আগেই অবশ্য ইতিহাস বিভাগের তিক্ত অভিজ্ঞতায় সম্ভবত আইন পেশায় যাওয়ার কথা ভেবে ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক হয়ে লিংকনস ইন লন্ডন থেকে বার অ্যাট ল' ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরেন।
বর্ণাঢ্য তার জীবন ও কর্মক্ষেত্র। আইন পেশায় যোগ দিয়ে ছেড়েছেন। আবার ধরেছেন। অধ্যাপনা করেছেন জগন্নাথ কলেজে, সিরাজগঞ্জ কলেজে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৬২ থেকে ৬৫)। আবার আইন পেশায় প্রত্যাবর্তন এবং কিছুকাল পর বিচার বিভাগে যোগদান। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ আসন প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে (১৯৯৬) সাফল্যের সঙ্গে নির্ভীক ভূমিকা রেখেছেন। সংবিধানের প্রতি অবিচল থেকেছেন সৃষ্ট জটিল সেই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে। বিশদ বিবরণ আছে তার লেখা স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ভার'-এ।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের মূল পরিচিতি অনেকখানি যেন আড়াল করে দিয়েছে তার পেশাগত পরিচয়। তিনি যে একজন উঁচুমাপের লেখক-গবেষক, রবীন্দ্র গবেষণায় নিবেদিতপ্রাণ, সে কথা খুব কম লোকই জানেন। 'রবীন্দ্র-প্রবন্ধে সংজ্ঞা ও পার্থক্য বিচার' আশির দশকেই প্রাজ্ঞ পাঠকদের দৃষ্টি কেড়েছিল। এ ছাড়া 'রবীন্দ্র রচনায় আইনী ভাবনা', 'রবীন্দ্রবাক্যে আর্ট সঙ্গীত ও সাহিত্য', 'রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ চিন্তা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ', 'রবীন্দ্ররচনার রবীন্দ্রব্যাখ্যা', 'মাতৃভাষার স্বপক্ষে রবীন্দ্রনাথ', 'কবি তুমি নহ গুরুদেব' গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিঃসন্দেহে। গত বছরই প্রথমা থেকে বেরিয়েছে তার সম্পাদিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বই 'গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা', যেখানে সংকলিত রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান, বর্ষার কবিতা, বর্ষাবিষয়ক প্রবন্ধ এবং চিঠিপত্রসহ বিভিন্ন রচনা। অসাধারণ এক বিশ্লেষণমূলক দীর্ঘ ভূমিকায় উৎকীর্ণ তার রবীন্দ্র পাঠ আর প্রজ্ঞার স্বাক্ষর।
এ ছাড়া তার মাইলফলক কয়েকটি কাজ পণ্ডিত-বুদ্ধিজীবী মহলে সমাদৃত হয়েছে অনেক আগেই। বিশেষ করে যথাশব্দ, অমিত্রাক্ষর, বচন ও প্রবচন, কোরান সূত্র, 'গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ', বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক ইত্যাদি।
বাংলা ভাষা, ব্যাকরণ ও শব্দ বিষয়েও অনেক গবেষণা আছে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের। আইনের শাসন ও বিচার বিভাগ নিয়েও রয়েছে তার উদার চিন্তার স্বাক্ষর সংবলিত গ্রন্থ। বাংলাদেশকে জাগিয়ে তোলার মতো, অভিভাবকের অবস্থানে থেকে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রগতিশীল এই লেখক মানুষকে সচেতন করার মতো অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন এবং এখনও লিখছেন। অশীতিপর এই সাহসী লেখকের বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদসহ নানামাত্রিক সৃজনকর্ম রয়েছে। এত পরিচয়ের মধ্যে তিনি যে নিষ্ঠা আর ভালোবাসা নিয়ে কবিতা রচনা করেন, সে কথা না বললে অন্যায় হবে। 'কলম এখন নাগালের বাইরে', 'মনের আগাছা পুড়িয়ে' ইত্যাদি বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে তার। কবিতায় তিনি স্পষ্ট, সমাজ সচেতন। সত্য বলার 'অপরাধে' ইতিহাসকেও যে কাঠগড়ায় নেয় কোনো কোনো শক্তি_ তা বলতে ভয় পান না তিনি। জন্মদিনে এই সাহসী পণ্ডিতকে জানাই প্রণতি। সুস্থ, সৃজনমুখর শতায়ু হোক তার।

নাসির আহমেদ : কবি ও সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.