শিক্ষক লাঞ্ছনা-ক্ষমতার দাপটে এভাবেই কি চলবে বিশ্ববিদ্যালয়? by সুস্মিতা চক্রবর্তী

গত ৩০ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের প্রভাষক অনুপম হীরা মণ্ডল ছাত্রলীগ কর্মীর হাতে আচমকা মারধরের শিকার হন। তাঁর বাঁ চোখটি গুরুতর জখম হয়। ঘটনার পরপরই ফোকলোর বিভাগের শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা প্রতিবাদ জানাই এবং ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছাত্রলীগের ওই কর্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিল করার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর লিখিত মতামত পেশ করি।


যত দূর শুনেছি, এখন পর্যন্ত ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছাত্রটির ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়নি। এ ধরনের ঘৃণ্য কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্দ্বিধায় এরই মধ্যে ওই ছাত্রের ছাত্রত্ব বাতিল করে দিতে পারত, কিন্তু তা করতে সময় নিতে হচ্ছে কেন—বিষয়টি গোটা শিক্ষক সম্প্রদায়ের জন্য বেশ দুর্ভাবনার। তবে খানিকটা হলেও আশার কথা এই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ থেকে ওই ছাত্রটিকে বহিষ্কার করা হয়েছে (সূত্র: প্রথম আলো, ১-১-১০)।
এরই মধ্যে খবর পেলাম, রাবি ক্যাম্পাসের শিবির ছাত্র সংগঠন-কর্মীরা আমাদের আরও কয়েকজন সহকর্মীর গায়ে হাত তুলেছে। নিগৃহীত শিক্ষকেরা ক্যাম্পাসের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে তথা সরাসরি এই প্রশাসনের কাজের সঙ্গেই যুক্ত। রেহাই পাননি তাঁরাও।
যে শিক্ষককে নিজের ক্যাম্পাসে অন্যায়ভাবে অপমানিত হতে হয়, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় এবং এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কালক্ষেপণ মেনে নিতে হয়; তার কাছে ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়, তা সহজে অনুমেয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল প্রশাসনিক কর্মকর্তা থাকেন, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত সব বিষয়ের নিরাপত্তাসহ বিবিধ দায়দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু ১০ বছরের শিক্ষকতার জীবনে আমি একাধিকবার লক্ষ করেছি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রক্টরিয়াল কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেখভাল করার পরিবর্তে তাদের ওপর দমন-নিপীড়ন জারি রাখতেই তত্পর থাকে। বিগত সময়ে এ ধরনের অনেক ঘটনার দৃষ্টান্ত সহজে হাজির করা সম্ভব।
অল্প কিছুদিন আগে অন্যায়ভাবে রাবির নাট্যকলা বিভাগের পরীক্ষা বানচাল করার কাজে ছাত্রলীগের বেশ কিছু কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের চোখের সামনে পরীক্ষার হলে ঢুকে আতঙ্কজনক অবস্থা তৈরি করেছিল, ওই পরীক্ষার খাতাপত্র ছিঁড়ে ফেলেছিল এবং পরীক্ষা কমিটিও একপর্যায়ে পরীক্ষাটি স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল।
এর আগে রাবি ক্যাম্পাসে একটি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় একজন শিক্ষক ছাত্রলীগের এক কর্মীর হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। এ ঘটনাগুলোকে অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় বিবেচনায় আপসের মাধ্যমে ধামাচাপা দিয়ে রাখতেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পিছপা হয় না। এর ফলে ঘটনা বাড়তেই থাকে, কমে না। এসব ঘটনায় বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্প্রদায় দলমতনির্বিশেষে যদি নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনায় না আনেন, তাহলে তাঁরা একের পর এক এ রকম ঘটনার শিকার হবেন, আর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের মর্যাদা-নিরাপত্তা ক্রমে ক্রমে মুখ থুবড়ে পড়বে। ঝুঁকি কাঁধে নিয়েও আমি আমার সম্মানিত সহকর্মীদের বিষয়গুলো নিয়ে সত্যিকার অর্থেই ভাবনাচিন্তা করতে বিনীত অনুরোধ জানাই।
গত ৩০ ডিসেম্বরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাবির ফোকলোর বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে শোভাযাত্রা করে, কালোব্যাজ ধারণ করে, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করে, তখনো কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল কর্মকর্তারা তাদের দমনের কাজে নিয়োজিত থাকেন। শিক্ষকের অপমানে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করবে এটা খুবই স্বাভাবিক আর প্রত্যাশিত। সেখানে কোনো দল-মত নেই, দলীয় রাজনীতির মারপ্যাঁচের হিসাব নেই। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী চেতনাকে ক্ষমতার দাপটে স্তব্ধ করে দেওয়ার সংস্কৃতি যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনবরত জারি রাখার কাজে আমরা শিক্ষকেরাই নিয়োজিত থাকি, তবে শিক্ষক হিসেবে আমরাই কি এই তরুণ প্রজন্মকে ‘মেরুদণ্ডহীন’, ‘অসার’ করে টিকে থাকার অভ্যাস করাচ্ছি না?
রাবি কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে নানান বিধিনিষেধ জারি রেখেছে। বিধিনিষেধ করে কখনো ক্যাম্পাসে ভালো পরিবেশ বজায় রাখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য দরকার হলো স্বাধীনতা, সংহতি ও সমঝোতা। সবচেয়ে আগে দরকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যাবতীয় দলীয় রাজনীতি বর্জন করা। আমাদের চিন্তা হবে, কেন শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের গায়ে হাত তোলে? কেনই বা শিক্ষকেরা ক্রমাগত তাঁদের শ্রদ্ধার আসন হারাচ্ছেন? সর্বপ্রকার দলীয় রাজনীতির আধিক্যই এর অন্যতম কারণ। আর বিদ্যমান যেকোনো বিধিনিষেধের মধ্যেও যদি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোনো অন্যায় ঘটনা আচমকা সংঘটিত হয়, তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? শিক্ষকেরা বিপদে-আপদে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকবেন, আবার শিক্ষার্থীরাও তাঁদের শিক্ষকদের পাশে থেকে কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক। অথচ ফোকলোর বিভাগের শতাধিক শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষকের গায়ে অন্যায়ভাবে হাত তোলার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের রোষানলে পড়েছে। এরই মধ্যে ওই ঘটনায় প্রতিবাদকারী ফোকলোর বিভাগের একজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে রাবি প্রশাসন লিখিতভাবে অভিযোগের নোটিশ পাঠিয়েছে। এসব এক অর্থে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে নির্যাতন করারই কৌশল।
রাবি প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব জমায়েত (শিক্ষার্থী-শিক্ষকের) দমন করতে নিয়োজিত আছে, এমনকি কোনো অনুষ্ঠান, মাইকিং ইত্যাদি করাও এখানে নিষিদ্ধ রয়েছে। অথচ, চ্যানেল আইয়ের সেরা কণ্ঠ-২০০৯-এর প্রচারণা এই ক্যাম্পাসে দিব্যি চলেছে, কোনো একটি সিনেমার প্রচারণার কাজও বন্ধ নেই। এসব ক্ষেত্রে তো বিদ্যমান বিধিনিষেধ লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না, সেটা বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় যে এসব নিষেধাজ্ঞা কেবল শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করার জন্যই জারি রয়েছে?
এসব ঘটনা থেকে বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ যদি দলীয়-ক্ষমতাবান শিক্ষক আর শিক্ষক নিপীড়নকারী ক্যাডারদের দৌরাত্ম্যের ভূমিতে পরিণত হয়, তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা কী করব? এক দল তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের চূড়ান্ত দেখিয়ে বিদায় নেবে। আবার এক দল আসবে এবং তারাও একই কাজ ঘুরেফিরে করবে। এই যদি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় নামের ধারণাটি সমাজে আদৌ তার স্বাধীনতা আর মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকতে পারবে বা পারছে?
শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকদেরও বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে অনুরোধ করি। বর্তমান সময়ে, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী যিনি স্বয়ং বলেছেন যে দলের কর্মীদের অন্যায় আচরণকে তিনি শক্ত হাতে প্রতিহত করবেন, তার কথা যেন স্রেফ বুলিতে পর্যবসিত না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে আমি প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সবাইকে আন্তরিকভাবে অনুরোধ জানাই।
সুস্মিতা চক্রবর্তী: শিক্ষক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.