ওবামা ও মিথ্যা-শান্তির খোলসের আড়ালে by জন পিলজার

ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েলের নাইনটিন এইটি-ফোর উপন্যাসে ওশেনিয়া নামের একটি শক্তিশালী বড় রাষ্ট্রের কথা আছে। এ রাষ্ট্রে যুদ্ধের ভাষা এমনসব মিথ্যাকে পাল্টে দেয়, যা ইতিহাসে ঢুকে গিয়ে সত্যে পরিণত হয়েছে। সেখানকার ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের স্লোগান হয়ে ওঠে, ‘অতীত যার নিয়ন্ত্রণে, সে ভবিষ্যতের নিয়ন্তা; বর্তমান যার হাতে, সে অতীতকেও নিয়ন্ত্রণ করে।’


যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আজকের দিনের ওশেনিয়ার নেতা। এ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষ প্রান্তে দুটি বক্তৃতায় নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ওবামা ঘোষণা করেন, শান্তি এখন আর শান্তি নয়, বরং শান্তি হলো এক স্থায়ী যুদ্ধ, যার ব্যাপ্তি ‘আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে ছাপিয়ে অরাজক অঞ্চল, ব্যর্থ রাষ্ট্র ও চারদিকে ছড়িয়ে থাকা শত্রু পর্যন্ত বিস্তৃত’। একেই তিনি নাম দিয়েছেন ‘বৈশ্বিক নিরাপত্তা’। আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ ও দখলদারি জারি রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানের জনগণের উদ্দেশে ওবামা একটি রসাল উক্তি করেছেন, ‘আপনাদের দেশে দখলদারি প্রতিষ্ঠার কোনো আগ্রহ আমাদের নেই।’
ওশেনিয়া রাষ্ট্রে সত্য-মিথ্যা অবিচ্ছেদ্য। ওবামার মতে, ২০০১ সালে আফগানিস্তানে আক্রমণের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ক্ষমতা প্রদান করে। বাস্তবে জাতিসংঘের কোনো অনুমতি ছিল না। ওবামা বলেছেন, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর আফগানিস্তানে আক্রমণ চালানোতে ‘দুনিয়া’ যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দিয়েছিল। সত্যি হলো, ৩৭টি দেশের ওপর গেলাপের (Gallup) চালানো জরিপে তিনটি ছাড়া বাকি দেশগুলো এটির তীব্র বিরোধিতার কথা জানিয়েছে। ওবামা বলেছেন, ‘ওসামা বিন লাদেন বিষয়ে তালেবানের অনড় অবস্থান নেওয়ার পরই শুধু’ আফগানিস্তানে আক্রমণ করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সূত্র জানিয়েছে, ওসামা বিন লাদেনের বিচার করার জন্য তালেবানরা ২০০১ সালে তিনবার তাঁকে হস্তান্তরের চেষ্টা করেছে, আর তারা প্রতিবারই উপেক্ষিত হয়েছে।
এমনকি এই যুদ্ধের যৌক্তিকতা প্রতিপাদন করতে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলাকে ওবামার রহস্যাবৃত করার বিষয়টিও মিথ্যা। টুইন টাওয়ারে হামলার দুই মাসেরও বেশি আগে সাবেক পাকিস্তানি কূটনীতিক নিয়াজ নাইককে বুশ প্রশাসন বলেছিল, মধ্য-নভেম্বর নাগাদ একটি সামরিক হামলা চালানো হবে। আফগানিস্তানের তালেবান শাসনের প্রতি গোপনে ক্লিনটন প্রশাসনের সমর্থন ছিল। কিন্তু কাস্পিয়ান সাগরে তেল ও গ্যাসের পাইপলাইনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার জন্য তালেবানকে আর যথেষ্ট ‘স্থিতিশীল’ গণ্য করা হচ্ছিল না। তাই তালেবানকে যেতেই হতো।
ওবামার সবচেয়ে দুর্বিনীত মিথ্যাটি হলো, পাশ্চাত্যে আক্রমণ চালানোর জন্য আল-কায়েদার ‘নিরাপদ আশ্রয়স্থল’ আজকের আফগানিস্তান। অথচ তাঁর জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা জেমস জোনস ২০০৯ সালের নভেম্বরে বলেছিলেন, আফগানিস্তানে আল-কায়েদার কর্মী আছে ১০০ জনেরও কম। মার্কিন গোয়েন্দাদের মতে, ৯০ শতাংশ তালেবান আসলে তালেবান নয় বললেই চলে, বরং তারা উপজাতীয় এলাকাভিত্তিক বিদ্রোহী। এই বিদ্রোহীদের সবাই যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী, কারণ, যুক্তরাষ্ট্রকে তারা দখলদার শক্তি মনে করে।
শান্তির খোলসের ভেতরে গুরুতর উদ্দেশ্য আছে। ইরাকে তাঁর আততায়ী স্কোয়াডের কারণে পরিচিতি পাওয়া জেনারেল স্টেনলি ম্যাকক্রিস্টালের অধীনে আফগানিস্তানে দখলদারির যে ব্যবস্থা বিরাজ করছে, সমসাময়িক ওশেনিয়ার আওতার বাইরে রয়ে যাওয়া ‘অরাজক অঞ্চলের’ জন্য এটি আদর্শ। বিদ্রোহ-দমন নামে এ ব্যবস্থা পরিচিত। ভাড়াটে সেনাবাহিনী, সাহায্য সংস্থা, মনোবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী, গণমাধ্যম ও জনসংযোগ সংস্থাগুলো বিদ্রোহ-দমনে এক জায়গায় চলে এসেছে। হূদয়-মন জয় করার কথার আড়ালে এর লক্ষ্য গৃহযুদ্ধের প্ররোচনা দেওয়া: তাজিক ও উজবেকরা যেন পশতুনদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে মাতে।
ইরাকে এ কাজটাই করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একটি বহু জাতি-গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত সমাজকে ধ্বংস করেছে। একসময় আন্তবিবাহের সম্পর্ক ছিল—এমন সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বিভেদের দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে; সুন্নিদের বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধি চালানো হয়েছে এবং লাখ লাখ সুন্নিকে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। পক্ষপাতী গণমাধ্যম একে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ বলে প্রচার করেছে। ওয়াশিংটনের কেনা বিদ্যায়তনিক পণ্ডিত আর পেন্টাগণের উপদেশ শুনতে অভ্যস্ত ‘নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা’ বিবিসিতে গিয়ে সেই সুখবর প্রচার করেছেন। নাইনটিন এইটি-ফোর-এর মতো এখানেও উল্টোটাই সত্যি।
একই রকমের পরিকল্পনা করা হয়েছিল আফগানিস্তান নিয়েও। জনগণকে ‘লক্ষ্যস্থলে’ ঠেলে দেওয়া হবে, যে এলাকার নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর আর্থিক সহায়তায় ও আফিম ব্যবসার মাধ্যমে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা যুদ্ধবাজদের হাতে। এসব যুদ্ধবাজ বর্বরোচিত, এটি এখন অপ্রাসঙ্গিক। ক্লিনটনের শাসনামলে একজন কূটনীতিক তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানে শরিয়া আইনের প্রত্যাবর্তন বিষয়ে একবার বলেছিলেন, ‘এর সঙ্গে আমরা মানিয়ে নিতে পারব।’ আনুকূল্যপ্রাপ্ত পশ্চিমা ত্রাণ সংস্থা, প্রকৌশলী ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা ‘মানবিক সংকট’ মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়বেন। আর এভাবে তাদের অধীনে আনা উপজাতীয় ভূমি ‘সুরক্ষিত’ করবেন।
এই হলো তত্ত্ব। যুগোস্লাভিয়ায় এতে কাজ হয়েছিল। সেখানে জাতিগত বিভক্তি একসময়ের শান্তিপূর্ণ সমাজকে উত্খাত করেছে। কিন্তু ভিয়েতনামে তা ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে সিআইএর ‘স্ট্র্যাটেজিক হ্যামলেট প্রোগ্রাম’ তৈরি করা হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চলের জনগণকে এক জায়গায় ঠেলে দিয়ে, তাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে, ভিয়েতকংকে পরাজিত করার জন্য। সেসব মানুষের সব প্রতিরোধকে আমেরিকানরা একটি মাত্র শব্দে ধরে নিয়ে বলত ‘ভিয়েতকং’, এখন যেমন তারা বলে ‘তালেবান’।
এসবের অনেক কিছুর পেছনে আছে ইসরায়েল। ইরাক ও আফগানিস্তান অভিযানে ইসরায়েলিরা বহুদিন ধরে আমেরিকাকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। জাতিগত সহিংসতা, দেয়াল নির্মাণ, চেকপয়েন্ট, সামষ্টিক শাস্তি ও সার্বক্ষণিক নজরদারি—এসব ইসরায়েলি উদ্ভাবন স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে ফিলিস্তিনের অধিকাংশ জায়গা চুরি করে নেওয়ার ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। তথাপি ফিলিস্তিনিদের সব ভোগান্তি সত্ত্বেও তাদের মধ্যে চূড়ান্ত বিভক্তি ঘটানো যায়নি এবং সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তারা একজাতি হিসেবে টিকে আছে।
আফগানিস্তানে ব্যর্থতাগুলোই বলে দেয় ওবামার পরিকল্পনার ভবিষ্যত্। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশরা আর বিংশ শতাব্দীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিগত শুদ্ধির পথে এ দেশ জয় করতে চেষ্টা চালিয়েছিল। ভয়ানক রক্তক্ষয়ের পর তাদের বিদায় নিতে হয়েছে। সাম্রাজ্যিক সমাধিগুলো তাদের স্মৃতি বহন করছে। জনতার শক্তি বরফের নিচে রয়ে যাওয়া বীজ। আক্রমণকারীরা এই শক্তিকে বড় ভয় পায়।
নাইনটিন এইটি-ফোর উপন্যাসে অরওয়েল লিখেছেন, ‘ইউরাশিয়া, ইসটাশিয়ার মতোই এখানের আকাশও একই, এমন ভাবনা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। এই আকাশের নিচের মানুষেরাও কম-বেশি একই ধরনের—সবখানের, সারা দুনিয়ার... কেউ অন্য অঞ্চলের মানুষের খোঁজ রাখে না, মিথ্যা আর ঘৃণার দেয়াল তাদের আলাদা করে রেখেছে, তথাপি তারা যেন প্রায় পুরোপুরি একই রকম। মানুষেরা... তাদের হূদয়ে, পেটে আর পেশিতে ক্ষমতা সঞ্চিত করেছে, যে ক্ষমতা একদিন এই দুনিয়া ওলট-পালট করে দেবে।’
নিউ স্টেটসম্যান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
জন পিলজার: অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।

No comments

Powered by Blogger.