বিল ব্যবস্থাপনা-'আপন ঘরে বোঝাই সোনা, পরে করে লেনা-দেনা' by শেখ রোকন

সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের দেশে বিলগুলো সত্যিই প্রকৃতির অনন্য অবদান। প্রতিবেশ, মৎস্যসম্পদ, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, সেচ, পুষ্টি, ঔষধি, নান্দনিকতা_ সব বিবেচনা করলে বিল যেন, সমাপ্তিতেও লালনের দোহাই দিতে হয়, আমাদের 'আপন ঘরে বোঝাই সোনা'।


সঠিক ব্যবস্থাপনা হলে আমাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে তা কাজে লাগত। দুর্ভাগ্যক্রমে এই সোনার হকদার যারা, তারা বঞ্চিত। সমাজের অসুরের হাতে এর লেনা-দেনা চলছে। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি

সন্দেহ নেই, লালন সাঁইজী রূপক অর্থেই বলেছেন যে 'নদী কিংবা বিল বাঁওড় খাল, সর্বস্তরে একই এক জল'। এক ঈশ্বরই সর্বত্র বিরাজমান। মানুষই তাকে নানা নাম দিয়ে, নানা গুণ আরোপ করে নানা ভাগে বিভক্ত করেছে। বক ধার্মিকরাই এক ধর্মের উপাস্যের সঙ্গে আরেক ধর্মের উপাস্যের বিরোধ আবিষ্কার করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, লালনের গানের এই রূপক আক্ষরিক অর্থেও সত্য। নদী, বিল, হাওর_ সর্বত্র একই জল। কেবল রাসায়নিক গঠন অর্থে নয়, বিশ্বজুড়েই জলস্তরের অভিন্নতা এখন স্বীকৃত। কিন্তু বাস্তবে, অন্তত আমাদের দেশে, জলাশয়মাত্রই সমান আদৃত নয়।
যদিও বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে জলাভূমির গর্ভে; যদিও আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, পুষ্টি_ বলতে গেলে সব ব্যবস্থাই জলাভূমিনির্ভর; খোদ জলাভূমি আমাদের কাছে অবহেলার পাত্র। যত ধরনের জলাভূমি আছে_ নদী, খাল, হাওর, বাঁওড়, বিল_ তার মধ্যে বিল আরও বেশি অবহেলিত। লক্ষণীয়, বাংলা ভাষায় 'খাল-বিল' শব্দযুগল ব্যবহৃত হয় যত্রতত্র অর্থে। এর বাইরে সাধারণভাবে আমরা নদীর মহিমা কীর্তন করি; কোথাও কোথাও সেগুলো দেব-দেবী। সাগরের বিশালত্ব আমাদের কাছে ভীতি ও বিস্ময়ের বিষয়। হাওরের নান্দনিকতায় আমরা মুগ্ধ। কিন্তু গাঁয়ের পাশে, মাঠের পরে পড়ে থেকে নিত্য-কাজে-লাগা বিল নিয়ে আমাদের ভাববার সময় নেই। কথায় আছে, গেয়ো যোগী ভিখ পায় না। বিলের দশা ঠিক তেমনই।
আমরা জানি, বিলম্বে হলেও নদী নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা তৎপরতা চলছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর নিয়েও আগের মতো নির্লিপ্ততা নেই। 'সমুদ্র বিজয়' নিয়ে যা চলছে, তা তো সবাই দেখতেই পাচ্ছি। সামনের দিনগুলোতে জাতীয় রাজনীতি ও আঞ্চলিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগর আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। দেশের বিভিন্ন জনপদে খাল ভরাট নিয়ে কথায় ও কাগজে কম হুজ্জত হচ্ছে না। কেবল বিলই যেন অস্পৃশ্য। ঢাকার চারপাশের নদী উদ্ধারে নানা কসরত চলছে। রাজধানীর ভেতর দিয়ে বয়ে চলা যে অর্ধশতাধিক খাল আমরা খেয়ে ফেলেছি, তা নিয়েও আফসোস আছে। নদী ও খালের পাশাপাশি মুঘল এই শহরে যে বিল-ঝিলও ছিল, এখনকার কথাবার্তায় তা বোঝার উপায় নেই। বিল-ঝিল ভরাট করে কীভাবে বাণিজ্যিক এলাকা গঠিত হলো, তার ব্যবচ্ছেদ বিরল। দেশের সব এলাকাতেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থেকেও বিল যেন কোথাও নেই।
সুতরাং 'জাতীয় বিল কনভেনশন ২০১২' প্রস্তুতি কমিটি থেকে যখন সাদামাটা আমন্ত্রণ আসে, তখন সেখানে যাওয়ার তাগিদ তৈরি হয় বিষয়গুণেই। যে কোনো কিছু নিয়ে 'কনভেনশন' ডেকে বসা হালের উন্নয়ন ফ্যাশন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আয়োজকরা ধন্যবাদ পেতে পারেন যে, তারা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু একেবারে অনালোচিত একটি ইস্যুতে এমন আয়োজন করেছেন। আর কিছু না হোক, বিল সংক্রান্ত একটি কনভেনশন গ্রামাঞ্চলে শৈশব-কৈশোর কাটানো অনেককে নস্টালজিক করে তুলতে পারে। বাংলাদেশে বোধহয় এমন গ্রামীণ জনপদ পাওয়া কঠিন, যার পাশে একটি বিল নিভৃতে শুয়ে-বসে নেই।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে রোদ ঝলমল, পানি টলটল নিজের শৈশবের জলাশয়টির কথাও মনে হয়েছিল_ নটান বিল। বিলের সূত্রেই পাশের গ্রামের নাম নটান পাড়। অপর পাড়ে প্রাচীন থানা সদর। শরৎকালে সেই বিল শাপলায় সাদা হয়ে থাকে। যত দূর চোখ যায় শালুকের সবুজ পাতার রাজত্ব। শীতকালে সেখানে অতিথি পাখির ওড়াউড়ি। গ্রামের কিশোর-কিশোরীরা হাত ভরে 'ভ্যাট' (শাপলা ফল) আর শালুক তুলে নিয়ে আসে। কই, মাগুর, শিং, শোল-গজার, টাকি মাছ ভরা। গ্রামের জেলেরা বছরভর জাল পাতে, শৌখিন গৃহস্থ বিকেলের মড়া রোদে বড়শি নিয়ে বসে। পানকৌড়ি ডুবের পর ডুব দেয়। শুকনো মৌসুমে জেগে ওঠা জমিতে গ্রামের কৃষক লাঙল চষে। কয়দিন পর কাকচক্ষু ঢেউয়ের বদলে বাতাসে দোল খায় সবুজ ধানের চারা। ক্ষেতের আলপথে, তলানিতে পেঁৗছে যাওয়া পানির প্রান্তে কলমি, হেলেঞ্চা, কচুশাকের দাম। গ্রামের মানুষের কুড়িয়ে পাওয়া পুষ্টি। উষালগ্নে দেখা যায়, উবু হয়ে ঔষধি উদ্ভিদ খুঁজছেন গ্রামের কবিরাজ।
এসবই দেড়-দুই দশক আগের চিত্র, নটান বিল এখন সুকুমার স্মৃতিমাত্র। উপজেলা সদরের 'উন্নয়ন' যখন শুরু হয়েছিল, নটান বিলের অবনতির শুরুও সেদিন। থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরাট কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছিল বিলের জমি ভরাট করে। তারও আগে বিডিআর কোম্পানি হেডকোয়ার্টার সম্প্রসারিত হয়েছিল নিম্নভূমির দিকেই। দূর পশ্চিমে বয়ে গিয়ে বিশাল ব্রহ্মপুত্র। তার শাখা সোনাভরি, সোনাভরির সঙ্গে নটান বিলের যোগসূত্র যে নালার সেটাকে চাপা দিয়েছিল পাটের গুদাম, সেই পাকিস্তান আমলে। বাকি ছিল দুটি নালা। একটি উত্তরপাশে এসে মিশেছে, দক্ষিণে বের হয়ে গেছে আরেকটি। উত্তরে সেতু, দক্ষিণে কালভার্ট। উজান থেকে যখন পাহাড়ি ঢল নেমে আসত সে দুটির টিকে থাকাই দায় হতো। কয়েক বছর পরপরই পানির তোড়ে ভেসে যেত। তখন ভরসা খেয়া, কিংবা বাঁশের সেতু। জলের এই দাপট সরকার বাহাদুর বরদাশত করবে কেন? ফলাফল উত্তর দিকে শক্ত বাঁধ আর দক্ষিণে কংক্রিটের মজবুত সেতু। হিসাবও টনটনে। উত্তর থেকে যদি পানির চাপ না থাকে, দক্ষিণের সেতু ভাঙার ভয় নেই। এটা ঠিক, ঢলের পানি না পেলে নটান বিল ভরাট হবে, শুকিয়ে যেতে পারে। হু কেয়ারস! শুরু হয় বেসরকারি দখল। গত বছর গিয়ে দেখলাম, কয়েকটি পুকুর ও ডোবা ছাড়া বিলের চিহ্নমাত্র নেই। কাকচক্ষু জল নেই, শাপলা নেই, পানকৌড়ি নেই, কলমি ঝোপ নেই, কই মাছ নেই। মুখব্যাদান করে আছে চাতাল, ইটভাটা, ঘরবাড়িতে ভরা ঘিঞ্চি এলাকা।
কনভেনশনে উপস্থিত আরও অনেকে মনে নিশ্চয়ই নিহত নিজস্ব বিলের জন্য বেদনা জমে ছিল। কিন্তু নাগরিক শোকের আয়ু আর কতক্ষণ? কিন্তু যাদের জীবিকা সরাসরি এই ধরনের জলাশয়নির্ভর? প্রাচীনকাল থেকে বংশ পরম্পরায় যারা কেবল মাছই ধরা শিখেছেন, বিলের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া মানে তাদের টিকে থাকা না থাকার প্রশ্ন। গত বছর জলাশয় দখল নিয়ে একটি গবেষণার কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, সরকার 'জাল যার, জলা তার' নীতি করেছে বটে; বাস্তবে দেশজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কাগুজে মৎস্যজীবী। যেসব বিল দখল এবং অপরিণামদর্শী উন্নয়নের আগ্রাসন সহ্য করে টিকে আছে, সেগুলোতেও আর প্রকৃত জেলের অধিকার নেই। লিজ ব্যবস্থার নামে রাজনৈতিক দলগুলো স্থানীয় নেতাকর্মী, প্রভাবশালী ভূমিমালিক, সাবেক আমলা, ঠিকাদারের হাতে চলে গেছে মালিকানা। তাদেরই অঙ্গুলি হেলনে বিলের পাড়ে পাড়ে গঠিত হয়েছে মৎস্যজীবী সমিতি। সবই কাগজ-কলমের খেল। প্রকৃত জেলেদের একটি অংশ বড়জোর 'ওয়াটার লর্ড'দের দিনমজুর। বাকিরা কী করছে, কে জানে!
সমস্যা হচ্ছে, বিল নিয়ে চিন্তা-ভাবনা যত সহজ, এগুলো বাঁচানো ও ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর কিছু করা যেন ততটাই কঠিন। তার অনেক কারণ। বিল কাকে বলে_ এর সংজ্ঞা সুস্পষ্ট নয়। হাওরাঞ্চলে বর্ষায় দিগন্তবিস্তারি পানি থাকে; শুকনো মৌসুমে হয়ে ওঠে শত বিলের সমাহার। সেগুলো কি বিল না হাওর? বিল আর বাঁওড়ের মধ্যে পার্থক্য কী? বেশিরভাগ বিলে শুকনো মৌসুমে ধান চাষ হয়। সেখানে শতবর্ষী ব্যক্তিমালিকানা তৈরি হয়েছে। সেগুলো বিল না নিম্নভূমি? নদীর দেখভালের জন্য সুনির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদফতর রয়েছে। রয়েছে হাওর উন্নয়ন বোর্ড। বিলের দায়িত্ব কোন প্রশাসনের? পানিসম্পদ, মৎস্য, না কৃষি মন্ত্রণালয়? বিলের ব্যাপারে পরিসংখ্যানও বিভ্রান্তিকর। দেশে কত বিল রয়েছে, কেউ সঠিক বলতে পারে না। সংজ্ঞাই যদি না থাকে, সংখ্যা নির্ধারণ হবে কীভাবে?
সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের দেশে বিলগুলো সত্যিই প্রকৃতির অনন্য অবদান। প্রতিবেশ, মৎস্যসম্পদ, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, সেচ, পুষ্টি, ঔষধি, নান্দনিকতা_ সব বিবেচনা করলে বিল যেন, সমাপ্তিতেও লালনের দোহাই দিতে হয়, আমাদের 'আপন ঘরে বোঝাই সোনা'। সঠিক ব্যবস্থাপনা হলে আমাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে তা কাজে লাগত। দুর্ভাগ্যক্রমে এই সোনার হকদার যারা তারা বঞ্চিত। সমাজের অসুরের হাতে এর লেনা-দেনা চলছে। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি।

শেখ রোকন :সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.