নিসর্গ-সামান্য ও অসামান্য by দ্বিজেন শর্মা
খবরে প্রকাশ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝিলগুলোতে এ বছর কমসংখ্যক অতিথি পাখি এসেছে এবং কারণ হিসেবে পরিবেশ বিনষ্টি ও মাছ চাষের কথা বলা হয়েছে। পার্ক ও বিদ্যালয়ের জলাশয়ে মাছের চাষ এবং চত্বরে মেহগনি, সেগুন ও আকাশমণির মতো অর্থকরী বৃক্ষ আবাদ এখন রেওয়াজে পরিণত।
দুটোই বাণিজ্যিক বিষয়, অবশ্যই প্রয়োজনীয়, তবে যথাস্থান পার্ক ও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর নয়। রমনা লেকে একদা নানা রঙের অজস্র শাপলা, এমনকি আমাজন লিলিও ছিল। মাছ চাষের কল্যাণে সবই গেছে এবং লেকটি এখন নিষ্প্রাণ ও মলিন। লিলিপুলের মতো ঝিলের সৌন্দর্যায়নও একটি বহুচর্চিত শিল্প। রমনা লেকের কিনার ঘেঁষে পানিপসন্দ গাছপালা এবং ভেতরে পদ্ম-শাপলা লাগালে এই জলস্থান হারানো ঐশ্বর্য ফিরে পেত এবং পার্কের বৃক্ষশোভার সঙ্গে একীভূত হতে পারত, তাতে গোটা চত্বরের সৌন্দর্য বাড়ত বহুগুণ। কিন্তু বাণিজ্যিক মাছের চাষ থাকলে নৈবচ নৈবচ। প্রকৃতি ও সৌন্দর্যকে ছাড় দেওয়ার গুরুত্ব আমরা ভুলতে বসেছি, একরৈখিক বৈষয়িক ভাবনায় আমাদের মনোজগৎ ক্রমেই আবিল হয়ে উঠছে আর সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হারাচ্ছে নান্দনিকতার মাত্রা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যাতায়াত আছে। একবার দেখলাম, ঝিলের পাড়ে লাগানো দু-তিনটি তালগাছ কুপোকাত হতে চলেছে। জানা গেল, মাটিভুক গ্রাসকার্প মাছেরাই এই অঘটন ঘটিয়েছে। কেন এই বাণিজ্যিক মাছের চাষ? এতে কতটাই বা আর্থিক লাভ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের? উপযোগী বিকল্প ভাবনাও কিন্তু ছিল। অতিথি পাখির যাতায়াত নির্বিঘ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে এখানে সৌন্দর্য, শিক্ষা ও সংরক্ষণের মেলবন্ধন ঘটানো যেত দুষ্প্রাপ্য মাছ ও বিপন্ন জলজ গাছগাছড়া লাগিয়ে। প্রসঙ্গত, জনসংখ্যার চাপে জলাভূমি সংকোচন ও অতি আহরণে আজ অনেক মৎস্য ও জলজ উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তপ্রায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিশ্চয়ই এমনটি দেখে থাকবেন বিদেশের শিক্ষাঙ্গন ও পার্কগুলোতে। এ ক্ষেত্রে একটি অসুবিধা হলো, এ দেশে ল্যান্ডস্কেপিংয়ে দক্ষ লোকের অভাব। আমাদের স্থাপত্য বিদ্যালয়ে বিষয়টির চর্চা প্রায় নেই, অন্যথা বিদ্যালয়চত্বর ও পার্কগুলো যথাযথ আঙ্গিকে গড়ে উঠতে পারত।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আগরতলায় থাকার সময় প্রাসাদের পেছনে একটি লেক দেখেছিলাম, ছেয়ে আছে এক জাতের সুগন্ধি লীল-শালুকে (Nymphaea capensis)। গন্ধমোদিত নীলের কী আশ্চর্য শোভা। একটি নমুনা আছে বলধা উদ্যানে, আছে ব্যক্তিগত সংগ্রহেও। শুনেছি, মৌলভীবাজারের মাধবপুর চা-বাগানের লেকে আছে অনেকগুলো। একসময় গাছগাছালির খোঁজে দূর-দূরান্ত ঘুরেছি, দেখেছি অনেক ছোট-বড় হাওর-বাঁওড়, কোনো কোনোটি প্রকৃতির অপূর্ব শিল্পকর্ম, কৃত্রিম ঝিলসজ্জার আদর্শ। এগুলো আজ বিলীয়মান। যখন লোপ পাবে, তখন চিরতরে হারিয়ে যাবে আমাদের প্রকৃতির আরেকটি অনন্য প্রতিমা।
মেহগনি, সেগুন ও আকাশমণির ব্যাপক চাষে আমাদের দেশি দারু বৃক্ষ এখন কোণঠাসা। লাভজনক বিধায় এটি নিয়ন্ত্রণ কঠিন। কিন্তু পার্ক ও বিদ্যালয়চত্বরে এগুলোর আগ্রাসন বড়ই দৃষ্টিকটু। এখানে এই গাছপালা লাগালে ও বড় হতে দিলে সেগুলো থেকে রেহাই মেলা কঠিন, তাতে চত্বরশোভার ব্যাপক ক্ষতি। কিছুদিন আগে দেশের দক্ষিণের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তাঁদের ক্যাম্পাস থেকে আকাশমণি উচ্ছেদ-বিষয়ে আমার পরামর্শ চেয়েছিলেন। আমি সেগুলো টিকিয়ে রাখতে বলেছি। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও একসঙ্গে অনেক গাছ কেটে ফেলা নান্দনিক বিচারে অযৌক্তিক। নির্বিচারে বিদেশি প্রজাতি পোষণের দায়ভার আমাদের অনেক দিন বইতেই হবে। সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সৌন্দর্যায়নের শুরুতে সেখানকার তিনটি টিলায় সিলেট বিভাগের বনবৃক্ষের একটি সংগ্রহ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী কালে প্রশাসনের নানা রদবদলে তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। এখন একটি টিলাজুড়ে আছে সেগুন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্তের এমন দুঃখজনক অপমৃত্যু কেবল আমাদের দেশেই সম্ভব।
দালানকোঠা নির্মাণের ব্যাপারে সরকারের নানা আইন আছে। বৃহৎ কোনো নির্মাণে ল্যান্ডস্কেপিং বাধ্যতামূলক করলে এবং যথাসম্ভব বেশি সংখ্যায় বনজ গাছগাছালি লাগানোর শর্ত রাখলে সমস্যার একটা সুরাহা হতে পারে। এতে প্রজাতিবৈচিত্র্যের সুরক্ষা ও শিক্ষা দুটিই লাভবান হবে।
দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গবিদ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যাতায়াত আছে। একবার দেখলাম, ঝিলের পাড়ে লাগানো দু-তিনটি তালগাছ কুপোকাত হতে চলেছে। জানা গেল, মাটিভুক গ্রাসকার্প মাছেরাই এই অঘটন ঘটিয়েছে। কেন এই বাণিজ্যিক মাছের চাষ? এতে কতটাই বা আর্থিক লাভ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের? উপযোগী বিকল্প ভাবনাও কিন্তু ছিল। অতিথি পাখির যাতায়াত নির্বিঘ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে এখানে সৌন্দর্য, শিক্ষা ও সংরক্ষণের মেলবন্ধন ঘটানো যেত দুষ্প্রাপ্য মাছ ও বিপন্ন জলজ গাছগাছড়া লাগিয়ে। প্রসঙ্গত, জনসংখ্যার চাপে জলাভূমি সংকোচন ও অতি আহরণে আজ অনেক মৎস্য ও জলজ উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তপ্রায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিশ্চয়ই এমনটি দেখে থাকবেন বিদেশের শিক্ষাঙ্গন ও পার্কগুলোতে। এ ক্ষেত্রে একটি অসুবিধা হলো, এ দেশে ল্যান্ডস্কেপিংয়ে দক্ষ লোকের অভাব। আমাদের স্থাপত্য বিদ্যালয়ে বিষয়টির চর্চা প্রায় নেই, অন্যথা বিদ্যালয়চত্বর ও পার্কগুলো যথাযথ আঙ্গিকে গড়ে উঠতে পারত।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আগরতলায় থাকার সময় প্রাসাদের পেছনে একটি লেক দেখেছিলাম, ছেয়ে আছে এক জাতের সুগন্ধি লীল-শালুকে (Nymphaea capensis)। গন্ধমোদিত নীলের কী আশ্চর্য শোভা। একটি নমুনা আছে বলধা উদ্যানে, আছে ব্যক্তিগত সংগ্রহেও। শুনেছি, মৌলভীবাজারের মাধবপুর চা-বাগানের লেকে আছে অনেকগুলো। একসময় গাছগাছালির খোঁজে দূর-দূরান্ত ঘুরেছি, দেখেছি অনেক ছোট-বড় হাওর-বাঁওড়, কোনো কোনোটি প্রকৃতির অপূর্ব শিল্পকর্ম, কৃত্রিম ঝিলসজ্জার আদর্শ। এগুলো আজ বিলীয়মান। যখন লোপ পাবে, তখন চিরতরে হারিয়ে যাবে আমাদের প্রকৃতির আরেকটি অনন্য প্রতিমা।
মেহগনি, সেগুন ও আকাশমণির ব্যাপক চাষে আমাদের দেশি দারু বৃক্ষ এখন কোণঠাসা। লাভজনক বিধায় এটি নিয়ন্ত্রণ কঠিন। কিন্তু পার্ক ও বিদ্যালয়চত্বরে এগুলোর আগ্রাসন বড়ই দৃষ্টিকটু। এখানে এই গাছপালা লাগালে ও বড় হতে দিলে সেগুলো থেকে রেহাই মেলা কঠিন, তাতে চত্বরশোভার ব্যাপক ক্ষতি। কিছুদিন আগে দেশের দক্ষিণের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তাঁদের ক্যাম্পাস থেকে আকাশমণি উচ্ছেদ-বিষয়ে আমার পরামর্শ চেয়েছিলেন। আমি সেগুলো টিকিয়ে রাখতে বলেছি। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও একসঙ্গে অনেক গাছ কেটে ফেলা নান্দনিক বিচারে অযৌক্তিক। নির্বিচারে বিদেশি প্রজাতি পোষণের দায়ভার আমাদের অনেক দিন বইতেই হবে। সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সৌন্দর্যায়নের শুরুতে সেখানকার তিনটি টিলায় সিলেট বিভাগের বনবৃক্ষের একটি সংগ্রহ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী কালে প্রশাসনের নানা রদবদলে তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। এখন একটি টিলাজুড়ে আছে সেগুন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্তের এমন দুঃখজনক অপমৃত্যু কেবল আমাদের দেশেই সম্ভব।
দালানকোঠা নির্মাণের ব্যাপারে সরকারের নানা আইন আছে। বৃহৎ কোনো নির্মাণে ল্যান্ডস্কেপিং বাধ্যতামূলক করলে এবং যথাসম্ভব বেশি সংখ্যায় বনজ গাছগাছালি লাগানোর শর্ত রাখলে সমস্যার একটা সুরাহা হতে পারে। এতে প্রজাতিবৈচিত্র্যের সুরক্ষা ও শিক্ষা দুটিই লাভবান হবে।
দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গবিদ।
No comments