চারদিক-‘দ্যাহা তো যায় ঘুঘুর মতো’ by আমীন আল রশীদ
তুফানি বেগম অথবা শুধুই তুফানি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকের পাড়ে পাতা কুড়াচ্ছিলেন। শুকনো পাতা। চুলোয় দেবেন। লেকের ওপর তখন অতিথি পাখিরা উড়ছিল। রঙিন শাপলার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছিল পানিতে ভেসে বেড়ানো পাখিরা। তাদের কিচিরমিচির তুফানির বস্তায় পাতা ভরার শব্দের সঙ্গে মিশে যায়।
তখন দুপুর। লেকের পাড়ের অজস্র ইউক্যালিপটাসের লম্বা শুকনো পাতার বাইরে আর কোনো নজর নেই এই বৃদ্ধার।
বয়স কত হলো?
‘আইডেন্টি কাটে ৬৫ লিখছি।’
ছেলে-মেয়ে?
‘দুই পোলা এক মাইয়া। মাইয়াডা দ্যাশে বিয়া দিয়া আইছি।’
তার স্বামী কী করে?
‘স্বামী যে কী করে...! কামলা-জামলা দ্যায়...।’
আর ছেলেরা?
‘অরা রাইস মিলে কাম করে। অগো লগেই থাহি। দুইজন এক বাড়িতেই থাহে। তয় ঘর আলাদা।’
আপনি কার সঙ্গে থাকেন?
‘মিল্যামিশ্যা থাহি। যেহেনে পাই হেইনেই দুইডা খাই।’
তুফানির স্বামী তোরাব আলীও সাভারে একটি চালকলে কাজ করতেন। তাঁর ছোট ছেলের বয়স যখন চার মাস, তখন তিনি মারা যান। সেই ছোট ছেলে এখন দুই ছেলের বাবা। তুফানি আর বিয়ে করেননি। ছেলেমেয়েদের বড় করেছেন। কিন্তু পয়সার অভাবে তাদের পড়ালেখা করাতে পারেননি। এখন দিন যায় কোনো মতে। শুকনোর দিনে ক্যাম্পাসে এসে পাতা কুড়ান। প্রতিদিন এক বস্তা করে নিয়ে যান। এতে দিনের জ্বালানিটা হয়।
কেউ কিছু বলে?
‘নাহ্, কী কইবো। দুনিয়ার মানুষ নিতাছে। পাতা নিতাছি, এতে তো জঙ্গল সাফ হইতাছে। এইডা বালা কাম না?’
ক্যাম্পাসের অদূরেই আমবাগান এলাকায় এই বৃদ্ধার ছেলেদের ঘর, যেখানে তিনি থাকেন। এ রকম পাতা কুড়ান অনেক বছর ধরে। লেকের পাড়ে, কখনো লেক ছাড়িয়ে রাস্তার ধারে। শীতের দিনে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে যে পাখিরা অতিথি হয়ে ক্যাম্পাসের লেকে এসে আস্তানা গাড়ে, তাদের দেখতে আসে অনেক মানুষ। গাড়ি নিয়েও আসে অনেকে। এই বৃদ্ধার সঙ্গে কি তাদের কথা হয়?
‘অনেকে মনে চাইলে জিগায়...কী আর জিগাইবো...।’
এই পাখিগুলো কোত্থেকে আসে, জানেন?
‘কোথা দিয়া আসে কেমনে কই। সব সময়ই তো দেহি, এইরম উইড়া আইসা পড়ে। এই পুকুরে বহে, ওইটায় বহে। ম্যালা দিন ধইরাই দেহি। দুনিয়ার মানুষ আহে এগুলানরে দেখতে। আর কোনোহানে এইরম পাখি তো দেখি না। কাউয়া শালিখের মতো না। অইন্য রহম।’
অন্য রকম কেমন?
‘দ্যাহা তো যায় ঘুঘুর মতো।’
তুফানির ‘ঘুঘু’রা উড়ে বেড়ায় লেকের ওপর, তাদের ছায়া পড়ে জলে। এই ঘুঘুরা কোন শীতের দেশ থেকে আসে, কেন আসে, কত দিন থাকে, তা নিয়ে তুফানির মাথাব্যথা নেই। থাকার কোনো কারণও নেই। শুকনো পাতা কুড়ানোই যাঁর জীবন, তাঁর মনে প্রশ্নরা ভিড় করতে পারে না। এই পাখিগুলোকে ধরার জন্য ওত পেতে আছে শিকারি। মওকা পেলেই বন্দী হবে ওরা। তারপর চলে আসবে ঢাকার রাজপথে, বিক্রেতার হাতে হাতে ঘুরবে ওরা। পরিবেশবাদীরা বলতেই থাকবে, অতিথি পাখি নিধন করা চলবে না। কেউ শুনবে না সেই কথা। চড়া দামে শীতের পাখিরা উঠবে গ্যাসের চুলোয়।
আসলেই কি তা? তুফানির মনে আলোড়ন তোলে না এ প্রশ্ন। কিন্তু যারা এই পাখিগুলোকে রসনার উপাদানে পরিণত করে, তারা কি কখনো ভেবে দেখেছে, একটু বাঁচার আশা নিয়েই পাখিগুলো উড়তে উড়তে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে! শীতের দেশে শীতটা একটু সহনীয় হলেই ওরা ফিরে যাবে ঘরে? পাখি নিধনের বিরুদ্ধে জনমত হয়তো গড়ে উঠছে একটু একটু করে, কিন্তু তাতে কতটা কাজ হচ্ছে? কিংবা অন্য প্রশ্নও তো তোলা যায়। আমাদের এই তুফানি বেগমের জীবনটা এভাবে কাটবে কেন? এ প্রশ্নেরই বা উত্তর দিতে পারবেন কজন? পাখি আর তুফানিতে মিলে যে শৈল্পিক আবহ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কারও কিছু যায়-আসে না। তাই তুফানি শুকনো পাতার বস্তা নিয়ে হেঁটে যান। মাটির পথ ধরেন। দুপুরের রোদ থাকে মাথার ওপর। পাখিদের কিচিরমিচির তার পাতার খসখস শব্দের সঙ্গে মিশে যায়। রঙিন শাপলার ভিড়ে হারিয়ে যায় এই সব ঘুঘুর শরীর।
বয়স কত হলো?
‘আইডেন্টি কাটে ৬৫ লিখছি।’
ছেলে-মেয়ে?
‘দুই পোলা এক মাইয়া। মাইয়াডা দ্যাশে বিয়া দিয়া আইছি।’
তার স্বামী কী করে?
‘স্বামী যে কী করে...! কামলা-জামলা দ্যায়...।’
আর ছেলেরা?
‘অরা রাইস মিলে কাম করে। অগো লগেই থাহি। দুইজন এক বাড়িতেই থাহে। তয় ঘর আলাদা।’
আপনি কার সঙ্গে থাকেন?
‘মিল্যামিশ্যা থাহি। যেহেনে পাই হেইনেই দুইডা খাই।’
তুফানির স্বামী তোরাব আলীও সাভারে একটি চালকলে কাজ করতেন। তাঁর ছোট ছেলের বয়স যখন চার মাস, তখন তিনি মারা যান। সেই ছোট ছেলে এখন দুই ছেলের বাবা। তুফানি আর বিয়ে করেননি। ছেলেমেয়েদের বড় করেছেন। কিন্তু পয়সার অভাবে তাদের পড়ালেখা করাতে পারেননি। এখন দিন যায় কোনো মতে। শুকনোর দিনে ক্যাম্পাসে এসে পাতা কুড়ান। প্রতিদিন এক বস্তা করে নিয়ে যান। এতে দিনের জ্বালানিটা হয়।
কেউ কিছু বলে?
‘নাহ্, কী কইবো। দুনিয়ার মানুষ নিতাছে। পাতা নিতাছি, এতে তো জঙ্গল সাফ হইতাছে। এইডা বালা কাম না?’
ক্যাম্পাসের অদূরেই আমবাগান এলাকায় এই বৃদ্ধার ছেলেদের ঘর, যেখানে তিনি থাকেন। এ রকম পাতা কুড়ান অনেক বছর ধরে। লেকের পাড়ে, কখনো লেক ছাড়িয়ে রাস্তার ধারে। শীতের দিনে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে যে পাখিরা অতিথি হয়ে ক্যাম্পাসের লেকে এসে আস্তানা গাড়ে, তাদের দেখতে আসে অনেক মানুষ। গাড়ি নিয়েও আসে অনেকে। এই বৃদ্ধার সঙ্গে কি তাদের কথা হয়?
‘অনেকে মনে চাইলে জিগায়...কী আর জিগাইবো...।’
এই পাখিগুলো কোত্থেকে আসে, জানেন?
‘কোথা দিয়া আসে কেমনে কই। সব সময়ই তো দেহি, এইরম উইড়া আইসা পড়ে। এই পুকুরে বহে, ওইটায় বহে। ম্যালা দিন ধইরাই দেহি। দুনিয়ার মানুষ আহে এগুলানরে দেখতে। আর কোনোহানে এইরম পাখি তো দেখি না। কাউয়া শালিখের মতো না। অইন্য রহম।’
অন্য রকম কেমন?
‘দ্যাহা তো যায় ঘুঘুর মতো।’
তুফানির ‘ঘুঘু’রা উড়ে বেড়ায় লেকের ওপর, তাদের ছায়া পড়ে জলে। এই ঘুঘুরা কোন শীতের দেশ থেকে আসে, কেন আসে, কত দিন থাকে, তা নিয়ে তুফানির মাথাব্যথা নেই। থাকার কোনো কারণও নেই। শুকনো পাতা কুড়ানোই যাঁর জীবন, তাঁর মনে প্রশ্নরা ভিড় করতে পারে না। এই পাখিগুলোকে ধরার জন্য ওত পেতে আছে শিকারি। মওকা পেলেই বন্দী হবে ওরা। তারপর চলে আসবে ঢাকার রাজপথে, বিক্রেতার হাতে হাতে ঘুরবে ওরা। পরিবেশবাদীরা বলতেই থাকবে, অতিথি পাখি নিধন করা চলবে না। কেউ শুনবে না সেই কথা। চড়া দামে শীতের পাখিরা উঠবে গ্যাসের চুলোয়।
আসলেই কি তা? তুফানির মনে আলোড়ন তোলে না এ প্রশ্ন। কিন্তু যারা এই পাখিগুলোকে রসনার উপাদানে পরিণত করে, তারা কি কখনো ভেবে দেখেছে, একটু বাঁচার আশা নিয়েই পাখিগুলো উড়তে উড়তে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে! শীতের দেশে শীতটা একটু সহনীয় হলেই ওরা ফিরে যাবে ঘরে? পাখি নিধনের বিরুদ্ধে জনমত হয়তো গড়ে উঠছে একটু একটু করে, কিন্তু তাতে কতটা কাজ হচ্ছে? কিংবা অন্য প্রশ্নও তো তোলা যায়। আমাদের এই তুফানি বেগমের জীবনটা এভাবে কাটবে কেন? এ প্রশ্নেরই বা উত্তর দিতে পারবেন কজন? পাখি আর তুফানিতে মিলে যে শৈল্পিক আবহ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কারও কিছু যায়-আসে না। তাই তুফানি শুকনো পাতার বস্তা নিয়ে হেঁটে যান। মাটির পথ ধরেন। দুপুরের রোদ থাকে মাথার ওপর। পাখিদের কিচিরমিচির তার পাতার খসখস শব্দের সঙ্গে মিশে যায়। রঙিন শাপলার ভিড়ে হারিয়ে যায় এই সব ঘুঘুর শরীর।
No comments