গতকাল সমকাল-আরব বিশ্বে রাজনৈতিক ‘সুনামি’ by ফারুক চৌধুরী
ষাটের দশকের শেষার্ধে আলজেরিয়ার পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত ছিলাম। তখন আলজেরিয়ার একদলীয় শাসনের একঘেয়েমি আর কর্কশতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে ভূমধ্যসাগরের কূল ঘেঁষে নয়নাভিরাম সড়কপথে চলে যেতাম শান্তি আর ঔদার্যের আশ্রয়স্থল তিউনিসিয়ায়।
তার মাত্র সাড়ে চার দশকের মধ্যে যে সেই তিউনিসিয়া আরব বিশ্ব তথা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির আগ্নেয়গিরি উদ্ভূত ভূকম্পনের ‘এপি সেন্টার’ তথা উৎপত্তিস্থল হয়ে উঠবে, তা ভাবার দিব্যদৃষ্টি কারও ছিল বলে আমার জানা নেই। তিউনিসিয়ার পলাতক প্রেসিডেন্ট বেন আলী অপহূত সব সোনাদানা নিয়ে সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু এক অর্থে তাঁকে নিয়ে অসন্তোষের ঝড়ের কাঁপন এখন অনুভূত হচ্ছে আরব বিশ্ব আর মধ্যপ্রাচ্যের নগরে-বন্দরে।
প্রাকৃতিক সুনামির ধ্বংসের বহুরূপ নিজের চোখেই দেখেছি, শ্রীলঙ্কায় আর মালদ্বীপে। তা অবিশ্বাস্য এবং ভয়াবহ। কিন্তু রাজনৈতিক সুনামির এই আঘাতটি লাগতে শুরু করেছে ইয়েমেন, জর্ডান, আলজেরিয়া আর না জানি কত দেশে আর সমাজে। তারও বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে নানা রূপে, সেই সব জনপদের আর্থসামাজিক আর রাজনৈতিক অবস্থার ওপর। তা নাড়িয়ে তুলতে পারে সেসব সমাজের ঘুণে ধরা সব ভিত্তি। আর তার তাৎক্ষণিক পরিণতিও হতে পারে প্রাকৃতিক সুনামির মতোই; অবিশ্বাস্য, ভয়াবহ আর সুদূরপ্রসারী।
তবে আজ আমাদের দৃষ্টি রইবে মিসরের ওপর, যেখানে গত পাঁচ দিনের প্রতিটি মুহূর্তে দেশটির চেহারা পাল্টে গেছে। এত দিনের নীল নদ, পিরামিড, আরব শিক্ষা-সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের পাদপীঠ, মধ্যযুগীয় অলিগলি আর আধুনিক বুলেভার্দ, মিউজিয়াম আর মিউজিক হল, একনায়কত্ব আর নিষ্পেষণ, ভূরাজনৈতিক অবস্থান আর সুয়েজ খাল, হোয়াইট হাউস আর হোসনি মোবারক; বিদেশি পর্যটক আর নাইট ক্লাব, সুরা আর রেস্তোরাঁ—সবই যেন অচেনা অচেনা ঠেকছে। কী করল এই রাজনৈতিক ভূকম্পনসৃষ্ট সুনামি? দশকের পর দশক ধরে এই কায়রোকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র কোটি কোটি ডলার ঢেলে মধ্যপ্রাচ্যে যে বৃত্তপরিধি রচনা করেছিল, তা কি থেঁতলে গেল? এসব প্রশ্নের উত্তর কেউই এখন দিতে পারবে না। তবে এটা বোধহয় বলা যায়, অবস্থা আর আগের মতো হবে না কোনো দিনও। মনে হচ্ছে, দারিদ্র্য আর প্রাচুর্যের মিসর, সংস্কৃতি আর অপসংস্কৃতির মিসর, সভ্যতা আর অনুকরণের প্রবণতার মিসরের নয় কোটি মানুষ তাদের মর্যাদা আর আত্মসম্মান পুনঃ অর্জন করতে চায়। যখন হোসনি মোবারক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন, তখন এই জনসংখ্যার অর্ধেকেরও জন্ম হয়নি। হোসনি মোবারকের পৃথিবীর বাইরে যে জীবন আছে, তারই আস্বাদ এখন আপামর মিসরীয়রা লাভ করতে চায়; সৌদি আরবের সরকার যতই মোবারকের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করুক না কেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এবং পাশ্চাত্যের বিদেশনীতি এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সবাই উঁচু গলায় এখন সংস্কারের কথা বলছেন, অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা বলছেন, ন্যায়-নীতি সম্বন্ধে মিসর আর মোবারককে ওয়াজ-নসিহত করছেন; যা তাঁরা এত দিন করেননি। যেখানেই যুক্তরাষ্ট্রের এবং পাশ্চাত্যের স্বার্থ এবং নীতির সংঘাত হয়েছে, সেখানেই তাদের কর্মকাণ্ডে স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে। একমাত্র তাদের কারণেই আজ ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর ধর্মান্ধ একটি রাষ্ট্র। বশংবদ মিসরের মাধ্যমেই তারা ইসরায়েলকে খোশমেজাজে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। আজ থেকে ৮০ বছর আগে জুইশ স্ট্যান্ডার্ড (Jewish Standard) পত্রিকার সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ইহুদি নেতৃবৃন্দ যদি প্যালেস্টাইনে তাঁদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ, আরবদের অনুরূপ স্বার্থের চাইতে আলাদা করে দেখেন, তাহলে সেই পবিত্র ভূমিতে জঘন্য সব বিস্ফোরণ (Ugly eruptions) ঘটবে।’ সেই বেদবাক্যটির পুনরাবৃত্তি ইহুদি নেতাদের কাছে না করে যুক্তরাষ্ট্র আর পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ মোবারকদের মতো নেতাকে বছর বছর ধরে দুধ-কলা দিয়ে পুষছেন—এই মাত্রায় যে রবীন্দ্রনাথও ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। কারণ, জঘন্য সব বিস্ফোরণ এখন শুধু ‘পবিত্র ভূমিতেই’ ঘটছে না, ঘটছে এবং ঘটবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য অনেক স্থানে।
মলম লাগিয়ে ক্যানসার সারানো যায় না। মিসরে নতুন ভাইস প্রেসিডেন্ট আর প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা সময়ের অপচয় বলেই মনে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মোবারকের প্রস্থানেও সমস্যার সমাধান হবে না। মিসরে মানুষ পুলিশকে এতই ঘৃণা করে যে তাদের টিকিটিরও নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তাঘাটে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে; কিন্তু কর্মকাণ্ড নেই। এ কারণে; এবং যথার্থই সেই কারণ যে, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা তাদের দায়িত্ব নয়। আমাদের যেসব রাজনৈতিক নেতা পান থেকে চুন খসলেই সেনাবাহিনীকে তলব করার আওয়াজ তোলেন, তাঁরা যেন সামান্য এই সত্যটিকে হূদয়ঙ্গম করেন। সামরিক বাহিনীর প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে গত পাঁচ দিনেই মিসরের সর্বত্র রক্তাক্ত অরাজকতা বিরাজ করত, দেশটির নিরাপত্তা সত্যিকার অর্থেই বিঘ্নিত হতো। লুটতরাজের মাঝে কায়রোর মিউজিয়াম হয়তো বা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
আজ হোক, কাল হোক, মোবারককে যেতেই হবে। তাঁর শাসনপদ্ধতি চিরতরে বর্জন করতে হবে। মনে হচ্ছে, মিসরীয়দের ভীতির বাঁধ অবশেষে ভেঙে গেছে, তারা স্বাধীনতা এবং আত্মসম্মান চায়। যুগ যুগ ধরে বিদেশি সাহায্য পাওয়ার পরও দেশটির ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে—বেকারদের নেই কোনো সঠিক পরিসংখ্যান। গত কয় দিনের আন্দোলনে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে হাজার হাজার। এত বিদ্রোহ সনাতন সভ্যতার মিসর কোনো দিন দেখেনি। আজ যাঁরা মোবারকের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা দলমত-নির্বিশেষে রংধনু কোয়ালিশন (RAINBOW COALITION) গঠন করেছেন। ভুললে চলবে না যে, তাদের মধ্যে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ও রয়েছে, যা এখন সরকারিভাবে বেআইনি। যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ হয়তো বা মোবারকের বিকল্প খুঁজছে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এলবারাদি, রাজনীতিবিদ আয়মান নূর অথবা সৈয়দ বাদাওয়ি অথবা মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিয়ে আপাতত এদের সবার কোয়ালিশন? তবে মোবারকের চূড়ান্ত উত্তরসূরি হবেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। আর যুক্তরাষ্ট্রের মনে রাখতেই হবে, ইসরায়েল তাদের সম্বন্ধে কী ভাবে, তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তারাও ইসরায়েলের বর্তমান কর্মকাণ্ড আর চিন্তাধারাকে কীভাবে মূল্যায়ন করে, তা সমানভাবেই দৃষ্টি আকর্ষণের দাবি রাখে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্বার্থ’ আর ‘উচ্চারিত নীতির’ সংঘাত ঘটে, সেখানে নীতিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতেই হবে। মধ্যপ্রাচ্যে মিসর লোকসংখ্যায় বৃহত্তম দেশ; তবে অন্যান্য দেশও রয়েছে, যেখানে এই রাজনৈতিক সুনামি আঘাত হানবে। তখন যদি নীতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শিত না হয়, তাহলে রাজনৈতিক সুনামির আঘাত প্রাকৃতিক সুনামির আঘাতের মতোই ভয়াবহ হতে পারে।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
প্রাকৃতিক সুনামির ধ্বংসের বহুরূপ নিজের চোখেই দেখেছি, শ্রীলঙ্কায় আর মালদ্বীপে। তা অবিশ্বাস্য এবং ভয়াবহ। কিন্তু রাজনৈতিক সুনামির এই আঘাতটি লাগতে শুরু করেছে ইয়েমেন, জর্ডান, আলজেরিয়া আর না জানি কত দেশে আর সমাজে। তারও বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে নানা রূপে, সেই সব জনপদের আর্থসামাজিক আর রাজনৈতিক অবস্থার ওপর। তা নাড়িয়ে তুলতে পারে সেসব সমাজের ঘুণে ধরা সব ভিত্তি। আর তার তাৎক্ষণিক পরিণতিও হতে পারে প্রাকৃতিক সুনামির মতোই; অবিশ্বাস্য, ভয়াবহ আর সুদূরপ্রসারী।
তবে আজ আমাদের দৃষ্টি রইবে মিসরের ওপর, যেখানে গত পাঁচ দিনের প্রতিটি মুহূর্তে দেশটির চেহারা পাল্টে গেছে। এত দিনের নীল নদ, পিরামিড, আরব শিক্ষা-সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের পাদপীঠ, মধ্যযুগীয় অলিগলি আর আধুনিক বুলেভার্দ, মিউজিয়াম আর মিউজিক হল, একনায়কত্ব আর নিষ্পেষণ, ভূরাজনৈতিক অবস্থান আর সুয়েজ খাল, হোয়াইট হাউস আর হোসনি মোবারক; বিদেশি পর্যটক আর নাইট ক্লাব, সুরা আর রেস্তোরাঁ—সবই যেন অচেনা অচেনা ঠেকছে। কী করল এই রাজনৈতিক ভূকম্পনসৃষ্ট সুনামি? দশকের পর দশক ধরে এই কায়রোকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র কোটি কোটি ডলার ঢেলে মধ্যপ্রাচ্যে যে বৃত্তপরিধি রচনা করেছিল, তা কি থেঁতলে গেল? এসব প্রশ্নের উত্তর কেউই এখন দিতে পারবে না। তবে এটা বোধহয় বলা যায়, অবস্থা আর আগের মতো হবে না কোনো দিনও। মনে হচ্ছে, দারিদ্র্য আর প্রাচুর্যের মিসর, সংস্কৃতি আর অপসংস্কৃতির মিসর, সভ্যতা আর অনুকরণের প্রবণতার মিসরের নয় কোটি মানুষ তাদের মর্যাদা আর আত্মসম্মান পুনঃ অর্জন করতে চায়। যখন হোসনি মোবারক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন, তখন এই জনসংখ্যার অর্ধেকেরও জন্ম হয়নি। হোসনি মোবারকের পৃথিবীর বাইরে যে জীবন আছে, তারই আস্বাদ এখন আপামর মিসরীয়রা লাভ করতে চায়; সৌদি আরবের সরকার যতই মোবারকের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করুক না কেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এবং পাশ্চাত্যের বিদেশনীতি এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সবাই উঁচু গলায় এখন সংস্কারের কথা বলছেন, অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা বলছেন, ন্যায়-নীতি সম্বন্ধে মিসর আর মোবারককে ওয়াজ-নসিহত করছেন; যা তাঁরা এত দিন করেননি। যেখানেই যুক্তরাষ্ট্রের এবং পাশ্চাত্যের স্বার্থ এবং নীতির সংঘাত হয়েছে, সেখানেই তাদের কর্মকাণ্ডে স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে। একমাত্র তাদের কারণেই আজ ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর ধর্মান্ধ একটি রাষ্ট্র। বশংবদ মিসরের মাধ্যমেই তারা ইসরায়েলকে খোশমেজাজে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। আজ থেকে ৮০ বছর আগে জুইশ স্ট্যান্ডার্ড (Jewish Standard) পত্রিকার সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ইহুদি নেতৃবৃন্দ যদি প্যালেস্টাইনে তাঁদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ, আরবদের অনুরূপ স্বার্থের চাইতে আলাদা করে দেখেন, তাহলে সেই পবিত্র ভূমিতে জঘন্য সব বিস্ফোরণ (Ugly eruptions) ঘটবে।’ সেই বেদবাক্যটির পুনরাবৃত্তি ইহুদি নেতাদের কাছে না করে যুক্তরাষ্ট্র আর পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ মোবারকদের মতো নেতাকে বছর বছর ধরে দুধ-কলা দিয়ে পুষছেন—এই মাত্রায় যে রবীন্দ্রনাথও ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। কারণ, জঘন্য সব বিস্ফোরণ এখন শুধু ‘পবিত্র ভূমিতেই’ ঘটছে না, ঘটছে এবং ঘটবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য অনেক স্থানে।
মলম লাগিয়ে ক্যানসার সারানো যায় না। মিসরে নতুন ভাইস প্রেসিডেন্ট আর প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা সময়ের অপচয় বলেই মনে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মোবারকের প্রস্থানেও সমস্যার সমাধান হবে না। মিসরে মানুষ পুলিশকে এতই ঘৃণা করে যে তাদের টিকিটিরও নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তাঘাটে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে; কিন্তু কর্মকাণ্ড নেই। এ কারণে; এবং যথার্থই সেই কারণ যে, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা তাদের দায়িত্ব নয়। আমাদের যেসব রাজনৈতিক নেতা পান থেকে চুন খসলেই সেনাবাহিনীকে তলব করার আওয়াজ তোলেন, তাঁরা যেন সামান্য এই সত্যটিকে হূদয়ঙ্গম করেন। সামরিক বাহিনীর প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে গত পাঁচ দিনেই মিসরের সর্বত্র রক্তাক্ত অরাজকতা বিরাজ করত, দেশটির নিরাপত্তা সত্যিকার অর্থেই বিঘ্নিত হতো। লুটতরাজের মাঝে কায়রোর মিউজিয়াম হয়তো বা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
আজ হোক, কাল হোক, মোবারককে যেতেই হবে। তাঁর শাসনপদ্ধতি চিরতরে বর্জন করতে হবে। মনে হচ্ছে, মিসরীয়দের ভীতির বাঁধ অবশেষে ভেঙে গেছে, তারা স্বাধীনতা এবং আত্মসম্মান চায়। যুগ যুগ ধরে বিদেশি সাহায্য পাওয়ার পরও দেশটির ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে—বেকারদের নেই কোনো সঠিক পরিসংখ্যান। গত কয় দিনের আন্দোলনে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে হাজার হাজার। এত বিদ্রোহ সনাতন সভ্যতার মিসর কোনো দিন দেখেনি। আজ যাঁরা মোবারকের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা দলমত-নির্বিশেষে রংধনু কোয়ালিশন (RAINBOW COALITION) গঠন করেছেন। ভুললে চলবে না যে, তাদের মধ্যে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ও রয়েছে, যা এখন সরকারিভাবে বেআইনি। যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ হয়তো বা মোবারকের বিকল্প খুঁজছে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এলবারাদি, রাজনীতিবিদ আয়মান নূর অথবা সৈয়দ বাদাওয়ি অথবা মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিয়ে আপাতত এদের সবার কোয়ালিশন? তবে মোবারকের চূড়ান্ত উত্তরসূরি হবেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। আর যুক্তরাষ্ট্রের মনে রাখতেই হবে, ইসরায়েল তাদের সম্বন্ধে কী ভাবে, তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তারাও ইসরায়েলের বর্তমান কর্মকাণ্ড আর চিন্তাধারাকে কীভাবে মূল্যায়ন করে, তা সমানভাবেই দৃষ্টি আকর্ষণের দাবি রাখে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্বার্থ’ আর ‘উচ্চারিত নীতির’ সংঘাত ঘটে, সেখানে নীতিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতেই হবে। মধ্যপ্রাচ্যে মিসর লোকসংখ্যায় বৃহত্তম দেশ; তবে অন্যান্য দেশও রয়েছে, যেখানে এই রাজনৈতিক সুনামি আঘাত হানবে। তখন যদি নীতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শিত না হয়, তাহলে রাজনৈতিক সুনামির আঘাত প্রাকৃতিক সুনামির আঘাতের মতোই ভয়াবহ হতে পারে।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
No comments