সমকালীন প্রসঙ্গ-বাংলাদেশে পহেলা মে by বদরুদ্দীন উমর

বাংলাদেশে পহেলা মে যেভাবে ঢাকঢোল বাজিয়ে, লাল টুপি পরে বড় বড় মিছিল ও সভা করে পালিত হয় তা থেকে বোঝা মুশকিল শ্রমিকরা এখানে কতখানি শোষিত ও নির্যাতিত। বোঝা মুশকিল এখানে প্রকৃত শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন বলে কিছু নেই।


কাজেই যারা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চান তাদের কর্তব্য হলো, শুধু কথাবার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে খোদ শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করা। যত দ্রুত সম্ভব শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠনকে নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য, নিজেদের প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি, সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালীভাবে সংগঠিত করা

বাংলাদেশে পহেলা মে দিবসে নানা অদ্ভুত ব্যাপার দেখা যায়। কট্টর শ্রমিকবিরোধীদের শাসন বলবৎ থাকলেও এ রাষ্ট্রের উদ্ভবের পর থেকেই এখানে পহেলা মে সরকারি ছুটি। পহেলা মে উপলক্ষে এখানে যে সভা-সমিতি-অনুষ্ঠান ইত্যাদি হয় সেগুলোর মধ্যে জৌলুসপূর্ণ অধিকাংশই হয় শিল্প-বাণিজ্যের মালিকশ্রেণী ও সরকারি লোকদের উদ্যোগে! এসব সভা-সমিতি অনুষ্ঠানে ধুয়োর মতো করে শ্রমিকদের বলা হয় উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করতে, কলকারখানায় ও সব ধরনের শ্রমিক অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে! কোনো কোনো অতি উৎসাহী এই দিবসে শ্রমিকদের ধর্মঘট না করার উপদেশও দিয়ে থাকেন! এসব দেখে মনে হয় বাংলাদেশে মে দিবস মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূল স্তম্ভের মধ্যে সমাজতন্ত্রকে অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করে একটি 'সমাজতান্ত্রিক' রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে পহেলা মে সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। এই কাজ করার অল্পদিন পরই ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে টঙ্গী শ্রমিক এলাকায় জিন্নাত টেক্সটাইল মিল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সেক্রেটারি আলী আজমসহ কয়েকজন শ্রমিক নিখোঁজ হন। পরে আলী আজমের মৃতদেহ ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। অন্য কারও কোনো খবর আর না পাওয়ায় ধরে নেওয়া হয় যে, তাদের গুম-খুন করা হয়েছে। সে সময় ১ অক্টোবর ১৯৭২ তারিখে আমি ইংরেজি দৈনিক হলিডে পত্রিকায় গঁৎফবৎ রহ ঞড়হমর নামে একটি প্রবন্ধ লিখি।
এরপর ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামের বাড়বকুণ্ডুতে আরআর জুট ও টেক্সটাইল মিলে শ্রমিকদের ওপর ব্যাপক সশস্ত্র হামলা চালানো হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বিরোধীদলীয় শ্রমিক সংগঠন একেবারে ভেঙে দিয়ে সরকারি শ্রমিক সংগঠনের আধিপত্য ওই শ্রমিক অঞ্চলে স্থাপন করা। এর কয়েক মাস আগে খুলনার শ্রমিক অঞ্চলে একই রকম ঘটনা ঘটে। সেখানে শ্রমিকদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে অনেককে হত্যা করা হয়। তাদের লাশ নদীতে ফেলা হয়। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামের কালুরঘাট শ্রমিক অঞ্চলে শ্রমিকদের ওপর একই ধরনের সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হয়। বাড়বকুণ্ডুতে শ্রমিকদের ওপর যে সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হয়েছিল তা অন্য জায়গায় এই ধরনের আক্রমণের ক্ষেত্রে অনেক ব্যাপক ছিল। বহু শ্রমিক এই ঘটনায় হতাহত হয়েছিলেন। সে সময় ঞযব ইধৎধনশঁহফধ ওহপরফবহঃ নামে এর ওপর আমার একটি প্রবন্ধ হলিডেতে প্রকাশিত হয়েছিল ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ তারিখে।
১৯৭৩ সালের ৫ এপ্রিল টঙ্গীতে 'বাংলা শ্রমিক ইউনিয়ন'-এর সদস্যদের ওপর সরকারি শ্রমিক ইউনিয়ন ও পুলিশ এক সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে বিরোধী শ্রমিক সংগঠনটিকে টঙ্গী থেকে কার্যত উৎখাত করে। সেদিন দুপুরে টঙ্গীর শিল্প কারখানা অঞ্চলে বিরোধী শ্রমিকদের নিষ্ঠুরভাবে মারপিট করে তাদের অনেককে হত্যা করা হয়। তাদের বাড়িতে বাড়িতে পর্যন্ত ধাওয়া করে সমগ্র এলাকা ছাড়তে এমনভাবে বাধ্য করা হয় যাতে হাজার হাজার শ্রমিক তাদের পরিবারসহ হেঁটে সন্ধ্যার দিকে ঢাকা উপস্থিত হন। প্রথমে শ্রমিক ফেডারেশনের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে। তিনি তাদের সুবিচারের আশ্বাস দেন। পরে এই হাজার হাজার শ্রমিক নিজেদের পরিবারসহ ঢাকা স্টেডিয়ামে আশ্রয় নেন এবং সেখানে তারা দু'দিন তিন রাত অবস্থান করেন। এ সময় ঝঃড়ৎস ঃৎড়ড়ঢ়বৎ ড়ঢ়বৎধঃরড়হ রহ ঞড়হমর নামে আমি একটি প্রবন্ধ লিখি ৮ এপ্রিল হলিডে পত্রিকায়। এখানে উলি্লখিত এই তিনটি প্রবন্ধই আমার চড়ষরঃরপং ধহফ ঝড়পরবঃু রহ ইধহমষধফবংয নামক বইটিতে প্রকাশিত হয়েছে ('ঝঁনধৎহধ', উযধশধ)।
মে দিবস উপলক্ষে অন্য আলোচনার আগে ১৯৭২-৭৩ সালের এসব শ্রমিকবিরোধী তৎপরতা এবং সশস্ত্র আক্রমণের বিষয় উল্লেখ করার কারণ, বাংলাদেশে মে দিবস উপলক্ষে শাসকশ্রেণী ও সরকারের বিভিন্ন মঞ্চ থেকে যাই বলা হোক, শ্রমিকদের ওপর আক্রমণ ও শ্রমিক শোষণ এমন পুরোদস্তুর চললেও এটা নতুন ব্যাপার নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সময় থেকেই শাসকশ্রেণী ও সরকার কর্তৃক শ্রমিকদের ওপর এই আচরণ নিষ্ঠুরভাবে শুরু হয় এবং তার ধারাবাহিকতাই এখনও পর্যন্ত চলে আসছে।
যারা প্রগতিশীল তাদের মে দিবস পালনের উদ্দেশ্য ২০১২ সালে এসে ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবিতে ইতিহাসের ঘটনা বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। এর জন্য আমাদের অবশ্যই বাংলাদেশকে বর্তমানে শ্রমিকদের অবস্থার দিকে তাকাতে হবে। তাদের আন্দোলন ও সংগঠনের অবস্থা পর্যালোচনা করতে হবে। শ্রমিকদের ওপর মালিকশ্রেণী ও সরকারের আক্রমণের বিষয়টি উপস্থিত করতে হবে।
বাংলাদেশে শিল্প শ্রমিকদের অবস্থা এখন প্রকৃতপক্ষে খুব খারাপ। তাদের প্রকৃত মজুরি এখন এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যা ১৯৬৯-৭০ সালে পাকিস্তান আমলে শ্রমিকদের মজুরির থেকে অনেক কম। সে সময় নূর খান কমিশন শিল্প শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ধার্য করেছিল মাসিক ১৫৫ টাকা। বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি যে হারে হয়েছে তাতে এখনকার শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি তখনকার ১৫৫ টাকার থেকে অনেক কম। অথচ তখনকার অবস্থা পরিবর্তনের জন্যই ১৯৭১ সালে শ্রমিকরা অন্য সকলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে নিজেদের উন্নতির অনেক স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন। সে স্বপ্ন তাদের অনেক আগেই ভঙ্গ হয়েছে।
মালিকরা ও তাদের সরকার তো শ্রমিকদের বিরুদ্ধে থাকবেই। কাজেই তাদের বর্তমান দুরবস্থা শুধু সরকার ও মালিকশ্রেণীর নীতি ও কার্যকলাপের দ্বারাই ব্যাখ্যা করতে যাওয়া ঠিক নয়। এর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো বর্তমান বাংলাদেশে কোনো প্রগতিশীল শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন না থাকা। এই অনুপস্থিতিই শ্রমিক পরিস্থিতিকে সংকটজনক করেছে। স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রার শুরুতেই তৎকালীন সরকার শ্রমিকদের ওপর নিষ্ঠুর ও সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে বিদ্যমান শ্রমিক সংগঠনগুলোকে ভেঙে দিয়ে নিজেদের সংগঠন শ্রমিক লীগকে সব অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সরকারি শ্রমিক সংগঠন যে শ্রমিকদের স্বার্থে কাজ করবে না এবং দালালদের দ্বারাই পরিচালিত হবে এটাই স্বাভাবিক। এই অবস্থা পরিবর্তিত হতে পারত যদি তার বিকল্প কোনো প্রগতিশীল শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার জন্য দাঁড়াত। কিন্তু বাংলাদেশে সে রকম কিছু হয়নি। নানা কারণে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন ও সংগঠন দুর্বল ও প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়াই ছিল প্রগতিশীল শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলনের কার্যকর উপস্থিতি না থাকার কারণ। কমিউনিস্ট আন্দোলন এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে নতুনভাবে গঠিত হয়ে যথেষ্ট শক্তি অর্জন করতে না পারাই কার্যকর ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক আন্দোলনের অনুপস্থিতির মূল কারণ। এর জন্য শুধু মালিকশ্রেণী ও তাদের সরকারকে দোষারোপ করলে এ ক্ষেত্রে সংগঠনের প্রকৃত চরিত্র বোঝা যাবে না।
যে দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী নয় সে দেশে শ্রমিক আন্দোলন শক্তিশালী হতে পারে না, শ্রমিকরা আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায় করতে পারেন না। এটা এক বাস্তব ব্যাপার এবং ঐতিহাসিক সত্য। বিশেষ করে বর্তমান দুনিয়া যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে বিশুদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন বলে কিছু নেই, থাকতে পারে না। শ্রমিক আন্দোলনের রাজনীতিকরণ ছাড়া ট্রেড ইউনিয়নগুলোর কোনো কর্মসূচিই শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি করতে পারে না, শ্রমিক শোষণ ও শ্রমিক নির্যাতনকে সহ্যসীমার মধ্যে রাখতে পারে না। বাংলাদেশেও সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এর মূল কারণ বাংলাদেশে কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের দুরবস্থা। দালাল শুধু সরকারি ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যেই নেই, তথাকথিত সরকারবিরোধী ট্রেড ইউনিয়নগুলোর নেতৃত্বও এখন দালালদের হাতে। এই দালালরা এমনভাবে সরকার ও মালিকদের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে যাতে শ্রমিক আন্দোলন স্বাধীনভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। শুধু তাই নয়, প্রকৃত প্রগতিশীল ট্রেড ইউনিয়নের অনুপস্থিতিতে এবং অনেক শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার না থাকার কারণে বাংলাদেশে এখন শ্রমিক আন্দোলনের শায়িত অবস্থা। গার্মেন্টসহ অন্য কোনো কোনো শিল্পক্ষেত্রে এ কারণেই শ্রমিকের উদ্বৃত্ত শ্রমমূল্য শোষণ এখন নির্মমভাবে হচ্ছে। এই নিম্নমজুরিই এখানকার গার্মেন্ট শিল্পের রমরমা অবস্থার মূল কারণ। এখানে শ্রমিকদের মজুরির এই অবস্থা অর্থাৎ শ্রমিক শোষণের এই সুবর্ণ সুযোগই বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে পুঁজি বিনিয়োগের প্রতি আগ্রহের মূল কারণ। এ কারণেই গার্মেন্ট শিল্পের বিকাশ এখানে এত দ্রুত।
বাংলাদেশে পহেলা মে যেভাবে ঢাকঢোল বাজিয়ে, লাল টুপি পরে বড় বড় মিছিল ও সভা করে পালিত হয় তা থেকে বোঝা মুশকিল শ্রমিকরা এখানে কতখানি শোষিত ও নির্যাতিত। বোঝা মুশকিল এখানে প্রকৃত শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন বলে কিছু নেই। কাজেই যারা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চান তাদের কর্তব্য হলো, শুধু কথাবার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে খোদ শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করা। যত দ্রুত সম্ভব শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠনকে নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য, নিজেদের প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি, সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালীভাবে সংগঠিত করা।
৩০.৪.২০১২
 

No comments

Powered by Blogger.