হাবিবুর রহমান স্যারকে মনে পড়ে by তুলসী কুমার দাস
প্রফেসর হাবিবুর রহমানের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ বুধবার। তিনি ছিলেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় উপাচার্য। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগে প্রায় ২৬ বছর শিক্ষকতা করেছেন।
এ বিভাগের ছাত্র থাকাকালে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরোটা সময়ই তাকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। তার ক্লাস উপভোগ করেনি এমন ছাত্রছাত্রী আমি দেখিনি। এক সেকেন্ড দেরিতে কখনও ক্লাসে আসতেন না। অভিনব ছিল তার লেকচার ডেলিভারি। তখন মাল্টিমিডিয়ায় পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে লেকচার দেওয়ার প্রযুক্তি ছিল না। প্রফেসর রহমান ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে ক্লাসে বক্তব্য দিতেন। তার বক্তব্য ছিল খুবই স্পষ্ট এবং অতি জোরালো। উদাহরণ উপস্থাপন করতেন মানুষের প্রতিদিনের জীবন, সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে। বক্তব্যগুলো অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে ঘোষণা করতেন। হৃদয় ছুঁয়ে যেত আমাদের। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমরা তার কথা শুনতাম। সেই প্রফেসর হাবিবুর রহমান আমাদের সবার মন খারাপ করে দিয়ে চলে এলেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেটা ছিল ১৯৯২ সাল। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়টি তখন একেবারেই নবীন। মাত্র এক বছর আগে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেছে।
১৯৯৭ সালে প্রফেসর হাবিবুর রহমান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আমি তখন বিদেশে। সেখান থেকেই উপাচার্য হাবিবুর রহমান স্যারের নানা সাফল্য সম্পর্কে অবহিত হতে থাকি। উপাচার্য হওয়ার আগে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য, সামাজিক বিজ্ঞান স্কুলের ডিন, সিন্ডিকেট সদস্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তার নেতৃত্বে এবং প্রফেসর মুহম্মদ জাফর ইকবালের সহযোগিতায় অপটিক ফাইবার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়কে ইন্টারনেট প্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রথম ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করে। তিনি উপাচার্য থাকাকালেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হয় এবং সেটিও সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম ছিল বলে জেনেছি। এ দুটি অর্জন নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক।
একাডেমিক ভবন, শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ভবন, ডরমিটরিসহ নানা নয়নাভিরাম স্থাপনা গড়ে তুলতে তিনি সমর্থ হন। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্ভবত দেশের মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার 'শহীদ মিনারটি' নির্মাণের ব্যবস্থা করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের শিশুদের জন্য তৈরি করেন 'বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল'। মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য সব আয়োজন সম্পন্ন করা হলেও উপাচার্য হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেটা অসমাপ্ত থাকে।
উপাচার্য হিসেবে প্রফেসর হাবিবুর রহমান ব্যাপক সাফল্য লাভ করলেও এক পর্যায়ে তিনি সাম্প্রদায়িক শক্তির রোষানলে পতিত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ভবনের নামকরণ দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের নামে করার জন্য সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। উপাচার্য সিন্ডিকেটের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে মৌলবাদী গোষ্ঠী তার তীব্র বিরোধিতা করে। এমনকি তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কর্তৃক গৃহীত নামকরণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি মেনে নেননি। ফলে এক জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকে। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে নামকরণের সিদ্ধান্ত স্থগিত করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে।
আমি উচ্চশিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে সমাজকর্ম বিভাগে পুনঃযোগদান করি ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। প্রফেসর হাবিবুর রহমান তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। সমাজকর্ম বিভাগে পুনঃযোগদানের অল্পদিনের মধ্যেই জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে আমাকে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন আমাদের বিভাগে কোনো প্রফেসর ছিলেন না। মাত্র তিন মাস পরই উপাচার্য হিসেবে প্রফেসর হাবিবুর রহমানের মেয়াদ শেষ হয় এবং তিনি আবার প্রফেসর হিসেবে সমাজকর্ম বিভাগে যোগদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধি অনুযায়ী তাকে সমাজকর্ম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত করা হয়, কিন্তু তিনি লিখিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন, তিনি শুধু একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে বিভাগের কাজ করবেন; বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নয়। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুধু মতাদর্শগত ভিন্নতার কারণে তাকে চাকরির এক্সটেনশন থেকে বঞ্চিত করেছে। প্রফেসর হাবিবুর রহমান আপাদমস্তক ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব। তিনি তার মতাদর্শে ছিলেন অতি উচ্চকণ্ঠ। আপসহীন এবং নির্ভীক চরিত্রের অধিকারী প্রফেসর রহমান কখনও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। আত্মবিশ্বাসী ও কর্মনিষ্ঠ এই শিক্ষক তার ব্যক্তিত্বের কারণেই বিরোধী মতাদর্শের অনেকের মনও জয় করতে পেরেছিলেন।
হঠাৎ করেই প্রফেসর হাবিবুর রহমান আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সমগ্র সিলেটে একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর সিলেট শহরে শোকের যে মিছিল দেখেছি তা এককথায় অবিশ্বাস্য। মৃত্যুর মাত্র ২০ ঘণ্টা আগে তার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ টেলিফোনে আমার আলাপ হয়। পরদিন সন্ধ্যায় তার বাসায় তার সঙ্গে আমার দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু সকাল ৮টার দিকেই তিনি মৃত্যুকে বরণ করেন। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার যে অবদান, সমাজকর্ম বিভাগে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা চিরদিন অম্লান থাকবে। হাবিবুর রহমান স্যার বেঁচে থাকবেন সব সময় আমার মতো অসংখ্য ভক্তের হৃদয় গভীরে।
tubshikumardas@gmail.com
১৯৯৭ সালে প্রফেসর হাবিবুর রহমান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আমি তখন বিদেশে। সেখান থেকেই উপাচার্য হাবিবুর রহমান স্যারের নানা সাফল্য সম্পর্কে অবহিত হতে থাকি। উপাচার্য হওয়ার আগে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য, সামাজিক বিজ্ঞান স্কুলের ডিন, সিন্ডিকেট সদস্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তার নেতৃত্বে এবং প্রফেসর মুহম্মদ জাফর ইকবালের সহযোগিতায় অপটিক ফাইবার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়কে ইন্টারনেট প্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রথম ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করে। তিনি উপাচার্য থাকাকালেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হয় এবং সেটিও সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম ছিল বলে জেনেছি। এ দুটি অর্জন নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক।
একাডেমিক ভবন, শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ভবন, ডরমিটরিসহ নানা নয়নাভিরাম স্থাপনা গড়ে তুলতে তিনি সমর্থ হন। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্ভবত দেশের মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার 'শহীদ মিনারটি' নির্মাণের ব্যবস্থা করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের শিশুদের জন্য তৈরি করেন 'বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল'। মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য সব আয়োজন সম্পন্ন করা হলেও উপাচার্য হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেটা অসমাপ্ত থাকে।
উপাচার্য হিসেবে প্রফেসর হাবিবুর রহমান ব্যাপক সাফল্য লাভ করলেও এক পর্যায়ে তিনি সাম্প্রদায়িক শক্তির রোষানলে পতিত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ভবনের নামকরণ দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের নামে করার জন্য সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। উপাচার্য সিন্ডিকেটের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে মৌলবাদী গোষ্ঠী তার তীব্র বিরোধিতা করে। এমনকি তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কর্তৃক গৃহীত নামকরণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি মেনে নেননি। ফলে এক জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকে। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে নামকরণের সিদ্ধান্ত স্থগিত করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে।
আমি উচ্চশিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে সমাজকর্ম বিভাগে পুনঃযোগদান করি ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। প্রফেসর হাবিবুর রহমান তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। সমাজকর্ম বিভাগে পুনঃযোগদানের অল্পদিনের মধ্যেই জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে আমাকে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন আমাদের বিভাগে কোনো প্রফেসর ছিলেন না। মাত্র তিন মাস পরই উপাচার্য হিসেবে প্রফেসর হাবিবুর রহমানের মেয়াদ শেষ হয় এবং তিনি আবার প্রফেসর হিসেবে সমাজকর্ম বিভাগে যোগদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধি অনুযায়ী তাকে সমাজকর্ম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত করা হয়, কিন্তু তিনি লিখিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন, তিনি শুধু একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে বিভাগের কাজ করবেন; বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নয়। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুধু মতাদর্শগত ভিন্নতার কারণে তাকে চাকরির এক্সটেনশন থেকে বঞ্চিত করেছে। প্রফেসর হাবিবুর রহমান আপাদমস্তক ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব। তিনি তার মতাদর্শে ছিলেন অতি উচ্চকণ্ঠ। আপসহীন এবং নির্ভীক চরিত্রের অধিকারী প্রফেসর রহমান কখনও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। আত্মবিশ্বাসী ও কর্মনিষ্ঠ এই শিক্ষক তার ব্যক্তিত্বের কারণেই বিরোধী মতাদর্শের অনেকের মনও জয় করতে পেরেছিলেন।
হঠাৎ করেই প্রফেসর হাবিবুর রহমান আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সমগ্র সিলেটে একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর সিলেট শহরে শোকের যে মিছিল দেখেছি তা এককথায় অবিশ্বাস্য। মৃত্যুর মাত্র ২০ ঘণ্টা আগে তার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ টেলিফোনে আমার আলাপ হয়। পরদিন সন্ধ্যায় তার বাসায় তার সঙ্গে আমার দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু সকাল ৮টার দিকেই তিনি মৃত্যুকে বরণ করেন। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার যে অবদান, সমাজকর্ম বিভাগে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা চিরদিন অম্লান থাকবে। হাবিবুর রহমান স্যার বেঁচে থাকবেন সব সময় আমার মতো অসংখ্য ভক্তের হৃদয় গভীরে।
tubshikumardas@gmail.com
No comments