রাজশাহী-সুখের নগর কি খুনের নগর হবে? by কুদরাত-ই-খুদা

স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ক্যাডেট কলেজসহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে রাজশাহীতে। এ কারণে রাজশাহীকে শিক্ষানগর বলা হয়ে থাকে। শিল্পকারখানা তেমন একটা গড়ে না ওঠায় এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা, আয়-ব্যয়, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অনেক কিছুই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। ভৌগোলিক, ঐতিহ্য ও স্বভাবগত দিক থেকে রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ অনেকটাই শান্তিপ্রিয়, সহজ-সরল এবং কঠোর পরিশ্রমবিমুখও বটে।


বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মহানগর খুঁজে পেতে ২০০৬ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের (এলএসই) উদ্যোগে ৭০টি দেশের নগরের ওপর বিভিন্ন দিক থেকে জরিপ চালানো হয়। ওই জরিপের ফলাফলে রাজশাহীকে বিশ্বের ‘সবচেয়ে সুখী মহানগর’ হিসেবেও ঘোষণা করা হয়, যা ছিল রাজশাহীবাসীর জন্য আনন্দের ও গর্বের বিষয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী মহানগরে যেভাবে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চলেছে, এতে করে জনমনে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে শিক্ষানগর এবং বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মহানগর রাজশাহী কি খুনের মহানগরে পরিণত হতে চলেছে?
পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১১ সালে রাজশাহীতে ৫৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের শুরুর মাস জানুয়ারিতেও রাজশাহীতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। রাজশাহীতে সর্বশেষ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী নাদিমুজ্জামান ওরফে সাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। প্রেম, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পরকীয়া, যৌতুক, জমিজমা, খেলাধুলা, পূর্বশত্রুতা, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা কারণ এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে কাজ করেছে। রাজশাহী মহানগরের বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে গত বছরের ১২ এপ্রিল ব্যবসায়ী আমিনুল হককে অপহরণপূর্বক মুক্তিপণ আদায়সহ হত্যা করে নয় টুকরা করা, ওই একই বছরের ২১ এপ্রিল হত্যার পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ক্যানটিনের পেছনের নালা থেকে ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলম ওরফে রাসেলের লাশ উদ্ধার, ১২ মে রাজশাহীর খড়খড়ি বাইপাস সড়কের ধারে অটোরিকশাচালক নাদিমের লাশ উদ্ধার, ১০ জুলাই রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার শিমুলতলী গ্রামের বিধবা আদিবাসী নারী মরিয়ম মুর্মুকে ধর্ষণের পর হত্যা, ২২ অক্টোবর রাজশাহীর পদ্মা নদী থেকে ব্যবসায়ী তৌফিকুল ইসলামের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার, ১৫ ডিসেম্বর রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার শিবপুরহাট জায়গীরপাড়া গ্রামে জোড়া খুনের ঘটনা অর্থাৎ দিনমজুর আলমকে জবাই করে হত্যা এবং দুই সন্তানের জননী সাহারা খাতুনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা, এর এক সপ্তাহ পর ২২ ডিসেম্বর পুঠিয়ার তারাপুর গ্রামের নূর ইসলামকে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া গত বছরের (২০১১) জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত রাজশাহী জেলা ও মহানগরে যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে: ৪ ডিসেম্বর মহানগরের রাজপাড়া বুলনপুরে রোকন, ৮ ডিসেম্বর মতিহার এলাকায় ক্লিনিকে আয়া নার্গিস, ১১ নভেম্বর মাদ্রাসাছাত্র ইলিয়াস হোসেন, ১৩ অক্টোবর গোদাগাড়ীর ভাটুপাড়া গ্রামে তাজমহল, ২০ সেপ্টেম্বর মহানগরের খুলীপাড়ায় আওয়ামী লীগ নেতা পিন্টু, ২১ সেপ্টেম্বর চারঘাটে প্রতিবন্ধী যুবক শহীদ আলী, ২৯ সেপ্টেম্বর ডাঙাপাড়া বিলে টুটুল, ১১ আগস্ট মোহনপুরের কলিগ্রামে সাথী, ১৪ জুন কোর্ট হড়গ্রাম বাজার এলাকায় আবদুল কুদ্দুস, ১০ এপ্রিল বালিয়াপুকুর খাসপাড়া এলাকায় নূরা আলী, ১৪ এপ্রিল মেহেরচণ্ডী এলাকায় আবুল কাশেম, ওই একই দিনে মহানগরের লক্ষ্মীপুরের হোটেল আল নূরের বোর্ডার সিহাবুল হত্যাসহ ওই বছরের বিভিন্ন সময়ে অবশিষ্ট হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়। গত বছরের মতো চলতি বছরেও রাজশাহীতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ৪ জানুয়ারি মহানগরের খিরশিনটিকর এলাকার একটি মসুরের খেত থেকে অটোরিকশাচালক মইনুল ইসলামের জবাই করা লাশ উদ্ধার। সর্বশেষ ২৫ জানুয়ারি শিরোইল এলাকার একটি ছাত্রাবাসের সেপটিক ট্যাংক থেকে মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র নাদিমুজ্জামানের জবাই করা লাশ উদ্ধার।
রাজশাহীতে ধারাবাহিকভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ায় এখানকার সাধারণ মানুষ এখন রীতিমতো আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি খুন ও গুপ্তহত্যার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় জনমনে তা ব্যাপকভাবে প্রভাবও ফেলেছে। ফলে এখানকার মানুষের পক্ষে এখন আর স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখা সম্ভব হচ্ছে না। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা অধিকাংশ মামলারই আদালতে এখন পর্যন্ত অভিযোগপত্র দিতে পারেননি মামলা-সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তারা। ধারাবাহিকভাবে এসব হত্যাকাণ্ড যে রাজশাহীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
খুন বা হত্যা করার পরও অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া, অপরাধীরা গ্রেপ্তার না হওয়া, আবার গ্রেপ্তার হলেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বা আইনের মারপ্যাঁচে শেষ পর্যন্ত ছাড় পেয়ে যাওয়া, ভৌগোলিক দিক দিয়ে রাজশাহী ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় খুন করার পর খুনিরা সহজেই ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া, এখানকার যুবসমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে মাদকাসক্তির প্রবণতা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রেম, স্বার্থগত বিরোধ, মনুষ্যত্ববোধ অধিকমাত্রায় লোপ পাওয়াসহ নানা কারণে এখানে হত্যা, খুন বা গুপ্তহত্যার ঘটনা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে বলে ধারণা করা যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি ঘটানোসহ প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রয়াস। প্রয়োজন প্রকৃত অপরাধীদের যেকোনো মূল্যে খুঁজে বের করে তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। পাশাপাশি যেকোনো মূল্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা বন্ধ করা, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা কমানো, সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের পারিবারিক ও ভালোবাসার বন্ধন শক্তিশালী করাসহ সবার মাঝে মনুষ্যত্ব ও বিবেকবোধ পরিপূর্ণরূপে জাগ্রত করতে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। অন্যথায় আজকের এ শিক্ষানগর রাজশাহী যে অদূর ভবিষ্যতে খুনের নগরে পরিণত হবে, তা সহজেই অনুমেয়। আর তখন বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মহানগর রাজশাহী হয়ে উঠবে বিশ্বের সবচেয়ে অসুখী মহানগরে, যা কারও কাম্য হতে পারে না।
কুদরাত-ই-খুদা: সাংবাদিক ও গবেষক (আইবিএস), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
kekbabu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.