মত দ্বিমত-সুস্থ রাজনীতির জয় হোক by আবদুল মান্নান
হঠাৎ করেই দেশের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বিএনপির গণমিছিল কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে পুলিশের গুলিতে চারজন মারা গেছেন। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল মান্নান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল সুস্থ, জবাবদিহিমূলক ও জনকল্যাণকর রাজনীতির পূর্বশর্তই হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা,
যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে এই সংস্কৃতির চর্চা না হওয়ার খেসারত দিতে হয় সাধারণ জনগণকে। তার একটি ট্র্যাজিক প্রমাণ গত রোববার, ৩০ ডিসেম্বর চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে পুলিশের গুলিতে চারজনের মৃত্যু। বিএনপি যে তার মিত্রদের নিয়ে গণমিছিল করবে, তার ঘোষণা তো দিয়েছিল গত ডিসেম্বরেই।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণমিছিল, জনসভা আর হরতাল বিএনপি আবিষ্কার করেনি। এগুলো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। এগুলোতে কত মানুষের সমাগম হলো, তাতে কিছু আসে-যায় না। যেহেতু এর একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অংশগ্রহণকারী ভাড়ায় খাটে। আজ এই দলের, তো কাল অন্য দলের।
সুতরাং, ২৯ তারিখ নির্বিঘ্নে সরকার যদি বিএনপিকে তাদের পূর্বনির্ধারিত গণমিছিল করতে দিত, এমন কী অসুবিধা ছিল? তা তো হলোই না, বরং তার ওপর মহানগর আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে একটা জনসভার ডাক দিল। এটার কি কোনো প্রয়োজন ছিল? না, ছিল না। ফলস্বরূপ, বিনা কারণে একদিকে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হলো, অন্যদিকে চারজন মানুষ প্রাণ হারাল।
৩০ তারিখ মহানগর পুলিশ উভয় পক্ষের মিছিল সমাবেশ করার জন্য যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তা তো আগের দিনই নেওয়া যেত। আসলে সরকারের এবং আওয়ামী লীগের কোনো কোনো কার্যকলাপ দেখলে সাধারণ মানুষের মনে হবে, যেকোনো কারণেই হোক, তারা আগামী নির্বাচনে বিজয়ের ব্যাপারে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন টক শো বিশারদেরা সম্ভবত সরকারকে এই ধারণা দিয়েছে, ১৯৯০-এর পর থেকে পর পর দুবার কোনো দল সরকার গঠন করেনি। করেনি তো করা যাবে না, তা কেন হবে?
বর্তমান সরকারের অনেক ভালো কাজ আছে। তা জনগণের সামনে তুলে ধরতে সরকার প্রায়ই ব্যর্থ হয়। কারণ, তার প্রচারযন্ত্র খুবই দুর্বল। আর যেসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে, তা বাস্তবায়নের দিকে অনেক বেশি যত্নশীল হতে হবে। আর বিএনপি যদি গণমিছিলের নামে জনজীবন বিপর্যস্ত করে, তা জনগণই বিচার করবে, যেমনটি গত সেপ্টেম্বরে তারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে করেছে। শহরে আওয়ামী লীগের হয়তো কিছু জনসমর্থন কমেছে, তার অর্থ এই নয় যে মানুষ এখনই বিএনপিকে ডেকে এনে ক্ষমতায় বসাবে। তাদের শাসনামল তো সবাই দেখেছে।
ইদানীং সরকার প্রায়শ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার বিষয়ে বিএনপির নানা ষড়যন্ত্রের কথা বলে। এটি শতভাগ সত্য ধরে নিয়েই বলি, এই বিচারকাজ বানচাল করার জন্য শুধু কি বিএনপি ষড়যন্ত্র করছে? এটি বানচাল করা তো তাদের প্রধান দায়িত্ব। কারণ, জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হলে তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যাবে। এ ছাড়া আছে বিএনপির সা কা চৌ আর আবদুল আলীম। হয়তো আরও যোগ হবে।
কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে, এই বিচারকার্যকে বানচাল করার জন্য শুধু বিএনপিই যে ষড়যন্ত্র করছে, তা তো নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জামায়াত কোটি কোটি ডলার খরচ করছে, এই বিচারকে বিতর্কিত করার জন্য এবং যেভাবেই হোক, তারা বিএনপির সঙ্গে সম্মিলিতভাবে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করবে, যাতে বর্তমান সরকারের আমলে এই বিচারকাজ শেষ না হয়। না হলে কী হবে? যেটি হবে সামনের নির্বাচনে, আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনে জয়ী হওয়া সহজ হবে না। কারণ, গত নির্বাচনে দেড় কোটি নতুন ভোটার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে—আওয়ামী লীগের এই অঙ্গীকারে বিশ্বাস করে উজাড় করে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন। বিএনপি-জামায়াত তো চাইবেই পানি ঘোলা করে সরকারকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থায় ফেলে দিতে। সরকার কেন বিএনপির এই ফাঁদে পা দেবে?
সরকারের কোনো কোনো কর্তাব্যক্তি ইদানীং বেশ জোর দিয়ে বলেন, বিএনপি দেশে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করার জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছে। ধরে নিলাম, তা ঠিক। সেটা দমন করার জন্য আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীর কি যোগ্যতার অভাব আছে? তাও তো মনে হয় না। তারা এরই মধ্যে অনেক নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটার আগেই নস্যাৎ করেছে। তার সর্বশেষ উদাহরণ, সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা বানচাল করে দেওয়া।
সবকিছু বিশ্লেষণ করে একটা উপসংহারে আসা যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনেক বাঘা বাঘা উপদেষ্টা আছেন, তবে তাঁদের বাস্তবসম্মত উপদেশ দেওয়ার সক্ষমতা কতটুকু আছে, আর থাকলেও তা তাঁরা দিতে পারেন কি না, আর দিলেও প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত তা পৌঁছায় কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এই মন্তব্যে কেউ মনঃকষ্ট পেলে তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। শুধু সামনের বার নয়, আমরা চাই বারবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসুক এবং গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণ করুক। কিন্তু নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস টলে গেলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
আর বিএনপিকে বলি, আপনাদের মানুষ ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছেন, সেখানে গিয়ে তাঁদের এবং আপনাদের কথা বলার জন্য; রাজপথে অহেতুক অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করার জন্য নয়। আর কদিন পর হয়তো আপনারা সংসদে যাবেন। তবে তা যেন সদস্যপদ রক্ষা করার জন্য না হয়। সব ধরনের হঠকারী রাজনীতির অবসান হোক। সুস্থ রাজনীতির জয় হোক।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ৩১ জানুয়ারি ২০১২
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণমিছিল, জনসভা আর হরতাল বিএনপি আবিষ্কার করেনি। এগুলো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। এগুলোতে কত মানুষের সমাগম হলো, তাতে কিছু আসে-যায় না। যেহেতু এর একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অংশগ্রহণকারী ভাড়ায় খাটে। আজ এই দলের, তো কাল অন্য দলের।
সুতরাং, ২৯ তারিখ নির্বিঘ্নে সরকার যদি বিএনপিকে তাদের পূর্বনির্ধারিত গণমিছিল করতে দিত, এমন কী অসুবিধা ছিল? তা তো হলোই না, বরং তার ওপর মহানগর আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে একটা জনসভার ডাক দিল। এটার কি কোনো প্রয়োজন ছিল? না, ছিল না। ফলস্বরূপ, বিনা কারণে একদিকে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হলো, অন্যদিকে চারজন মানুষ প্রাণ হারাল।
৩০ তারিখ মহানগর পুলিশ উভয় পক্ষের মিছিল সমাবেশ করার জন্য যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তা তো আগের দিনই নেওয়া যেত। আসলে সরকারের এবং আওয়ামী লীগের কোনো কোনো কার্যকলাপ দেখলে সাধারণ মানুষের মনে হবে, যেকোনো কারণেই হোক, তারা আগামী নির্বাচনে বিজয়ের ব্যাপারে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন টক শো বিশারদেরা সম্ভবত সরকারকে এই ধারণা দিয়েছে, ১৯৯০-এর পর থেকে পর পর দুবার কোনো দল সরকার গঠন করেনি। করেনি তো করা যাবে না, তা কেন হবে?
বর্তমান সরকারের অনেক ভালো কাজ আছে। তা জনগণের সামনে তুলে ধরতে সরকার প্রায়ই ব্যর্থ হয়। কারণ, তার প্রচারযন্ত্র খুবই দুর্বল। আর যেসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে, তা বাস্তবায়নের দিকে অনেক বেশি যত্নশীল হতে হবে। আর বিএনপি যদি গণমিছিলের নামে জনজীবন বিপর্যস্ত করে, তা জনগণই বিচার করবে, যেমনটি গত সেপ্টেম্বরে তারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে করেছে। শহরে আওয়ামী লীগের হয়তো কিছু জনসমর্থন কমেছে, তার অর্থ এই নয় যে মানুষ এখনই বিএনপিকে ডেকে এনে ক্ষমতায় বসাবে। তাদের শাসনামল তো সবাই দেখেছে।
ইদানীং সরকার প্রায়শ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার বিষয়ে বিএনপির নানা ষড়যন্ত্রের কথা বলে। এটি শতভাগ সত্য ধরে নিয়েই বলি, এই বিচারকাজ বানচাল করার জন্য শুধু কি বিএনপি ষড়যন্ত্র করছে? এটি বানচাল করা তো তাদের প্রধান দায়িত্ব। কারণ, জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হলে তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যাবে। এ ছাড়া আছে বিএনপির সা কা চৌ আর আবদুল আলীম। হয়তো আরও যোগ হবে।
কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে, এই বিচারকার্যকে বানচাল করার জন্য শুধু বিএনপিই যে ষড়যন্ত্র করছে, তা তো নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জামায়াত কোটি কোটি ডলার খরচ করছে, এই বিচারকে বিতর্কিত করার জন্য এবং যেভাবেই হোক, তারা বিএনপির সঙ্গে সম্মিলিতভাবে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করবে, যাতে বর্তমান সরকারের আমলে এই বিচারকাজ শেষ না হয়। না হলে কী হবে? যেটি হবে সামনের নির্বাচনে, আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনে জয়ী হওয়া সহজ হবে না। কারণ, গত নির্বাচনে দেড় কোটি নতুন ভোটার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে—আওয়ামী লীগের এই অঙ্গীকারে বিশ্বাস করে উজাড় করে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন। বিএনপি-জামায়াত তো চাইবেই পানি ঘোলা করে সরকারকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থায় ফেলে দিতে। সরকার কেন বিএনপির এই ফাঁদে পা দেবে?
সরকারের কোনো কোনো কর্তাব্যক্তি ইদানীং বেশ জোর দিয়ে বলেন, বিএনপি দেশে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করার জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছে। ধরে নিলাম, তা ঠিক। সেটা দমন করার জন্য আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীর কি যোগ্যতার অভাব আছে? তাও তো মনে হয় না। তারা এরই মধ্যে অনেক নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটার আগেই নস্যাৎ করেছে। তার সর্বশেষ উদাহরণ, সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা বানচাল করে দেওয়া।
সবকিছু বিশ্লেষণ করে একটা উপসংহারে আসা যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনেক বাঘা বাঘা উপদেষ্টা আছেন, তবে তাঁদের বাস্তবসম্মত উপদেশ দেওয়ার সক্ষমতা কতটুকু আছে, আর থাকলেও তা তাঁরা দিতে পারেন কি না, আর দিলেও প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত তা পৌঁছায় কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এই মন্তব্যে কেউ মনঃকষ্ট পেলে তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। শুধু সামনের বার নয়, আমরা চাই বারবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসুক এবং গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণ করুক। কিন্তু নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস টলে গেলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
আর বিএনপিকে বলি, আপনাদের মানুষ ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছেন, সেখানে গিয়ে তাঁদের এবং আপনাদের কথা বলার জন্য; রাজপথে অহেতুক অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করার জন্য নয়। আর কদিন পর হয়তো আপনারা সংসদে যাবেন। তবে তা যেন সদস্যপদ রক্ষা করার জন্য না হয়। সব ধরনের হঠকারী রাজনীতির অবসান হোক। সুস্থ রাজনীতির জয় হোক।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ৩১ জানুয়ারি ২০১২
No comments