বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩০০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। সিরাজউদ্দীন আহমেদ, বীর প্রতীক অসমসাহসী কুশলী এক মুক্তিযোদ্ধা সিরাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ চালালেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে। আকস্মিক আক্রমণে হকচকিত পাকিস্তানি সেনারা। কিছুক্ষণ পর তাদের দিক থেকে শুরু হলো প্রতিরোধ। তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকল। গোলাগুলিতে গোটা এলাকা প্রকম্পিত।
আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারাই বিজয়ী হলেন। এ ঘটনা জিনারদীতে। ১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট।
জিনারদী নরসিংদী জেলার অন্তর্গত (ঘোড়াশালের সন্নিকটে)। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখানে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৩ আগস্ট দুপুরে মুক্তিযোদ্ধারা জিনারদীতে আক্রমণ করেন। আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধের পর ১৫ জন পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সাতজন পালিয়ে যায়। একজন নিহত হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা জিনারদী রেলস্টেশন ধ্বংস করেন। এই যুদ্ধে সিরাজউদ্দীন আহমেদ অসীম সাহস ও বীরত্ব এবং কৌশল প্রদর্শন করেন। তাঁরা ছিলেন মাত্র কয়েকজন। মূলত তাঁর কৌশলী ভূমিকার জন্যই পাকিস্তানি সেনারা সেদিন পরাজিত হয়।
মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল) সাক্ষাৎকারে এই যুদ্ধের বিবরণ আছে। তিনি বলেন, ‘...আগস্ট মাসের ১৩ তারিখে আমাদের একটি গেরিলা দল পাকিস্তানি সেনাদের জিনারদী ক্যাম্প আক্রমণ করে। আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধের পর একজন নিহত, ১৫ জন আত্মসমর্পণ করে। সাতজন পালিয়ে যায়। গেরিলারা জিনারদী রেলস্টেশন সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। টেলিফোন যোগাযোগও তারা ধ্বংস করে। টিকিট ও অন্যান্য কাগজপত্র জ্বালিয়ে দেয়। ক্যাম্প থেকে আমাদের গেরিলারা একটি হালকা মেশিনগান, ১১টি রাইফেল, হালকা মেশিনগানের ৪৫০০ গুলি, ১টি স্টেনগান ও ১০০ রাউন্ড গুলি, ১০টি বেল্ট, ২৬ জোড়া বুট, ১৭ ক্যান আটা, ১১ পেটি দুধ ও আরও জিনিসপত্র উদ্ধার করে।’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৩-১৫৪)।
১৯৭১ সালে সিরাজউদ্দীন আহমেদ চাকরি করতেন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে। তখন তাঁর পদবি ছিল লিডিং রাইটার। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তিনি ছুটিতে বাড়ি ছিলেন। ছুটি শেষ হলেও চাকরিতে আর যোগ দেননি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধকালে নরসিংদীর পাঁচদোনার যুদ্ধে (৮-৯ এপ্রিল) তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এই যুদ্ধের পর তিনি স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। নরসিংদীর পতন হলে তিনি সংগঠিত ছাত্র-যুবকদের সঙ্গে নিয়ে ভারতে যান। কয়েক দিন পর এলাকায় ফিরে স্থানীয় আরও কিছু ছাত্র-যুবককে সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠান। তাঁরা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসে তাঁর অধীনে গেরিলা যুদ্ধ করেন। নরসিংদী সদর থানা ও এর আশপাশ এলাকায় অনেক যুদ্ধে তিনি অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য সিরাজউদ্দীন আহমেদকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৩৫।
সিরাজউদ্দীন আহমেদ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুষ্কৃতকারীদের হাতে নিহত হন। এ কারণে তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের অত্যন্ত দীনহীনভাবে জীবন যাপন করতে হয়। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার সদর উপজেলার পাঁচদোনা ইউনিয়নের নেহাব গ্রামে। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তাঁর বাবার নাম মো. জোবেদ আলী। মা ঘোষেদা বেগম। স্ত্রী আলেয়া বেগম। তাঁর চার ছেলে এক মেয়ে।
সূত্র: নরসিংদী জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
জিনারদী নরসিংদী জেলার অন্তর্গত (ঘোড়াশালের সন্নিকটে)। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখানে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৩ আগস্ট দুপুরে মুক্তিযোদ্ধারা জিনারদীতে আক্রমণ করেন। আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধের পর ১৫ জন পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সাতজন পালিয়ে যায়। একজন নিহত হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা জিনারদী রেলস্টেশন ধ্বংস করেন। এই যুদ্ধে সিরাজউদ্দীন আহমেদ অসীম সাহস ও বীরত্ব এবং কৌশল প্রদর্শন করেন। তাঁরা ছিলেন মাত্র কয়েকজন। মূলত তাঁর কৌশলী ভূমিকার জন্যই পাকিস্তানি সেনারা সেদিন পরাজিত হয়।
মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল) সাক্ষাৎকারে এই যুদ্ধের বিবরণ আছে। তিনি বলেন, ‘...আগস্ট মাসের ১৩ তারিখে আমাদের একটি গেরিলা দল পাকিস্তানি সেনাদের জিনারদী ক্যাম্প আক্রমণ করে। আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধের পর একজন নিহত, ১৫ জন আত্মসমর্পণ করে। সাতজন পালিয়ে যায়। গেরিলারা জিনারদী রেলস্টেশন সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। টেলিফোন যোগাযোগও তারা ধ্বংস করে। টিকিট ও অন্যান্য কাগজপত্র জ্বালিয়ে দেয়। ক্যাম্প থেকে আমাদের গেরিলারা একটি হালকা মেশিনগান, ১১টি রাইফেল, হালকা মেশিনগানের ৪৫০০ গুলি, ১টি স্টেনগান ও ১০০ রাউন্ড গুলি, ১০টি বেল্ট, ২৬ জোড়া বুট, ১৭ ক্যান আটা, ১১ পেটি দুধ ও আরও জিনিসপত্র উদ্ধার করে।’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৩-১৫৪)।
১৯৭১ সালে সিরাজউদ্দীন আহমেদ চাকরি করতেন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে। তখন তাঁর পদবি ছিল লিডিং রাইটার। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তিনি ছুটিতে বাড়ি ছিলেন। ছুটি শেষ হলেও চাকরিতে আর যোগ দেননি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধকালে নরসিংদীর পাঁচদোনার যুদ্ধে (৮-৯ এপ্রিল) তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এই যুদ্ধের পর তিনি স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। নরসিংদীর পতন হলে তিনি সংগঠিত ছাত্র-যুবকদের সঙ্গে নিয়ে ভারতে যান। কয়েক দিন পর এলাকায় ফিরে স্থানীয় আরও কিছু ছাত্র-যুবককে সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠান। তাঁরা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসে তাঁর অধীনে গেরিলা যুদ্ধ করেন। নরসিংদী সদর থানা ও এর আশপাশ এলাকায় অনেক যুদ্ধে তিনি অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য সিরাজউদ্দীন আহমেদকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৩৫।
সিরাজউদ্দীন আহমেদ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুষ্কৃতকারীদের হাতে নিহত হন। এ কারণে তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের অত্যন্ত দীনহীনভাবে জীবন যাপন করতে হয়। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার সদর উপজেলার পাঁচদোনা ইউনিয়নের নেহাব গ্রামে। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তাঁর বাবার নাম মো. জোবেদ আলী। মা ঘোষেদা বেগম। স্ত্রী আলেয়া বেগম। তাঁর চার ছেলে এক মেয়ে।
সূত্র: নরসিংদী জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments