তুমি কোন গগনের তারা by মাহী ফ্লোরা
একসময় অয়নকে আমার স্বপ্নপুরুষ মনে হত। ভাঙা চোয়ালে ইচ্ছে করে রাখা খোঁচা দাড়ি। বিশেষত তার আচ্ছন্ন বড় বড় চোখ! সারাক্ষন হাসছে। বড় খালার ছেলে। কিছুদিন আগেও দেখলাম দাড়ি টাড়ি ছেড়ে একাকার অবস্থা। ঢোলা একটা জমাট রক্ত রঙের কাবলি পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, তাবলিগে গিয়ে কাটিয়ে এসেছে তিন মাস।
গতকাল তো তাকে দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম! ক্লিন সেভ আর চোখে সেই পুরোনো কৌতুক। ওদের বাসায় পরদিন সম্ভবত কোন অনুষ্ঠান। তিতলি আপুকে আংটি পরাতে আসবে শুনলাম। তিতলি অয়নের ফুফাত বোন। চাচা-ফুফু কাজিনরা দেখি সবাই বাড়িতে। আমি আর আমার বান্ধবী আলো হঠাৎ উপস্থিত হয়ে একটু অপ্রস্তুত লাগছে। কদিন আগে একটা জামায় ফুল তুলছিলাম। অয়নের ছোটবোন সিমি আবার আমার ন্যাওটা। দেখতে চেয়েছে। সারপ্রাইজ দেয়া যাবে ভেবে না জানিয়ে এসে পড়ে একরকম বোকা বোকা লাগছিল।
সারা বাড়ি ভর্তি মানুষ। ওদের সবাই আলাদা বাড়িতে থাকলেও ছোটখাট অনুষ্ঠানেও সব এক হয়ে যায়। মজাই লাগে।
অয়নকে এক ঝলক দেখলাম। তারপরই উধাও। সিমি দেখি হাত ধরে টানছে। আপু ও ঘরে যাও। ছোড়দা ডাকছে। ও আমাকে খেয়াল করেছে ভাবতেই সর্বাঙ্গে অন্যরকম অনুভূতি। গিয়ে দেখি নবাবজাদা শুয়ে।
-মাথা টিপে দে।
আমি বললাম, `হাহ! তোমার ইয়ে নাকি আমি। মাথা টিপে দে। শখ কত!’ অবশ্য আমার খুব ইচ্ছে করছিল পাশে বসে হাত বুলিয়ে দেই চুলে।
- ইয়ে আবার কিরে!
ওহ এত মিষ্টি করে হাসে নাকি কেউ! আমার বুকের ভেতর ধ্বক ধ্বক করছে। হঠাৎ দেখি ওপাশের বিছানায় বড়দা চাদরমুড়ি দিয়ে শোয়া ছিল। মুখ থেকে চাদর সরিয়ে বলল, `এই কি শুরু করলি তোরা? যা ভাগ ঘুমাতে দে।‘
আমি একবার অয়নের দিকে তাকিয়ে গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে এলাম। এদেরই মনে হয় গজমূর্খ বলে। উপমান কর্মধারয়। যার সাথে তুলনা। শুধু কি তুলনা সব গজই মুর্খ। সাধারণ ধর্ম। রাগে শরীর জ্বলছে। না=জানি বড়দা কি ভাবল। ছিঃ ছিঃ ও ধরনী দ্বিধা হও!
কিছুক্ষন বসতে না বসতেই আবার ডাক। বাড়ির পেছনে গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেশী আমড়ার গাছ। থোকা থোকা হয়ে আমড়া ধরেছে। একদম কচি। এখানে বেতসলতার অন্যরকম একটা ঘ্রান। আমড়ার পাতা ছিঁড়ে একমনে চিবুচ্ছে। আমাকে দেখেই বলল তোর সাথে কথা ছিল।
ওহ কি নির্লজ্জ আমি। ডাকলেই ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে আসতে হবে। কেউ দেখলে কি ভাববে। ইজ্জতের ফালুদা হইতে দু’মিনিটও লাগবেনা। মুখ যথেষ্ট গম্ভীর করে বললাম, কি কথা?
-তুই আমার সাথে যাবি?
-কোথায়? এমন অবাক জীবনে হইনি। দেখি আমতা আমতা করে বলছে,
-না মানে ইয়ে ঐ তো ফাস্ট ইয়ারের রেজাল্ট হয়েছে। দেখতে যেতে ভয় লাগছে। তুই গিয়ে না হয় একটু দেখে আসতি।
-ফেল করেছো?
চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করলাম।
-ফিজিক্সে শুনলাম ছয় দিয়েছে। টাকলু স্যার। ক্লাস করি নাইতো। ব্যাপার না। একমনে পাতা চিবুচ্ছে। মনে হল একটা চিৎকার দেই। খুব আস্তে করে বললাম, -ছোড়দা তোমার লজ্জা করেনা?
-তুই আসিস না কেন তুনী?এতদিন পর পর আসিস। আমার ভাল লাগেনা।
সবাই আমাকে নীতু বলে আর এই ছেলেটা নীতু বললেই আমার মনে হয় এই বুঝি পর করে দিল। অনেক দিন পর তুনী শুনে আমার ভেতর কেমন করে উঠল। গলা ভারি হয়ে গেল।
-এজন্য পড়ালেখা কর নাই?
-এটাতো এমনি এক্সাম। ফাইনালে ঠিক পড়ব দেখিস।
হঠাৎ আনমনে বলে বসলাম,-কোথায় যাওয়ার কথা বলছিলে?
-বনে চলে যাব তুনী। তোকে নিয়ে যেদিকে চোখ যায় পালিয়ে যাব।
-কি বিড়বিড় করছো?
-তুনী তুই আমার সঙ্গে চল।
-তো যাবা কই? সেটাতো বল!চিড়িয়াখানা যাবা?
-আচ্ছা তাই চল।
-তোমার দাড়ি কেটে ফেললা যে? শখ শেষ?
-ধুর কুটকুট করে। মনে হয় উকুন হইছিল।
-আর তাবলীগ?
-ওখানে খাওয়ার খুব কষ্টরে!
-ছোড়দা তুমি ভাল করে পড়তে পারনা?
একবার ভাবলাম লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলি, মেয়েরা খুব দ্রুত বড় হয়ে যায় ছোড়দা। তুমি এমন করলে আমি কিভাবে আম্মুকে বোঝাবো? অথচ বলতে পারলাম না। সিমি উঁকি দিচ্ছে। আপু মা তোমারে ডাকে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, যাই।পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে উদভ্রান্তের মত অয়ন। আমার স্বপ্নপুরুষ!
ঘটনাটা এভাবে ঘটেনি। অয়ন তখন অনেক বড়। বিয়ে করেছে। পরীদের এক ছেলে তার ঘর আলো করে এসেছে। আমি আমার বান্ধবী আলোকে নিয়ে বেড়াতে গেছি। অয়ন পাশের ঘরে আমাকে ডাকলো। ছেলেবেলা থেকেই আমার অল্পতেই কান্না পায়। গলার কাছে পুটলি পাকিয়ে আছে কান্নার দলা। আমি গেলাম। যাবনা ভেবেও। আমার সব বাঁধ ভেঙে গেছে। প্রথমবারের মত বুঝলাম অয়নের ডাক উপেক্ষা করার মত ক্ষমতা বিধাতা আমাকে দেয়নি।
-কিছু বলবে?
-বস।
-বল।
-তুই রাগ করেছিস?
-কেন?
হাত বাড়ায় অয়ন। খুব কাছেই আমার হাতটা। তবু এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয় অনন্তকাল ধরে সে হাত বাড়িয়ে আছে। আমার অস্থির লাগে। শেষবারের মত কি সে হাতটা ধরবে।হঠাৎ কি যেন হল।আমার ভেতরটা জমে গেল অকস্মাৎ। পরপুরুষ মনে হতে থাকে। মনে হয় ও হাত আমাকে স্পর্শ করলেই আমি অশুচি হয়ে যাব চিরকালের মত। আমার শরীরে কালো দাগ পড়বে। জীবানুরা কিল কিল করে হেঁটে বেড়াবে। হাজার ফেনাতেও ও জীবানুরা মরবেনা। এক ঝটকায় সরে যাই।
-রাগ করব কেন? তোমার উপর রাগ করব কেন অ্যাঁ?
বোধহয় বেশ জোরেই বলে ফেলেছিলাম। সিমি এসে পেছন থেকে আমাকে ধরে। অন্যঘরে নিয়ে যায় টেনে। আমার লজ্জা করতে থাকে। ভেবেছিলাম সময়ে বদলে যায় অনেক কিছু। আমি কি আর না বদলে আছি! অয়নের বিয়ের খবর আম্মু আমাকে তারিয়ে তারিয়ে শুনিয়েছে। আমি স্থানুর মত শুনেছি। নির্বিকার হতে শিখেছি আমি সেদিন থেকেই। গত দেড়বছর এ বাড়িতে আসিনি আমি। বড় খালা খুব ডাকে। একে ওকে দিয়ে ডেকে পাঠায়। আম্মু আসলে বারবার আমার কথা বলে। এখন উনি অসুস্থ। আমি তার খুব আদরের ছিলাম সবসময়। কখনো কখনো তো মনে হত উনি সিমির চেয়েও বুঝি আমাকে বেশি ভালবাসেন।খুব সাহস করে খালাকে দেখতে এসেছিলাম। কে জানতো আমি আবার এলোমেলো হয়ে যাব!
খালাকে না বলেই বেরিয়ে এলাম। আলো আমার হাত ধরে আছে। হঠাৎ শুনলাম কেউ বলছে, নীতু ওরা তোকে সম্পর্কটা শেষ করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে। তুই আর এ বাড়িতে আসিস না নীতু। ছোড়দার ডাকে তুই যখন ও ঘরে গেলি, সবাই মিলে তোর নিন্দে করল।
সামনে চোখ পড়তেই দেখি বিথি আপু। একসময় আমার বড় ভাইয়ার বান্ধবী ছিল। ছোঁক ছোঁক স্বভাবের। ভাইয়ার সাথে প্রেম করার জন্য আমাকে খুব চকলেট টকলেট দিত একসময়। এখন তো অয়নকেই কেড়ে নিয়ে সাম্রাজ্য গড়েছে। ওর মুখে কি তাচ্ছিল্যের হাসি দেখলাম না একটু!
কি জানি কোথায় ছিল এতক্ষণ! বললাম, ভাল আছেন?
না শোনার ভান করে এড়িয়ে গেল। আমি আরো শক্ত করে আলোর হাত ধরলাম। যেন আমার অপমানগুলো ইলেকট্রন প্রোটন বেয়ে ওর শরীরে ছড়িয়ে যায়। এত ভার আমি নিতে পারছিলাম না কিছুতেই।
ছুটতে ছুটতে একটা মাঠ। চারদিক ঘিরে শিংওয়ালা মহিষের মত জন্তুরা নরম একটা হরিণ ছানাকে পিষে ফেলতে চাচ্ছে। কি করে যেন বাঁচিয়ে দিলাম হরিণটাকে। বুকের মধ্যে নিয়ে আদর করলাম। হরিণের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আদি মানবী। আলোকচ্ছটা। সুপেয়ী দেবী। আমাকে বর দিল। বলল, পালাও নীতুমনি।এই জন্তুগুলো থেকেই শুধু রক্ষা করব আমি কিন্তু তোমার সামনে আরো বিপদ। তুমি পালাও। দৌড়াতে থাকো। মহিষগুলোকে ভয় পেওনা। পালাও!
আমি আলোকে ছাড়িনা। ওর হাত শক্ত করে ধরে দৌড়াতে থাকি। ওকে তো বিপদের মধ্যে টেনে এনেছি আমিই। ও বলতে থাকে আমার অবর্তমানে আমাকে অপমানের কথা। আমি মুখ বুঁজে থাকি। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। আমি দৌড়াই প্রাণপনে। বাইসনের মত। আমার মাথায় শিং নেই। আমি আঘাত করতে পারিনা। শুধু চোখে কান্না আছে। ধানের ক্ষেত, গমের ক্ষেত, সারি সারি ভুট্টার ক্ষেত, জলের কাদা, আমি দৌড়াতে থাকি। গতি বাড়লে এক আধটু মাটি ছেড়ে উপরে উঠতে পারি আমি!
ঘটনাটা হয়ত এভাবেও ঘটেনা। আরো অন্যরকম। অনেক দিন পেরিয়ে যায় অয়নের বিয়ের পর। একসন্ধ্যায় সে আমার নিজের বাড়িতে আসে। আমার বাবুটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করে। আশীর্বাদ করে। বহুদিন তাদের বাড়ি যাওয়া হয়না বলে অনুযোগ করে। আমি হেসে হেসে বলি, সময় করতে পারিনা ছোড়দা। যাব একদিন। সবাই মিলে গিয়ে বেড়িয়ে আসব।
খালা ভাল আছে? আর সিমি? ওর জামাই বিদেশ থেকে ফিরেছে? তোমার বাচ্চারা? ভাবি কেমন আছে? সে একটুও বোঝেনা, এসব জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আমার বুক ভেঙে যায়। আমি অয়নের চোখের দিকে তাকাতে পারিনা। যদিবা সাহস করে একবার তাকিয়ে ফেলি, সম্মোহিত হয়ে যায়। সেই ছেলেবেলার মত হতে থাকে। আমি অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাই। মনে মনে বলি এভাবে সময় হওয়ার আগেই বিয়েটা না করলেও পারতে ছোড়দা!
সারা বাড়ি ভর্তি মানুষ। ওদের সবাই আলাদা বাড়িতে থাকলেও ছোটখাট অনুষ্ঠানেও সব এক হয়ে যায়। মজাই লাগে।
অয়নকে এক ঝলক দেখলাম। তারপরই উধাও। সিমি দেখি হাত ধরে টানছে। আপু ও ঘরে যাও। ছোড়দা ডাকছে। ও আমাকে খেয়াল করেছে ভাবতেই সর্বাঙ্গে অন্যরকম অনুভূতি। গিয়ে দেখি নবাবজাদা শুয়ে।
-মাথা টিপে দে।
আমি বললাম, `হাহ! তোমার ইয়ে নাকি আমি। মাথা টিপে দে। শখ কত!’ অবশ্য আমার খুব ইচ্ছে করছিল পাশে বসে হাত বুলিয়ে দেই চুলে।
- ইয়ে আবার কিরে!
ওহ এত মিষ্টি করে হাসে নাকি কেউ! আমার বুকের ভেতর ধ্বক ধ্বক করছে। হঠাৎ দেখি ওপাশের বিছানায় বড়দা চাদরমুড়ি দিয়ে শোয়া ছিল। মুখ থেকে চাদর সরিয়ে বলল, `এই কি শুরু করলি তোরা? যা ভাগ ঘুমাতে দে।‘
আমি একবার অয়নের দিকে তাকিয়ে গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে এলাম। এদেরই মনে হয় গজমূর্খ বলে। উপমান কর্মধারয়। যার সাথে তুলনা। শুধু কি তুলনা সব গজই মুর্খ। সাধারণ ধর্ম। রাগে শরীর জ্বলছে। না=জানি বড়দা কি ভাবল। ছিঃ ছিঃ ও ধরনী দ্বিধা হও!
কিছুক্ষন বসতে না বসতেই আবার ডাক। বাড়ির পেছনে গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেশী আমড়ার গাছ। থোকা থোকা হয়ে আমড়া ধরেছে। একদম কচি। এখানে বেতসলতার অন্যরকম একটা ঘ্রান। আমড়ার পাতা ছিঁড়ে একমনে চিবুচ্ছে। আমাকে দেখেই বলল তোর সাথে কথা ছিল।
ওহ কি নির্লজ্জ আমি। ডাকলেই ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে আসতে হবে। কেউ দেখলে কি ভাববে। ইজ্জতের ফালুদা হইতে দু’মিনিটও লাগবেনা। মুখ যথেষ্ট গম্ভীর করে বললাম, কি কথা?
-তুই আমার সাথে যাবি?
-কোথায়? এমন অবাক জীবনে হইনি। দেখি আমতা আমতা করে বলছে,
-না মানে ইয়ে ঐ তো ফাস্ট ইয়ারের রেজাল্ট হয়েছে। দেখতে যেতে ভয় লাগছে। তুই গিয়ে না হয় একটু দেখে আসতি।
-ফেল করেছো?
চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করলাম।
-ফিজিক্সে শুনলাম ছয় দিয়েছে। টাকলু স্যার। ক্লাস করি নাইতো। ব্যাপার না। একমনে পাতা চিবুচ্ছে। মনে হল একটা চিৎকার দেই। খুব আস্তে করে বললাম, -ছোড়দা তোমার লজ্জা করেনা?
-তুই আসিস না কেন তুনী?এতদিন পর পর আসিস। আমার ভাল লাগেনা।
সবাই আমাকে নীতু বলে আর এই ছেলেটা নীতু বললেই আমার মনে হয় এই বুঝি পর করে দিল। অনেক দিন পর তুনী শুনে আমার ভেতর কেমন করে উঠল। গলা ভারি হয়ে গেল।
-এজন্য পড়ালেখা কর নাই?
-এটাতো এমনি এক্সাম। ফাইনালে ঠিক পড়ব দেখিস।
হঠাৎ আনমনে বলে বসলাম,-কোথায় যাওয়ার কথা বলছিলে?
-বনে চলে যাব তুনী। তোকে নিয়ে যেদিকে চোখ যায় পালিয়ে যাব।
-কি বিড়বিড় করছো?
-তুনী তুই আমার সঙ্গে চল।
-তো যাবা কই? সেটাতো বল!চিড়িয়াখানা যাবা?
-আচ্ছা তাই চল।
-তোমার দাড়ি কেটে ফেললা যে? শখ শেষ?
-ধুর কুটকুট করে। মনে হয় উকুন হইছিল।
-আর তাবলীগ?
-ওখানে খাওয়ার খুব কষ্টরে!
-ছোড়দা তুমি ভাল করে পড়তে পারনা?
একবার ভাবলাম লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলি, মেয়েরা খুব দ্রুত বড় হয়ে যায় ছোড়দা। তুমি এমন করলে আমি কিভাবে আম্মুকে বোঝাবো? অথচ বলতে পারলাম না। সিমি উঁকি দিচ্ছে। আপু মা তোমারে ডাকে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, যাই।পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে উদভ্রান্তের মত অয়ন। আমার স্বপ্নপুরুষ!
ঘটনাটা এভাবে ঘটেনি। অয়ন তখন অনেক বড়। বিয়ে করেছে। পরীদের এক ছেলে তার ঘর আলো করে এসেছে। আমি আমার বান্ধবী আলোকে নিয়ে বেড়াতে গেছি। অয়ন পাশের ঘরে আমাকে ডাকলো। ছেলেবেলা থেকেই আমার অল্পতেই কান্না পায়। গলার কাছে পুটলি পাকিয়ে আছে কান্নার দলা। আমি গেলাম। যাবনা ভেবেও। আমার সব বাঁধ ভেঙে গেছে। প্রথমবারের মত বুঝলাম অয়নের ডাক উপেক্ষা করার মত ক্ষমতা বিধাতা আমাকে দেয়নি।
-কিছু বলবে?
-বস।
-বল।
-তুই রাগ করেছিস?
-কেন?
হাত বাড়ায় অয়ন। খুব কাছেই আমার হাতটা। তবু এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয় অনন্তকাল ধরে সে হাত বাড়িয়ে আছে। আমার অস্থির লাগে। শেষবারের মত কি সে হাতটা ধরবে।হঠাৎ কি যেন হল।আমার ভেতরটা জমে গেল অকস্মাৎ। পরপুরুষ মনে হতে থাকে। মনে হয় ও হাত আমাকে স্পর্শ করলেই আমি অশুচি হয়ে যাব চিরকালের মত। আমার শরীরে কালো দাগ পড়বে। জীবানুরা কিল কিল করে হেঁটে বেড়াবে। হাজার ফেনাতেও ও জীবানুরা মরবেনা। এক ঝটকায় সরে যাই।
-রাগ করব কেন? তোমার উপর রাগ করব কেন অ্যাঁ?
বোধহয় বেশ জোরেই বলে ফেলেছিলাম। সিমি এসে পেছন থেকে আমাকে ধরে। অন্যঘরে নিয়ে যায় টেনে। আমার লজ্জা করতে থাকে। ভেবেছিলাম সময়ে বদলে যায় অনেক কিছু। আমি কি আর না বদলে আছি! অয়নের বিয়ের খবর আম্মু আমাকে তারিয়ে তারিয়ে শুনিয়েছে। আমি স্থানুর মত শুনেছি। নির্বিকার হতে শিখেছি আমি সেদিন থেকেই। গত দেড়বছর এ বাড়িতে আসিনি আমি। বড় খালা খুব ডাকে। একে ওকে দিয়ে ডেকে পাঠায়। আম্মু আসলে বারবার আমার কথা বলে। এখন উনি অসুস্থ। আমি তার খুব আদরের ছিলাম সবসময়। কখনো কখনো তো মনে হত উনি সিমির চেয়েও বুঝি আমাকে বেশি ভালবাসেন।খুব সাহস করে খালাকে দেখতে এসেছিলাম। কে জানতো আমি আবার এলোমেলো হয়ে যাব!
খালাকে না বলেই বেরিয়ে এলাম। আলো আমার হাত ধরে আছে। হঠাৎ শুনলাম কেউ বলছে, নীতু ওরা তোকে সম্পর্কটা শেষ করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে। তুই আর এ বাড়িতে আসিস না নীতু। ছোড়দার ডাকে তুই যখন ও ঘরে গেলি, সবাই মিলে তোর নিন্দে করল।
সামনে চোখ পড়তেই দেখি বিথি আপু। একসময় আমার বড় ভাইয়ার বান্ধবী ছিল। ছোঁক ছোঁক স্বভাবের। ভাইয়ার সাথে প্রেম করার জন্য আমাকে খুব চকলেট টকলেট দিত একসময়। এখন তো অয়নকেই কেড়ে নিয়ে সাম্রাজ্য গড়েছে। ওর মুখে কি তাচ্ছিল্যের হাসি দেখলাম না একটু!
কি জানি কোথায় ছিল এতক্ষণ! বললাম, ভাল আছেন?
না শোনার ভান করে এড়িয়ে গেল। আমি আরো শক্ত করে আলোর হাত ধরলাম। যেন আমার অপমানগুলো ইলেকট্রন প্রোটন বেয়ে ওর শরীরে ছড়িয়ে যায়। এত ভার আমি নিতে পারছিলাম না কিছুতেই।
ছুটতে ছুটতে একটা মাঠ। চারদিক ঘিরে শিংওয়ালা মহিষের মত জন্তুরা নরম একটা হরিণ ছানাকে পিষে ফেলতে চাচ্ছে। কি করে যেন বাঁচিয়ে দিলাম হরিণটাকে। বুকের মধ্যে নিয়ে আদর করলাম। হরিণের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আদি মানবী। আলোকচ্ছটা। সুপেয়ী দেবী। আমাকে বর দিল। বলল, পালাও নীতুমনি।এই জন্তুগুলো থেকেই শুধু রক্ষা করব আমি কিন্তু তোমার সামনে আরো বিপদ। তুমি পালাও। দৌড়াতে থাকো। মহিষগুলোকে ভয় পেওনা। পালাও!
আমি আলোকে ছাড়িনা। ওর হাত শক্ত করে ধরে দৌড়াতে থাকি। ওকে তো বিপদের মধ্যে টেনে এনেছি আমিই। ও বলতে থাকে আমার অবর্তমানে আমাকে অপমানের কথা। আমি মুখ বুঁজে থাকি। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। আমি দৌড়াই প্রাণপনে। বাইসনের মত। আমার মাথায় শিং নেই। আমি আঘাত করতে পারিনা। শুধু চোখে কান্না আছে। ধানের ক্ষেত, গমের ক্ষেত, সারি সারি ভুট্টার ক্ষেত, জলের কাদা, আমি দৌড়াতে থাকি। গতি বাড়লে এক আধটু মাটি ছেড়ে উপরে উঠতে পারি আমি!
ঘটনাটা হয়ত এভাবেও ঘটেনা। আরো অন্যরকম। অনেক দিন পেরিয়ে যায় অয়নের বিয়ের পর। একসন্ধ্যায় সে আমার নিজের বাড়িতে আসে। আমার বাবুটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করে। আশীর্বাদ করে। বহুদিন তাদের বাড়ি যাওয়া হয়না বলে অনুযোগ করে। আমি হেসে হেসে বলি, সময় করতে পারিনা ছোড়দা। যাব একদিন। সবাই মিলে গিয়ে বেড়িয়ে আসব।
খালা ভাল আছে? আর সিমি? ওর জামাই বিদেশ থেকে ফিরেছে? তোমার বাচ্চারা? ভাবি কেমন আছে? সে একটুও বোঝেনা, এসব জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আমার বুক ভেঙে যায়। আমি অয়নের চোখের দিকে তাকাতে পারিনা। যদিবা সাহস করে একবার তাকিয়ে ফেলি, সম্মোহিত হয়ে যায়। সেই ছেলেবেলার মত হতে থাকে। আমি অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাই। মনে মনে বলি এভাবে সময় হওয়ার আগেই বিয়েটা না করলেও পারতে ছোড়দা!
No comments