গিরগিটি ও একজন মেয়ে by চন্দন আনোয়ার
হাজি বাড়ির ছেলে জামাল শহরে পড়তে গিয়ে বউ নিয়ে ফিরেছে। আজকের দিনে খুব মামুলি একটা খবর। তদুপরি, গ্রাম ভেঙে পড়ল হাজির উঠোনে। মোদ্দাকথা, ওরা দেখতে চায় হাজির বউ কী রিয়্যাক্ট করে এই ঘটনায়। তার দেমাগে গ্রামে টেকা ভীষণ দায় হয়েছে! তার রাজপুত্রের মতো ছেলে, রাজরানির মতো বউ আনবে, গ্রামের মানুষদের এক রাতের ঘুম নষ্ট করবে, এরপরে বউ ঘরে তুলবে। হাজির বউ একই রেকর্ড বাজাচ্ছে দশ বছর ধরে।
সেই রাজপুত্র ভ্যানে চড়িয়ে রাজরানি নিয়ে ফিরেছে! পাশের বাড়ির চতুর মেয়েমানুষ জোহুরা বেগম ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা তোড়জোড় লাগিয়ে দিল বউকে বরণ করে নিতে। দশ বছরের দেমাগের জুতসই জবাব দেবার সুলভ সুযোগ শেষে ফসকে না যায়! হাজির বউ দমফাটা চিৎকার দিয়েছে কিনা, তা আগতদের জানার উপায় ছিল না। কারণ, ছেলেটা বাড়ির সামনের বড় রাস্তা দিয়ে না এসে বারেক মোড়ে ভ্যান থামিয়ে মাঠের পাথালে হেঁটে বাড়ি ধরেছে। খবরটা রাষ্ট্র হতে সময় নিয়েছে ঘণ্টা দেড়েক। আপাত, হাজির বউ ঘরের চৌকাঠে বসে ধোড়াসাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলছে। এদিকে চলছে ধান-দূর্বা দিয়ে বরণের হল্লা। মেয়েটাও মন্ত্রাহতের মতো যে যা বলছে তাই করছে। জামাল দাঁড়াল মেয়েটার শরীর ঘেঁষে। পরিস্থিতি ওকে বাধ্য করেছে দাঁড়াতে। বরণ পর্ব সমাপ্ত হল।
চমৎকার একটি নাটক নগদ মঞ্চস্থ করে জোহুরা বাহিনী। নাটকের যবনিকাপতন হলে চলে গা টেপাটিপি, চোখ টিপ্পনি। মুখটাকে বিষাদ বিষাদ করে প্রধান অভিনেত্রী জোহুরা বেগম বসে গেল হাজির বউয়ের শরীর লেপটে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে- বুবু! একালের ছেলে ওরা। তোমার-আমার মন বুঝবো! বাদ্য-বাজনা বাজায়া দশগ্রাম মাতাইয়া বউ ঘরে তোলার কী আনন্দ! মাইন্যা লও বুবু! মাইন্যা লও!
যেমনটা ভাবা হয়েছিল বরং তার বিপরীতটাই ঘটেছে। হাজি রহমতুল্ল¬¬¬¬¬াহ হাটে ছিল। বাড়ি ফিরে তেমন উচ্চবাচ্য করল না। হাজির বউ একবেলা ফোঁসফাঁস করে বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেল। নিজের বিয়ের বালাজোড়া বউয়ের হাতে পরিয়ে দিল। সে আনন্দে গদ্গদ্। আরো বেশি আনন্দ পেত-যদি বউ একবার মা বলে ডাকত। আঁচলের চাবিটাও হাতিয়ে নিতে পারত এক বেলাতেই-যদি মুখ খুলে একবারের জন্য মা শব্দটি উচ্চারণ করত। বাড়িতে পা ফেলার পর হতেই হরদম কাঁদছে! নাকে-চোখে জলের স্রোতধারা বইছে! মা বলে ডাক দিবে কখন! যেদিন মা বলে ডাকবে, সেদিনই সব উজাড় করে দিবে। আঁচলের চাবি, সংসারের ভারাপ্পন, নিজের দেখভাল-শরীরটা নেতিয়ে আসছে। একটা মেয়ের আপত্তি ছিল তার। খুব চেষ্টা তদবির করে দোয়া-দরুদ-মানত করেও পেট থেকে মেয়ে বের করতে পারল না। এক ছেলে এসেই পেটটা খালি হয়ে গেল। ছেলেটা বউ আনবে, সে-ই মা ডেকে ভরাবে তার এই শূন্যতা, এই চিন্তা থেকেই সখের যা কিছু হাতের কাছে পেত সবই কিনে রাখত। ছেলে বউ আনলে দেবে। বিশ-বাইশটা শাড়ি, হাত-কান-নাকের জন্য কতটা যে কী পরিমাণ জমেছে তার হদিস নেই। বড় ট্রাংক ভর্তি। তার কিছুই বউকে দিল না।
একদিন দুইদিন করে সপ্তাহ পার হতে লাগল মেয়েটির কান্না আর থামছে না! আর কোনদিন থামবে বলেও মনে হচ্ছে না। নাড়ি ছেঁড়ার কষ্ট জানে, তাই ছেলের বউকে আরো বেশি বুকের ভিতরে ঠাঁই করে দিল হাজির বউ। ঘোরলাগা বিস্ময় আর মুগ্ধতা নিয়ে বিষাদে ভরা কচি মুখে তাকিয়ে ভাবে-কোন মা’র মেয়ে কে জানে! সে মা নিশ্চয় বুক ফাটা চিক্কুর দিয়ে বাতাস ভারি করে তুলছে! কত কৌশল করে, বহু আর্তি-বিনয় করে একটি বাক্যও উদ্ধার করতে পারল না মেয়েটার মুখ থেকে। বরং কিছু জিজ্ঞেস করলে শরীর কাঁপিয়ে কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে বুকের ধড়ফড়ানি ঝড় তুলে তারপর থামে! অদৃশ্যে চোখ ফেলে যেন পালানোর পথ খোঁজে। সব প্রচেষ্টা বিফলে যাবে বলে মনে হচ্ছে। ভাবগতিক কেমন ওলটপালট। ক্রমেই মেয়েটা একটা সাংঘাতিক সংকট জটলা পাকিয়ে তুলছে। শুধু পরের মেয়ে একা জট পাকাচ্ছে না, নিজের ছেলেও মাথামুণ্ডহীন এলোমেলো কথা বলে মায়ের-বাপের মাথা গুল পাকিয়ে দিচ্ছে। একবার বলে তো বিয়ে করেছে, ফেরবার বলে, বড় বিপদ! কী বিপদ? কার বিপদ ? প্রশ্ন করলে মুখে রা শব্দটিও করে না। তালা মারে। রহস্যের ঘোঁট পাকাচ্ছে নিজের ছেলেই! এ রকম বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ খুঁজে পেল হাজি।
উত্তেজনা ও কৌতূহলের চাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে রুষ্টমূর্তি নিয়ে এবার মেয়েটির মুখোমুখি দাঁড়াল হাজি-আমার ছেলে তোমারে তুইল্যা আনছে?
মেয়েটা অসম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকিয়ে আর থামল না। পটকা মাছের পেটের মতো ফর্সা গাল ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে!
হাজি আর দাঁড়াতে পারল না!
মেয়েটার ননস্টপ কান্না এবং জামালের অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ ও বেখাপ্পা কথাবার্তায় অসহ্য উত্তেজনার বশে হাজির বউ দাঁতে দাঁত কুটে! নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করে! ধৈর্যের সব ঘাট ভেঙে গেল তার। মেয়েটা যেন তাকে স্বপ্নের হিমালয় চূড়া হতে সূতা কেটে দপ করে ফেলে দিয়েছে অথই সাগরে। ভীষণ আক্রোশে মেয়েটাকে ছোবল দিতে উদ্যত! এখন আর খাতির করে না। অপ্রয়োজনেই দেমাগি ধমক ছাড়ে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। মেয়েটা যে কোন আহামরি ঘরের নয়, এটা প্রায় নিশ্চিত সে। ভয়াবহ রকম খাপছাড়া ব্যবহার জুড়ে দিল। কিন্তু ছেলের মুখে কেনো কুলুপ আঁটা! ছেলের বাপও কী এমন সাতরাজার ধন পেয়েছে- কিছু বললেই গরম তেলে মাছ ভাজার মতো ছেঁৎ করে ওঠে। বলে কিনা-তুমি কইদিন কানছিলা মনে নাই! তার কান্না আর মেয়েটার কান্না যে এক রকমের না, মাথা মোটা পুরুষ মানুষটাকে কে বোঝাবে? মেয়েটা কেমন গুমরে গুমরে কাঁদে! সংগ্রামের বছর তার সই সাজেদা এরকম গুমরে গুমরে কাঁদত। খানসেনারা সাজেদাকে তুলে নিয়ে দুইদিন পরে ফিরিয়ে দিয়ে গেছিল। মেয়েটা কী করে অবিকল সেই রকম গুমরে গুমরে কাঁদে! কোথায় পেল সে এই কান্না! খান সেনারা তো কবেই পালাইছে! একজন মানুষ যদি ফাঁক-ফোঁকর পেলেই বুক ধড়ফড়ানি কান্না জুড়ে দেবে! সহ্য আর হয় না ! সে সংসারে কি সুখ থাকে নাকি কিছু ভাল লাগে? ফলে একচোট খিস্তিÑখেউড় করে হাজিকে কিছুটা ক্ষেপিয়ে তুলতে পারল। হাজি তার কণ্ঠে সুর মিলিয়ে বলে- তোমার পোলাও বড় ধড়িবাজ আছে। মেনিমুখো হয়ে থাকলে কি হবে, ভিত্রে ভিত্রে শয়তানের মাসতুতু ভাই।
হাজির বউ যেন পালে বাতাস পেল-তোমার লাই পাইয়াই এই লড়োদাসটা ঘটছে। ছাইকপাল আমার! কপাল চাপড়ানোর চোটে জামালকে ডাকল হাজি।
তোমার এম এ পরীক্ষার ফল বাইর হতে আর কয়দিন?
দিন পনের।
চেয়ারম্যান বাজারে কলেজ দিতাছে, ঢুকবানি।
ডোনেশন তিন লাখ !
হাজির বউ লাফিয়ে চেঁচিয়ে উঠল-আসল কথা ছাইড়া ঢং। যম বাড়ি থাইকা বাইর করবো কবে?
হাজি ধমকায়, থামো।
থামা-থামি নাই। বহুত থামছি। একে একে কতলা দিন গেল। যার ছেঁড়ি তার বাড়ি দিয়াইতে কও পোলারে।
মায়ের কথার জবাব দিল না জামাল। নিঃশব্দে উঠে গেল। মেয়েটা কেন যে এমন করছে! পড়েছে ভয়ানক এক দুর্বিপাকে। মেয়েটা যে বাস্তবে কে, জামাল নিজেও জানে না। অধিকন্তু সে যে বলবে, মেয়েটা তার অপরিচিত, সেই পরিবেশও নেই। এ কথা বলে গ্রামের মানুষের কাছে পার পাবে না। ধান-দূর্বা দিয়ে বউ ঘরে তুলে দিয়েছে!
রাতের নিস্তব্ধ নীরবতা নেমে আসলে নীরব পায়ে রাস্তায় পায়চারি করে জামাল। দুপুর রাতের এলোমেলো বাতাস শরীরে ধাক্কা খেয়ে গতিপথ পাল্টে চলে যাচ্ছে কোন এক সুখনগরে! জামালকে সুখ দেয় না। ওর ভিতরে ধানকাটা মাঠের মতো আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। মাথার উপরে বাটির মতো ঝকমকে চাঁদ সর্বশক্তি দিয়ে সামনে দৌড়াচ্ছে। সেদিন এমনই একটি চাঁদ ছিল আকাশে। শহরের চাঁদ বলে বিবর্ণÑলালচে হয়ে মুখগুঁজে ছিল আকাশে। ঘটনাটি ঘটার পরে জামালের সামনে চাঁদটা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কিছু ঝিঁ ঝিঁ পোকা ছিল। কলা ভবনের পিছনের ঘাস ঢাকা তেরছা পথ ধরে হলে ফিরছিল। রাত তখন দুপুর। সকালেই ছাত্রজীবনের যবনিকা টেনেছে জামাল। ভাইভা বোর্ডে কী সব হিজিবিজি প্রশ্ন করেছে, ফার্স্ট ক্লাসটা ফস্কে গেল কি না, এসবই মগজে চর্চা চলছে। ক্যাম্পাসের পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাবে সকালের ট্রেনে। বন্ধুদের অনেকেই চলে গেছে। টিউশনির সুবাদে শহরের এক পরিবারের সাথে খুব সখ্য গড়ে উঠেছিল। তাদের কাছেই শেষবারের মতো বিদায়Ñআর্তি নিতে গিয়ে ফিরতে দেরি হয়ে গেল।
কলা ভবনের ঠিক উত্তর-দক্ষিণ কর্নার বরাবর মানুষের সাড়াশব্দ পেয়ে থমকে দাঁড়াল জামাল। কিছু ছায়া যেন এক হয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফাস করছে। হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠের আর্তনাদের শব্দ কানে ঠেকল। তখন অনিচ্ছাতেই জামালের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল- এই কারা তোমরা?
ধমকের সুরে ছায়ার জটলা হতে ফেরত প্রশ্ন আসে-তুই কে?
তোমরা কারা?
রফিক দেখ তো রে টিকটিকিটা কে?
প্রবল আতঙ্কে কেঁপে ওঠে জামাল। কণ্ঠ খুব শোনা-চেনা ঠেকে। একটি ছায়া এগিয়ে আসে। জামালের ঠিক নাক সোজা দাঁড়াল ছায়াটি। জামালের চিনতে অসুবিধা হল না। ওরা পার্টির ছেলে!
বস্, বড়ো ভাই।
বড়ো ভাই! বড়ো ভাই কোন চুদনা রে!
জামাল সন্ত্রস্ত হয়ে পালাতে চাইল। কিন্তু পা যেন মাটির সাথে নাট-বল্টু দিয়ে আটকানো। কিছুতেই চেতাতে পারছে না।
ঐ কই যায়? ধরে আন। একটু জামাই আদর করে দেই। ছায়ার জটলা থেকে হাত নেড়ে বলছে একজন।
দ্বিধায় কাঁপতে কাঁপতে ছায়ার পাশে এসে দাঁড়াল জামাল। চাঁদের আলো কলা ভবনের দেওয়ালে আটকে এদিকটায় বেশ ঝাঁকালো অন্ধকারই পড়েছে। জামাল মার্ক করতে পারছে সবার মুখ। ওরা চারজন। তিনজনকেই চিনেছে। কিন্তু কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার মুখ আবছা দেখাচ্ছে। জামালের মাথা ঘুরছে। কলা ভবনটাই যেন টলমলিয়ে মাথার উপরে পড়বে। পুরো ক্যাম্পাসের দূর্বাঘাস থেকে সর্বোচ্চ কর্তা যাকে সমীহ করে, সেই লিডার শিপন পুরো ন্যাংটা! মুখে মদ ঢালছে দেদারছে। বেহুঁশ বিবস্ত্র এক যুবতী পায়ের কাছে লুটিয়ে আছে ঘাস কামড়ে। যুবতীকে ব্যবহার করে শিপন এখন ক্লান্ত। ক্লান্তির ছাপ চোখে-মুখে। তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে আর এক ঢোক করে মদ মুখে ঢালছে। খুব শক্ত করে পা দিয়ে মাটি কামড়ে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখল জামাল। ওদের পরস্পরের মুখ চাওয়াÑসাংকেতিক অঙ্গভঙ্গিতে ভেতরে অকস্মাৎ অন্যচিন্তা ঢুকে গেল-দেখে ফেলার জন্যে ওরা আমাকে নাই করে দিবে না তো! ওরা এসব কাজের সাক্ষী রাখে না। নিজেকে সেফ করতে নিজে থেকেই বলল জামাল, শিপন ভাই, আমি আসি তবে। কাল ভোরের ট্রেনেই নড়াইল চলে যাচ্ছি তো, ব্যাগপত্র গুছাতে হবে।
বহুকষ্টে চোখ টেনে একনজর জমালকে দেখে চোখ বন্ধ করেই শিপন বলল- ওহ, তুমি কাল চলে যাচ্ছ! থাক রেফাত, গুলিটা খরচা করে লাভ নেই!
হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল জামালের। ওদের কাছে পিস্তল আছে! একটা পিস্তল খুব আদর করে নাড়াচাড়া করছে রেফাত। পিস্তলের ভিতর থেকে একটা গুলি বের করতে হাত যেন নিশপিশ করছে ওর।-বস্, নতুন এই মালটা খুব পাতলা। অমন একটা মালের বহুদিনের খায়েশ ছিল আমার। শালার টিকটিকিরা এবার দেমাগ দেখাইছে। গতমাসে ওরা আমাদের ক্যাম্পাস থেকে বাইর করে দিছে। আমাদের একটা ফেলছে। শালাদের এবার শিয়াল তাড়ানো তাড়িয়ে হাড়ে বাতাস লাগাব। পলিটিক্স শিখিয়ে দিব জনমের মতন। কমপক্ষে তিনটা ফেলব। শিপন ভাই, বসের কাছে একটা ডেট ফিক্সট করে নেন। বসের পায়ে সালাম করে নেই বলে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার ছায়ার উপরে হুমড়ি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল রেফাত।
রেফাতের কথা মার্ক করতে পারল জামাল। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়া মানুষটি ওদের পার্টির সেন্ট্রাল লিডার! এই লিডার আসবে বলেই তো ক’দিন ধরে ক্যাম্পাস থমথমে! মিছিলে-গর্জনে ভূকম্পনে মাটির ক্যাম্পাস ফেটে চৌচির হবার জো! তার সম্মানে পুরোদিনই ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ছিল। সে-ই কণ্ঠে করে এনেছে নতুন স্লোগান- শিক্ষা-সন্ত্রাস এক সাথে চলবে না! পিস্তলÑকলম একসাথে চলে না! তার নিরাপত্তার বাড়তি ব্যবস্থা হিসেবে পুলিশে ভরে গেছে ক্যাম্পাস! এত দামের নেতা এ-খা-নে! জামাল ভাবে- পাক আর্মির সাথে ওদের পার্থক্য রইল কৈ !
পাথরচাপ নীরবতা ভেঙে ঢেকুর তুলে জামাল বললজ্জ শিপন ভাই, আমি আসি। কম্পমান বাম হাতটা বাড়িয়ে দিল শিপনের দিকে। শিপন হেঁচকা টানে কাছবর্তী করে কাটা কাটা শব্দে বলে- তু-মি খু-ব ভা-ল ছেলে! তাই একটা গুলি বাঁইচা গেল। তাছাড়া তুমি তো কাল চলেই যাচ্ছো, না? জানো তো, আমাদের পার্টির হাত কত লম্বা! কী করতে পারি! আমি অর্ডার করলে তোমার নড়াইল কেন, সত্তর গজ মাটির নিচ থেকে পাকড়াও করে আনবে। কিছু উনিশÑবিশ হলে এখানেই কিন্তু কবর হবে। বহুদিন পরে সেন্ট্রাল লিডারের অনারে জুত্ মতন মৌজ করতে ছিলাম, তুমি শালা এসে বাগড়া বসালে। যাও। খুব ভাল ছেলে রে রেফাত।
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়া মানুষটি ধমকের সুরে ডাকল- এই শিপন!
শিপন চমকাল। জ্বি বস্! এক লাফে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বস্ কিছু একটা নির্দেশনা দিল। ফিরে এসে জামালকে বলল- প্যান্ট খুলো!
জামালের শরীর কেঁপে উঠল- কেন শিপন ভাই ?
শিপন বলল- একটু মৌজ করো মেয়েটার সাথে।
মাফ করবেন শিপন ভাই। আপনি বড় ভাইয়ের মত।
জামালের পেছনে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে থাকা রেফাতকে উদ্দেশ্য করে শিপন বলল-ওহ! তোরা যা তো ওদিকে। কালচার্ড ছেলে। শরম পাচ্ছে।
রেফাতরা সরে গেল। সেন্ট্রাল লিডার ওদের নিয়ে আরো দূরে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
দিশেহারা হয়ে শিপনের হাত চেপে ধরল জামাল।
ধ্যাত্! এত ন্যাকামি দেখার সময় নাই। শালা চুদনার বেটা, প্যান্ট খুল্ বলছি! তোর জান যে রাখছি সত্তরবার আল্ল¬¬¬ার নাম ল! সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল জামালকে। হুমড়ি খেয়ে পাক খেতে খেতে দেহের ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে দপ করে পড়ে গেল মাটি কামড়ে থাকা মেয়েটির উপরেই। মেয়েটা ক্যাক করে উঠল। শিপন সরে গেল। এক ঝটকায় উঠে দৌড়াতে উদ্যত হল জামাল। মাথায় আঘাত খাওয়া সাপের মতো দেহ কুণ্ডলি পাকিয়ে কোনপ্রকারে উঠে পা ঝাপটে ধরল মেয়েটা- ওরা মেরে ফেলবে! নির্ঘাত মেরে ফেলবে! গুম করে ফেলবে! বাঁচান! আমাকে বাঁচান প্লিজ!
আশেপাশে ওদের সাড়াশব্দ নেই। হেঁচকা টানে মেয়েটাকে তুলে বসাল জামাল। পাশে সবুজ ঘাসের উপরে পড়ে আছে লালরঙের পায়জামা, সবুজ রঙের কামিজ, তার থেকে সামান্য দূরে বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে লাল-সবুজের মিশেল রঙের ওড়না। কাপড় শরীরের টেনে দিতে দিতে জামাল বলল-পালাও! পালাও! দৌড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে বারে বারে লুটিয়ে পড়ছে মেয়েটা। একাডেমিক ভবনের পিছন দিয়ে ব্যাংকের লাগোয়া রাস্তা দিয়ে মেইন গেটে এসে দাঁড়াল দুজনে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে মেয়েটার চোখে চোখ পড়তেই জামালের বুক কেঁপে উঠল। পাতলা ছিপছিপে গড়নের ফর্সা ধবধবে মুখ অবয়ব থেকে যেন নিষ্পাপ শুভ্র জ্যোতি বেরুচ্ছে! এত জুলুমের পরও এই রূপ! ওরা যখন স্টেশনে পৌঁছাল তখন ঘড়ির কাঁটা রাত দুটার ঘরে। জামাল ভেবেছিল শিপনরা স্টেশনে হামলা দেবে। সকালে ট্রেন ছাড়া অবধি ভয়ে ভিতরে ধুন্ধুমার ছিল। ওরা আসে নি। মেয়েটা মাঘ মাসের শীতার্তের মতো কাঁপতে কাঁপতে রাত পার করেছে। একটি বাক্যও বিনিময় হল না দু’জনের! বলার কী আছে ?
জানালার শিক ধরে মুখ থুবড়ে পড়ে রইল মেয়েটা। জামাল কিছু বলার সাহস পেল না। কী বলবে তাই-ই খুঁজে পেল না। ওরাই দেশের ভবিষ্যত নেতা! একদিন সংসদ কাঁপাবে। ওদের গাড়িতেই লাল সবুজের পতাকা পত্পত্ করে উড়বে! স্বাধীনতার ঝকমকে সোনালি ফসল ওদের ভোগ দখলে যাবে! অলরেডি পেতে শুরু করেছে! ভবিষ্যত মন্ত্রী-এমপিদের এই কুৎসিত রূপ কোনদিনই মানুষ জানবে না! শকুনের মতো খাবলে খেল মেয়েটাকে! ওরকম কত মেয়ে ওদের ক্ষুধা চরিতার্থ করতে অন্ধকারে এইভাবে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে কে জানে! পত্র-পত্রিকায় আর কয়টা আসে। সকালে এরাই মিছিল বের করবে- শিক্ষা-সন্ত্রাস এক সাথে চলবে না! পিস্তলÑকলম একসাথে চলে না! বায়ান্ন, চুয়ান্ন, ছেষট্টি, উনসত্তর, একাত্তর, নব্বই- ওরা কারা আর এরা কারা? এত পতন! এত পচন! কারা করল এত বড় ক্ষতি? দেশটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? মেয়েটা কোথায় দাঁড়াবে?
এরিমধ্যে পত্রিকা বিক্রেতা স্লে¬¬¬াগানের মতো চেঁচাতে চেঁচাতে ট্রেনে প্রবেশ করে। জামাল একটা কিনল। লাল বড় হরফে মোটা লাইনে হেডলাইন করেছে ক্যাম্পসের খবর- দলে কোন সন্ত্রাসী-অস্ত্রবাজের ঠাঁই নেই! অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের কোন দল নেই! শিক্ষা-সন্ত্রাস এক সাথে চলবে না! নিচে কালো হরফে লেখা সেন্ট্রাল লিডারের নাম। মহাত্মা গান্ধীর মতো বিনয়ের স্টাইলে দাঁড়িয়ে তর্জনী উঁচিয়ে ঝাঁঝালো বক্তৃতা করছে লিডার। ফিক করে হেসে দিল জামাল। নিউজের ভেতরে কী লিখেছে পড়ে দেখার ইচ্ছে হল না। ভেবেছিল, মেয়েটাকে একনজর দেখাবে। দেখাল না। লিডারের ছবিসহ বক্তৃতা অংশ একটানে ছিঁড়ে পকেটে নিয়ে টয়লেটে গেল। বিকেলে রুম থেকে বেরুবার সময় পকেটে টয়লেট টিস্যু নিতে ভুলে গিয়েছিল।
রাতের নীরবতা চারদিক হতেই মমির মতো নিষ্পন্দ হয়ে যেন জামালের দেহ অবশ করে ফেলছে। এর পরিণতি কোথায়? মেয়েটার কী হবে! গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যাবে! রাতে ঘুম হয় না। চোখ বুঁজলেই আহত মোরগের বাচ্চার মতো রমিতনারী কণ্ঠের আর্তনাদ কানে আসে। অমার্জিত চিন্তা একবারের জন্যও মাথায় ঢোকে না। লাফাঙ্গাররা এমন একটি মেয়ের এতবড় সর্বনাশ করতে পারল কী করে!
মেয়েটা চৌকিতে শোয়। পাশের একটি লম্বা বেঞ্চিতে জামাল। মিথ্যা পরিচয়ের বেসাতি কতদিন টানবে! মেয়েটা নাম-ঠিকানা কিছুই বলে না। নিষ্পলক চোখে ভীতু বিড়াল ছানার মতো পিট পিট করে তাকিয়ে থাকে শুধু! ওদের কারো সাথে রিলেশন ছিল কিনা, কিংবা কী করে ওদের হাতে গেল কিছুই বলে না। জামালের বুকের ভিতরে অন্যরকম অনুভূতি ঢেউ খেলে যায়। নি®প্রাণ কাঠের মতো বাক্হীন মেয়েটা অদ্ভুত এক মায়ার শেকলে বেঁধে ফেলেছে! এখন সে মেয়েটাকে ভালবাসে। মিথ্যা বউয়ের শেকল ভেঙে সত্যি বউয়ের শেকলে বাঁধতে অস্থির হয়ে ওঠে।
নাহ! আর অপেক্ষা অসহ্য।
জামাল ছুটে গেল। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেই চমকাল, কে যেন পরীর একটি ছোট্ট ছানাকে ঘুম পাড়িয়ে গেছে! চাঁদের বুড়ির কলঙ্কের মতো চোখের নিচে জমাট বেঁধেছে একটা করে দুটো কলঙ্কের তিলক। ননস্টপ কাঁদছে! চোখে আর কত কুলাবে।
জামাল চাপা কণ্ঠে ডাকলজ্জএই! এই ঘুমাচ্ছো!
মেয়েটার সাড়াশব্দ না পেয়ে ফের ডাকল। আলতো করে শরীর ছুঁয়ে ডাকল তৃতীয় দফায়।
বিষাক্ত সাপের মুখেপড়া ব্যাঙের মতো ঘৎ করে লাফিয়ে উঠল মেয়েটা। পাক খেতে খেতে বিছানা দলাপাকিয়ে জবুথবু হয়ে বসে র্তির্তি করে কাঁপতে থাকল। জামাল ভড়কে গেল। ভূতের মতো নাকিকণ্ঠে বলল- আমি! আমি!
মেয়েটার নিঃশব্দ চোখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করে জামাল। টলমলে হয়ে উঠছে বিশালায়তনের দুটো চোখ। ভাবলেশহীন নির্বাক চাহ্নি বড়শির মতো জামালের বুকে বিঁধছে। বড়শি বুকে বিঁধা মাছের মতোই সে ছটফটায়। নাম-ঠিকানা এখন জামাল চায় না। রোজ কেয়ামত পর্যন্ত না বলুক তাতেও কিছু আসে যায় না। একটি কথা মেয়েটার মুখ থেকে বের করবার জন্য মরিয়া জামাল-সে বিয়ে করবে!
‘বিয়ে’ শব্দটি জামালের কাঁপা কণ্ঠের সিঁড়ি বেয়ে মুখে আসতেই আর মুখ হা করতেই মেয়েটার মুখের মানচিত্র পুরো বদলে গেল! ফোঁস করে একটা গরম নিশ্বাস ফেলল।
খপ্ করে মেয়েটার হাত ধরে ফেলল জামাল। ধানচারার মতো কাঁপছে বুকের লোম। হাত কাঁপছে। আটকানো দম ফেলে ফেলে কথা বলছে- আমাকে বিশ্বাস কর! আমিও পুরুষ! ওদের মতো পুরুষ নই! আমাকে বিশ্বাস কর!
মেয়েটা এক টানে নিজের হাত মুক্ত করে নিল। একসাথে বিপুল নিশ্বাস ফেলল। অসীম আক্রোশে টকটকে ফর্সা মুখের শিরাগুলো ফুলে উঠছে। গরম বাতাস বেরুচ্ছে ঘন নিশ্বাসে।
কিছুক্ষণ দম আটকে থাকে জামাল। চাবুক মারার শব্দের মতো হিস হিস শব্দ বেরোয় মুখ দিয়ে। বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ে ভয়ানক শব্দ করে চিৎকার করে- আমাকে বিশ্বাস কর! আমি ওদের মতো হিংস্র নই! আমি ওদের মতো শকুন নই! আমি ওদের মতো কুকুর নই! আমি মানুষ! আমি মানুষ!!
গলা কাটা গরুর মতো দুই ঠ্যাং উঁচিয়ে শ্বাস আটকে পড়ে থাকা জামালের মুখের দিকে করুণার চোখে তাকিয়ে কী যেন ভাবল মেয়েটা! ওড়নাটাকে এক গোছা দড়ির মতো প্যাঁচিয়ে হাতে নিল।
No comments