রূপবান ঢাকার রক্তক্ষরণ by জাফরিন গুলশান

যেসব ঢাকাবাসী মানুষ সুউচ্চ অট্টালিকা ভেদ করে বিস্তৃত নীলাকাশ দেখতে চেষ্টা করে, সবুজ দেখলেই যাদের মায়াময় কোনো গাছের কথা মনে পড়ে মন শীতলতা ও শিথিলতা চায়, তারা হয়তো কখনো প্রেমিকের মতো ভালোবাসা নিয়ে ‘ঢাকা’ শহরকে আগলে রাখতে চায় কিংবা এর নির্মম বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে রোমান্টিক হয়ে ওঠে। হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চায় নিঃসঙ্গতার সুন্দরে কিংবা কখনো অন্য সবাইকে আহ্বান করে এই প্রেমে আর দায়িত্বে, হয়তো ব্যবহার করে বিবিধ ভাষা।
আমাদের আত্মাকে বাঁচাও—নিঃসঙ্গতার অন্বেষণে এসওএস ঢাকা সিকস সলিটিউড শীর্ষক প্রদর্শনী যেন সে রকমই একটি আহ্বান, শিল্পের ভাষায়। বাংলাদেশের তিনজন সৃজনশীল কর্মোদ্যোগী শিল্পী, শিল্পী রোকেয়া সুলতানা, মোস্তফা জামান ও রনি আহমেদের স্থাপনাশিল্পে বা ইনস্টলেশন, ডিজিটাল প্রিন্ট, পেইন্টিং এবং ফটোগ্রাফির সম্মিলনে ধানমন্ডি ৯ নম্বর রোডে অবস্থিত জার্মান কালচারাল সেন্টারের (গ্যেটে ইনস্টিটিউট) প্রবেশপথের উঠোন থেকে শুরু করে সিঁড়ি বেয়ে বেলকনি ছুঁয়ে ছাদ অবধি চলছে এই প্রদর্শনী। শুরু হয়েছে ১০ মার্চ। চলবে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত। বার্লিন প্রবাসী বাংলাদেশি শিল্পী ও কিউরেটর মুর্শিদা আরজু আল্পনার ডাকে সাড়া দিয়ে এই ঢাকা শহর ও লোকালয়ের জীবন-চরিত্রকে অ্যাবসার্ড ও ফ্যান্টাসির আঙ্গিকে প্রায় ১৩টি শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছে দর্শকের সামনে।
শিল্পী রোকেয়া সুলতানা, মোস্তফা জামান ও রনি আহমেদের নিজস্ব দর্শনের প্রকাশ ব্যতিক্রমী, যদিও প্রদর্শনীর বিষয় ‘ঢাকা শহর’-এর নিঃসঙ্গতা খোঁজার মতো একটি স্যুররিয়াল বিষয়, সুতরাং একটা যোগসূত্রে তিন শিল্পীই আবদ্ধ। প্রথম দর্শক দেখেন, শিল্পী রনি আহমেদের ‘মিরর ইমেজেস অব গ্রাসরুট গ্রিন অ্যাকটিভিজম অ্যান্ড সেফ ফিউচার ফর দি মাস পিপল’ শীর্ষক একটি ইনস্টলেশন। বাগানের প্রবেশমুখের এক কোণে একটি টেবিল, যাতে চায়ের কাপ, কেটলি আর তাতে লাগানো ছোট ছোট সবুজ চারাগাছ। একটু সামনে দৃষ্টি ঘুরপাক খেতে থাকে বিভিন্ন কোণে মাটিতে পোঁতা বাঁশ, ঝুলছে অনেক জুতা, জুতার ভেতরে সবুজ ছোট ছোট গাছ লাগানো, মাটিতে ফেলে রাখা ছাতা। শিল্পী রনি আহমেদ বরাবরের মতোই অ্যাবসার্ডিটি আর ফ্যান্টাসিকে বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়েছেন। ঢাকা শহরের এই জনবিস্ফোরণ আর দিনে দিনে কমতে থাকা জমিতে গাছ লাগানোর অবস্থা থাকছে না, ফলে জুতায় গাছ লাগানো, চায়ের কাপে ও কেটলিতে গাছ লাগানোর মতো কল্পনার আশ্রয় নিতে হচ্ছে ভবিষ্যতের মানুষের জন্য। আয়না হলো প্রতিফলন, বাস্তবের বা কল্পনার। ছাতা কি জায়গা দিতে চায়, কোন নিশ্চয়তার স্বপ্ন? জার্মান কালচারাল সেন্টারের ওপরে ওঠার পথে চোখে পড়ে শিল্পী রোকেয়া সুলতানার শিল্পকর্ম। শিল্পী একাধারে একজন শিল্পী ও ছাপচিত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগের অধ্যাপক। ‘জিরো লেভেল ডেলিরিয়াম’ শীর্ষক শিল্পকর্মটি চোখে পড়ে। বিভিন্ন ধরনের লাইন আর শিল্পীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে আঁকা ম্যাডোনা সিরিজের একটি ছবির সঙ্গে আরেকটি বিষয় যুক্ত হয়েছে। দোতলায় গ্যালারিতে ‘সিটি অব স্পাইডার ম্যানস অ্যান্ড কিংকং’স হেলুসিনেশন’ শীর্ষক স্থাপনাশিল্পে, নিজের প্রিন্ট এবং অসংখ্য গাড়ি-মানুষ-গাড়ির ড্রয়িংয়ের ভেতর থেকে ত্রাতা হিসেবে বড় কিংকংয়ের আবির্ভাব। দেয়ালে একজন স্পাইডার ম্যান ছবি আকারে কম্পোজ করা। শিল্পীর ভাষায়, ‘এখানে দুটো বস্তু বা মাধ্যমের মধ্যে ন্যূনতম কোনো খালি জমি নেই। সবখানে গাড়ি-মানুষ আর আকাশে তাকালে অ্যাপার্টমেন্টস। সবুজ গাছ নেই কোথাও। বাতাসের এই দূষণে শ্বাস নেওয়া দায়। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকাকে নিয়ে আমি কল্পনা করি, হয়তো কোনো কিংকং বা স্পাইডার ম্যানের পক্ষেই এ শহরে অপরিকল্পিত রাক্ষুসে অবস্থাকে নতুনভাবে গুছিয়ে দিতে পারবে। এটাই আমার কাজের মূল বিষয়।’ এর সঙ্গেই দেখা যায় ‘সেলিব্রেটিস অ্যাজ মিরর ইমেজ অব দ্য কমন পিপল’ নামের আরেকটি ইনস্টলেশন। অসংখ্য প্রতিকৃতি চৌকো আকৃতির ছোট পরিসরের সারফেসে ডিজিটাল প্রিন্ট ছাপানো। সেগুলো বিভিন্ন আঙ্গিকে কম্পোজ করা। সামনেই একটা গোলাকৃতির বড় ফর্ম, যার ওপরে আরেকটি ছোট গোলাকৃতি ফর্ম। নিচে শিল্পীর ম্যাডোনা সিরিজের মা-শিশু। শিল্পী এ পর্যায়ে ঢাকা শহরের সেই বাস্তবতাকে সামনে এনেছেন, যাদের জীবন কাটে রূঢ়তায় স্যুয়ারেজ পাইপের ছায়াতলে। একদিকে সুউচ্চ অ্যাপার্টমেন্টস, অন্যদিকে স্যুয়ারেজ পাইপে মানুষের জীবন-গল্প, বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার প্রতিরূপ। শিল্পী মোস্তফা জামানকে গ্যালারিতে পাই ‘কনস্ট্রাকটিং ওপেনিংস একোর্ডিং টু ঢাকা আন্ডারগ্রাউন্ড’ শীর্ষক ইনস্টলেশনে। তিনি একাধারে কবি, শিল্পী, শিল্প সমালোচক। এ শিল্পী ঢাকা শহরকে দেখেছেন আরেক নতুন মাত্রায়। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা এই প্রদর্শনীতে শুধুই শিল্প তৈরি করেছি, যা দর্শককে ভাবনার খোরাক দেবে, দেবে খেলাসুলভ আনন্দ। আমরাও এই খেলায় অংশ নিয়েছি।’ শিল্পী মোস্তফা জামান ঢাকা শহরের জীবনে ব্যবহূত বস্তুকে সরাসরি ব্যবহার করেছেন। ইনস্টলেশনে তিনি বসতি বিল্ডিংয়ে ব্যবহূত হয় এমন পিভিসি পাইপকে সাজেশন আকারে ব্যবহার করেছেন, তাঁর ভাবনার বাস্তবায়নে। দেয়ালে একটি মানুষের অবয়ব মাস্ক পরা। বৃত্তাকার ফর্মের ব্যবহার, কখনো সাদা-কালো রঙের ব্যবহার—শিল্পী মোস্তফা জামানের শিল্পকর্ম দর্শককে আরও পুঙ্খানুপুঙ্খতায় ভাবায়। তাঁর শিল্পভাবনা কখনো জটিল মনে হতে পারে সাধারণ দর্শকের কাছে। তিনি জ্ঞান ও চিন্তার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার সম্মিলন ঘটান তাঁর শিল্পভাবনায়। শূন্যবাদ এসেছে এই শহরে। শহর ও মানুষের বেঁচে থাকার আকৃতিগত বিষয়কে ধরতে চেষ্টায় তারই রূপক উপস্থাপন বৃত্তগুলো। সঙ্গে ভাবনা ও আনন্দ দিতে প্রস্তুত।
==============================
নারী জীবনের অচলায়তন  'ত্যাগের' মূল্যায়ন ও মুক্তকণ্ঠ তারুণ্য  মূল সংবিধান সংরক্ষণে সরকারের ইউটার্ন  তুরস্কে জেনারেলদের পদত্যাগ কেন?  ছোট দলগুলো ফুরফুরে মেজাজে!  কোচিং ব্যবসা এবং শিক্ষার বেহাল দশা  গল্প- লঞ্চের আপার ক্লাসে বাচ্চা হাতি  গুরুপল্লির আশ্রমে ভর্তি না হয়েই  মুক্তিযুদ্ধের ১০ বই  মগ্নচৈতন্যের বর্ণময় অভিঘাত  গল্প- চিনেজোঁক  পুস্তক প্রকাশনা ও বাংলা একাডেমীর বইমেলা  শাহি মনজিলে সাহিত্য উৎসব by শাহীন আখতার  বাজে জসীমউদ্দীন  নান্দনিক চৈতন্য  গ্রামকে শহরে এনেছি  গল্প- জলঝড়  একাত্তরের অপ্রকাশিত দিনপঞ্জি  রশীদ করীমে'র সাক্ষাৎকার- 'মনে পড়ে বন্ধুদের'  প্রাচ্যের ছহি খাবনামা  গল্প- এভাবেই ভুল হয়  গল্প- মাঠরঙ্গ  ফয়েজ আহমেদঃ স্মৃতিতে চিঠিতে  অরুন্ধতী রায়ের সাক্ষাৎকারঃ উপন্যাসের জগতের জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই  ইতিহাস ও জাতি দিয়ে ঘেরা  গল্প- চাল ডাল লবণ ও তেল  ক-য়ে ক্রিকেট খ-য়ে খেলা  গল্পসল্প- ডাংগুলি  হ্যারল্ড পিন্টারের শেষ সাক্ষাৎকারঃ আশৈশব ক্রিকেটের ঘোর  সূচনার পিকাসো আর ভ্যান গঘ  আল্লাহআকবরিজ সি সি  গল্প- কবি কুদ্দুস ও কালনাগিনীর প্রেম  গল্পসল্প- আমার বইমেলা  বাংলাদেশ হতে পারে বহুত্ববাদের নির্মল উদাহরণ  শিক্ষানীতি ২০১০, পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি এবং জাতীয় স্বার্থ  চীন-ভারত সম্পর্ক এবং এ অঞ্চলে তার প্রভাব  নারী লাঞ্ছনার সর্বগ্রাস  একজন এস এ জালাল ও মুক্তিযুদ্ধের তথ্যভাণ্ডার  গল্প- স্বপ্নের মধ্যে কারাগারে  গল্পিতিহাস- কাঁথা সিলাই হইসে, নিশ্চিন্ত  ‘এখন প্রাধান্য পাচ্ছে রম্যলেখা'  অকথিত যোদ্ধা  কানকুনের জলবায়ু সম্মেলন, বাংলাদেশের মমতাজ বেগম এবং আমার কিছু কথা  নাপাম বোমা যা পারেনি, চ্যালেঞ্জার ও আব্রাম্‌স্‌ ট্যাংক কি তা পারবে?  ঠাকুর ঘরে কে রে...!  ষড়যন্ত্র নয়, ক্ষুধা ও বঞ্চনাই আন্দোলনের ইন্ধন  বাহাত্তরের সংবিধানের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধা কোথায়?


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ জাফরিন গুলশান


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.