অসন্তোষ কমিয়ে রফতানি মূল্যবৃদ্ধিই পোশাক খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ by জিয়াউল হক মিজান
দেশের
রফতানি আয়ে ৮৪ শতাংশ অবদান বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প খাতের এই বিশাল
অর্থনৈতিক সেক্টরের সামনে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা শ্রমিক অসন্তোষ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এ সমস্যাও ততটা জটিল হতো না, যদি শ্রমিক অসন্তোষকে কাজে
লাগিয়ে পানি ঘোলা করার মতো দেশী-বিদেশী বিভিন্ন পক্ষ তৎপর না থাকত। দ্বিতীয়
যে সমস্যার কারণে সম্ভাবনাময় এ শিল্প ধুঁকছে তা হলো পণ্যের উপযুক্ত দাম না
পাওয়া।
শ্রমিকের মজুরি এবং গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি পাশাপাশি বিদেশীদের শর্ত পূরণে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে গিয়ে পণ্যের উৎপাদন খরচ দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও তৈরি পণ্যের দাম বাড়ছে না। পরিস্থিতির বাস্তবতায় আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিনিয়ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন কারখানা।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ানোর এই দুই প্রধান সমস্যাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে উদ্যোক্তাদের বৃহত্তম সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম নারী সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন এই সংগঠনেরই সাবেক সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক। স্বামীর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতির উন্নয়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তৈরী পোশাক শিল্প খাতে শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে সময়মতো মজুরি না পাওয়া। অধিকাংশ কারখানাই শ্রমিকদের সময়মতো মজুরি পরিশোধ করে না। অনেক প্রতিষ্ঠান মজুরি প্রদানে সামর্থ্য থাকার পরও প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক অন্যত্র চলে যাবে এই ভয়ে এক মাসের মজুরি পরিশোধ করা হয় পরের মাসের ১৫ থেকে ২০ তারিখে। চাকরি ছেড়ে যাওয়ার পর ভাঙ্গা মাসের বেতন পান না তারা।
আর যেসব কারখানার আর্থিক সঙ্কট থাকে সেগুলোয় মজুরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় মাসের পর মাস। কোনো কারণে স্টক লট কিংবা একটা শিপমেন্ট বাতিল হলে মালিকদের পাশাপাশি বিপর্যয় নেমে আসে সংশ্লিষ্ট কারখানার শ্রমিকদের ওপরও। এমন পরিস্থিতিতে সময়মতো মজুরি পেতে উদগ্রীব হয়ে থাকেন শ্রমিকরা। এতে সামান্য ব্যত্যয় ঘটলেই বেধে যায় লঙ্কাকাণ্ড। উসকানি দিয়ে হাজির হয় সুবিধাবাদি বিভিন্ন পক্ষ। আর এগুলো প্রচার করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে তৎপর হয়ে ওঠে প্রতিযোগী দেশগুলো।
এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের দায়ও কম নয়। কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই এবং মামলা দায়েরের প্রবণতায় মুহূর্তেই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। উদ্যোক্তাদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে মজুরি নিয়ে আন্দোলনের জের ধরে গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে পাঁচ হাজার ৮৪৫ পোশাক শ্রমিককে আসামি করে ২৮টি মামলা হয়েছে।
এর মধ্যে গাজীপুরের কোনাবাড়ী ও গাছা, সাভার, আশুলিয়া ও টঙ্গী পূর্ব থানায় ২৭টি কারখানার করা মামলায় চার হাজার ৩৪৫ শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে। মামলায় ৫১৫ শ্রমিকের নাম উল্লেখ আছে, বাকিরা অজ্ঞাতনামা। সাভার থানায় শিল্প পুলিশের করা এক মামলায় আসামি এক হাজার ৫০০ অজ্ঞাত শ্রমিক। পাশাপাশি চাকরি হারিয়েছেন বেশ কয়েক হাজার শ্রমিক।
শ্রমিকদের সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিল (আইবিসি) সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছে, ৯৯টি কারখানার ১১ হাজারের বেশি শ্রমিক ছাঁটাই ও বরখাস্ত হয়েছেন। অনেক নিরীহ শ্রমিকের পাশাপাশি ইউনিয়নের সাথে যুক্ত শ্রমিকেরাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
বিজিএমইএ নেতাদের দাবি, পোশাক শিল্পের ক্ষতির জন্য শ্রমিক অসন্তোষ যতটা দায়ি তার চেয়ে বেশি দায়ী অসন্তোষের প্রচারকারীরা। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন পক্ষ এ ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণ হিসেবে শ্রমিক সংগঠনের আন্তর্জাতিক জোট ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন (সিসিসি) এবং গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেন বিজিএমইএ সভাপতি মো: সিদ্দিকুর রহমান।
তিনি জানান, প্রতিযোগীদের উসকানিতে গত ২৮ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, জেনেভা, বার্লিন, ব্রাসেলস, মাদ্রিদ ও দ্য হেগে অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশনের সামনে ‘হ্যাশট্যাগ উই স্ট্যান্ড উইথ গার্মেন্ট ওয়ার্কার’ শীর্ষক কর্মসূচি পালন করে সিসিসি। তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলো প্রকৃত ঘটনা না জেনে আন্দোলন করে।
প্রখ্যাত ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ব্রিটেনের দাতব্য প্রতিষ্ঠান কমিক রিলিফ বাংলাদেশের একটি পোশাক কারখানা থেকে টি-শার্ট তৈরি করিয়েছে, যেখানে শ্রমিককে ঘণ্টায় মাত্র ৩৫ পেনি বা ৩৮ টাকা মজুরি দেয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, এই শ্রমিকদের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়, হেনস্তা করা হয়। তাদের দিনে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব শ্রমিকের অনেকের মজুরি ৮ হাজার ৮০০ টাকা (৮২ পাউন্ড)। শ্রমিকেরা দীর্ঘ দিন ধরে ১৬ হাজার টাকা মজুরির দাবি করে এলেও তা মানা হয়নি। শ্রমিকদের প্রায়ই ‘অসম্ভব’ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অতিরিক্ত সময় কাজ বা ওভারটাইম করতে বাধ্য করা হয়। এমনকি দিনে ১৬ ঘণ্টাও কাজ করেন তারা। মধ্য রাত পর্যন্তও কাজ করতে হয় কখনো। শ্রমিকেরা লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে তাদের গালাগালি করা হয়। অনেকে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হন।
এ দিকে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে গত চার বছরে ১২০০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন তৈরী পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মো: সিদ্দিকুর রহমান। নিকট ভবিষ্যতে আরো অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে আশঙ্কা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, রফতানি বাণিজ্যের চাহিদা অনুযায়ী গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকা, দীর্ঘ লিড টাইম এবং শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কম থাকার কারণে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় রফতানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে আমরা ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছি।
২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত পোশাক শিল্পে মজুরি ৩৮১.৩৫ শতাংশ বেড়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। ২০১৪-১৮ সময়ে আমাদের অন্যতম প্রধান বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পোশাকের দরপতন হয়েছে ১১.৭২ শতাংশ। অন্য দিকে এ সময়ে পোশাকের গড় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৯.৫৪ শতাংশ।
তিনি জানান, ২০১৪ সালে বিশ্বের পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ৪৮৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৭ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৫৪ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ উৎপাদনকারী দেশগুলোতে ক্রেতাদের চাহিদা কমেছে, যা মূল্যভিত্তিক বাজার প্রতিযোগিতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় রফতানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে আমরা পিছিয়ে পড়েছি।
এ দিকে বাড়তি খরচ মেটানোর জন্য পণ্যের দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই জানিয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নয়া দিগন্তকে বলেন, উৎপাদিত পণ্যের দাম চাইলেই বাড়ানো যাচ্ছে না। প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় নীতিনৈতিকতা ভুলে গিয়ে বায়াররা অস্বাভাবিক কম দাম অফার করে। কাজ না নিয়েও উপায় নেই।
চলমান খরচের কথা ভেবে অনেক সময় বাধ্য হয়েই কম দরে অর্ডার নিচ্ছি, কখনো ফিরিয়ে দিচ্ছি। তা ছাড়া আমি রিফিউজ করলে কী হবে? অর্ডার তো আর আমার জন্য অপেক্ষা করেনি, হয় আমার দেশেরই অন্য কোনো ফ্যাক্টরি নিয়েছে অথবা অন্য কোনো দেশে অর্ডার চলে গেছে। তিনি বলেন, কম দামে যারা অর্ডার নিচ্ছে তারা অর্ডার নিয়ে হয়তো লস করেছে ২৫ লাখ, না নিলে লস হতো এক কোটি টাকা।
এ দিকে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই বিজিএমইএ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মরহুম আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক। আনিসুল হক ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের প্রভাবশালী সংগঠন বিজিএমইএ, এফবিসিসিআই ও সার্ক চেম্বারেরও সাবেক সভাপতি ছিলেন। রুবানা হকের স্বামী আনিসুল হক প্রতিষ্ঠিত মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান।
ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে স্বামীর নেতৃত্ব থেকে অনেক কিছু শিখেছেন রুবানা হক। গত ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রুবানা হকের নেতৃত্বে সম্মিলিত পরিষদ-ফোরাম ঘোষিত পূর্ণ প্যানেলে ৩৫ জন পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী, তাদের ভোটে রুবানা হকের সভাপতি নির্বাচিত হওয়া এখন আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের বিদ্যমান সমস্যা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল রুবানা হক সমস্যাগুলোকে নিয়েছেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে।
নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে রুবানা হক বলেন, আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত পোশাক। দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ এ খাতের সাথে জড়িত। আমরাই মূলত দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছি। আমাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। দেশের পোশাক খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ইমেজ সঙ্কট রয়েছে মন্তব্য করে রুবানা হক বলেন, সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করব।
অনেকে মনে করেন, আমরা সবচেয়ে সস্তা। এই সস্তা কোনোভাবেই ভালো না বলে আমি মনে করি। প্রতিযোগিতা হলো সবচেয়ে ভালো। কিন্তু আমরা সম্মিলিতভাবে দরকষাকষির জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। সবাই এ বিষয়ে একমত হতে পারিনি। এখন সময় এসেছে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে একটা উদ্যোগ নেয়ার।
তিনি বলেন, আমাদের বেশ ভালো মানের ফ্যাক্টরি রয়েছে। আমরা মনে করি সেলফ মনিটরিংয়ের এখনই সময়। আমাদের চ্যালেঞ্জটা হবে, কী করে শ্রমিক-মালিক একসাথে কাজ করবে। আমার মরহুম স্বামী আনিসুল হক মেয়র হিসেবে দুই বছরে সেটা দেখিয়ে গেছেন; কিভাবে পরিবর্তন আনতে হয়। তার দেখানো পথেই পরিবর্তন সম্ভব বলে দাবি করেন রুবানা।
শ্রমিকের মজুরি এবং গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি পাশাপাশি বিদেশীদের শর্ত পূরণে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে গিয়ে পণ্যের উৎপাদন খরচ দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও তৈরি পণ্যের দাম বাড়ছে না। পরিস্থিতির বাস্তবতায় আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিনিয়ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন কারখানা।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ানোর এই দুই প্রধান সমস্যাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে উদ্যোক্তাদের বৃহত্তম সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম নারী সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন এই সংগঠনেরই সাবেক সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক। স্বামীর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতির উন্নয়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তৈরী পোশাক শিল্প খাতে শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে সময়মতো মজুরি না পাওয়া। অধিকাংশ কারখানাই শ্রমিকদের সময়মতো মজুরি পরিশোধ করে না। অনেক প্রতিষ্ঠান মজুরি প্রদানে সামর্থ্য থাকার পরও প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক অন্যত্র চলে যাবে এই ভয়ে এক মাসের মজুরি পরিশোধ করা হয় পরের মাসের ১৫ থেকে ২০ তারিখে। চাকরি ছেড়ে যাওয়ার পর ভাঙ্গা মাসের বেতন পান না তারা।
আর যেসব কারখানার আর্থিক সঙ্কট থাকে সেগুলোয় মজুরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় মাসের পর মাস। কোনো কারণে স্টক লট কিংবা একটা শিপমেন্ট বাতিল হলে মালিকদের পাশাপাশি বিপর্যয় নেমে আসে সংশ্লিষ্ট কারখানার শ্রমিকদের ওপরও। এমন পরিস্থিতিতে সময়মতো মজুরি পেতে উদগ্রীব হয়ে থাকেন শ্রমিকরা। এতে সামান্য ব্যত্যয় ঘটলেই বেধে যায় লঙ্কাকাণ্ড। উসকানি দিয়ে হাজির হয় সুবিধাবাদি বিভিন্ন পক্ষ। আর এগুলো প্রচার করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে তৎপর হয়ে ওঠে প্রতিযোগী দেশগুলো।
এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের দায়ও কম নয়। কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই এবং মামলা দায়েরের প্রবণতায় মুহূর্তেই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। উদ্যোক্তাদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে মজুরি নিয়ে আন্দোলনের জের ধরে গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে পাঁচ হাজার ৮৪৫ পোশাক শ্রমিককে আসামি করে ২৮টি মামলা হয়েছে।
এর মধ্যে গাজীপুরের কোনাবাড়ী ও গাছা, সাভার, আশুলিয়া ও টঙ্গী পূর্ব থানায় ২৭টি কারখানার করা মামলায় চার হাজার ৩৪৫ শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে। মামলায় ৫১৫ শ্রমিকের নাম উল্লেখ আছে, বাকিরা অজ্ঞাতনামা। সাভার থানায় শিল্প পুলিশের করা এক মামলায় আসামি এক হাজার ৫০০ অজ্ঞাত শ্রমিক। পাশাপাশি চাকরি হারিয়েছেন বেশ কয়েক হাজার শ্রমিক।
শ্রমিকদের সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিল (আইবিসি) সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছে, ৯৯টি কারখানার ১১ হাজারের বেশি শ্রমিক ছাঁটাই ও বরখাস্ত হয়েছেন। অনেক নিরীহ শ্রমিকের পাশাপাশি ইউনিয়নের সাথে যুক্ত শ্রমিকেরাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
বিজিএমইএ নেতাদের দাবি, পোশাক শিল্পের ক্ষতির জন্য শ্রমিক অসন্তোষ যতটা দায়ি তার চেয়ে বেশি দায়ী অসন্তোষের প্রচারকারীরা। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন পক্ষ এ ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণ হিসেবে শ্রমিক সংগঠনের আন্তর্জাতিক জোট ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন (সিসিসি) এবং গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেন বিজিএমইএ সভাপতি মো: সিদ্দিকুর রহমান।
তিনি জানান, প্রতিযোগীদের উসকানিতে গত ২৮ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, জেনেভা, বার্লিন, ব্রাসেলস, মাদ্রিদ ও দ্য হেগে অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশনের সামনে ‘হ্যাশট্যাগ উই স্ট্যান্ড উইথ গার্মেন্ট ওয়ার্কার’ শীর্ষক কর্মসূচি পালন করে সিসিসি। তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলো প্রকৃত ঘটনা না জেনে আন্দোলন করে।
প্রখ্যাত ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ব্রিটেনের দাতব্য প্রতিষ্ঠান কমিক রিলিফ বাংলাদেশের একটি পোশাক কারখানা থেকে টি-শার্ট তৈরি করিয়েছে, যেখানে শ্রমিককে ঘণ্টায় মাত্র ৩৫ পেনি বা ৩৮ টাকা মজুরি দেয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, এই শ্রমিকদের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়, হেনস্তা করা হয়। তাদের দিনে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব শ্রমিকের অনেকের মজুরি ৮ হাজার ৮০০ টাকা (৮২ পাউন্ড)। শ্রমিকেরা দীর্ঘ দিন ধরে ১৬ হাজার টাকা মজুরির দাবি করে এলেও তা মানা হয়নি। শ্রমিকদের প্রায়ই ‘অসম্ভব’ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অতিরিক্ত সময় কাজ বা ওভারটাইম করতে বাধ্য করা হয়। এমনকি দিনে ১৬ ঘণ্টাও কাজ করেন তারা। মধ্য রাত পর্যন্তও কাজ করতে হয় কখনো। শ্রমিকেরা লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে তাদের গালাগালি করা হয়। অনেকে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হন।
এ দিকে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে গত চার বছরে ১২০০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন তৈরী পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মো: সিদ্দিকুর রহমান। নিকট ভবিষ্যতে আরো অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে আশঙ্কা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, রফতানি বাণিজ্যের চাহিদা অনুযায়ী গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকা, দীর্ঘ লিড টাইম এবং শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কম থাকার কারণে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় রফতানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে আমরা ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছি।
২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত পোশাক শিল্পে মজুরি ৩৮১.৩৫ শতাংশ বেড়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। ২০১৪-১৮ সময়ে আমাদের অন্যতম প্রধান বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পোশাকের দরপতন হয়েছে ১১.৭২ শতাংশ। অন্য দিকে এ সময়ে পোশাকের গড় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৯.৫৪ শতাংশ।
তিনি জানান, ২০১৪ সালে বিশ্বের পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ৪৮৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৭ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৫৪ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ উৎপাদনকারী দেশগুলোতে ক্রেতাদের চাহিদা কমেছে, যা মূল্যভিত্তিক বাজার প্রতিযোগিতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় রফতানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে আমরা পিছিয়ে পড়েছি।
এ দিকে বাড়তি খরচ মেটানোর জন্য পণ্যের দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই জানিয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নয়া দিগন্তকে বলেন, উৎপাদিত পণ্যের দাম চাইলেই বাড়ানো যাচ্ছে না। প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় নীতিনৈতিকতা ভুলে গিয়ে বায়াররা অস্বাভাবিক কম দাম অফার করে। কাজ না নিয়েও উপায় নেই।
চলমান খরচের কথা ভেবে অনেক সময় বাধ্য হয়েই কম দরে অর্ডার নিচ্ছি, কখনো ফিরিয়ে দিচ্ছি। তা ছাড়া আমি রিফিউজ করলে কী হবে? অর্ডার তো আর আমার জন্য অপেক্ষা করেনি, হয় আমার দেশেরই অন্য কোনো ফ্যাক্টরি নিয়েছে অথবা অন্য কোনো দেশে অর্ডার চলে গেছে। তিনি বলেন, কম দামে যারা অর্ডার নিচ্ছে তারা অর্ডার নিয়ে হয়তো লস করেছে ২৫ লাখ, না নিলে লস হতো এক কোটি টাকা।
এ দিকে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই বিজিএমইএ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মরহুম আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক। আনিসুল হক ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের প্রভাবশালী সংগঠন বিজিএমইএ, এফবিসিসিআই ও সার্ক চেম্বারেরও সাবেক সভাপতি ছিলেন। রুবানা হকের স্বামী আনিসুল হক প্রতিষ্ঠিত মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান।
ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে স্বামীর নেতৃত্ব থেকে অনেক কিছু শিখেছেন রুবানা হক। গত ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রুবানা হকের নেতৃত্বে সম্মিলিত পরিষদ-ফোরাম ঘোষিত পূর্ণ প্যানেলে ৩৫ জন পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী, তাদের ভোটে রুবানা হকের সভাপতি নির্বাচিত হওয়া এখন আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের বিদ্যমান সমস্যা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল রুবানা হক সমস্যাগুলোকে নিয়েছেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে।
নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে রুবানা হক বলেন, আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত পোশাক। দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ এ খাতের সাথে জড়িত। আমরাই মূলত দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছি। আমাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। দেশের পোশাক খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ইমেজ সঙ্কট রয়েছে মন্তব্য করে রুবানা হক বলেন, সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করব।
অনেকে মনে করেন, আমরা সবচেয়ে সস্তা। এই সস্তা কোনোভাবেই ভালো না বলে আমি মনে করি। প্রতিযোগিতা হলো সবচেয়ে ভালো। কিন্তু আমরা সম্মিলিতভাবে দরকষাকষির জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। সবাই এ বিষয়ে একমত হতে পারিনি। এখন সময় এসেছে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে একটা উদ্যোগ নেয়ার।
তিনি বলেন, আমাদের বেশ ভালো মানের ফ্যাক্টরি রয়েছে। আমরা মনে করি সেলফ মনিটরিংয়ের এখনই সময়। আমাদের চ্যালেঞ্জটা হবে, কী করে শ্রমিক-মালিক একসাথে কাজ করবে। আমার মরহুম স্বামী আনিসুল হক মেয়র হিসেবে দুই বছরে সেটা দেখিয়ে গেছেন; কিভাবে পরিবর্তন আনতে হয়। তার দেখানো পথেই পরিবর্তন সম্ভব বলে দাবি করেন রুবানা।
No comments