ধানের দামে কৃষকের কান্না by এম এম মাসুদ ঢাকা ও আশরাফুল ইসলাম
ক্ষেত
ভরা পাকা ধান। কেউ কেউ তা কেটে তুলছেন গোলায়। আবার শ্রমিকের অভাবে কেউ কেউ
আছেন কেটে তোলার অপেক্ষায়। কিন্তু কারও মুখে হাসি নেই। বরং চাপা কান্নায়
বুক ভারী কৃষকের। কারণ ধানের দাম নেই। জমি চাষ করতে যে খরচ হয়েছে পুরো ফলন
বিক্রি করেও তা উঠবে না। তাহলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জমি চাষ করে কী লাভ?
কষ্টের পুঁজি খাটানোরই বা দরকার কী? এমন প্রশ্নের কোন উত্তর পাচ্ছে না
দেশের মেরুদণ্ড খ্যাত কোটি কৃষক। কৃষি অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষক
পরিস্থিতির শিকার। সরকারি নীতিও কৃষকের এমন দুরবস্থার জন্য দায়ী। এমন
অবস্থা অব্যাহত থাকলে সামনে ধান চাষই ছেড়ে দিতে পারেন অনেকে।
বোরো ধানের মণ বাজারে প্রকার ভেদে ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা। ধান কাটা শ্রমিকের মজুরি গুনতে হচ্ছে পাঁচশ থেকে নয়শ টাকা পর্যন্ত। অবস্থা এতোটাই ভয়াবহ যে, ক্ষোভে দুঃখে অভিনব এক প্রতিবাদ করেছেন টাঙ্গাইলের কৃষক আবদুল মালেক সিকদার। গত রোববার নিজের পাকা ধানের ক্ষেতে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের কৃষকদের এ দুর্দশা পুরো দেশের অর্থনীতির জন্য এক অশনিসংকেত বলে মনে করে সংশ্লিষ্টরা।
ধানের দাম না পাওয়ার কারণ হিসেবে কৃষি ও কৃষকদের নিয়ে কাজ করা গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ বলেন, সরকার ধানের দাম নির্ধারণ করতে দেরি করে। যেটা করা দরকার ছিল মৌসুমের সঙ্গে সঙ্গে। দামটা নির্ধারণ করে বাজারে দেয়া হলে ফড়িয়ারা কৃষকের সঙ্গে কারসাজি করতে পারতো না। দাম নির্ধারণে দেরি করায় ফড়িয়ারা সুযোগ নেয়। এটা একটা বড় সমস্যা। তিনি বলেন, সরকার যে পরিমাণ ধান ক্রয় করে তা খবুই সীমিত। আবার যা ক্রয় করে তা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে নেয় না। ক্রয় করে চাতাল মলিক বা ধান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এটাও একটা অন্যতম বড় সমস্যা। সরকার যে পরিমাণ ধান ক্রয় করে তা কোনোভাবেই বাজারে প্রভাব ফেলে না বলে মনে করেন তিনি।
শাইখ সিরাজ বলেন, সরকারের নিজস্ব গুদামে ধান বা চালের ধারণ ক্ষমতা যদি ২০ লাখ টনের কাছাকাছি হয়। তা হলে এই পরিমাণ ধান-চাল দিয়ে বছরে ৩ কোটি টনের বাজারে ফড়িয়াদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টেকা সরকারের জন্য মুশকিল। সরকারের কাছে যদি ৫০ লাখ টন খাদ্য মজুদ থাকতো তা হলে প্রতিযোগিতায় ঠিকতে পারতো। এতো স্বল্প পরিমাণ চাল নিয়ে সরকারের পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রয় অসম্ভব। তিনি বলেন, কৃষককে সবাই ঠকায়। কৃষকের কাছে কম দামে ধান কিনে বেশি দামে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। ঠকছে কৃষক। কৃষক দাম পাচ্ছে না। কম দামে ধান বিক্রি করে ভোক্তা যদি কম দামে চাল কিনতে পারতো তা হলে কৃষক লাভবান হতো। যেমন; কৃষক ২০ টাকায় ধান বিক্রি করলো। এরপর ভোক্তা যদি চাল ৩০ টাকায় কিনতে পারতো তা হলে কৃষক লাভবান হতো। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। ৪০ টাকার নিচে কোনো চাল বাজারে পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, এর ফল দাঁড়াবে এক সময় কৃষক ধান চাষ বন্ধ করে দেবে। ইতিমধ্যেই অনেকেই চাষ বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানান তিনি।
বিভিন্ন কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বেশিরভাগ এলাকায় ধান পেকে গেছে। অনেক জায়গায় রাতদিন পরিশ্রম করে ধানকাটা হচ্ছে। আবার কোথাও শ্রমিক সঙ্কটের কারণে থেমে আছে। কয়েক দিন আগের ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে। ফণীর প্রভাবে সারাদেশেই বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো হাওয়ার কারণে অনেক এলাকায় ধান পড়ে গেছে জমিতে। এই পড়ে যাওয়া ধান দ্রুত কাটার হিড়িক পড়েছে। পড়ে যাওয়া সোনার ফসল কৃষক ঘরে উঠাতে ব্যস্ত থাকলেও শ্রমিক সঙ্কট একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে শ্রমিকের মজুরিও। এক মণ ধান বিক্রি করেও একজন শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করা যাচ্ছে না। শুধু তাই নয় এক মণ ধান বিক্রি করে কৃষক বাজার থেকে এক কেজি গরুর মাংসও কিনতে পারছেন না। কেননা বাজারে এক কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা করে।
এদিকে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সারাদেশে ৪৯ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। ধান কাটায় এগিয়ে রয়েছে হাওর অঞ্চলের জেলাগুলো। হাওরের সাত জেলায় প্রায় শতভাগ জমির ধান ঘরে তোলা হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। তবে পিছিয়ে রয়েছে উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা এবং রাজধানীর আশপাশ, বিশেষ করে ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা অঞ্চল। তথ্যমতে, এবার বোরো আবাদের জন্য জমির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪৮ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর। তবে নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে বেশি জমিতে প্রায় ৪৯ লাখ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে বোরো ধান।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বোরো মৌসুমে ১২ লাখ ৫০ হাজার টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ১০ লাখ টন সেদ্ধ ও দেড় লাখ টন আতপ চাল। এছাড়া ধান সংগ্রহ করা হবে দেড় লাখ টন (এক লাখ টন চালের সমপরিমাণ)। প্রতিকেজি ধানের সংগ্রহমূল্য ধরা হয়েছে ২৬ টাকা। কেজিপ্রতি সেদ্ধ চাল ৩৬ ও আতপ চালের সংগ্রহমূল্য ৩৫ টাকা ধরা হয়েছে। গত ২৫শে এপ্রিল শুরু হওয়া ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চলবে আগামী ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত। অথচ এখন পর্যন্ত কোনো ধানও ওঠেনি খাদ্য বিভাগের গুদামে। কারণ ক্রয়ের খাতা শূন্য।
এদিকে উৎপাদন খরচের চেয়ে দাম কম হওয়ায় প্রতিমণ ধানে দুই/তিন শ’ টাকা লোকসান হচ্ছে কৃষকের। প্রতিমণ ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হাজার টাকা ছাড়ালেও বিক্রি করতে হচ্ছে ৬৫০-৭০০ টাকায়। ধানের মোকামগুলোয় ক্রেতা না থাকায় ধানের দাম এখনও নিম্নমুখী। ব্যবসায়ীদের কাছে আমদানি চালের সরবরাহ থাকায় তারা বাজার থেকে ধান কেনায় কম গুরুত্ব দিচ্ছে। জানা গেছে, সরকার প্রতিমণ ধানের মূল্য নির্ধারণ করছে ১ হাজার ৪০ টাকা। এর কোন প্রভাব নেই বাজারে, মাঠের চিত্র ভিন্ন।
আবার সরকারিভাবে ধান কেনায় এখনও গতি আসেনি। ফলে কৃষক ভাল দামে ধান বিক্রি করতে পারছেন না। একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যদি ধান-চালের দাম বাড়ে, তাহলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের কষ্ট হয়। আবার ধানের দাম কমে গেলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাজেই দুইয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকা দরকার।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, আমাদের কৃষকদের ভর্তুকি যদি একটু বাড়ানো যায় অর্থাৎ সার, বীজ, সেচের ক্ষেত্রে ভর্তুকি বাড়াতে পারলে উৎপাদন খরচ কমে আসবে।
হাওর এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন ভেজা ধান প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে ৪৫০-৫৫০ টাকা। শুকনো ধান ৬০০-৬৫০ টাকা। মাস দুয়েক পর ধানের দাম কিছুটা বাড়তে পারে। তাই যাদের সামর্থ্য আছে, তারা এমন পানির দরে ধান বিক্রি করছেন না।
বগুড়ায় বোরো ধান কাটার ভরা মৌসুম চলছে। এক সপ্তাহ আগে থেকে ধান কাটা শুরু করে কৃষকরা। বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ মিলে এই কৃষি অঞ্চলের এখন পর্যন্ত ৩৯ ভাগ ধান কেটে ঘরে তুলতে পেরেছে কৃষক। ফলনও ভাল হয়েছে তবে কৃষকদের মুখে হাসি নেই। ধান কেটে ঘরে তোলার পর বিক্রির সময় দাম না পাওয়ায় কৃষকদের মুখে হতাশার রেখা ফুটে উঠেছে। অনেকে ধানের বাজারদর শুনে ধান উৎপাদন খরচ তুলতে পারবেন কি না এমন দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে মাঠে ধান কাটছেন।
বর্তমানে এই অঞ্চলে ধান মাত্র ৫০০-৫৩০ টাকা মন। এই দামে ধান বিক্রি করে প্রতিবিঘা জমিতে মোটা অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকদের। গত ২ সপ্তাহ ধরে ধান কাটা শুরু হয়েছে। প্রথম দিকে ধানের দাম ৭০০ টাকা ছিল।
এদিকে ধানের বাজার কমের কারণ হিসেবে কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধান চাল মজুদ থাকায় মিল মালিকরা ধান নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। এছাড়া সরকারি ভাবে এখনো কৃষকদের থেকে ধান ক্রয় শুরু করেনি। এরপর বাজারে ভারতীয় চালের আমদানি পর্যাপ্ত থাকায় ভরা মৌসুমে কৃষকদের মাথায় হাত পড়েছে। ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছ থেকে মণ প্রতি ৫০০-৫৩০ টাকা দরে ধান কিনছেন। এতে কৃষকদের লোকসান গুণতে হচ্ছে।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার ১ লাখ ৮০ হাজার ৭৮১ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও কৃষক ১ লাখ ৮৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে ধান রোপন করেছিল। জেলায় এবার ধানের ফলন ভাল হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদনও হবে। এখন পর্যন্ত ৩% জমির ধান কাটা হয়েছে। বগুড়া জেলায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৭ লাখ ১৬ হাজার ৬৬৩ টন। এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৪৬৭ টন জমির ধান ঘরে তোলা হয়েছে।
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার গোহাইল ইউনিয়নের শালিকা গ্রামের কৃষক লুৎফর, আব্দুর রহিম জানালেন, লাভের আশায় ধান চাষ করে এবার তাদের লোকসান গুনতে হবে। তাদের কেউ ১০ বিঘা, কেউ ১৭ বিঘা আবার কেউ ১৩ বিঘা জমিতে ধান রোপন করেছিলেন। সপ্তাহের শুরুতে ধানের দাম একটু থাকলেও ধীরে ধীরে বাজার কমতে শুরু করে। এখন বাজারে ধানের দাম মণ প্রতি ৬৭০ টাকা। ১ বিঘা জমিতে ধান রোপন থেকে শুরু করে কাটা মাড়াই পর্যন্ত কৃষকের খরচ পড়ে প্রায় ১২ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে কৃষক ধান পায় ২০ থেকে ২২ মণ। সে তুলনায় কৃষক এবার বিঘা প্রতি পাবে সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। বিভিন্ন এনজিও এবং দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লোন নিয়ে জমিতে বিনিয়োগ করে এবং হাড়ভাঙা পরিশ্রমে এত স্বল্প পরিমাণ টাকা শঙ্কিত এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছে তাদের।
নন্দীগ্রাম উপজেলার ক্ষুদ্র ধান ব্যবসায়ী শাহ আলম জানালেন, তিনি কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান ক্রয় করে মহাজনদের দেন।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নিখিল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, যে কোন মুহুর্তে ঝড় বৃষ্টি হতে পারে। তাই আমাদের পক্ষ থেকে পাকা ধান কেটে ঘরে তুলতে মাইকিং করা হয়েছিল এবং কৃষকদের নিয়ে গ্রুপ মিটিং করা হয়েছিল।
হাওরে দশ বছর ধরে লোকসানে কৃষক
ধান উৎপাদনে ব্যয় বাড়লেও, মিলছে না ন্যায্য দাম। কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় গত দশ বছর ধরে তারা বোরো আবাদে লোকসান দিয়ে যাচ্ছেন। এবার ভাল ফলন হলে সে ধকল কিছুটা কাটিয়ে ওঠার আশা করেছিলেন তারা। কিন্তু তাদের সে আশায় গুড়েবালি। ঘটেছে ব্রিধান-২৮ এর ফলন বিপর্যয়। এছাড়া ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণে এবারও লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদের। কেবল ন্যায্য দাম নয়, একের পর এক সংকটে কাবু হাওরের কৃষক। দ্বিগুণ-তিনগুণ পারিশ্রমিক দিয়েও মিলেনি ধান কাটা শ্রমিক। তাই এবারের ধান কাটা পর্ব ছিল একেবারেই ছন্দহীন। ব্যাপক দরপতন ও ফলন বিপর্যয়ের কারণে হাসি নেই কৃষকের মুখে।
দেশের অন্যতম প্রধান বোরো উৎপাদনকারী জেলা কিশোরগঞ্জ। কৃষি বিভাগ জানায়, এ বছর জেলায় প্রায় পৌনে ২ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। এর মধ্যে হাওর অধ্যুষিত ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী-এ চারটি উপজেলায় আবাদ হয়েছিল প্রায় এক লাখ হেক্টর।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, হাওরের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক মূলত ধার দেনা ও মহাজনের কাছ থেকে সুদের ওপর ঋণ নিয়ে জমি চাষ করেন। ধান তোলার সাথে সাথেই তাদের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু ধানের কম দাম তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এই কারণে তারা মহাজনের ঋণ শোধ করা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। কৃষকেরা জানান, সারের চড়ামূল্য, সেচ খরচ, শ্রমিকের চড়া মজুরীতে তাদের নাভিশ্বাস অবস্থা। কিন্তু ফসলের ন্যায্য দাম নেই। মূল্য কম-বেশি যাই হোক, মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতেই হয়।
সরজমিন হাওরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, জেলার হাওরের অনেক কৃষক অন্যের জমি পত্তন নিয়ে বোরো আবাদ করেছেন। আবার অনেকে বিত্তশালীদের জমি বর্গা চাষ করেছেন। কৃষকেরা শ্রমিকের মজুরি আর মহাজনের ঋণ শোধ করতে গিয়ে ধান কাটা শুরু হওয়ার পর থেকেই নতুন ধান বিক্রি করছেন। প্রতি মণ ধানের সর্বোচ্চ মূল্য ৫৫০ টাকা। ১০০% ভাগ শুকনো ধানের দাম সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা। অথচ উৎপাদন ব্যয় পড়েছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। তাই বর্তমান বাজারে সর্বোচ্চ দামেও তাদের উৎপাদন ব্যয় উঠবে না বলে জানান কৃষক।
কৃষকেরা জানান, প্রতিটি কৃষক পরিবারের যেসব সদস্য চাষাবাদে শ্রম দেন, তারা নিজেদের মজুরিটা কখনোই টাকার মুল্যে হিসাব করতে শেখেননি। কেবল নগদ যে টাকাগুলো চাষাবাদে খরচ করেন, কেবল সেটাই হিসাবের মধ্যে ধরেন। তারপরও মৌসুমের শুরুর দিকে প্রতি মণ ধানে কম করে হলেও তাদের দু’শ টাকা ক্ষতি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষকরা বোরো আবাদ করতে গিয়ে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নেন, এনজিও থেকেও ঋণ নেন। আবার উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন চাতাল মালিক কৃষকদের মধ্যে আগাম লগ্নি করেন। ধানের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্য নির্ধারণ করে এসব লগ্নির টাকা কৃষকদের হাতে তুলে দেন। আর নতুন ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এসব চাতাল মালিকের লোকদের হাতে কৃষকদের পরিশ্রমের ধান তুলে দিতে হয়।
এই সময় হাজার হাজার মণ ধান বড় বড় নৌকা বা কার্গোতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় হাওরাঞ্চলের ‘প্রবেশদ্বার’ বলে খ্যাত করিমগঞ্জের চামড়া নৌবন্দরে। সেখান থেকে ট্রাক এবং ট্রাক্টরে ভরে নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন অঞ্চলের চাতালে। আবার ধান কাটার মৌসুমে চামড়া নৌবন্দরে অস্থায়ী আড়ত খুলে বসেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তারা দালালের মাধ্যমে হাওরের কৃষকদের কাছ থেকে সস্তায় ধান কিনে আড়তে গুদামজাত করেন। এখান থেকে সরবরাহ করেন বিভিন্ন বড় বড় চালকল বা চাতালে। চামড়া বন্দরের আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এখন সর্বোচ্চ ৫৫০ টাকা মণ দরে ধান কিনছেন। নিকলী উপজেলার ভাটিবরাটিয়া গ্রামের কৃষক আবদুল মান্নান এবার ৯ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। এর মধ্যে ব্রিধান ২৮ রোপন করেছিলেন ৭ একর জমিতে। এ ৭ একর জমিতে স্বাভাবিক ফলনে ধান হওয়ার কথা ৪০০ মণ। ফলন বিপর্যয়ের কারণে ধান হয়েছে ২২০ মণ। বাকি ২ একর জমিতে ব্রিধান ২৯ রোপণ করে স্বাভাবিক ফলন পেলেও ঋণগ্রস্থ এই কৃষক এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। আবদুল মান্নান মানবজমিনকে বলেন, ‘একদিকে ধানের উৎপাদন কম হয়েছে, অন্যদিকে ধানের দাম কম থাকায় এবার আমি বড় ধরণের ধরা খেয়েছি। পাওনাদারদের তাগাদার কারণে সস্তায় সব ধান বিক্রি করে দিয়েছি। ঘরে এক ছটাক ধানও রাখিনি। সামনের দিনগুলোতে কী খেয়ে বাঁচবো এই চিন্তায় আছি।’
গতকাল মঙ্গলবার সকালে করিমগঞ্জ উপজেলার বড় হাওরে সরেজমিন কথা হয় উপজেলার গুনধর গ্রামের কৃষক মো: আল আমিনের সঙ্গে। তিনি জানান, এবার সব মিলিয়ে ৭ একর জমিতে বোরো ধান করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে ব্রিধান ২৮ করেছিলেন ৪ একর জমিতে। ব্রি ধান ২৯ করেছিলেন ৩ একর জমিতে। সব মিলিয়ে ধান পেয়েছেন ৩২০ মন। আল আমিন জানান, স্বাভাবিক ফলনে তার জমিতে ধান হওয়ার কথা কমপক্ষে ৪০০ মণ। ৭ একর জমিতে ধান উৎপাদনে তার খরচ হয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ৩২০ মণ ধান ৫৫০ টাকা করে বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন মাত্র ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। প্রায় ছয় মাস রোদে পুড়ে কষ্ট করে বোরো ধান করে তাকে ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা লোকসান গুণতে হয়েছে।
মিঠামইনের কাটখাল গ্রামের ষাটোর্ধ কৃষক হারিছ মিয়া এবার ১০ একর জমিতে ব্রিধান ২৯ আবাদ করেছিলেন। ফলন মোটামুটি হয়েছে। তারপরও স্বস্তি নেই তার মনে। মহাজনের ঋণের বোঝা তার মাথার উপর ঝুলছে। ধানের কম দাম তার ফসল তোলার আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে। ‘মহাজনের ঋণ শোধ করে যে সারাটা বছর কিভাবে চলবো তা একমাত্র আল্লাহই জানে!’ বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন হারিছ মিয়া। মিঠামইন উপজেলার ঢাকী গ্রামের কৃষক কামাল মিয়া জানান, তিনি ৮ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। ধানের দাম কম হলেও তাকে ঋণ পরিশোধ করতে খলাতে রেখেই ধান বিক্রি করতে হয়েছে। কৃষক মরম আলী জানান, প্রতি মণ ধান ফলাতে কৃষকের খরচ পড়েছে সাড়ে ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা। অথচ বর্তমানে এর কাছাকাছি দামও পাওয়া যাচ্ছে না।
এতে তাদের মণপ্রতি বড় অঙ্কের লোকসান গুণতে হচ্ছে। ইটনা সদরের কৃষক মোহাম্মদ আলী জানান, কৃষিকাজ না করে কৃষক বসে থাকতে পারে না। তাই লাভ-লোকসানের হিসাব না করে প্রতি বছরই তারা বোরো আবাদ করেন। তিনি বলেন, দিন দিন কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে চলেছে। তাই হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে কৃষিকাজ করলেও তারা লাভবান হতে পারেন না। তার দাবি, কৃষকদের লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে সরকারিভাবে সরাসরি কৃষকদের হাত থেকে মৌসুমের শুরু থেকেই ধান ক্রয় করতে হবে। মৃগা গ্রামের কৃষক শামীম মিয়া জানান, একটি মাত্র বোরো ফসলই হাওরের জীবন-জীবিকা। কৃষকের হাতে নগদ টাকা না থাকায় শ্রমিক খরচসহ নানা খরচের যোগান দিতে বাধ্য হয়ে কম মূল্যে তাদের ধান বিক্রি করতে হয়। এই কারণে ধানের ফলনে তারা কমবেশি খুশি হলেও দামে ধরা খাচ্ছেন। করনশী গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, ধান কাটার জন্য তাদেরকে অতিরিক্ত টাকা গুণতে হয়েছে। ঘরে যে পরিমাণ ধান তারা তুলতে পারবেন বলে আশা করেছিলেন, তার এক চতুর্থাংশও তুলতে পারেননি।
এর উপর ধানের দাম কম হওয়ায় তারা দিশেহারা। তিনি বলেন, প্রতি বছর ভালো দাম পাওয়ার আশা করলেও আমরা বার বারই নিরাশ হচ্ছি। তবুও বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে আমাদের বাধ্য হয়ে ধান চাষ করতে হচ্ছে। একই গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম জানান, উৎপাদিত ধানের বেশির ভাগই ধান কাটা ও মাড়াইয়ের মজুরি মেটাতে চলে যায়। এছাড়া মৌসুমজুড়ে হালচাষ, আবাদ, সার ও কীটনাশকসহ উৎপাদন সংশ্লিষ্ট নানা খরচ গুণতে হয়েছে। কিন্তু ধানের দাম কৃষকদেরকে চরমভাবে হতাশ করেছে। একই রকম কথা জানালেন মিঠামইনের মহিষারকান্দি গ্রামের কৃষক সাহিদ মিয়া, কালু মিয়া ও বাছির মিয়া, ঢাকী গ্রামের শফিকুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর মিয়া ও জিল্লুর রহমান, অষ্টগ্রামের সাপান্ত গ্রামের কৃষক বিষ্টু লাল দাস, চৌদন্ত বড়হাটির কৃষক আনন্দ দাস ও সুখময় দাস এবং ইটনার ধনপুর গ্রামের কৃষক ভজন দাস, সদরের আজাদ হোসেন ও আবদুর রউফসহ অনেকেই। তারা জানান, হাওরে এখন অধিকাংশ কৃষকের একই দশা। ধানের দাম না থাকায় তাদের মাথায় হাত পড়েছে। তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, যখন কৃষকের হাতে ধান থাকে তখন দাম থাকে না। ধান কৃষকের হাত থেকে চলে গেলে দাম বাড়ে।
বোরো ধানের মণ বাজারে প্রকার ভেদে ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা। ধান কাটা শ্রমিকের মজুরি গুনতে হচ্ছে পাঁচশ থেকে নয়শ টাকা পর্যন্ত। অবস্থা এতোটাই ভয়াবহ যে, ক্ষোভে দুঃখে অভিনব এক প্রতিবাদ করেছেন টাঙ্গাইলের কৃষক আবদুল মালেক সিকদার। গত রোববার নিজের পাকা ধানের ক্ষেতে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের কৃষকদের এ দুর্দশা পুরো দেশের অর্থনীতির জন্য এক অশনিসংকেত বলে মনে করে সংশ্লিষ্টরা।
ধানের দাম না পাওয়ার কারণ হিসেবে কৃষি ও কৃষকদের নিয়ে কাজ করা গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ বলেন, সরকার ধানের দাম নির্ধারণ করতে দেরি করে। যেটা করা দরকার ছিল মৌসুমের সঙ্গে সঙ্গে। দামটা নির্ধারণ করে বাজারে দেয়া হলে ফড়িয়ারা কৃষকের সঙ্গে কারসাজি করতে পারতো না। দাম নির্ধারণে দেরি করায় ফড়িয়ারা সুযোগ নেয়। এটা একটা বড় সমস্যা। তিনি বলেন, সরকার যে পরিমাণ ধান ক্রয় করে তা খবুই সীমিত। আবার যা ক্রয় করে তা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে নেয় না। ক্রয় করে চাতাল মলিক বা ধান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এটাও একটা অন্যতম বড় সমস্যা। সরকার যে পরিমাণ ধান ক্রয় করে তা কোনোভাবেই বাজারে প্রভাব ফেলে না বলে মনে করেন তিনি।
শাইখ সিরাজ বলেন, সরকারের নিজস্ব গুদামে ধান বা চালের ধারণ ক্ষমতা যদি ২০ লাখ টনের কাছাকাছি হয়। তা হলে এই পরিমাণ ধান-চাল দিয়ে বছরে ৩ কোটি টনের বাজারে ফড়িয়াদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টেকা সরকারের জন্য মুশকিল। সরকারের কাছে যদি ৫০ লাখ টন খাদ্য মজুদ থাকতো তা হলে প্রতিযোগিতায় ঠিকতে পারতো। এতো স্বল্প পরিমাণ চাল নিয়ে সরকারের পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রয় অসম্ভব। তিনি বলেন, কৃষককে সবাই ঠকায়। কৃষকের কাছে কম দামে ধান কিনে বেশি দামে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। ঠকছে কৃষক। কৃষক দাম পাচ্ছে না। কম দামে ধান বিক্রি করে ভোক্তা যদি কম দামে চাল কিনতে পারতো তা হলে কৃষক লাভবান হতো। যেমন; কৃষক ২০ টাকায় ধান বিক্রি করলো। এরপর ভোক্তা যদি চাল ৩০ টাকায় কিনতে পারতো তা হলে কৃষক লাভবান হতো। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। ৪০ টাকার নিচে কোনো চাল বাজারে পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, এর ফল দাঁড়াবে এক সময় কৃষক ধান চাষ বন্ধ করে দেবে। ইতিমধ্যেই অনেকেই চাষ বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানান তিনি।
বিভিন্ন কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বেশিরভাগ এলাকায় ধান পেকে গেছে। অনেক জায়গায় রাতদিন পরিশ্রম করে ধানকাটা হচ্ছে। আবার কোথাও শ্রমিক সঙ্কটের কারণে থেমে আছে। কয়েক দিন আগের ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে। ফণীর প্রভাবে সারাদেশেই বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো হাওয়ার কারণে অনেক এলাকায় ধান পড়ে গেছে জমিতে। এই পড়ে যাওয়া ধান দ্রুত কাটার হিড়িক পড়েছে। পড়ে যাওয়া সোনার ফসল কৃষক ঘরে উঠাতে ব্যস্ত থাকলেও শ্রমিক সঙ্কট একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে শ্রমিকের মজুরিও। এক মণ ধান বিক্রি করেও একজন শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করা যাচ্ছে না। শুধু তাই নয় এক মণ ধান বিক্রি করে কৃষক বাজার থেকে এক কেজি গরুর মাংসও কিনতে পারছেন না। কেননা বাজারে এক কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা করে।
এদিকে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সারাদেশে ৪৯ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। ধান কাটায় এগিয়ে রয়েছে হাওর অঞ্চলের জেলাগুলো। হাওরের সাত জেলায় প্রায় শতভাগ জমির ধান ঘরে তোলা হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। তবে পিছিয়ে রয়েছে উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা এবং রাজধানীর আশপাশ, বিশেষ করে ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা অঞ্চল। তথ্যমতে, এবার বোরো আবাদের জন্য জমির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪৮ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর। তবে নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে বেশি জমিতে প্রায় ৪৯ লাখ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে বোরো ধান।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বোরো মৌসুমে ১২ লাখ ৫০ হাজার টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ১০ লাখ টন সেদ্ধ ও দেড় লাখ টন আতপ চাল। এছাড়া ধান সংগ্রহ করা হবে দেড় লাখ টন (এক লাখ টন চালের সমপরিমাণ)। প্রতিকেজি ধানের সংগ্রহমূল্য ধরা হয়েছে ২৬ টাকা। কেজিপ্রতি সেদ্ধ চাল ৩৬ ও আতপ চালের সংগ্রহমূল্য ৩৫ টাকা ধরা হয়েছে। গত ২৫শে এপ্রিল শুরু হওয়া ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চলবে আগামী ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত। অথচ এখন পর্যন্ত কোনো ধানও ওঠেনি খাদ্য বিভাগের গুদামে। কারণ ক্রয়ের খাতা শূন্য।
এদিকে উৎপাদন খরচের চেয়ে দাম কম হওয়ায় প্রতিমণ ধানে দুই/তিন শ’ টাকা লোকসান হচ্ছে কৃষকের। প্রতিমণ ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হাজার টাকা ছাড়ালেও বিক্রি করতে হচ্ছে ৬৫০-৭০০ টাকায়। ধানের মোকামগুলোয় ক্রেতা না থাকায় ধানের দাম এখনও নিম্নমুখী। ব্যবসায়ীদের কাছে আমদানি চালের সরবরাহ থাকায় তারা বাজার থেকে ধান কেনায় কম গুরুত্ব দিচ্ছে। জানা গেছে, সরকার প্রতিমণ ধানের মূল্য নির্ধারণ করছে ১ হাজার ৪০ টাকা। এর কোন প্রভাব নেই বাজারে, মাঠের চিত্র ভিন্ন।
আবার সরকারিভাবে ধান কেনায় এখনও গতি আসেনি। ফলে কৃষক ভাল দামে ধান বিক্রি করতে পারছেন না। একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যদি ধান-চালের দাম বাড়ে, তাহলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের কষ্ট হয়। আবার ধানের দাম কমে গেলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাজেই দুইয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকা দরকার।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, আমাদের কৃষকদের ভর্তুকি যদি একটু বাড়ানো যায় অর্থাৎ সার, বীজ, সেচের ক্ষেত্রে ভর্তুকি বাড়াতে পারলে উৎপাদন খরচ কমে আসবে।
হাওর এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন ভেজা ধান প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে ৪৫০-৫৫০ টাকা। শুকনো ধান ৬০০-৬৫০ টাকা। মাস দুয়েক পর ধানের দাম কিছুটা বাড়তে পারে। তাই যাদের সামর্থ্য আছে, তারা এমন পানির দরে ধান বিক্রি করছেন না।
বগুড়ায় বোরো ধান কাটার ভরা মৌসুম চলছে। এক সপ্তাহ আগে থেকে ধান কাটা শুরু করে কৃষকরা। বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ মিলে এই কৃষি অঞ্চলের এখন পর্যন্ত ৩৯ ভাগ ধান কেটে ঘরে তুলতে পেরেছে কৃষক। ফলনও ভাল হয়েছে তবে কৃষকদের মুখে হাসি নেই। ধান কেটে ঘরে তোলার পর বিক্রির সময় দাম না পাওয়ায় কৃষকদের মুখে হতাশার রেখা ফুটে উঠেছে। অনেকে ধানের বাজারদর শুনে ধান উৎপাদন খরচ তুলতে পারবেন কি না এমন দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে মাঠে ধান কাটছেন।
বর্তমানে এই অঞ্চলে ধান মাত্র ৫০০-৫৩০ টাকা মন। এই দামে ধান বিক্রি করে প্রতিবিঘা জমিতে মোটা অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকদের। গত ২ সপ্তাহ ধরে ধান কাটা শুরু হয়েছে। প্রথম দিকে ধানের দাম ৭০০ টাকা ছিল।
এদিকে ধানের বাজার কমের কারণ হিসেবে কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধান চাল মজুদ থাকায় মিল মালিকরা ধান নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। এছাড়া সরকারি ভাবে এখনো কৃষকদের থেকে ধান ক্রয় শুরু করেনি। এরপর বাজারে ভারতীয় চালের আমদানি পর্যাপ্ত থাকায় ভরা মৌসুমে কৃষকদের মাথায় হাত পড়েছে। ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছ থেকে মণ প্রতি ৫০০-৫৩০ টাকা দরে ধান কিনছেন। এতে কৃষকদের লোকসান গুণতে হচ্ছে।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার ১ লাখ ৮০ হাজার ৭৮১ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও কৃষক ১ লাখ ৮৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে ধান রোপন করেছিল। জেলায় এবার ধানের ফলন ভাল হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদনও হবে। এখন পর্যন্ত ৩% জমির ধান কাটা হয়েছে। বগুড়া জেলায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৭ লাখ ১৬ হাজার ৬৬৩ টন। এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৪৬৭ টন জমির ধান ঘরে তোলা হয়েছে।
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার গোহাইল ইউনিয়নের শালিকা গ্রামের কৃষক লুৎফর, আব্দুর রহিম জানালেন, লাভের আশায় ধান চাষ করে এবার তাদের লোকসান গুনতে হবে। তাদের কেউ ১০ বিঘা, কেউ ১৭ বিঘা আবার কেউ ১৩ বিঘা জমিতে ধান রোপন করেছিলেন। সপ্তাহের শুরুতে ধানের দাম একটু থাকলেও ধীরে ধীরে বাজার কমতে শুরু করে। এখন বাজারে ধানের দাম মণ প্রতি ৬৭০ টাকা। ১ বিঘা জমিতে ধান রোপন থেকে শুরু করে কাটা মাড়াই পর্যন্ত কৃষকের খরচ পড়ে প্রায় ১২ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে কৃষক ধান পায় ২০ থেকে ২২ মণ। সে তুলনায় কৃষক এবার বিঘা প্রতি পাবে সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। বিভিন্ন এনজিও এবং দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লোন নিয়ে জমিতে বিনিয়োগ করে এবং হাড়ভাঙা পরিশ্রমে এত স্বল্প পরিমাণ টাকা শঙ্কিত এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছে তাদের।
নন্দীগ্রাম উপজেলার ক্ষুদ্র ধান ব্যবসায়ী শাহ আলম জানালেন, তিনি কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান ক্রয় করে মহাজনদের দেন।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নিখিল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, যে কোন মুহুর্তে ঝড় বৃষ্টি হতে পারে। তাই আমাদের পক্ষ থেকে পাকা ধান কেটে ঘরে তুলতে মাইকিং করা হয়েছিল এবং কৃষকদের নিয়ে গ্রুপ মিটিং করা হয়েছিল।
হাওরে দশ বছর ধরে লোকসানে কৃষক
ধান উৎপাদনে ব্যয় বাড়লেও, মিলছে না ন্যায্য দাম। কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় গত দশ বছর ধরে তারা বোরো আবাদে লোকসান দিয়ে যাচ্ছেন। এবার ভাল ফলন হলে সে ধকল কিছুটা কাটিয়ে ওঠার আশা করেছিলেন তারা। কিন্তু তাদের সে আশায় গুড়েবালি। ঘটেছে ব্রিধান-২৮ এর ফলন বিপর্যয়। এছাড়া ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণে এবারও লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদের। কেবল ন্যায্য দাম নয়, একের পর এক সংকটে কাবু হাওরের কৃষক। দ্বিগুণ-তিনগুণ পারিশ্রমিক দিয়েও মিলেনি ধান কাটা শ্রমিক। তাই এবারের ধান কাটা পর্ব ছিল একেবারেই ছন্দহীন। ব্যাপক দরপতন ও ফলন বিপর্যয়ের কারণে হাসি নেই কৃষকের মুখে।
দেশের অন্যতম প্রধান বোরো উৎপাদনকারী জেলা কিশোরগঞ্জ। কৃষি বিভাগ জানায়, এ বছর জেলায় প্রায় পৌনে ২ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। এর মধ্যে হাওর অধ্যুষিত ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী-এ চারটি উপজেলায় আবাদ হয়েছিল প্রায় এক লাখ হেক্টর।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, হাওরের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক মূলত ধার দেনা ও মহাজনের কাছ থেকে সুদের ওপর ঋণ নিয়ে জমি চাষ করেন। ধান তোলার সাথে সাথেই তাদের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু ধানের কম দাম তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এই কারণে তারা মহাজনের ঋণ শোধ করা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। কৃষকেরা জানান, সারের চড়ামূল্য, সেচ খরচ, শ্রমিকের চড়া মজুরীতে তাদের নাভিশ্বাস অবস্থা। কিন্তু ফসলের ন্যায্য দাম নেই। মূল্য কম-বেশি যাই হোক, মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতেই হয়।
সরজমিন হাওরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, জেলার হাওরের অনেক কৃষক অন্যের জমি পত্তন নিয়ে বোরো আবাদ করেছেন। আবার অনেকে বিত্তশালীদের জমি বর্গা চাষ করেছেন। কৃষকেরা শ্রমিকের মজুরি আর মহাজনের ঋণ শোধ করতে গিয়ে ধান কাটা শুরু হওয়ার পর থেকেই নতুন ধান বিক্রি করছেন। প্রতি মণ ধানের সর্বোচ্চ মূল্য ৫৫০ টাকা। ১০০% ভাগ শুকনো ধানের দাম সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা। অথচ উৎপাদন ব্যয় পড়েছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। তাই বর্তমান বাজারে সর্বোচ্চ দামেও তাদের উৎপাদন ব্যয় উঠবে না বলে জানান কৃষক।
কৃষকেরা জানান, প্রতিটি কৃষক পরিবারের যেসব সদস্য চাষাবাদে শ্রম দেন, তারা নিজেদের মজুরিটা কখনোই টাকার মুল্যে হিসাব করতে শেখেননি। কেবল নগদ যে টাকাগুলো চাষাবাদে খরচ করেন, কেবল সেটাই হিসাবের মধ্যে ধরেন। তারপরও মৌসুমের শুরুর দিকে প্রতি মণ ধানে কম করে হলেও তাদের দু’শ টাকা ক্ষতি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষকরা বোরো আবাদ করতে গিয়ে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নেন, এনজিও থেকেও ঋণ নেন। আবার উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন চাতাল মালিক কৃষকদের মধ্যে আগাম লগ্নি করেন। ধানের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্য নির্ধারণ করে এসব লগ্নির টাকা কৃষকদের হাতে তুলে দেন। আর নতুন ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এসব চাতাল মালিকের লোকদের হাতে কৃষকদের পরিশ্রমের ধান তুলে দিতে হয়।
এই সময় হাজার হাজার মণ ধান বড় বড় নৌকা বা কার্গোতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় হাওরাঞ্চলের ‘প্রবেশদ্বার’ বলে খ্যাত করিমগঞ্জের চামড়া নৌবন্দরে। সেখান থেকে ট্রাক এবং ট্রাক্টরে ভরে নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন অঞ্চলের চাতালে। আবার ধান কাটার মৌসুমে চামড়া নৌবন্দরে অস্থায়ী আড়ত খুলে বসেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তারা দালালের মাধ্যমে হাওরের কৃষকদের কাছ থেকে সস্তায় ধান কিনে আড়তে গুদামজাত করেন। এখান থেকে সরবরাহ করেন বিভিন্ন বড় বড় চালকল বা চাতালে। চামড়া বন্দরের আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এখন সর্বোচ্চ ৫৫০ টাকা মণ দরে ধান কিনছেন। নিকলী উপজেলার ভাটিবরাটিয়া গ্রামের কৃষক আবদুল মান্নান এবার ৯ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। এর মধ্যে ব্রিধান ২৮ রোপন করেছিলেন ৭ একর জমিতে। এ ৭ একর জমিতে স্বাভাবিক ফলনে ধান হওয়ার কথা ৪০০ মণ। ফলন বিপর্যয়ের কারণে ধান হয়েছে ২২০ মণ। বাকি ২ একর জমিতে ব্রিধান ২৯ রোপণ করে স্বাভাবিক ফলন পেলেও ঋণগ্রস্থ এই কৃষক এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। আবদুল মান্নান মানবজমিনকে বলেন, ‘একদিকে ধানের উৎপাদন কম হয়েছে, অন্যদিকে ধানের দাম কম থাকায় এবার আমি বড় ধরণের ধরা খেয়েছি। পাওনাদারদের তাগাদার কারণে সস্তায় সব ধান বিক্রি করে দিয়েছি। ঘরে এক ছটাক ধানও রাখিনি। সামনের দিনগুলোতে কী খেয়ে বাঁচবো এই চিন্তায় আছি।’
গতকাল মঙ্গলবার সকালে করিমগঞ্জ উপজেলার বড় হাওরে সরেজমিন কথা হয় উপজেলার গুনধর গ্রামের কৃষক মো: আল আমিনের সঙ্গে। তিনি জানান, এবার সব মিলিয়ে ৭ একর জমিতে বোরো ধান করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে ব্রিধান ২৮ করেছিলেন ৪ একর জমিতে। ব্রি ধান ২৯ করেছিলেন ৩ একর জমিতে। সব মিলিয়ে ধান পেয়েছেন ৩২০ মন। আল আমিন জানান, স্বাভাবিক ফলনে তার জমিতে ধান হওয়ার কথা কমপক্ষে ৪০০ মণ। ৭ একর জমিতে ধান উৎপাদনে তার খরচ হয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ৩২০ মণ ধান ৫৫০ টাকা করে বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন মাত্র ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। প্রায় ছয় মাস রোদে পুড়ে কষ্ট করে বোরো ধান করে তাকে ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা লোকসান গুণতে হয়েছে।
মিঠামইনের কাটখাল গ্রামের ষাটোর্ধ কৃষক হারিছ মিয়া এবার ১০ একর জমিতে ব্রিধান ২৯ আবাদ করেছিলেন। ফলন মোটামুটি হয়েছে। তারপরও স্বস্তি নেই তার মনে। মহাজনের ঋণের বোঝা তার মাথার উপর ঝুলছে। ধানের কম দাম তার ফসল তোলার আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে। ‘মহাজনের ঋণ শোধ করে যে সারাটা বছর কিভাবে চলবো তা একমাত্র আল্লাহই জানে!’ বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন হারিছ মিয়া। মিঠামইন উপজেলার ঢাকী গ্রামের কৃষক কামাল মিয়া জানান, তিনি ৮ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। ধানের দাম কম হলেও তাকে ঋণ পরিশোধ করতে খলাতে রেখেই ধান বিক্রি করতে হয়েছে। কৃষক মরম আলী জানান, প্রতি মণ ধান ফলাতে কৃষকের খরচ পড়েছে সাড়ে ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা। অথচ বর্তমানে এর কাছাকাছি দামও পাওয়া যাচ্ছে না।
এতে তাদের মণপ্রতি বড় অঙ্কের লোকসান গুণতে হচ্ছে। ইটনা সদরের কৃষক মোহাম্মদ আলী জানান, কৃষিকাজ না করে কৃষক বসে থাকতে পারে না। তাই লাভ-লোকসানের হিসাব না করে প্রতি বছরই তারা বোরো আবাদ করেন। তিনি বলেন, দিন দিন কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে চলেছে। তাই হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে কৃষিকাজ করলেও তারা লাভবান হতে পারেন না। তার দাবি, কৃষকদের লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে সরকারিভাবে সরাসরি কৃষকদের হাত থেকে মৌসুমের শুরু থেকেই ধান ক্রয় করতে হবে। মৃগা গ্রামের কৃষক শামীম মিয়া জানান, একটি মাত্র বোরো ফসলই হাওরের জীবন-জীবিকা। কৃষকের হাতে নগদ টাকা না থাকায় শ্রমিক খরচসহ নানা খরচের যোগান দিতে বাধ্য হয়ে কম মূল্যে তাদের ধান বিক্রি করতে হয়। এই কারণে ধানের ফলনে তারা কমবেশি খুশি হলেও দামে ধরা খাচ্ছেন। করনশী গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, ধান কাটার জন্য তাদেরকে অতিরিক্ত টাকা গুণতে হয়েছে। ঘরে যে পরিমাণ ধান তারা তুলতে পারবেন বলে আশা করেছিলেন, তার এক চতুর্থাংশও তুলতে পারেননি।
এর উপর ধানের দাম কম হওয়ায় তারা দিশেহারা। তিনি বলেন, প্রতি বছর ভালো দাম পাওয়ার আশা করলেও আমরা বার বারই নিরাশ হচ্ছি। তবুও বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে আমাদের বাধ্য হয়ে ধান চাষ করতে হচ্ছে। একই গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম জানান, উৎপাদিত ধানের বেশির ভাগই ধান কাটা ও মাড়াইয়ের মজুরি মেটাতে চলে যায়। এছাড়া মৌসুমজুড়ে হালচাষ, আবাদ, সার ও কীটনাশকসহ উৎপাদন সংশ্লিষ্ট নানা খরচ গুণতে হয়েছে। কিন্তু ধানের দাম কৃষকদেরকে চরমভাবে হতাশ করেছে। একই রকম কথা জানালেন মিঠামইনের মহিষারকান্দি গ্রামের কৃষক সাহিদ মিয়া, কালু মিয়া ও বাছির মিয়া, ঢাকী গ্রামের শফিকুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর মিয়া ও জিল্লুর রহমান, অষ্টগ্রামের সাপান্ত গ্রামের কৃষক বিষ্টু লাল দাস, চৌদন্ত বড়হাটির কৃষক আনন্দ দাস ও সুখময় দাস এবং ইটনার ধনপুর গ্রামের কৃষক ভজন দাস, সদরের আজাদ হোসেন ও আবদুর রউফসহ অনেকেই। তারা জানান, হাওরে এখন অধিকাংশ কৃষকের একই দশা। ধানের দাম না থাকায় তাদের মাথায় হাত পড়েছে। তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, যখন কৃষকের হাতে ধান থাকে তখন দাম থাকে না। ধান কৃষকের হাত থেকে চলে গেলে দাম বাড়ে।
No comments