কুমার জীবনের ইতি টানলেন মুজিবুল by জাহিদ হাসান
কেউ কেউ বলছেন, এ বিয়ে অভিনব। রেলমন্ত্রী
মুজিবুল হক ৬৭ বছর বয়সে এসে যখন কুমার জীবনের ইতি টানার ঘোষণা দেন তখন
থেকেই এক ধরনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। গেল ক’মাস ধরেই মন্ত্রীর বিয়ে
নিয়ে আলোচনা ছিল সর্বত্র। ফেসবুক থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভা- কোথায় এ নিয়ে
কথা হয়নি? গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার হয়েছে টিভি চ্যানেলে।
পার্শ্ববর্তী দেশের সংবাদ মাধ্যমেও খবর হয়েছে এ বিয়ে। সব আনুুষ্ঠানিকতা
শেষে অবশেষে জীবনসঙ্গী হিসেবে হনুফা আক্তার রিক্তাকে কবুল করলেন মুজিবুল
হক। গতকাল শুক্রবার এলাহী আয়োজনে সম্পন্ন হলো বহুল আলোচিত বিয়ে। একই সঙ্গে
দেশের ইতিহাসে প্রথম মন্ত্রী হিসেবে কারও কুমারজীবনের ইতি ঘটলো। বিকালে ৫
লাখ ১ টাকা দেনমোহরে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকতা শেষে সন্ধ্যা ৬টার
দিকে গ্রামের মেঠোপথ পেরিয়ে নববধূ হনুফা আক্তার রিক্তাকে নিয়ে
রেলপথমন্ত্রী সড়কপথে ঢাকার বেইলী রোডের মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্টের
উদ্দেশে রওনা করেন।
গতকাল বেলা ২টা ৫৫ মিনিটে জাতীয় পতাকা সুশোভিত পাজেরো গাড়িতে চড়ে মন্ত্রী বর মুজিবুল হক ফুল দিয়ে অপরূপে সাজানো গাড়িতে করে পৌঁছান কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার ১০নং গল্লাই ইউনিয়নের মিরাখলা গ্রামে। তাকেসহ বরযাত্রীদের ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ করে কনেপক্ষ। তার পরনে ছিল গাঢ় সোনালি রঙের শেরওয়ানি ও কিছুুটা সাদা রঙের ওপর সোনালি কাজের টুপি, হাতে রুমাল। এসময় তার গাড়িতে ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু এমপি, যুবলীগ নেতা শাহিনুল হক শাহীনসহ তার নিকটাত্মীয়রা। কিন্তু বর মন্ত্রী হলেও সরাসরি ঢুকতে পারেননি বিয়ের অনুষ্ঠানস্থ বরের আসনে। পথে বাঁধ সাধে ১২-১৩ বছরের ৬ শিশু খাদিজা, আলো, ময়না, দীনা, শাওন ও হেলাল। দৃষ্টিনন্দন প্রধান ফটকে মন্ত্রীবরকে আগলে দাঁড়ায় তারা। তাদের ৫ হাজার ১ টাকা নজরানা দিয়ে শিশুদের থেকে ছাড়া পেলেন মন্ত্রীবর মুজিবুল হক। পরে একটু এগিয়ে গাড়ি থেকে নেমে তিনি হেঁটে গিয়ে বসলেন বরের আসনে। ৩টি প্যান্ডেল করা হয় মেহমানদের আপ্যায়নের জন্য। বাড়ির পূর্বাংশে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে একটি, পশ্চিমাংশে অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য একটি এবং দুই প্যান্ডেলের মাঝে আরও একটি প্যান্ডেলে বর ও ভিআইপিদের জন্য একটি প্যান্ডেল করা হয়েছে। অতিথিদের কাচ্চি বিরিয়ানী, চিকেন রোস্ট, জালি কাবাব, আলু বোখারা, চাটনী, বোরহানী, মিনারেল ওয়াটার ও কোল্ড ড্রিংকস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। বরকে দেয়া হয় আস্ত খাসির রোস্ট। বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে পড়ান স্থানীয় মসজিদের ইমাম ক্বারী আবদুল লতিফ। নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করেন গল্লাই ইউনিয়নের কাজী মাওলানা ছিদ্দিকুর রহমান। ৫ লাখ ১ টাকা মূল্যের কাবিনে বর ও কনে স্বাক্ষর করেন। এ বিয়েতে উকিল করা হয় মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ডিএমডি আবুল হাসেমকে। বিয়ের কাবিনে বরপক্ষে সাক্ষী রাখা হয় মন্ত্রীর পিএস গোলাম কিবরিয়া, চৌদ্দগ্রামের ৪নং শ্রীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহজালাল মজুমদার, চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার মেয়র মিজানুর রহমান এবং কনেপক্ষে গল্লাই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুল করিম। এ সময় কনের পরনে ছিল সোনালি রঙের শাড়ির ওপর পুঁতির কাজ করা লেহেঙ্গা। অনুষ্ঠানে অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মহিলা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকী, জাতীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশ্রাফ, তাজুল ইসলাম, সাবেক এমপি নাসিমুল আলম চৌধুরী নজরুল, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আফজল খান এডভোকেট, জেলা পরিষদ প্রশাসক আলহাজ ওমর ফারুক, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি সফিকুর রহমান, রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. তফাজ্জল হোসেন, এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান, কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল, পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকজন অংশ নেয়।
কনের (হনুফা আক্তার রিক্তা) বাড়ি মিরাখোলার সবুজঘেরা ছোট একটি গ্রামে। যে গ্রামে লোক সংখ্যা প্রায় ১৭’শর মতো। কিন্তু বিয়ের দিন শুধু কনের বাড়ি ঘিরেই লোকসংখ্যা পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। চান্দিনার কুটম্বপুর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে কনের বাড়িতে আসার সময় রাস্তার দু’পাশে ছিল সব বয়সী মানুষের উপচে পড়া ভিড়। একটি বারের জন্য বরের হাত ছুঁতে রাস্তা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল শত শত লোক। যাদের অধিকাংশই ব্যস্ত ছিলেন মোবাইল ফোনে ছবি ও ভিডিও করতে। কেউ বা বর ও যাত্রীদের গাড়িতে ছিটিয়ে দেন ফুলের পাপড়ি। ফসল আর সবজির জমিতে চাষরত শ্রমিকরাও রাস্তার পাশে দাঁড়ান বরকে দেখার জন্য। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্য বয়সী নারী বিলকিস বেগমের হাতে ছিল একটি শাড়ি ও সাবানদানী। জানালেন তিনি গোসল করতে এসেছিলেন, বরকে দেখার জন্য প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবৎ গোসল না করেই রাস্তার পাশে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ২ মাসের শিশু কন্যা সায়মাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আসমা আক্তার, পাশেই ৭০ বছর বয়সী শাশুড়ি লায়লা বানু। আসমার ভাষ্য, মন্ত্রীর বিয়ের প্রচার কয়েক মাস ধরেই সমানতালে হচ্ছে। বরবেশে মন্ত্রীকে একটি বার দেখার জন্য কোলের শিশুকে নিয়েই পথে দাঁড়িয়ে রইলাম। এদিকে বরকে স্বাগত জানাতে কুটুম্বপুর থেকে কনের বাড়ি পর্যন্ত প্রায় ১১টি তোরণ তৈরি করা হয়। যার মধ্যে ৯টি তোরণই স্থানীয় গ্রামবাসীদের উদ্যোগে করা হয়। তোরণ নির্মাণকারীরা জানান, এ বিয়ে ইতিহাস হয়ে থাকবে, যে ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে থাকতেই গ্রামবাসীর সঙ্গে তারা ৫-৬ জন বন্ধু্ মিলে একটি তোরণ তৈরি করেছেন। এদিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছিল পুলিশ, আনসারসহ প্রায় ২শ’ স্বেচ্ছাসেবক। যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। একই সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের প্রায় সহস্রাধিক নেতাকর্মী বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অপর দিকে প্রায় ১শ’ ৫৬টি বিলাসবহুল গাড়ির বহর নিয়ে ঢাকা থেকে বর আসেন কনের বাড়িতে। বর ও যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তারা ছিলেন। কনের ভাই আলাউদ্দিন জানান, ৫ ভাই ২ বোনের মধ্যে রিক্তা (কনে) সবার ছোট। সবার আদরের। এদিকে কনের বাবা না থাকায় (মৃত্যু) মা জোসনা বেগমই কনেকে বরের হাতে তোলে দেন। তখন সন্ধ্যা ৬টা। এ সময় কনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কাঁদেন স্বজনরাও। এর আগে রাজধানীর মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বরযাত্রা শুরু হয় বেলা ১১টায়। দুপুর সোয়া ১টায় দাউদকান্দির শহীদনগর বাজার জামে মসজিদে নামাজ আদায় করেন বরসহ বর যাত্রীরা।
No comments