ইতিহাসবিদ এ এফ সালাহউদ্দীন আহমদ by এবনে গোলাম সামাদ
সদ্যপ্রয়াত অধ্যাপক এ এফ সালাহউদ্দীন আহমদকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে। অধ্যাপক সালাহউদ্দীন সাহেবের সাথে আমি রাজশাহী বশ্বিবিদ্যালয়ে অনেক দিন চাকরি করেছি। আমি তার অন্তরঙ্গ ছিলাম না; কিন্তু তিনি আমার অপরিচিতও ছিলেন না। তার সাথে দেশ-দশ ও ইতিহাস নিয়ে কিছু কিছু কথাও হয়েছে। মরহুম অধ্যাপক সালাহউদ্দীন সাহেব সম্বন্ধে আমার মনে জমে থাকা স্মৃতি উঠছে ভেসে। আমি তার কিছু স্মৃতিচারণ করতে চাচ্ছি আমার এই বর্তমান লেখায়। তার সম্বন্ধে আমার মনে কৌতূহল জাগে। কারণ, শুনেছিলাম তিনি নাকি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের (গ ঘ জড়ু) একজন ভাবশিষ্য। রায় সম্বন্ধে আমার মনে যথেষ্ট কৌতূহল ছিল। রায়ের লেখা অনেক বই আমি পড়েছিলাম। তাই যখন জানলাম অধ্যাপক সালাহউদ্দীন সাহেব রায়ের একজন বিশেষ ভক্ত, তখন তার কাছ থেকে রায় সম্পর্কে কিছু জানা যায় কি না সেটা জানতে ইচ্ছা হয়; কিন্তু হতাশ হই তার সাথে টুকরো টুকরো আলাপচারিতায়। আমার মনে হয় রায় সম্পর্কে তিনি জানেন না। জানেন না বিশেষ কিছুই। তার ধারণা নেই রায়ের চিন্তাজগৎ সম্পর্কে। আমাদের পত্রপত্রিকায় সরবে প্রচার করা হচ্ছে, তিনি ছিলেন রায়পন্থী; কিন্তু সেটা আদৌ সত্য বলে ভাবতে পারছি না আমি।
মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রথম জীবনে ছিলেন একনিষ্ঠ মার্কসবাদী। কার্ল মার্কস ইতিহাসের অর্থনৈতিক ভাষ্যে আস্থাশীল ছিলেন; কিন্তু তিনি অর্থনীতি বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তা নিয়ে আছে যথেষ্ট বিতর্ক। তিনি অর্থনীতি বলতে যেমন বুঝিয়েছিলেন অর্থনৈতিক উৎপাদনের সাজসরঞ্জামকে, তেমনি আবার বুঝিয়েছিলেন অর্থনীতিকে নির্ভর করে সমাজে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিরোধী অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্ঘাতকে, যাকে তিনি বলছেন শ্রেণিসঙ্ঘাত। উৎপাদনের সাজসরঞ্জামের ওপর মানবসমাজ কাঠামো ও তার ইতিহাস যে নির্ভর করে সে কথা এখন মোটামুটিভাবে স্বীকৃত। মানুষ যখন পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তখন তার সমাজজীবন যেমন ছিল, ধাতুযুগে এসে তা আর থাকেনি। একইভাবে মানুষ যখন হাত দিয়ে তাঁত চালিয়েছে, তখন তার সমাজজীবন যেমন ছিল, বাষ্পচালিত তাঁতের যুগে তা আর থাকেনি। বিলাতে ঘটেছে বিরাট শিল্পবিপ্লব। সমাজ গেছে বদলে। ইতিহাসকে বুঝতে গেলে তাই ভেবে দেখতে হয় মানুষ কী ধরনের উৎপাদনযন্ত্র ব্যবহার করছে। অন্য দিকে সমাজে অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসতে পারে শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। মার্কসের এই ধারণা এখন আর আগের মতো আদৃত নয়। যদিও একসময় বিবেচিত হতো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হিসেবে। মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রথম জীবনে মার্কসবাদী হলেও পরবর্তী জীবনে হয়ে ওঠেন বিশেষভাবে মানবতন্ত্রী বা হিউম্যানিস্ট। তিনি বলেন, মানব ইতিহাস বিকশিত হচ্ছে, কারণ মানুষ হয়ে উঠছে মানবতন্ত্রী। স্বার্থপরতার জায়গায় অধিক স্থান অধিকার করছে পরার্থপরতা। মার্কস ইতিহাস ব্যাখ্যায় যোগ দিয়েছেন বস্তুবাদী দর্শনের ওপর। স্বার্থবাদী ধারণার ওপর। মানুষের কল্যাণবুদ্ধিকে তিনি বিবেচনায় নিতে চাননি। যেটা মার্কসবাদের সবচেয়ে বড় ভুল।
মানব ইতিহাস কেবল স্বার্থবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না, পরিচালিত হচ্ছে শুভবুদ্ধি দ্বারা। রায় তার শেষজীবনে ভাবতে আরম্ভ করেন সব কিছুর অস্তিত্ব নিয়ে। মানুষ প্রশ্ন তুলতে পারে; কিন্তু মানুষ, মানুষ হিসেবে নিজের অস্তিত্বের বাস্তবতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারে না। মানুষের কাছে মানুষই সবচেয়ে বড় সত্য। তাই মানুষের ভালো-মন্দ দিয়েই বিচার করতে হবে সব কিছুর ভালো-মন্দকে। মানুষ সব কিছু বিচারের শেষ মাত্রা। এ হলো রায়ের মানবতাবাদের অন্তিম ভিত্তি। এরকম কথা আরো অনেক দার্শনিক বলেছেন; কিন্তু রায় বলেছেন নতুন করে। অধ্যাপক সালাহউদ্দীন সাহেবের সাথে কথা বলে তাকে মনে হয়নি তিনি একজন মানবতন্ত্রী। তিনি গল্প করতে ভালোবাসতেন। তার প্রথম যৌবনে তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নির্দেশে কাজ করতেন কলকাতার িিদরপুর ডক অঞ্চলে, ডক অঞ্চলের জাহাজী শ্রমিকদের সাথে। ল্য ছিল শ্রমজীবীদের একত্র করে সমাজ বিপ্লব ঘটানো; কিন্তু রায় এই সমাজ বিপ্লবের ধারণা বর্জন করেছিলেন পুরোপুরিভাবে। তিনি মনে করতেন, তার আগের ধারণা মোটেও সমর্থনীয় নয়। এই উপমহাদেশে মানুষ মূলত হলো কৃষিজীবী। তাদের মথাপিছু আয় বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য গড়তে হবে সমবায়ভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা। কৃষকের ক্রয়মতার উন্নতি হলে তারা কিনতে চাইবে নানা শিল্পদ্রব্য। তাদের এই চাহিদার কারণে ধীরে ধীরে দেশে কলকারখানার অর্থনীতিও স্থাপিত হতে পারবে। কৃষিজীবী মানুষের আয় বৃদ্ধি ছাড়া এই উপমহাদেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না। অর্থনীতির আছে দুটো দিক। একটি হলো সম্পদ উৎপাদনের আর অপরটি হলো উৎপাদিত সম্পদ বিতরণের। উৎপাদনের মাত্রা না বাড়িয়ে বিতরণের মাত্রা বাড়ানো কখনোই সম্ভব নয়। তা আমরা যতই শ্রেণিসংগ্রাম করি; কিন্তু অধ্যাপক সালাহউদ্দীন সাহেব অহঙ্কার করতেন, তিনি একসময় ছিলেন শ্রমজীবী আন্দোলনের একজন সংগঠক। অধ্যাপক সালাহউদ্দীন সাহেব দ্বিজাতি তত্ত্বে আস্থাবান ছিলেন না; কিন্তু রায় দ্বিজাতিতত্ত্বকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দ্বিজাতিতত্ত্ব ব্যাপারটি যে কেবল ধর্মীয় কারণে ঘটছে তা নয়। এর মূলে আছে হিন্দু মনের বিশেষ সংস্কার। হিন্দুরা মনে করে যে, মুসলমান হলো যবন, ম্লেচ্ছ, অশুচি। তাদের এই ঘৃণাই এই উপমহাদেশের মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করেছে পৃথক রাষ্ট্র গড়তে। তিনি আরো বলেন, মানুষ নিয়েই রাষ্ট্র। মানুষ ধর্মনিরেপে না হলে রাষ্ট্র ধর্মনিরেপ হতে পারে না। ভারত ধর্মনিরপে রাষ্ট্র নয়। কেননা, ভারতের বেশির ভাগ মানুষ এখনো ধর্মনিরপে হতে পারেনি। মুসলমানদের তারা এখনো ভাবছে যবন, ম্লেচ্ছ, অশুচি। এই মনোভাব কোনোভাবেই ধর্মনিরপেতার সৃষ্টি করতে পারে না। রায়ের কথা বিশেষভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে বাবরি মসজিদ ভাঙেনি, ভেঙেছে স্বাধীন ভারতে ধর্মনিরপে দল কংগ্রেসের শাসনামলে।
বাংলাদেশের খুব খ্যাতনামা দৈনিক পত্রিকা হলো ‘প্রথম আলো’। প্রথম আলোতে (২৪ অক্টোবর, ২০১৪) অধ্যাপক সালাহউদ্দীন সাহেবের দেয়া একটি সাাৎকার পড়লাম। সাাৎকারটি তিনি দিয়েছিলেন তার মৃত্যুর এক মাস আগে। এতে তিনি বলেছেন, উপমহাদেশে রাজনীতির ধারা হলো দু’টি। একটি হলো ধর্মনিরপেতা আর অপরটি হলো বিচ্ছিন্নতাবাদ। তিনি কখনোই বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিলেন না। তার এই বক্তব্য আমার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হলো। কেননা, ধর্মনিরপেতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদকে একত্র করে দেখা চলে না। অনেক দেশেই আছেন ধর্মনিরপেতাবাদী; কিন্তু তারা মোটেও বিচ্ছিন্নতাবাদী নন। দণি এশিয়ায় মুসলমানরা দাবি করেছিলেন, তারা হলেন একটা পৃথক জাতি। কোনো সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নয়, পাকিস্তানের দাবি উঠেছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। সালাহউদ্দীন সাহেব কেন ধর্মনিরপেতাবাদ আর দ্বিজাতিতত্ত্ববাদকে পরস্পরবিরোধীভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন, সেটা পরিষ্কার নয়। তিনি বলেছেন, তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদকে অর্থাৎ পাকিস্তানের দাবিকে কখনোই যথার্থ বলে মনে করেননি। এই সাাৎকারকে যদি ধরে নেয়া যায় সত্যি, তবে বলতে হবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সালাহউদ্দীন সাহেব ছিলেন অখণ্ড ভারতে বিশ্বাসী। তার মতে এখন আমরা যদি আস্থাবান হই তবে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব কি টিকবে? প্রশ্নটি আমার কাছে সঙ্গত মনে হচ্ছে। অনেক দিন আগের কথা, আমি সালাহউদ্দীন সাহেবকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলোম, আপনি পাকিস্তানে আস্থাবান নন; কিন্তু কলকাতা ছেড়ে প্রথমে ঢাকায় পরে রাজশাহীতে চাকরি করতে এলেন কেন? তিনি আমার কথার উত্তরে বলেন, তিনি জন্মসূত্রে ফরিদপুরের লোক। ফরিদপুর পাকিস্তানে পড়েছে। তাই তিনি জন্মভূমির টানে এসেছেন পূর্ব পাকিস্তানে। না হলে আসতেন না। তার এই উত্তর আমার কাছে খুব যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। আমার মনে পড়েছিল আরেকজন ব্যক্তির নাম। তিনি হলেন কাজী আবদুল ওদুদ। তিনি একসময় ঢাকা কলেজে চাকরি করতেন। ঢাকায় গড়ে তুলেছিলেন বুদ্ধি মুক্তির আন্দোলন। প্রকাশ করেছিলেন শিখা নামে পত্রিকা। ওদুদ সাহেব অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করে গিয়েছেন বাংলাদেশের সমাজ- সংস্কৃতি সম্বন্ধে; কিন্তু তিনি যেহেতু পাকিস্তান আন্দোলনে আস্থাবান ছিলেন না, তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তার ঢাকার বাড়ি বিক্রি করে ফরিদপুরের সহায়সম্পত্তি পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। গ্রহণ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিা বিভাগে চাকরি। আমার মনে হয়েছিল কাজী আবদুল ওদুদ তার বিশ্বাসের ব্যাপারে যে পরিমাণ দৃঢ় ও সৎ, সালাহউদ্দীন সাহেব মোটেও তা নন। তিনি পাকিস্তানে এসেছিলেন বিশেষ সুযোগ-সুবিধা লাভের কথা বিবেচনা করেই। দ্বিজাতিতত্ত্বে তিনি বিশ্বাস না করেও নিজের নিরাপত্তার জন্য তিনি চলে আসতে বাধ্য হন কলকাতা ছেড়ে ঢাকায়। কাজী আবদুল ওদুদ কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন; কিন্তু তিনি ঢাকা কলেজে নিয়োজিত ছিলেন বাংলা বিভাগে। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান উল্লেখ্য হয়ে আছে।
সালাহউদ্দীন সাহেব পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ খ্যাতি পেয়েছেন রাজা রামমোহন রায়কে নিয়ে লেখা অভিসন্দর্ভ রচনার কারণে। তিনি রাজা রামমোহন রায়কে নিয়ে গবেষণা করেন বিলাতে, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে; কিন্তু কাজী আবদুল ওদুদ নিজ দেশে বসেই ব্রাহ্ম সমাজকে নিয়ে রচনা করেছেন প্রথম শ্রেণীর গ্রন্থ। তাকে বিলাতে যেতে হয়নি। তাকে রবীন্দ্রনাথ নিজে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা ও রাজা রামমোহন রায়ের ওপর বক্তৃতা করার জন্য।
আর একদিনের কথা মনে পড়ে। সালাহউদ্দীন সাহেব হাজী শরীয়তুল্লাহ ও ফারায়েজী আন্দোলন সম্পর্কে করেছিলেন খুব বিরূপ মন্তব্য; কিন্তু হিন্দু সমাজে যখন জন্মেছেন রাজা রামমোহন রায়, তখন মুসলমান সমাজে জন্মেছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। সালাহউদ্দীন সাহেবের কাছে হাজী শরীয়তুল্লাহ কেবলই ছিলেন একজন গোঁড়া মৌলবাদী মুসলমান। তিনি কোনো মুক্ত চিন্তার অধিকারী ছিলেন না। তিনি হাজী শরীয়তুল্লাহ সম্পর্কে খুবই নীচু ধারণা পোষণ করতেন, যা অন্য ঐতিহাসিকেরা করেননি। ১৯৮২ সালে মস্কো থেকে প্রকাশিত ভারতবর্ষের ইতিহাস নামক বইয়ের এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বাধীন ‘ফারাজী’ আন্দোলন ছিল ওহাবীদেরই একটি উপশাখা। হিন্দু, মুসলিম জমিদার ও বৃটিশ নীলকর নির্বিশেষে সকল অত্যাচারীর বিরুদ্ধে এরা অহিংস প্রতিশোধ গ্রহণ করত। বাংলায় এটি ছিল মূলত মধ্যযুগীয় ধরনের একটি কৃষক আন্দোলন। তাদের পূর্ববর্তী ওহাবীদের মতো এরাও বিশুদ্ধ ইসলামের আদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরত এবং খোদার দুনিয়ায় সকল মানুষের সমানাধিকারের কথা বলত। তারা ঘোষণা করত যে, তাদের সম্প্রদায়ের সকল সভ্যই সমান, জমির মালিক খোদা; তাই নিজ স্বার্থে কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের অধিকার কারও নেই।’ অনেক ইতিহাসের অধ্যাপককে আমি বলতে শুনেছি যে, রামমোহন নয় বাংলাভাষী মুসলমানের ইতিহাস বিশ্লেষণে হাজী শরীয়তুল্লাহর গুরুত্ব বহু গুণে বেশি। ১৭৬০ সালের কাছাকাছি বিলাতে ঘটে কলকারখানার বিপ্লøব। কলকারখায় তৈরী সস্তা কাপড় আসতে থাকে বাংলাদেশে, যার সাথে পেরে ওঠে না আমাদের হস্তচালিত তাঁতশিল্প। যেহেতু দেশ ছিল ব্রিটিশ শাসনের অধীন। তাই কর বসিয়ে বিদেশী কাপড় আসা বন্ধ করা যায় না। অন্য দিকে আমাদের দেশে হতে পারে না শিল্পবিপ্লব। ফলে ধ্বংস হতে থাকে আমাদের দেশের সমৃদ্ধ তাঁতশিল্প। তাঁতশিল্পে প্রধানত নিয়েজিত ছিলেন মুসলমান তন্তুবায়রা (জুলহা)। তারা দ্রুত হয়ে পড়তে থাকেন কর্মসংস্থানহীন। শরীয়তুল্লাহর ফারায়েজী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এসব কর্মসংস্থানহীন তন্তুবায়। পান্তরে রামমোহন চেয়েছিলেন ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা করে মতা ভাগ করে নিতে। সরকারি চাকরিতে হিন্দু মধ্যবিত্তকে অধিক নিয়োজন দিতে। ফারায়েজী আন্দোলন ছিল দরিদ্র কৃষিজীবী মানুষের আত্মরার আন্দোলন; কিন্তু ব্রাহ্ম সমাজের ল্য ছিল অধিক সরকারি চাকরি লাভ করে মধ্যবিত্তের আর্থিক উন্নয়ন। দেশে যখন নীলকরবিরোধী আন্দোলন আরম্ভ হয়, তখন ব্রাহ্মরা বলেন, এরকম আন্দোলন করা উচিত হচ্ছে না। কারণ নীলকর সাহেবদের মাধ্যমে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে পারছে ইউরোপীয় চিন্তাচেতনা। নীলকর সাহেবদের নির্ভর করে উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে দেশের শিা-দীা।
রামমোহন বাংলা ব্যাকরণ লিখেছিলেন। নিজে বাংলা গদ্য লিখে বাড়াতে সম হয়েছিলেন বাংলা গদ্যের প্রকাশ মতা; কিন্তু তিনি কখনোই ভাবতে পারেননি যে, বাংলা কখনো কোনো দেশের রাষ্ট্রভাষা হতে পারবে। হিন্দু কখনোই চায়নি বাংলাকে কোনো দেশের রাষ্ট্রভাষা করতে। বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ব্রিটিশ শাসনামলে প্রকাশিত তার ‘ভারতের ভাষা ও ভাষাসমস্যা’ নামে বইয়ে বলেন, ভারতের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত হিন্দি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন প্রায় একই রকম কথা; কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর সাবেক পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যে হয়েছিল বাংলাকে উর্দুর সাথে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার আন্দোলন। এই আন্দোলন সফল হয়েছিল। সাবেক পাকিস্তানে উর্দুর সাথে বাংলা হতে পেরেছিল রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তান না হলে বাংলাভাষাভাষী অঞ্চল সম্পূর্ণটাই হতো ভারতের অন্তর্গত। আর আমাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে শিখতে হতো হিন্দি। বাংলা কোনো দেশেরই রাষ্ট্রভাষা হতে পারত না। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হতে পেরেছে বাংলাভাষী মুসলমানেরই সংগ্রামের ফলে। এই ইতিহাস এখন ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রভাষার কথা আসছে। কেননা, আমরা দেখতে পেলাম ভাষা শহীদদের মিনারে অধ্যাপক পিয়াস করিমের লাশ রেখে শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে দেয়া হলো না। সরকার দিলো বাধা। অন্য দিকে অধ্যাপক সালাহউদ্দীন সাহেবের লাশ শহীদ মিনারে স্থাপন করে প্রদর্শন করা হলো বিশেষ শ্রদ্ধা। আমাদের কাছে মনে হলো, এটাকে একটা নোংরা রাজনীতি বলে। ভাষা আন্দোলনের পশ্চাতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কোনো আবদান ছিল না; কিন্তু আওয়ামী লীগের দাবি, ভাষা আন্দোলনের পেছনে ছিল শেখ মুজিবের বিশেষ অবদান। যেটা অনেক কারণেই স্বীকার্য নয়। শেখ মুজিব ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের রাজনৈতিক শিষ্য। তিনি পরিচালিত হতেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নির্দেশেই। ১৯৫১ সালের ২৪ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে গঠিত হয় পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী লীগ। ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারি সিন্ধুর হায়দরাবাদ শহরে সোহরাওয়ার্দী সাহেব বলেন, যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তদানুসারে উর্দুই হতে হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা; কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ যেতে চাচ্ছে এই ইতিহাস এড়িয়ে। আওয়ামী লীগ ও তার সাথীরা শহীদ মিনারের ওপর দাবি করছে একাধিকার। এই ইতিহাসও যথেষ্ট বিচিত্র এবং জটিল ব্যাখ্যাসাপে।
একদিনের একটি বিশেষ ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। সেটা ১৯৭০ সাল। শেখ মুজিব এসেছিলেন রাজশাহীতে, নির্বাচনী প্রচার উপল।ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাযহারুল ইসলাম শেখ মুজিবকে আমন্ত্রণ করেছিলেন এক মধ্যাহ্নভোজে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন এই ভোজসভায়। ভোজসভার শেষে শেখ মুজিব শিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন। ঘটানাচক্রে আমি ও ড. সালাহউদ্দীন সাহেব উভয়ই ছিলাম সেই ভোজসভায়। ফিরতি পথে সালাহউদ্দীন সাহেব বলেন, দেশে যেমন নেতার প্রয়োজন, তার কাছে শেখ মুজিবকে তা মনে হলো না। তার মনে হয়েছে মতা পেলে শেখ মুজিব দেশ চালাতে সম হবেন না; কিন্তু আমরা দেখলাম পরবর্তীকালে শেখ মুজিবকে সালাহউদ্দীন সাহেব করলেন প্রভূত প্রশংসা। বদলে গেল তার শেখ মুজিব সম্পর্কে পূর্বমূল্যায়ন। কেন কী কারণে শেখ মুজিব সম্পর্কে তার চিন্তাচেতনা বদলালো, তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি প্রদান করেননি তার লেখায়। মানুষের ধারণা বদলাতেই পারে; কিন্তু এই যে পরিবর্তন, এটা অনেককেই করেছে খুবই বিস্মিত।
পুরনো দিনের অনেক কথা মনে পড়ছে। সালাহউদ্দীন সাহেব গড়ে তুলতে পেরেছিলেন তার নিজের একটা অন্তরঙ্গ বন্ধুবলয়, যাদের অনেকে পরবর্তীকালে খ্যাতি পেয়েছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী হিসেবে। যেমন, বদরউদ্দীন উমর, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মুস্তফা নূরউল ইসলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিল্লুর রহমান ও নূরউল ইসলাম সাহেব প্রকাশ করতেন একটি মাসিক পত্রিকা, যার নাম ছিল পূর্বমেঘ। বদরউদ্দীন উমর সাহেব ছিলেন প্রায় সালাহউদ্দীন সাহেবের অনুজপ্রতিম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার সময় সালাহউদ্দীন সাহেবের তত্ত্বাবধানে (আমার তাই মনে হয়) সাম্প্রদায়িকতা নামে একটি বই লিখেছিলেন। কেন জানি না রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক আমার চেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন হলেও উমর সাহেব তার লেখা বইটি অন্য কাউকে না দিয়ে আমাকে দিয়েছিলেন সমালোচনা করতে। আমি তার বইয়ের সমালোচনা করে ঢাকার তখনকার মাসিক সমকাল পত্রিকায় ছাপিয়েছিলাম; কিন্তু আমার সমালোচনা বদরউদ্দীন উমর সাহেবের মনে সৃষ্টি করেছিল খুবই বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কেননা আমি বলেছিলাম, এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার জন্য কেবল মুসলমানদেরই দায়ী করা ঐতিহাসিক বাস্তবতা নয়। বদরউদ্দীন উমর সাহেব তার বইয়ে বলেন, সিপাহি বিদ্রোহ নাকি ছিল একটি প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তবাদী অভ্যুত্থান। যেটাকে আমি সমর্থন করতে পারিনি। পরে জেনেছিলাম তার এই অভিমত সালাহউদ্দীন সাহেবও পোষণ করেন; কিন্তু সিপাহি অভ্যুত্থানের পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছিল সারা উত্তর ভারতের মানুষ। সিপাহি অভ্যুত্থান জনসমর্থনবিহীন ছিল না। পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু তার বিখ্যাত ঞযব উরংপড়াবৎু ড়ভ ওহফরধ বইয়ে বলেছেন, সিপাহি বিদ্রোহ ছিল মতাচ্যুত ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক রাজন্যবর্গের মতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা; কিন্তু আধুনিককালের গবেষণা থেকে এরকম বক্তব্যের আর সমর্থন মিলছে না। কেননা, অধিকাংশ সামন্ত রাজা বিদ্রোহকে সমর্থন দিতে চাননি। নিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনেরই প। অন্য দিকে কার্ল মার্কস সিপাহি বিদ্রোহকে বলেছিলেন ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধ। বদরউদ্দীন উমর সাহেব এ সময় নিজেকে কিছুটা মার্কসবাদী বলে দাবি করতেন; কিন্তু তার জানা ছিল না, মার্কস নিজে সিপাহি বিদ্রোহ সম্পর্কে কী বলেছেন। অনেক দিনের কথা। এসব কথা আমার মনে আসছে, কারণ পরবর্তীকালে বদরউদ্দীন উমর পরিচিতি পেয়েছেন একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তক হিসেবে। আর তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃপ্রতিম সালাহউদ্দীন সাহেব খ্যাতি লাভ করেছেন একজন প্রথম শ্রেণীর ইতিহাসবেত্তা হিসেবে।
আমি ইতিহাসের গবেষক নই। ইতিহাস পড়েছিলাম নিজেকে কিছুটা আলোকিত করার জন্য। আমি সালাহউদ্দীন সাহেবের কোনো সমালোচনা করতে চাচ্ছি না। কেবল তুলে ধরতে চাচ্ছি তার ও তার ঘনিষ্ঠ সাথীদের সম্পর্কে আমার মনে জমে থাকা কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি। এই লেখাটিকে কোনোভাবেই উল্লেখ করা উচিত হবে না সালাহউদ্দীন সাহেবের মূল্যায়ন হিসেবে। আমি সে যোগ্যতা রাখি না।
প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রথম জীবনে ছিলেন একনিষ্ঠ মার্কসবাদী। কার্ল মার্কস ইতিহাসের অর্থনৈতিক ভাষ্যে আস্থাশীল ছিলেন; কিন্তু তিনি অর্থনীতি বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তা নিয়ে আছে যথেষ্ট বিতর্ক। তিনি অর্থনীতি বলতে যেমন বুঝিয়েছিলেন অর্থনৈতিক উৎপাদনের সাজসরঞ্জামকে, তেমনি আবার বুঝিয়েছিলেন অর্থনীতিকে নির্ভর করে সমাজে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিরোধী অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্ঘাতকে, যাকে তিনি বলছেন শ্রেণিসঙ্ঘাত। উৎপাদনের সাজসরঞ্জামের ওপর মানবসমাজ কাঠামো ও তার ইতিহাস যে নির্ভর করে সে কথা এখন মোটামুটিভাবে স্বীকৃত। মানুষ যখন পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তখন তার সমাজজীবন যেমন ছিল, ধাতুযুগে এসে তা আর থাকেনি। একইভাবে মানুষ যখন হাত দিয়ে তাঁত চালিয়েছে, তখন তার সমাজজীবন যেমন ছিল, বাষ্পচালিত তাঁতের যুগে তা আর থাকেনি। বিলাতে ঘটেছে বিরাট শিল্পবিপ্লব। সমাজ গেছে বদলে। ইতিহাসকে বুঝতে গেলে তাই ভেবে দেখতে হয় মানুষ কী ধরনের উৎপাদনযন্ত্র ব্যবহার করছে। অন্য দিকে সমাজে অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসতে পারে শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। মার্কসের এই ধারণা এখন আর আগের মতো আদৃত নয়। যদিও একসময় বিবেচিত হতো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হিসেবে। মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রথম জীবনে মার্কসবাদী হলেও পরবর্তী জীবনে হয়ে ওঠেন বিশেষভাবে মানবতন্ত্রী বা হিউম্যানিস্ট। তিনি বলেন, মানব ইতিহাস বিকশিত হচ্ছে, কারণ মানুষ হয়ে উঠছে মানবতন্ত্রী। স্বার্থপরতার জায়গায় অধিক স্থান অধিকার করছে পরার্থপরতা। মার্কস ইতিহাস ব্যাখ্যায় যোগ দিয়েছেন বস্তুবাদী দর্শনের ওপর। স্বার্থবাদী ধারণার ওপর। মানুষের কল্যাণবুদ্ধিকে তিনি বিবেচনায় নিতে চাননি। যেটা মার্কসবাদের সবচেয়ে বড় ভুল।
মানব ইতিহাস কেবল স্বার্থবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না, পরিচালিত হচ্ছে শুভবুদ্ধি দ্বারা। রায় তার শেষজীবনে ভাবতে আরম্ভ করেন সব কিছুর অস্তিত্ব নিয়ে। মানুষ প্রশ্ন তুলতে পারে; কিন্তু মানুষ, মানুষ হিসেবে নিজের অস্তিত্বের বাস্তবতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারে না। মানুষের কাছে মানুষই সবচেয়ে বড় সত্য। তাই মানুষের ভালো-মন্দ দিয়েই বিচার করতে হবে সব কিছুর ভালো-মন্দকে। মানুষ সব কিছু বিচারের শেষ মাত্রা। এ হলো রায়ের মানবতাবাদের অন্তিম ভিত্তি। এরকম কথা আরো অনেক দার্শনিক বলেছেন; কিন্তু রায় বলেছেন নতুন করে। অধ্যাপক সালাহউদ্দীন সাহেবের সাথে কথা বলে তাকে মনে হয়নি তিনি একজন মানবতন্ত্রী। তিনি গল্প করতে ভালোবাসতেন। তার প্রথম যৌবনে তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নির্দেশে কাজ করতেন কলকাতার িিদরপুর ডক অঞ্চলে, ডক অঞ্চলের জাহাজী শ্রমিকদের সাথে। ল্য ছিল শ্রমজীবীদের একত্র করে সমাজ বিপ্লব ঘটানো; কিন্তু রায় এই সমাজ বিপ্লবের ধারণা বর্জন করেছিলেন পুরোপুরিভাবে। তিনি মনে করতেন, তার আগের ধারণা মোটেও সমর্থনীয় নয়। এই উপমহাদেশে মানুষ মূলত হলো কৃষিজীবী। তাদের মথাপিছু আয় বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য গড়তে হবে সমবায়ভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা। কৃষকের ক্রয়মতার উন্নতি হলে তারা কিনতে চাইবে নানা শিল্পদ্রব্য। তাদের এই চাহিদার কারণে ধীরে ধীরে দেশে কলকারখানার অর্থনীতিও স্থাপিত হতে পারবে। কৃষিজীবী মানুষের আয় বৃদ্ধি ছাড়া এই উপমহাদেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না। অর্থনীতির আছে দুটো দিক। একটি হলো সম্পদ উৎপাদনের আর অপরটি হলো উৎপাদিত সম্পদ বিতরণের। উৎপাদনের মাত্রা না বাড়িয়ে বিতরণের মাত্রা বাড়ানো কখনোই সম্ভব নয়। তা আমরা যতই শ্রেণিসংগ্রাম করি; কিন্তু অধ্যাপক সালাহউদ্দীন সাহেব অহঙ্কার করতেন, তিনি একসময় ছিলেন শ্রমজীবী আন্দোলনের একজন সংগঠক। অধ্যাপক সালাহউদ্দীন সাহেব দ্বিজাতি তত্ত্বে আস্থাবান ছিলেন না; কিন্তু রায় দ্বিজাতিতত্ত্বকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দ্বিজাতিতত্ত্ব ব্যাপারটি যে কেবল ধর্মীয় কারণে ঘটছে তা নয়। এর মূলে আছে হিন্দু মনের বিশেষ সংস্কার। হিন্দুরা মনে করে যে, মুসলমান হলো যবন, ম্লেচ্ছ, অশুচি। তাদের এই ঘৃণাই এই উপমহাদেশের মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করেছে পৃথক রাষ্ট্র গড়তে। তিনি আরো বলেন, মানুষ নিয়েই রাষ্ট্র। মানুষ ধর্মনিরেপে না হলে রাষ্ট্র ধর্মনিরেপ হতে পারে না। ভারত ধর্মনিরপে রাষ্ট্র নয়। কেননা, ভারতের বেশির ভাগ মানুষ এখনো ধর্মনিরপে হতে পারেনি। মুসলমানদের তারা এখনো ভাবছে যবন, ম্লেচ্ছ, অশুচি। এই মনোভাব কোনোভাবেই ধর্মনিরপেতার সৃষ্টি করতে পারে না। রায়ের কথা বিশেষভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে বাবরি মসজিদ ভাঙেনি, ভেঙেছে স্বাধীন ভারতে ধর্মনিরপে দল কংগ্রেসের শাসনামলে।
বাংলাদেশের খুব খ্যাতনামা দৈনিক পত্রিকা হলো ‘প্রথম আলো’। প্রথম আলোতে (২৪ অক্টোবর, ২০১৪) অধ্যাপক সালাহউদ্দীন সাহেবের দেয়া একটি সাাৎকার পড়লাম। সাাৎকারটি তিনি দিয়েছিলেন তার মৃত্যুর এক মাস আগে। এতে তিনি বলেছেন, উপমহাদেশে রাজনীতির ধারা হলো দু’টি। একটি হলো ধর্মনিরপেতা আর অপরটি হলো বিচ্ছিন্নতাবাদ। তিনি কখনোই বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিলেন না। তার এই বক্তব্য আমার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হলো। কেননা, ধর্মনিরপেতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদকে একত্র করে দেখা চলে না। অনেক দেশেই আছেন ধর্মনিরপেতাবাদী; কিন্তু তারা মোটেও বিচ্ছিন্নতাবাদী নন। দণি এশিয়ায় মুসলমানরা দাবি করেছিলেন, তারা হলেন একটা পৃথক জাতি। কোনো সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নয়, পাকিস্তানের দাবি উঠেছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। সালাহউদ্দীন সাহেব কেন ধর্মনিরপেতাবাদ আর দ্বিজাতিতত্ত্ববাদকে পরস্পরবিরোধীভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন, সেটা পরিষ্কার নয়। তিনি বলেছেন, তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদকে অর্থাৎ পাকিস্তানের দাবিকে কখনোই যথার্থ বলে মনে করেননি। এই সাাৎকারকে যদি ধরে নেয়া যায় সত্যি, তবে বলতে হবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সালাহউদ্দীন সাহেব ছিলেন অখণ্ড ভারতে বিশ্বাসী। তার মতে এখন আমরা যদি আস্থাবান হই তবে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব কি টিকবে? প্রশ্নটি আমার কাছে সঙ্গত মনে হচ্ছে। অনেক দিন আগের কথা, আমি সালাহউদ্দীন সাহেবকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলোম, আপনি পাকিস্তানে আস্থাবান নন; কিন্তু কলকাতা ছেড়ে প্রথমে ঢাকায় পরে রাজশাহীতে চাকরি করতে এলেন কেন? তিনি আমার কথার উত্তরে বলেন, তিনি জন্মসূত্রে ফরিদপুরের লোক। ফরিদপুর পাকিস্তানে পড়েছে। তাই তিনি জন্মভূমির টানে এসেছেন পূর্ব পাকিস্তানে। না হলে আসতেন না। তার এই উত্তর আমার কাছে খুব যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। আমার মনে পড়েছিল আরেকজন ব্যক্তির নাম। তিনি হলেন কাজী আবদুল ওদুদ। তিনি একসময় ঢাকা কলেজে চাকরি করতেন। ঢাকায় গড়ে তুলেছিলেন বুদ্ধি মুক্তির আন্দোলন। প্রকাশ করেছিলেন শিখা নামে পত্রিকা। ওদুদ সাহেব অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করে গিয়েছেন বাংলাদেশের সমাজ- সংস্কৃতি সম্বন্ধে; কিন্তু তিনি যেহেতু পাকিস্তান আন্দোলনে আস্থাবান ছিলেন না, তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তার ঢাকার বাড়ি বিক্রি করে ফরিদপুরের সহায়সম্পত্তি পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। গ্রহণ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিা বিভাগে চাকরি। আমার মনে হয়েছিল কাজী আবদুল ওদুদ তার বিশ্বাসের ব্যাপারে যে পরিমাণ দৃঢ় ও সৎ, সালাহউদ্দীন সাহেব মোটেও তা নন। তিনি পাকিস্তানে এসেছিলেন বিশেষ সুযোগ-সুবিধা লাভের কথা বিবেচনা করেই। দ্বিজাতিতত্ত্বে তিনি বিশ্বাস না করেও নিজের নিরাপত্তার জন্য তিনি চলে আসতে বাধ্য হন কলকাতা ছেড়ে ঢাকায়। কাজী আবদুল ওদুদ কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন; কিন্তু তিনি ঢাকা কলেজে নিয়োজিত ছিলেন বাংলা বিভাগে। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান উল্লেখ্য হয়ে আছে।
সালাহউদ্দীন সাহেব পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ খ্যাতি পেয়েছেন রাজা রামমোহন রায়কে নিয়ে লেখা অভিসন্দর্ভ রচনার কারণে। তিনি রাজা রামমোহন রায়কে নিয়ে গবেষণা করেন বিলাতে, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে; কিন্তু কাজী আবদুল ওদুদ নিজ দেশে বসেই ব্রাহ্ম সমাজকে নিয়ে রচনা করেছেন প্রথম শ্রেণীর গ্রন্থ। তাকে বিলাতে যেতে হয়নি। তাকে রবীন্দ্রনাথ নিজে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা ও রাজা রামমোহন রায়ের ওপর বক্তৃতা করার জন্য।
আর একদিনের কথা মনে পড়ে। সালাহউদ্দীন সাহেব হাজী শরীয়তুল্লাহ ও ফারায়েজী আন্দোলন সম্পর্কে করেছিলেন খুব বিরূপ মন্তব্য; কিন্তু হিন্দু সমাজে যখন জন্মেছেন রাজা রামমোহন রায়, তখন মুসলমান সমাজে জন্মেছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। সালাহউদ্দীন সাহেবের কাছে হাজী শরীয়তুল্লাহ কেবলই ছিলেন একজন গোঁড়া মৌলবাদী মুসলমান। তিনি কোনো মুক্ত চিন্তার অধিকারী ছিলেন না। তিনি হাজী শরীয়তুল্লাহ সম্পর্কে খুবই নীচু ধারণা পোষণ করতেন, যা অন্য ঐতিহাসিকেরা করেননি। ১৯৮২ সালে মস্কো থেকে প্রকাশিত ভারতবর্ষের ইতিহাস নামক বইয়ের এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বাধীন ‘ফারাজী’ আন্দোলন ছিল ওহাবীদেরই একটি উপশাখা। হিন্দু, মুসলিম জমিদার ও বৃটিশ নীলকর নির্বিশেষে সকল অত্যাচারীর বিরুদ্ধে এরা অহিংস প্রতিশোধ গ্রহণ করত। বাংলায় এটি ছিল মূলত মধ্যযুগীয় ধরনের একটি কৃষক আন্দোলন। তাদের পূর্ববর্তী ওহাবীদের মতো এরাও বিশুদ্ধ ইসলামের আদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরত এবং খোদার দুনিয়ায় সকল মানুষের সমানাধিকারের কথা বলত। তারা ঘোষণা করত যে, তাদের সম্প্রদায়ের সকল সভ্যই সমান, জমির মালিক খোদা; তাই নিজ স্বার্থে কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের অধিকার কারও নেই।’ অনেক ইতিহাসের অধ্যাপককে আমি বলতে শুনেছি যে, রামমোহন নয় বাংলাভাষী মুসলমানের ইতিহাস বিশ্লেষণে হাজী শরীয়তুল্লাহর গুরুত্ব বহু গুণে বেশি। ১৭৬০ সালের কাছাকাছি বিলাতে ঘটে কলকারখানার বিপ্লøব। কলকারখায় তৈরী সস্তা কাপড় আসতে থাকে বাংলাদেশে, যার সাথে পেরে ওঠে না আমাদের হস্তচালিত তাঁতশিল্প। যেহেতু দেশ ছিল ব্রিটিশ শাসনের অধীন। তাই কর বসিয়ে বিদেশী কাপড় আসা বন্ধ করা যায় না। অন্য দিকে আমাদের দেশে হতে পারে না শিল্পবিপ্লব। ফলে ধ্বংস হতে থাকে আমাদের দেশের সমৃদ্ধ তাঁতশিল্প। তাঁতশিল্পে প্রধানত নিয়েজিত ছিলেন মুসলমান তন্তুবায়রা (জুলহা)। তারা দ্রুত হয়ে পড়তে থাকেন কর্মসংস্থানহীন। শরীয়তুল্লাহর ফারায়েজী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এসব কর্মসংস্থানহীন তন্তুবায়। পান্তরে রামমোহন চেয়েছিলেন ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা করে মতা ভাগ করে নিতে। সরকারি চাকরিতে হিন্দু মধ্যবিত্তকে অধিক নিয়োজন দিতে। ফারায়েজী আন্দোলন ছিল দরিদ্র কৃষিজীবী মানুষের আত্মরার আন্দোলন; কিন্তু ব্রাহ্ম সমাজের ল্য ছিল অধিক সরকারি চাকরি লাভ করে মধ্যবিত্তের আর্থিক উন্নয়ন। দেশে যখন নীলকরবিরোধী আন্দোলন আরম্ভ হয়, তখন ব্রাহ্মরা বলেন, এরকম আন্দোলন করা উচিত হচ্ছে না। কারণ নীলকর সাহেবদের মাধ্যমে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে পারছে ইউরোপীয় চিন্তাচেতনা। নীলকর সাহেবদের নির্ভর করে উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে দেশের শিা-দীা।
রামমোহন বাংলা ব্যাকরণ লিখেছিলেন। নিজে বাংলা গদ্য লিখে বাড়াতে সম হয়েছিলেন বাংলা গদ্যের প্রকাশ মতা; কিন্তু তিনি কখনোই ভাবতে পারেননি যে, বাংলা কখনো কোনো দেশের রাষ্ট্রভাষা হতে পারবে। হিন্দু কখনোই চায়নি বাংলাকে কোনো দেশের রাষ্ট্রভাষা করতে। বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ব্রিটিশ শাসনামলে প্রকাশিত তার ‘ভারতের ভাষা ও ভাষাসমস্যা’ নামে বইয়ে বলেন, ভারতের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত হিন্দি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন প্রায় একই রকম কথা; কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর সাবেক পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যে হয়েছিল বাংলাকে উর্দুর সাথে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার আন্দোলন। এই আন্দোলন সফল হয়েছিল। সাবেক পাকিস্তানে উর্দুর সাথে বাংলা হতে পেরেছিল রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তান না হলে বাংলাভাষাভাষী অঞ্চল সম্পূর্ণটাই হতো ভারতের অন্তর্গত। আর আমাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে শিখতে হতো হিন্দি। বাংলা কোনো দেশেরই রাষ্ট্রভাষা হতে পারত না। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হতে পেরেছে বাংলাভাষী মুসলমানেরই সংগ্রামের ফলে। এই ইতিহাস এখন ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রভাষার কথা আসছে। কেননা, আমরা দেখতে পেলাম ভাষা শহীদদের মিনারে অধ্যাপক পিয়াস করিমের লাশ রেখে শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে দেয়া হলো না। সরকার দিলো বাধা। অন্য দিকে অধ্যাপক সালাহউদ্দীন সাহেবের লাশ শহীদ মিনারে স্থাপন করে প্রদর্শন করা হলো বিশেষ শ্রদ্ধা। আমাদের কাছে মনে হলো, এটাকে একটা নোংরা রাজনীতি বলে। ভাষা আন্দোলনের পশ্চাতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কোনো আবদান ছিল না; কিন্তু আওয়ামী লীগের দাবি, ভাষা আন্দোলনের পেছনে ছিল শেখ মুজিবের বিশেষ অবদান। যেটা অনেক কারণেই স্বীকার্য নয়। শেখ মুজিব ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের রাজনৈতিক শিষ্য। তিনি পরিচালিত হতেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নির্দেশেই। ১৯৫১ সালের ২৪ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে গঠিত হয় পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী লীগ। ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারি সিন্ধুর হায়দরাবাদ শহরে সোহরাওয়ার্দী সাহেব বলেন, যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তদানুসারে উর্দুই হতে হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা; কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ যেতে চাচ্ছে এই ইতিহাস এড়িয়ে। আওয়ামী লীগ ও তার সাথীরা শহীদ মিনারের ওপর দাবি করছে একাধিকার। এই ইতিহাসও যথেষ্ট বিচিত্র এবং জটিল ব্যাখ্যাসাপে।
একদিনের একটি বিশেষ ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। সেটা ১৯৭০ সাল। শেখ মুজিব এসেছিলেন রাজশাহীতে, নির্বাচনী প্রচার উপল।ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাযহারুল ইসলাম শেখ মুজিবকে আমন্ত্রণ করেছিলেন এক মধ্যাহ্নভোজে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন এই ভোজসভায়। ভোজসভার শেষে শেখ মুজিব শিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন। ঘটানাচক্রে আমি ও ড. সালাহউদ্দীন সাহেব উভয়ই ছিলাম সেই ভোজসভায়। ফিরতি পথে সালাহউদ্দীন সাহেব বলেন, দেশে যেমন নেতার প্রয়োজন, তার কাছে শেখ মুজিবকে তা মনে হলো না। তার মনে হয়েছে মতা পেলে শেখ মুজিব দেশ চালাতে সম হবেন না; কিন্তু আমরা দেখলাম পরবর্তীকালে শেখ মুজিবকে সালাহউদ্দীন সাহেব করলেন প্রভূত প্রশংসা। বদলে গেল তার শেখ মুজিব সম্পর্কে পূর্বমূল্যায়ন। কেন কী কারণে শেখ মুজিব সম্পর্কে তার চিন্তাচেতনা বদলালো, তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি প্রদান করেননি তার লেখায়। মানুষের ধারণা বদলাতেই পারে; কিন্তু এই যে পরিবর্তন, এটা অনেককেই করেছে খুবই বিস্মিত।
পুরনো দিনের অনেক কথা মনে পড়ছে। সালাহউদ্দীন সাহেব গড়ে তুলতে পেরেছিলেন তার নিজের একটা অন্তরঙ্গ বন্ধুবলয়, যাদের অনেকে পরবর্তীকালে খ্যাতি পেয়েছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী হিসেবে। যেমন, বদরউদ্দীন উমর, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মুস্তফা নূরউল ইসলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিল্লুর রহমান ও নূরউল ইসলাম সাহেব প্রকাশ করতেন একটি মাসিক পত্রিকা, যার নাম ছিল পূর্বমেঘ। বদরউদ্দীন উমর সাহেব ছিলেন প্রায় সালাহউদ্দীন সাহেবের অনুজপ্রতিম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার সময় সালাহউদ্দীন সাহেবের তত্ত্বাবধানে (আমার তাই মনে হয়) সাম্প্রদায়িকতা নামে একটি বই লিখেছিলেন। কেন জানি না রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক আমার চেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন হলেও উমর সাহেব তার লেখা বইটি অন্য কাউকে না দিয়ে আমাকে দিয়েছিলেন সমালোচনা করতে। আমি তার বইয়ের সমালোচনা করে ঢাকার তখনকার মাসিক সমকাল পত্রিকায় ছাপিয়েছিলাম; কিন্তু আমার সমালোচনা বদরউদ্দীন উমর সাহেবের মনে সৃষ্টি করেছিল খুবই বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কেননা আমি বলেছিলাম, এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার জন্য কেবল মুসলমানদেরই দায়ী করা ঐতিহাসিক বাস্তবতা নয়। বদরউদ্দীন উমর সাহেব তার বইয়ে বলেন, সিপাহি বিদ্রোহ নাকি ছিল একটি প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তবাদী অভ্যুত্থান। যেটাকে আমি সমর্থন করতে পারিনি। পরে জেনেছিলাম তার এই অভিমত সালাহউদ্দীন সাহেবও পোষণ করেন; কিন্তু সিপাহি অভ্যুত্থানের পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছিল সারা উত্তর ভারতের মানুষ। সিপাহি অভ্যুত্থান জনসমর্থনবিহীন ছিল না। পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু তার বিখ্যাত ঞযব উরংপড়াবৎু ড়ভ ওহফরধ বইয়ে বলেছেন, সিপাহি বিদ্রোহ ছিল মতাচ্যুত ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক রাজন্যবর্গের মতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা; কিন্তু আধুনিককালের গবেষণা থেকে এরকম বক্তব্যের আর সমর্থন মিলছে না। কেননা, অধিকাংশ সামন্ত রাজা বিদ্রোহকে সমর্থন দিতে চাননি। নিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনেরই প। অন্য দিকে কার্ল মার্কস সিপাহি বিদ্রোহকে বলেছিলেন ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধ। বদরউদ্দীন উমর সাহেব এ সময় নিজেকে কিছুটা মার্কসবাদী বলে দাবি করতেন; কিন্তু তার জানা ছিল না, মার্কস নিজে সিপাহি বিদ্রোহ সম্পর্কে কী বলেছেন। অনেক দিনের কথা। এসব কথা আমার মনে আসছে, কারণ পরবর্তীকালে বদরউদ্দীন উমর পরিচিতি পেয়েছেন একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তক হিসেবে। আর তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃপ্রতিম সালাহউদ্দীন সাহেব খ্যাতি লাভ করেছেন একজন প্রথম শ্রেণীর ইতিহাসবেত্তা হিসেবে।
আমি ইতিহাসের গবেষক নই। ইতিহাস পড়েছিলাম নিজেকে কিছুটা আলোকিত করার জন্য। আমি সালাহউদ্দীন সাহেবের কোনো সমালোচনা করতে চাচ্ছি না। কেবল তুলে ধরতে চাচ্ছি তার ও তার ঘনিষ্ঠ সাথীদের সম্পর্কে আমার মনে জমে থাকা কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি। এই লেখাটিকে কোনোভাবেই উল্লেখ করা উচিত হবে না সালাহউদ্দীন সাহেবের মূল্যায়ন হিসেবে। আমি সে যোগ্যতা রাখি না।
প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
No comments