কেনার দামে বিমান লিজ by মুজিব মাসুদ
সেই ইজিপ্ট এয়ারলাইন্স থেকে আরও দুটি এয়ারক্রাফট লিজ নিয়েছে বাংলাদেশ বিমান। অভ্যন্তরীণ রুট পরিচালনার অজুহাতে উড়োজাহাজ দুটি পাঁচ বছরের জন্য ভাড়া নেয়া হয়। এ দুটি আগামী মাসেই বিমানবহরে যুক্ত হবে। দুটির জন্য বিমানকে প্রায় চারশ’ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। অথচ এই টাকায় চারটি এয়ারক্রাফট কেনা সম্ভব। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কম ভাড়ায় এয়ারক্রাফট পাওয়া গেলেও বিমান তা গ্রহণ করেনি। উল্টো ত্রুটিপূর্ণ দরদাতার কাছ থেকেই জাহাজ ভাড়া নেয়ার নেপথ্যে বড় অংকের লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। ইজিপ্ট এয়ারলাইন্সের দুই এয়ারক্রাফট ভাড়া নেয়ায় বিমানের ৯ মাসে ২১০ কোটি টাকা গচ্চা গেছে। হজের পর জাহাজ দুটির পেছনে প্রতি মাসে ২৪ কোটি টাকা লোকসান হবে। এতকিছু জেনেও সেই ইজিপ্ট এয়ারলাইন্স থেকেই বিমান কর্তৃপক্ষ কেন আরও দুটি এয়ারক্রাফট লিজ নিচ্ছে তা নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠছে।
বিমান এমডি ক্যাপ্টেন (অব.) মোসাদ্দেক আহম্মেদ এসব বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, অভ্যন্তরীণ রুট চালুর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, মন্ত্রণালয়, সংসদীয় কমিটি, জাতীয় সংসদের এমপি মহোদয়গণ থেকে শুরু করে মানুষের গণদাবি ছিল। এ কারণে দ্রুত অভ্যন্তরীণ রুট পরিচালনার জন্য এয়ারক্রাফট দুটি লিজ নিয়েছেন। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত সাত দফা দরপত্র দিয়েও উড়োজাহাজ পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ একটি পাওয়া গেলেও ইন্সফেকশন পর্যায়ে গিয়ে দেখা গেছে, ওই কোম্পানির কোনো জাহাজ নেই। যে কারণে বাধ্য হয়ে তারা এই এয়ারক্রাফট দুটি নিয়েছেন। তিনি বলেন, লিজ প্রক্রিয়ায় সব ধরনের স্বচ্ছতা রক্ষা করা হয়েছে। দরপত্রে লিজদাতা কোম্পানি প্রতিটি এয়ারক্রাফটের ভাড়া মাসে ১ লাখ ৮৫ হাজার মার্কিন ডলার দর দিলেও নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে তারা ১ লাখ ৬৮ হাজার মার্কিন ডলার নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেন, মাত্র ৫ বছরের কম বয়সী এ ধরনের এয়ারক্রাফট কেউ এত কম দামে দিতে পারবে না। এত বেশি টাকায় ভাড়া নিয়ে অভ্যন্তরীণ রুটের অন্য এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে কিনা- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইনশাআল্লাহ পারবেন। তবে ভাড়ার টাকায় ৪টি উড়োজাহাজ ক্রয় সম্ভব- এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি বিমান এমডি।
এয়ারক্রাফট দুটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোমবাডিয়ার সূত্রে জানা গেছে, লিজের টাকায় বিমান প্রায় একই ধরনের চারটি উড়োজাহাজ কিনতে পারত, যা দিয়ে কমপক্ষে ১৫ বছর অনায়াসে বিমান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ঝুঁকিমুক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারত। বিমানের ভাড়া নেয়া ড্যাস-৮-কিউ-৪০০ সিরিজের টার্বো প্রপ উড়োজাহাজ দুটি ২০১১ সালের তৈরি।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অভ্যন্তরীণ রুট পরিচালনার ক্ষেত্রে বিমানের কোনো ধরনের পরিকল্পনা নেই। বহন পরিকল্পনা, অভ্যন্তরীণ রুটের ভাড়া যাচাই-বাছাই ও অন্যান্য এয়ারলাইন্সের ব্যবসায়িক পরিকল্পনার কথা কিছুই বিবেচনায় নেয়নি বিমান কর্তৃপক্ষ। অথচ তারা দ্রুতগতিতে উড়োজাহাজ দুটি ৫ বছরের জন্য লিজ নেয়ার প্রস্তাবনা পাঠায় পরিচালনা পর্ষদে। গত সপ্তাহে বোর্ড তা অনুমোদন দেয় এবং উড়োজাহাজ দুটি ইন্সফেকশনে পাঠানোর জন্য ম্যানেজমেন্টকে নির্দেশ দেয়। জানা গেছে, ম্যানেজমেন্ট এমন এক কর্মকর্তাকে ইন্সফেকশন টিমে পাঠিয়েছেন যিনি এই দুটি উড়োজাহাজ লিজ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। যার সঙ্গে ইজিপ্ট এয়ারলাইন্সের শীর্ষ কর্মকর্তা ভিপি হাসানের (যিনি এখন বাংলাদেশে এয়ারক্রাফট লিজ সিন্ডিকেটের আন্তর্জাতিক হোতা হিসেবে পরিচিত) ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তারপরও তাকে তার পছন্দের কোম্পানি ইজিপ্ট এয়ারের উড়োজাহাজ লিজ ইন্সফেকশনে পাঠানোর বিষয়ে বিমানজুড়ে তোলপাড় উঠেছে।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইজিপ্ট এয়ারলাইন্সের নাম গোপন করে স্মার্ট এভিয়েশনের নাম দিয়ে টার্বো প্রপ উড়োজাহাজ দুটি ভাড়া নেয় বিমান। দরপত্রে স্মার্ট এভিয়েশনের নাম ব্যবহার করলেও মূলত ইজিপ্টের সেই ভিপি হাসানের সঙ্গেই সংক্রান্ত সবকিছু চূড়ান্ত হয়। আর স্মার্ট এভিয়েশন, ইজিপ্ট এয়ারের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। অভিযোগ আছে, হাসানের সঙ্গে এ দুটি টার্বো প্রপ এয়ারক্রাফট নিয়ে গোপন সমঝোতা হয়েছে চট্টগ্রামের বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার বনানীর একটি অভিজাত হোটেলে। সেখানে বিমান ম্যানেজমেন্টের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে হাসান। এরপরই দরপত্রে দেয়া দর ১ লাখ ৮৫ হাজার থেকে কমিয়ে ১ লাখ ৬৮ হাজার মার্কিন ডলারে উড়োজাহাজ দুটি ভাড়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। যদিও এর আগের দফায় দেয়া দরপত্রে বিমান ১ লাখ ২৫ হাজার টাকায় টার্বো প্রপ (কিউ-৪০০) উড়োজাহাজ পেয়েও কমিশন বাণিজ্য না হওয়ায় সেটি ভাড়া নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বর্তমান দরপত্রেও একটি কোম্পানি ১ লাখ ২০ হাজার ডলারে একটি এয়ারক্রাফট দিতে চেয়েছিল, দ্বিতীয় এয়ারক্রাফট ৬ মাসের মধ্যে একই দরে দিতে চিয়েছিল। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষ একমাত্র স্মার্ট এভিয়েশনকে রেখে বাকি ৮টি দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে নন-রেসপন্সিভ করে দেয়।
অভিযোগ- এক্ষেত্রেও বিমানের সিন্ডিকেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ভাঙিয়ে দ্রুত লিজ কার্যক্রমটি সম্পন্ন করেছে। জানা গেছে, এ অজুহাত দেখিয়ে আরএফপির (রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল) একটি মাস্ট চুক্তি (প্রধান শর্ত) পর্যন্ত ভঙ্গ করা হয়েছে। শিথিল করা হয়েছে চুক্তির আরও অনেকগুলো শর্ত। বিমান বোর্ডের ১০৭তম সভার জন্য তৈরি করা খোদ বোর্ড পেপার থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। বোর্ড পেপারে দরপত্রের ‘বেসিক টার্ম অ্যান্ড কমিশন’ বিভাগের ৫ নম্বর প্যারার ‘হেভি মেনটেনেন্স চেক’ সংক্রান্ত শর্তের কথা উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডেলিভারির তারিখ থেকে ২ বছরের মধ্যে ‘হেভি মেনটেনেন্স চেক’ করা যাবে না। কিন্তু দেখা গেছে, ২০১৬ সালের জুন ও সেপ্টেম্বর মাসে দুটি জাহাজেরই হেভি চেক (সি চেক, ডি চেক, এয়ারক্রাফট ওভারহোলিং, ইঞ্জিন ওভারহোলিং, ল্যান্ডিং গিয়ার ওভারহোলি) করতে হবে। বোর্ড পেপারে আরও বলা হয়েছে, এয়ারক্রাফট দুটির হেভি চেক ২ বছর পর করা যাবে কিনা এ বিষয়ে বিমান থেকে স্মার্ট এভিয়েশনের কাছে জানতে চাওয়া হলেও তা সম্ভব নয় বলে তারা নাকচ করে দিয়েছে। বোর্ড পেপারে স্পষ্ট বলা হয়েছে, দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী প্রথম দফায়ই স্মার্ট এভিয়েশন নন-রেসপন্সিভ হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্মার্ট এভিয়েশন তাদের আরএফপিতে উড়োজাহাজ দুটির উৎপাদনের তারিখ, এ সংক্রান্ত কাগজপত্র, মালিকানা সংক্রান্ত কাগজপত্র, ড্রাই লিজ অনুযায়ী ডেলিভারি সিডিউল, আইটেম অনুসারে মেনটেনেন্স সংক্রান্ত দরসহ কোনো ধরনের জরুরি কাগজপত্র দেয়নি। নিয়ম অনুযায়ী কোনো দরপত্রে এ ধরনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকলে শুরুতেই দরপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বোর্ড সাবকমিটি ও টেকনো কমিটি এমনকি দরপত্র যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত কমিটির কেউ তাদের নন-রেসপন্সিভ করেনি। উল্টো ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং শামীম নজরুলের নির্দেশে পরিকল্পনা বিভাগ অতি উৎসাহী হয়ে নিজেরাই সেসব কাগজপত্র সংগ্রহ করে দরপত্রে সংযোজন করেছেন। ঘরে বসে সব কাগজপত্র তৈরি করে দরপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। এ ধরনের কার্যক্রম বিমানের ইতিহাসে নজিরবিহীন ছিল বলে অনেকে মনে করছেন। কিন্তু বিমান সিন্ডিকেট ও প্ল্যানিং বিভাগ তা না করে উল্টো একমাত্র স্মার্ট এভিয়েশনকে রেসপন্সিভ করে বাকি ৮টি অপারেটরকে নন-রেসপন্সিভ করে স্মার্ট এভিয়েশনকে কাজটি পাইয়ে দেয়ার সব দরজা খুলে দেয়।
বিমানের ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং শামীম নজরুল এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, বিমানের স্বার্থেই তিনি ইজিপ্টের সঙ্গে উড়োজাহাজ লিজ নেয়ার লিয়াজোঁ করেছেন। এখানে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি। যাতে দ্রুতগতিতে জাহাজগুলো বিমানের বহরে যোগ হয় সেজন্য তিনি ফাইল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছেন। এই জাহাজগুলো যদি সে সময় না নেয়া হতো তাহলে এতদিনে বিমান বন্ধ হয়ে যেত বলেও তিনি দাবি করেন।
ভাড়ার টাকায় দুটি উড়োজাহাজ ক্রয় সম্ভব : অভ্যন্তরীণ রুটে বর্তমানে বিমানের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে ইউএস বাংলা, রিজেন্ট ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরীণ রুট পরিচালনার জন্য যে ধরনের উড়োজাহাজ এনেছে তাতে তারা অনেক কম ভাড়ায় ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারছে। বেসরকারি একটি বিমান সংস্থা সম্প্রতি কিউ-৪০০ মডেলের দুটি উড়োজাহাজ কিনেছে। প্রতিটির দাম পড়েছে সাড়ে ৭ মিলিয়ন ডলার। অভ্যন্তরীণ রুটের জন্য বিমান একই মডেলের যে দুটি উড়োজাহাজ ভাড়া নিয়েছে সেগুলোর প্রতিটির জন্য মাসে পরিশোধ করতে হবে ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এছাড়া মেনটেনেন্স রিজার্ভ ও ক্রুসহ আরও খরচ হবে ১ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ৫ বছর পর বিমান উড়োজাহাজ দুটিকে একদিকে ফেরত দিতে হবে অপরদিকে ভাড়া গুনতে হবে প্রতিটির জন্য মেনটেনেন্স রিজার্ভ, রি-ডেলিভারি পেমেন্টসহ সব মিলিয়ে গড়ে ২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার। দুটি উড়োজাহাজের পেছনে খরচ হবে ৫০ মিলিয়ন ডলার। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই খরচে বিমান কমপক্ষে ৪টি ডেস-৮০, কিউ ৪০০ মডেলের এয়ারক্রাফট ক্রয় করতে পারত। তবে উড়োজাহাজগুলোর বয়স এগুলোর তুলনায় কিছুটা বেশি হবে। জানা গেছে, বিমান যে দুটি উড়োজাহাজ ভাড়া নিচ্ছে সেগুলো অপেক্ষাকৃত নতুন ও উন্নতমানের। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশীয় অন্য উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে এত বেশি দামে নতুন এয়ারক্রাফট এনে কোনো কূলই রক্ষা করতে পারবে না বিমান। এতে প্রতিযোগিতা থেকে দ্রুত সিটকে পড়তে হবে সরকারি এই সংস্থাটিকে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ভাড়া বেশি হলে গ্রাহকরা বিমানের টিকিট কিনবে না। ফ্লাইটে আসন খালি যাবে। আর এক পর্যায়ে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে বিমানকে। তাদের মতে, বিমান যদি অন্তত ১০ বছরের পুুরনো উড়োজাহাজও কিনত তবে প্রতি উড়োজাহাজের দাম পড়ত গড়ে ৮ থেকে ১০ লাখ মিলিয়ন ইউএস ডলার। এতে বিমান গ্রাহকদের কাছে ভাড়া নিতে পারত কম আর উড়োজাহাজ দুটি নিজস্ব সম্পদ হতো। কিন্তু কমিশন বাণিজ্যের লোভে বিমান ম্যানেজমেন্ট এয়ারক্রাফট ক্রয় না করে লিজ নিয়েছে। খোদ মার্কেটিং বিভাগ বলছে, বর্তমানে আনা উড়োজাহাজগুলো চালিয়ে লাভ করতে হলে বিমানকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে অন্যান্য এয়ারলাইন্সের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি ভাড়া নিতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ নীতিনির্ধারকের সঙ্গে ইজিপ্টের হাসানের একাধিক বৈঠক : বিমান মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ নীতিনির্ধারকের সঙ্গেও এ দুটি উড়োজাহাজ কেনা নিয়ে ইজিপ্টের ভিপি হাসানের পরপর দুই দফায় বৈঠক হয়েছে। বিমানের ট্রেনিং বিভাগের একজন কর্মকর্তার সহযোগিতায় জনৈক মাহবুব নামের এক ব্যক্তির মধ্যস্থতায় সরকারের ওই শীর্ষ নীতিনির্ধারকের সচিবালয়ের কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জানা গেছে, ভিপি হাসান এজন্য মাহবুব সিন্ডিকেটকে তার চারটি উড়োজাহাজের লোকাল এজেন্ট নিয়োগের লোভ দেখিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের ওই শীর্ষ ব্যক্তির সঙ্গে ভিপি হাসানের বড় ধরনের আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং হতে পারে। যার কারণে ইজিপ্ট এয়ার থেকে আনা বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজ দুটি ফেরত দিতেও বিমান মন্ত্রণালয় গড়িমসি করছে।
বিমান এমডি ক্যাপ্টেন (অব.) মোসাদ্দেক আহম্মেদ এসব বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, অভ্যন্তরীণ রুট চালুর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, মন্ত্রণালয়, সংসদীয় কমিটি, জাতীয় সংসদের এমপি মহোদয়গণ থেকে শুরু করে মানুষের গণদাবি ছিল। এ কারণে দ্রুত অভ্যন্তরীণ রুট পরিচালনার জন্য এয়ারক্রাফট দুটি লিজ নিয়েছেন। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত সাত দফা দরপত্র দিয়েও উড়োজাহাজ পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ একটি পাওয়া গেলেও ইন্সফেকশন পর্যায়ে গিয়ে দেখা গেছে, ওই কোম্পানির কোনো জাহাজ নেই। যে কারণে বাধ্য হয়ে তারা এই এয়ারক্রাফট দুটি নিয়েছেন। তিনি বলেন, লিজ প্রক্রিয়ায় সব ধরনের স্বচ্ছতা রক্ষা করা হয়েছে। দরপত্রে লিজদাতা কোম্পানি প্রতিটি এয়ারক্রাফটের ভাড়া মাসে ১ লাখ ৮৫ হাজার মার্কিন ডলার দর দিলেও নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে তারা ১ লাখ ৬৮ হাজার মার্কিন ডলার নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেন, মাত্র ৫ বছরের কম বয়সী এ ধরনের এয়ারক্রাফট কেউ এত কম দামে দিতে পারবে না। এত বেশি টাকায় ভাড়া নিয়ে অভ্যন্তরীণ রুটের অন্য এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে কিনা- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইনশাআল্লাহ পারবেন। তবে ভাড়ার টাকায় ৪টি উড়োজাহাজ ক্রয় সম্ভব- এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি বিমান এমডি।
এয়ারক্রাফট দুটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোমবাডিয়ার সূত্রে জানা গেছে, লিজের টাকায় বিমান প্রায় একই ধরনের চারটি উড়োজাহাজ কিনতে পারত, যা দিয়ে কমপক্ষে ১৫ বছর অনায়াসে বিমান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ঝুঁকিমুক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারত। বিমানের ভাড়া নেয়া ড্যাস-৮-কিউ-৪০০ সিরিজের টার্বো প্রপ উড়োজাহাজ দুটি ২০১১ সালের তৈরি।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অভ্যন্তরীণ রুট পরিচালনার ক্ষেত্রে বিমানের কোনো ধরনের পরিকল্পনা নেই। বহন পরিকল্পনা, অভ্যন্তরীণ রুটের ভাড়া যাচাই-বাছাই ও অন্যান্য এয়ারলাইন্সের ব্যবসায়িক পরিকল্পনার কথা কিছুই বিবেচনায় নেয়নি বিমান কর্তৃপক্ষ। অথচ তারা দ্রুতগতিতে উড়োজাহাজ দুটি ৫ বছরের জন্য লিজ নেয়ার প্রস্তাবনা পাঠায় পরিচালনা পর্ষদে। গত সপ্তাহে বোর্ড তা অনুমোদন দেয় এবং উড়োজাহাজ দুটি ইন্সফেকশনে পাঠানোর জন্য ম্যানেজমেন্টকে নির্দেশ দেয়। জানা গেছে, ম্যানেজমেন্ট এমন এক কর্মকর্তাকে ইন্সফেকশন টিমে পাঠিয়েছেন যিনি এই দুটি উড়োজাহাজ লিজ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। যার সঙ্গে ইজিপ্ট এয়ারলাইন্সের শীর্ষ কর্মকর্তা ভিপি হাসানের (যিনি এখন বাংলাদেশে এয়ারক্রাফট লিজ সিন্ডিকেটের আন্তর্জাতিক হোতা হিসেবে পরিচিত) ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তারপরও তাকে তার পছন্দের কোম্পানি ইজিপ্ট এয়ারের উড়োজাহাজ লিজ ইন্সফেকশনে পাঠানোর বিষয়ে বিমানজুড়ে তোলপাড় উঠেছে।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইজিপ্ট এয়ারলাইন্সের নাম গোপন করে স্মার্ট এভিয়েশনের নাম দিয়ে টার্বো প্রপ উড়োজাহাজ দুটি ভাড়া নেয় বিমান। দরপত্রে স্মার্ট এভিয়েশনের নাম ব্যবহার করলেও মূলত ইজিপ্টের সেই ভিপি হাসানের সঙ্গেই সংক্রান্ত সবকিছু চূড়ান্ত হয়। আর স্মার্ট এভিয়েশন, ইজিপ্ট এয়ারের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। অভিযোগ আছে, হাসানের সঙ্গে এ দুটি টার্বো প্রপ এয়ারক্রাফট নিয়ে গোপন সমঝোতা হয়েছে চট্টগ্রামের বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার বনানীর একটি অভিজাত হোটেলে। সেখানে বিমান ম্যানেজমেন্টের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে হাসান। এরপরই দরপত্রে দেয়া দর ১ লাখ ৮৫ হাজার থেকে কমিয়ে ১ লাখ ৬৮ হাজার মার্কিন ডলারে উড়োজাহাজ দুটি ভাড়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। যদিও এর আগের দফায় দেয়া দরপত্রে বিমান ১ লাখ ২৫ হাজার টাকায় টার্বো প্রপ (কিউ-৪০০) উড়োজাহাজ পেয়েও কমিশন বাণিজ্য না হওয়ায় সেটি ভাড়া নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বর্তমান দরপত্রেও একটি কোম্পানি ১ লাখ ২০ হাজার ডলারে একটি এয়ারক্রাফট দিতে চেয়েছিল, দ্বিতীয় এয়ারক্রাফট ৬ মাসের মধ্যে একই দরে দিতে চিয়েছিল। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষ একমাত্র স্মার্ট এভিয়েশনকে রেখে বাকি ৮টি দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে নন-রেসপন্সিভ করে দেয়।
অভিযোগ- এক্ষেত্রেও বিমানের সিন্ডিকেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ভাঙিয়ে দ্রুত লিজ কার্যক্রমটি সম্পন্ন করেছে। জানা গেছে, এ অজুহাত দেখিয়ে আরএফপির (রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল) একটি মাস্ট চুক্তি (প্রধান শর্ত) পর্যন্ত ভঙ্গ করা হয়েছে। শিথিল করা হয়েছে চুক্তির আরও অনেকগুলো শর্ত। বিমান বোর্ডের ১০৭তম সভার জন্য তৈরি করা খোদ বোর্ড পেপার থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। বোর্ড পেপারে দরপত্রের ‘বেসিক টার্ম অ্যান্ড কমিশন’ বিভাগের ৫ নম্বর প্যারার ‘হেভি মেনটেনেন্স চেক’ সংক্রান্ত শর্তের কথা উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডেলিভারির তারিখ থেকে ২ বছরের মধ্যে ‘হেভি মেনটেনেন্স চেক’ করা যাবে না। কিন্তু দেখা গেছে, ২০১৬ সালের জুন ও সেপ্টেম্বর মাসে দুটি জাহাজেরই হেভি চেক (সি চেক, ডি চেক, এয়ারক্রাফট ওভারহোলিং, ইঞ্জিন ওভারহোলিং, ল্যান্ডিং গিয়ার ওভারহোলি) করতে হবে। বোর্ড পেপারে আরও বলা হয়েছে, এয়ারক্রাফট দুটির হেভি চেক ২ বছর পর করা যাবে কিনা এ বিষয়ে বিমান থেকে স্মার্ট এভিয়েশনের কাছে জানতে চাওয়া হলেও তা সম্ভব নয় বলে তারা নাকচ করে দিয়েছে। বোর্ড পেপারে স্পষ্ট বলা হয়েছে, দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী প্রথম দফায়ই স্মার্ট এভিয়েশন নন-রেসপন্সিভ হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্মার্ট এভিয়েশন তাদের আরএফপিতে উড়োজাহাজ দুটির উৎপাদনের তারিখ, এ সংক্রান্ত কাগজপত্র, মালিকানা সংক্রান্ত কাগজপত্র, ড্রাই লিজ অনুযায়ী ডেলিভারি সিডিউল, আইটেম অনুসারে মেনটেনেন্স সংক্রান্ত দরসহ কোনো ধরনের জরুরি কাগজপত্র দেয়নি। নিয়ম অনুযায়ী কোনো দরপত্রে এ ধরনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকলে শুরুতেই দরপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বোর্ড সাবকমিটি ও টেকনো কমিটি এমনকি দরপত্র যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত কমিটির কেউ তাদের নন-রেসপন্সিভ করেনি। উল্টো ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং শামীম নজরুলের নির্দেশে পরিকল্পনা বিভাগ অতি উৎসাহী হয়ে নিজেরাই সেসব কাগজপত্র সংগ্রহ করে দরপত্রে সংযোজন করেছেন। ঘরে বসে সব কাগজপত্র তৈরি করে দরপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। এ ধরনের কার্যক্রম বিমানের ইতিহাসে নজিরবিহীন ছিল বলে অনেকে মনে করছেন। কিন্তু বিমান সিন্ডিকেট ও প্ল্যানিং বিভাগ তা না করে উল্টো একমাত্র স্মার্ট এভিয়েশনকে রেসপন্সিভ করে বাকি ৮টি অপারেটরকে নন-রেসপন্সিভ করে স্মার্ট এভিয়েশনকে কাজটি পাইয়ে দেয়ার সব দরজা খুলে দেয়।
বিমানের ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং শামীম নজরুল এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, বিমানের স্বার্থেই তিনি ইজিপ্টের সঙ্গে উড়োজাহাজ লিজ নেয়ার লিয়াজোঁ করেছেন। এখানে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি। যাতে দ্রুতগতিতে জাহাজগুলো বিমানের বহরে যোগ হয় সেজন্য তিনি ফাইল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছেন। এই জাহাজগুলো যদি সে সময় না নেয়া হতো তাহলে এতদিনে বিমান বন্ধ হয়ে যেত বলেও তিনি দাবি করেন।
ভাড়ার টাকায় দুটি উড়োজাহাজ ক্রয় সম্ভব : অভ্যন্তরীণ রুটে বর্তমানে বিমানের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে ইউএস বাংলা, রিজেন্ট ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরীণ রুট পরিচালনার জন্য যে ধরনের উড়োজাহাজ এনেছে তাতে তারা অনেক কম ভাড়ায় ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারছে। বেসরকারি একটি বিমান সংস্থা সম্প্রতি কিউ-৪০০ মডেলের দুটি উড়োজাহাজ কিনেছে। প্রতিটির দাম পড়েছে সাড়ে ৭ মিলিয়ন ডলার। অভ্যন্তরীণ রুটের জন্য বিমান একই মডেলের যে দুটি উড়োজাহাজ ভাড়া নিয়েছে সেগুলোর প্রতিটির জন্য মাসে পরিশোধ করতে হবে ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এছাড়া মেনটেনেন্স রিজার্ভ ও ক্রুসহ আরও খরচ হবে ১ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ৫ বছর পর বিমান উড়োজাহাজ দুটিকে একদিকে ফেরত দিতে হবে অপরদিকে ভাড়া গুনতে হবে প্রতিটির জন্য মেনটেনেন্স রিজার্ভ, রি-ডেলিভারি পেমেন্টসহ সব মিলিয়ে গড়ে ২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার। দুটি উড়োজাহাজের পেছনে খরচ হবে ৫০ মিলিয়ন ডলার। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই খরচে বিমান কমপক্ষে ৪টি ডেস-৮০, কিউ ৪০০ মডেলের এয়ারক্রাফট ক্রয় করতে পারত। তবে উড়োজাহাজগুলোর বয়স এগুলোর তুলনায় কিছুটা বেশি হবে। জানা গেছে, বিমান যে দুটি উড়োজাহাজ ভাড়া নিচ্ছে সেগুলো অপেক্ষাকৃত নতুন ও উন্নতমানের। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশীয় অন্য উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে এত বেশি দামে নতুন এয়ারক্রাফট এনে কোনো কূলই রক্ষা করতে পারবে না বিমান। এতে প্রতিযোগিতা থেকে দ্রুত সিটকে পড়তে হবে সরকারি এই সংস্থাটিকে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ভাড়া বেশি হলে গ্রাহকরা বিমানের টিকিট কিনবে না। ফ্লাইটে আসন খালি যাবে। আর এক পর্যায়ে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে বিমানকে। তাদের মতে, বিমান যদি অন্তত ১০ বছরের পুুরনো উড়োজাহাজও কিনত তবে প্রতি উড়োজাহাজের দাম পড়ত গড়ে ৮ থেকে ১০ লাখ মিলিয়ন ইউএস ডলার। এতে বিমান গ্রাহকদের কাছে ভাড়া নিতে পারত কম আর উড়োজাহাজ দুটি নিজস্ব সম্পদ হতো। কিন্তু কমিশন বাণিজ্যের লোভে বিমান ম্যানেজমেন্ট এয়ারক্রাফট ক্রয় না করে লিজ নিয়েছে। খোদ মার্কেটিং বিভাগ বলছে, বর্তমানে আনা উড়োজাহাজগুলো চালিয়ে লাভ করতে হলে বিমানকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে অন্যান্য এয়ারলাইন্সের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি ভাড়া নিতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ নীতিনির্ধারকের সঙ্গে ইজিপ্টের হাসানের একাধিক বৈঠক : বিমান মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ নীতিনির্ধারকের সঙ্গেও এ দুটি উড়োজাহাজ কেনা নিয়ে ইজিপ্টের ভিপি হাসানের পরপর দুই দফায় বৈঠক হয়েছে। বিমানের ট্রেনিং বিভাগের একজন কর্মকর্তার সহযোগিতায় জনৈক মাহবুব নামের এক ব্যক্তির মধ্যস্থতায় সরকারের ওই শীর্ষ নীতিনির্ধারকের সচিবালয়ের কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জানা গেছে, ভিপি হাসান এজন্য মাহবুব সিন্ডিকেটকে তার চারটি উড়োজাহাজের লোকাল এজেন্ট নিয়োগের লোভ দেখিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের ওই শীর্ষ ব্যক্তির সঙ্গে ভিপি হাসানের বড় ধরনের আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং হতে পারে। যার কারণে ইজিপ্ট এয়ার থেকে আনা বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজ দুটি ফেরত দিতেও বিমান মন্ত্রণালয় গড়িমসি করছে।
No comments