মানবজীবন by মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
মানুষের মন বড়ই বিচিত্র। মানুষের জীবনও বিচিত্র। যিনি ১০০ বছর বা ৮০-৯০ বছর পর্যন্ত বাঁচেন তার জীবন বৈচিত্র্যে ভরা। আমার বয়সও নেহায়েত কম হল না। ৬৪ বছর পার করতে চলেছি। আমার মা ৮৬-৮৭ বছর বয়সে মারা গেলেন। তার জীবনও বৈচিত্র্যে ভরা ছিল। জীবন সংসারে তিনি একজন সংগ্রামী নারী ছিলেন। ১৯২৭ সালে তার জন্ম। ব্রিটিশরা এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় তার বয়স ছিল ২০ বছর। ততদিনে তিনি ব্রিটিশ শাসনের অনেক কিছু দেখে ফেলেছেন। তার এবং আমার উভয়েরই জন্ম পাবনা শহরের পশ্চিম-দক্ষিণে সে সময়ের প্রমত্তা পদ্মা নদীর ধারে। জায়গাটির নাম বাজিতপুর ঘাট। এ বাজিতপুর ঘাটের ঐতিহাসিক ঘটনা প্রায়ই মা আমাকে বলতেন। বলতেন, বড়লাটকে (গভর্নর) উত্তরবঙ্গে ঢুকতে হলে পদ্মা নদীর এই ঘাটকেই ব্যবহার করতে হতো। স্টিমার এসে ঘাটে ভিড়লে যে বটগাছটার সঙ্গে বাঁধা হতো সে গাছটা এখনও আছে। ২০০ বছরের বুড়ো বটগাছটি এখনও দাঁত বের করে হাসে। তার ডাল-পালা এখনও মানুষকে ছায়া দেয়। ছেলেবেলায় আমরা এ বটগাছের শেকড়ের ওপর বসে আড্ডা দিতাম। সে আজ প্রায় ৬০ বছর আগের কথা। তখন এলাকায় ক্লাব বা আড্ডা জমানোর কোনো জায়গা ছিল না। বটগাছটার উত্তর দিকে একটি বিরাট দোকান ছিল। তখনকার ওই দোকানটিকে বর্তমানকালের একটি ডিপার্টমেন্ট স্টোরের সঙ্গে তুলনা করা চলে। কারণ সে দোকানে আলকাতরা থেকে শুরু করে সুঁই-সুতাসহ শতেক রকমের সওদা পাওয়া যেত। পদ্মা নদীতে মাছ ধরা জেলে নৌকাগুলো ভিড়িয়ে তেল, নুন, চাল, ডাল, আলকাতরা, কেরোসিন কিনত। এ নৌকাগুলো আবার প্রচুর ইলিশ ধরে সকালবেলা কূলে ভিড়ত। মা আমার হাতে একটি সিকি (চার আনা) ধরিয়ে দিয়ে একটা মাছ আনতে বলতেন। আমি ততক্ষণে গিয়ে দেখতাম নৌকার পাশে বয়স্ক লোকরা ভিড় করেছেন। তারা লম্বায় আমার দ্বিগুণ হওয়ায় আমি নৌকার কাছে ভিড়তে পারতাম না। শেষে কেউ বলতেন, ছেলেটাকে একটা মাছ নিতে দাও। সে সুযোগে চার আনায় একটা ইলিশ কিনে ঘরে ফিরতাম। মায়ের হাতের সে ইলিশ রান্নার তুলনা হয় না। বাড়ির আঙিনার তরকারি বাগানের চালকুমড়া বা বেগুন দিয়ে ইলিশ রান্না হতো। কত মজা করেই না সেসব রান্না খেয়েছি। সেই মা আমার ১৫ অক্টোবর হঠাৎ করে মারা গেলেন। সকালে তিনি প্রাতঃভ্রমণ করেছেন। দুপুরে নিজ হাতে রান্না করে খেয়েছেন। বিকালে হঠাৎ করেই মৃত্যু সংবাদ। আমার কাছে সংবাদটি ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। কারণ কদিন আগেই ঈদের সময় পাবনা গেলে তিনি সামনের চেয়ারটায় বসে আমার মাথা টেনে নিয়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। মাথায় ফুঁ দিয়ে দোয়া করলেন। আমি ছেলেবেলায় নদীতে সাঁতরাতাম এজন্য সে সময়ই আমার বুকে ঠাণ্ডা লেগে এখন ফুসফুসে সমস্যা হচ্ছে একথা বলে সাবধানে থাকতে বললেন। সে মাকেই কবরে রেখে আসার সময় ভাবলাম এই তো মানুষের জীবন। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মাকে বলে এলাম, মা তুমি ঘুমাও, আমরা যতদিন বেঁচে থাকব তোমার জন্য দোয়া করব। মহান আল্লাহর উদ্দেশে বললাম, আমার মায়ের কবরখানাকে যেন তিনি বেহেশত বানিয়ে দেন। তার কবরের সঙ্গে যেন বেহেশতের সংযোগ ঘটিয়ে দেন। একই গোরস্থানে আমার বাবাও শায়িত আছেন। তার উদ্দেশেও একই প্রার্থনা জানালাম।
আগেই বলেছি, আমার বয়সও ৬৪ পার হতে চলেছে। এ বয়সে আমি বেশ কয়েকটি রোগে আক্রান্ত। যার মধ্যে অন্যতম ফুসফুসের সংক্রমণ। মন খারাপ থাকলে শরীরও খারাপ হয়ে পড়ে। মা হারানোর শোকে আমার শরীর বেশ খারাপ হয়ে পড়ল। মাঝে মধ্যে শরীর কাঁপতে শুরু করল। সে অবস্থা একটুখানি সামাল দিয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি টিকিট কেটে দুদিনের জন্য সিঙ্গাপুর গেলাম। খুব সকালে রওনা করে বিকালে ডাক্তার দেখিয়ে হোটেলে ঢুকলাম। আলবার্ট কোর্ট ভিলেজ হোটেলে অনলাইনে বুকিং দিয়ে গিয়েছিলাম। রুমে ঢুকে বিশ্রাম নিয়ে রাত ৯টার দিকে নিচে নামলাম। হোটেলটির মাঝখানে বেশ খানিকটা চওড়া খোলা জায়গা। দুই পাশে হোটেল ভবন। মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় কিছু বামন তালগাছ। তার নিচেই চেয়ার-টেবিল পাতা। দুই পাশের হোটেল ভবনের নিচতলায় তিনটি করে রেস্টুরেন্ট। মাঝের ফাঁকা জায়গায় প্রচুর মানুষ খাবার খাচ্ছেন আর বিয়ার পান করছেন।
আবার মায়ের কথায় ফিরে আসি। আমার এবং মায়ের জন্মস্থান বাজিতপুর ঘাট ব্রিটিশ আমলে একটি ঐতিহাসিক নদীবন্দর ছিল। পাকিস্তান আমলে আমিও সে নদীবন্দরে হাজার-মণি নাও, লঞ্চ, স্টিমার ভিড়তে দেখেছি। সেই বাজিতপুর ঘাটে স্টিমার থেকে বড়লাট নামলে লাল পাগড়ি পরা পুলিশরা রাস্তার দুধারে কেমন দাঁড়িয়ে থাকত এবং বড়লাট কীভাবে যেতেন, মা আমাকে সে গল্প শোনাতেন। বটগাছটার সঙ্গে বড়লাটের স্টিমারকে শেকল দিয়ে কীভাবে বাঁধা হতো তাও বলতেন। সেই বটগাছটা এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ আমার মা নেই।
এই হল মানুষের জীবন। এটাই বাস্তবতা। তবুও মন মানে না। কারণ পুত্রের কাছে মায়ের কোনো বয়স নেই। বয়স ৮০, ৯০, ১০০ বছর যাই হোক, পুত্রের কাছে তিনি শুধুই মা। যেমন পুত্রের বয়স যত বেশিই হোক মায়ের কাছে সে সব সময়ই শিশু। জন্ম-জন্মান্তরে এটাই মাতা-পুত্রের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান। আর এ মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান নিয়েই আবহমানকাল ধরে মানবজীবন আবর্তিত হয়ে চলেছে। সব পাঠকের কাছে আমার মায়ের জন্য দোয়া চেয়ে লেখাটি শেষ করছি।
মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : মুক্তিযোদ্ধা ও কলাম লেখক
আগেই বলেছি, আমার বয়সও ৬৪ পার হতে চলেছে। এ বয়সে আমি বেশ কয়েকটি রোগে আক্রান্ত। যার মধ্যে অন্যতম ফুসফুসের সংক্রমণ। মন খারাপ থাকলে শরীরও খারাপ হয়ে পড়ে। মা হারানোর শোকে আমার শরীর বেশ খারাপ হয়ে পড়ল। মাঝে মধ্যে শরীর কাঁপতে শুরু করল। সে অবস্থা একটুখানি সামাল দিয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি টিকিট কেটে দুদিনের জন্য সিঙ্গাপুর গেলাম। খুব সকালে রওনা করে বিকালে ডাক্তার দেখিয়ে হোটেলে ঢুকলাম। আলবার্ট কোর্ট ভিলেজ হোটেলে অনলাইনে বুকিং দিয়ে গিয়েছিলাম। রুমে ঢুকে বিশ্রাম নিয়ে রাত ৯টার দিকে নিচে নামলাম। হোটেলটির মাঝখানে বেশ খানিকটা চওড়া খোলা জায়গা। দুই পাশে হোটেল ভবন। মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় কিছু বামন তালগাছ। তার নিচেই চেয়ার-টেবিল পাতা। দুই পাশের হোটেল ভবনের নিচতলায় তিনটি করে রেস্টুরেন্ট। মাঝের ফাঁকা জায়গায় প্রচুর মানুষ খাবার খাচ্ছেন আর বিয়ার পান করছেন।
আবার মায়ের কথায় ফিরে আসি। আমার এবং মায়ের জন্মস্থান বাজিতপুর ঘাট ব্রিটিশ আমলে একটি ঐতিহাসিক নদীবন্দর ছিল। পাকিস্তান আমলে আমিও সে নদীবন্দরে হাজার-মণি নাও, লঞ্চ, স্টিমার ভিড়তে দেখেছি। সেই বাজিতপুর ঘাটে স্টিমার থেকে বড়লাট নামলে লাল পাগড়ি পরা পুলিশরা রাস্তার দুধারে কেমন দাঁড়িয়ে থাকত এবং বড়লাট কীভাবে যেতেন, মা আমাকে সে গল্প শোনাতেন। বটগাছটার সঙ্গে বড়লাটের স্টিমারকে শেকল দিয়ে কীভাবে বাঁধা হতো তাও বলতেন। সেই বটগাছটা এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ আমার মা নেই।
এই হল মানুষের জীবন। এটাই বাস্তবতা। তবুও মন মানে না। কারণ পুত্রের কাছে মায়ের কোনো বয়স নেই। বয়স ৮০, ৯০, ১০০ বছর যাই হোক, পুত্রের কাছে তিনি শুধুই মা। যেমন পুত্রের বয়স যত বেশিই হোক মায়ের কাছে সে সব সময়ই শিশু। জন্ম-জন্মান্তরে এটাই মাতা-পুত্রের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান। আর এ মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান নিয়েই আবহমানকাল ধরে মানবজীবন আবর্তিত হয়ে চলেছে। সব পাঠকের কাছে আমার মায়ের জন্য দোয়া চেয়ে লেখাটি শেষ করছি।
মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : মুক্তিযোদ্ধা ও কলাম লেখক
No comments