শুধু কি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? by পলাশ কুমার রায়
আজ বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ দিবস। ১৯৯৯ সালের শেষদিকে আপিল বিভাগ বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করতে বলেন। আপিল বিভাগের আদেশে ১২ দফা নির্দেশনাও দেয়া হয়েছিল। এরপর দীর্ঘ সাত বছরেও রাজনৈতিক সরকারগুলো বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা না করায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত নির্দেশনা মোতাবেক ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণের কাজটি করেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কত দিবসই তো আমরা নিয়মিত পালন করছি। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ দিবসও কি সে রকম? সভা-সেমিনার আর কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করার মাঝেই কি দিনটি সীমাবদ্ধ থাকবে? বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণের জন্য বহু আন্দোলন ও আইনি লড়াই করতে হয়েছে। ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে অনেককে। এতকিছুর বিনিময়ে বিচারপ্রার্থীরা এর সুফল পাচ্ছেন কিনা, তা-ই আজ আলোচনার চেষ্টা করব।
বিচারপ্রার্থীরা তাদের প্রত্যাশিত আইনি পরিষেবা পাচ্ছেন, সেটা হলফ করে বলা যাবে না। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পরও আদালতপাড়ার চিত্র যে বদলায়নি, তা জানাতে ঢাকার ব্যস্ততম আদালতপাড়ার একদিনের ঘটনাবলী তুলে ধরতে চাই। সদরঘাট সংলগ্ন ঢাকার আদালতপাড়াকে স্থানীয় অধিবাসী ভোরবেলায় মিনি পার্ক হিসেবে ব্যবহার করেন। কেউ হাঁটেন, কেউবা একটু ব্যায়াম করেন। সকাল ৮টা বাজতে না বাজতেই আদালতপাড়ার নিরাপত্তায় চলে আসে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। এরপর শুরু হয় বিচারপ্রার্থীদের আসা-যাওয়া। সকাল ৯টা বাজতেই শত শত বিচারপ্রার্থী আর তাদের আত্মীয়-স্বজন, মামলার সাক্ষী, গণমাধ্যমকর্মী, কৌতূহলী জনসাধারণে মুখর হয়ে ওঠে আদালতপাড়া। এ দৃশ্য প্রতিদিনের। প্রায় ১৫ হাজার আইনজীবী আদালতপাড়ায় আগত বিচারপ্রার্থীদের আইনি সহায়তা দিতে তৎপর। রয়েছে সরকারি কৌঁসুলি। আদালতের পেশকার-পিয়ন। রয়েছে শখানেক উমেদার, যারা সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত না হয়েও বিশ্বস্ততা বজায় রেখে আদালতে ফাইল টানাহেঁচড়া আর তদারকির কাজ করে। রয়েছে অস্থায়ী ফলের দোকানদার থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের দোকানও।
আদালতপাড়ায় আইনজীবীদের জন্য সুলভ মূল্যে খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিচারপ্রার্থীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ বিচারপ্রার্থীরা চড়া দামে দুপুরের খাবার খেলেও অপেক্ষাকৃত দরিদ্র বিচারপ্রার্থীদের অনেককে না খেয়েই থাকতে হয়। নেই পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধা। চাহিদামতো সেলামি দিতে না পারলে বিচারপ্রার্থীরা আদালত সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তির কাছেই কাক্সিক্ষত সহযোগিতা ও সমাদর পান না। দরিদ্র বিচারপ্রার্থীরা আদালতে হাজিরা দিতে এসে সেদিন আর কোনো কাজ করার সুযোগ না পাওয়ায় অনেকের পরিবারে সেদিন অন্ন জোটে না বলেও শোনা যায়।
বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হলেও বিচারপ্রার্থীরা এ থেকে কতটা সুফল পেয়েছেন তার বিচারের ভার আদালতপাড়ায় আগত বিচারপ্রার্থীদের ওপরই ছেড়ে দিলাম। তবে স্বল্প সময়ে ন্যায়বিচার না পাওয়ায় বিচারপ্রার্থীরা যে হতাশ ও ক্ষুব্ধ তা প্রায়ই শোনা যায়। দেশের আদালতগুলোতে বর্তমানে প্রায় ২৮ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগে ৩ লাখ ২৫ হাজার, জেলা ও দায়রা জজ/মহানগর দায়রা জজের আদালতে ১৪ লাখ ৮২ হাজার এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোয় ৯ লাখ ২৭ হাজার মামলা বিচারাধীন। সম্প্রতি সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ২০১৩-১৪ অর্থবছরের কার্যাবলী সম্পর্কিত আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ২৪। প্রতিবেদনে মামলা নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করতে বিচার বিভাগের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, নতুন আদালত ও ট্রাইব্যুনাল গঠন, প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। দেশের নিু আদালতগুলোয় কর্মরত ১৭০০ বিচারককে দিয়ে এত বিশালসংখ্যক মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন করা যে বেশ কঠিন তা সহজেই অনুমেয়। উচ্চ আদালত ও নিু আদালতগুলোয় প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিচারক নিয়োগ সময়ের দাবি। শুধু বিচারক নিয়োগই যথেষ্ট নয়, পেশাদার ও দায়িত্বশীল বিচারক নিয়োগ দেয়া জরুরি। কারণ নিকট অতীতে কিছু দুর্নীতিপরায়ণ বিচারকের জন্য বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। গণমাধ্যমের বদৌলতে আমরা জানতে পেরেছি, অবৈধ সম্পদ অর্জন, বিদেশে অর্থ পাচার এবং দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত বিচারকের তথ্যানুসন্ধান করছে দুদক।
আদালতে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিচারক ও আইনজীবীদের পাশাপাশি বিচারাধীন মামলার তদন্তকারী পুলিশ অফিসার এবং আদালতে কর্মরত পেশকার, সেরেস্তাদার, পিয়ন, উমেদারদেরও আন্তরিক হতে হবে। নগদ নারায়ণ ছাড়া ফাইল খুঁজে পাওয়া যায় না এবং মামলার নথি এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে যায় না। এই মনোভাব বদলাতে হবে। অনেক চতুর ও মতলববাজ পেশকার এবং সেরেস্তাদারের দৈনিক যা আয়, তা নিু আদালতের একজন বিচারকের পুরো মাসের বেতনের চেয়েও বেশি। নিু আদালতের পেশকার, পিয়নদের কাছে বিচারপ্রার্থীরা জিম্মি। শুধু বিচারপ্রার্থীরা নন, অনেক আইনজীবীও জিম্মি। প্রবীণ আইনজীবীরাও পেশকার, সেরেস্তাদার, পিয়নদের সমীহ করে চলেন কোনো সহযোগিতা না পাওয়ার আশংকায়। আদালতের কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যপনা রোধে সারা দেশের আইনজীবীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া সময়ের দাবি। নতুবা ভবিষ্যতে নবীন আইনজীবীদের চড়া মূল্য গুনতে হবে এবং বিচার বিভাগ তার স্বকীয়তা ও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। বিচারপ্রার্থীরা উকিল সাহেবকে মামলা পরিচালনার জন্য সম্মানী দেন। সেই সম্মানী থেকে পেশকার, পিয়নদের কিছু বকশিশ দিলে আপত্তির কিছু থাকত না। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি, কতিপয় আইনজীবী বিচারপ্রার্থীদের নিয়ে আদালতে যান এবং পেশকার, পিয়নদের বাড়তি সেলামি দেয়ার নির্দেশনা দেন। বিচারপ্রার্থীরা সুবিচারের আশায় আইনজীবীর নির্দেশনামতো পেশকার, পিয়নদের বাড়তি সেলামি দেন। এভাবে সেলামি দেয়ার অনিয়মটাই এখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। যে যত বেশি সেলামি দেয় সেই বিচারপ্রার্থী পেশকার, পিয়নদের কাছে খুব ভালো এবং ভদ্রলোক হিসেবে চিহ্নিত হন। বেচারা বিচারপ্রার্থীর যে পকেট খালি হচ্ছে, সেটা উপলব্ধি করবে কে?
সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রেণীর মানুষকে হয়রান করার জন্য মিথ্যা মামলার আশ্রয় নিয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরে মিথ্যা মামলা দিয়ে একজন অন্যজনকে হয়রান করার মহোৎসব চললেও মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে সরকার আন্তরিক নয় কেন, তার সদুত্তর দিতে পারেননি সংশ্লিষ্ট অনেকেই। মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে আইন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো নয়। আইন কমিশনও ঘুমাচ্ছে। অনেকে মনে করেন, সরকার প্রভাবশালীদের পক্ষাবলম্বন করায় মিথ্যা মামলা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে এবং বিচারপ্রার্থীদের স্বার্থ সংরক্ষণে মিথ্যা মামলা প্রতিরোধ আইন প্রণয়নে বিলম্ব করা হচ্ছে কেন তা বোধগম্য নয়। আমরা নিকট অতীতে দেখেছি, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্মমভাবে নিরীহ মানুষকে বিভিন্ন ফাঁদে ফেলে মিথ্যা মামলা দিয়ে নিজেরা ধোয়া তুলসি পাতা হিসেবে আইন-আদালতের ঊর্ধ্বে থেকেছে। নিয়ম-নীতি ও আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে বারবার নিরপরাধ মানুষকে হেনস্থা করার পরও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যের বিচারহীনতার কারণে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুরের সাতুরিয়া গ্রামের নিজ বাড়ির পাশে মাঠে গরু আনতে গিয়ে কলেজছাত্র লিমন হোসেনকে র্যাবের গুলিতে পা হারাতে হয়। র্যাব বরিশাল অঞ্চলের তৎকালীন উপ-সহকারী পরিচালক বাদী হয়ে লিমনের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে এবং সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা করেন। দেশ-বিদেশে লিমনের পঙ্গুত্ববরণ এবং এই মিথ্যা মামলা বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলে সরকার বাধ্য হয়ে লিমনের নামে বিচারাধীন দুটি মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে লিমনকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তার মা বাদী হয়ে রাজাপুর থানায় র্যাবের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। করিৎকর্মা তদন্তকারী পুলিশ অফিসার র্যাবের দোষ নেই মর্মে আদালতে দ্রুতগতিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। লিমনের মা ওই চূড়ান্ত পুলিশ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করলে আদালত সেটিও খারিজ করে দেন। লিমনের মা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারিক হাকিমের খারিজাদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন করেন। সরকারি কৌঁসুলি বিভিন্ন অজুহাতে বারবার সময়ের আবেদন করলে অদ্যাবধি ১১টি ধার্য তারিখেও রিভিশন শুনানি হয়নি। র্যাব কর্তৃক ঝালকাঠির কলেজ ছাত্র লিমন হোসেনের নামে দায়েরকৃত দুটি মামলা আদালতপাড়ায় মিথ্যা মামলার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। লিমনের মতো হাজার হাজার দরিদ্র বিচারপ্রার্থী রয়েছে, যারা মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে সুবিচার পাওয়ার আশায় বছরের পর বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছে।
আদালতপাড়ার বেহাল দশা স্বচক্ষে দেখলে একজন নির্বোধ ব্যক্তির পক্ষেও সহজে অনুমান করা সহজ হবে যে, বিচার বিভাগ শুধু কাগজে-কলমে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হয়েছে, বাস্তবে নয়। কেননা বিচার বিভাগ এখনও সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। অধিকার বঞ্চিত একজন ব্যক্তি সমাজের কোনো জায়গায় যখন সুবিচার পান না, তখনই তিনি ন্যায়বিচারের আশায় আদালতের দ্বারস্থ হন। সেই বিচারপ্রার্থী আদালতে সুবিচার পাবেন কি-না তা নির্ভর করে বিচারক, আইনজীবী, সরকারি কৌঁসুলি, তদন্তকারী পুলিশ অফিসার, সাক্ষী এবং আদালতের কর্মচারীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। দেশের নিু আদালতগুলোয় বিচার প্রার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ আর অসহায়ত্ব দেখলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত পঙ্ক্তিটি- বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে মনে পড়ে যায়।
বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের দিনটি শুধু যেন গতানুগতিক দিবস উদযাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। বিচারপ্রার্থীরা যাতে স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে সুবিচার পান সেজন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি আমরাও কি যে যার অবস্থান থেকে অসহায়, দরিদ্র ও ক্ষমতাহীন বিচারপ্রার্থীদের পাশে দাঁড়াতে পারি না?
পলাশ কুমার রায় : আইনজীবী; আহ্বায়ক, সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন (সুপ্রা)
palashroy2012@yahoo.com
বিচারপ্রার্থীরা তাদের প্রত্যাশিত আইনি পরিষেবা পাচ্ছেন, সেটা হলফ করে বলা যাবে না। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পরও আদালতপাড়ার চিত্র যে বদলায়নি, তা জানাতে ঢাকার ব্যস্ততম আদালতপাড়ার একদিনের ঘটনাবলী তুলে ধরতে চাই। সদরঘাট সংলগ্ন ঢাকার আদালতপাড়াকে স্থানীয় অধিবাসী ভোরবেলায় মিনি পার্ক হিসেবে ব্যবহার করেন। কেউ হাঁটেন, কেউবা একটু ব্যায়াম করেন। সকাল ৮টা বাজতে না বাজতেই আদালতপাড়ার নিরাপত্তায় চলে আসে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। এরপর শুরু হয় বিচারপ্রার্থীদের আসা-যাওয়া। সকাল ৯টা বাজতেই শত শত বিচারপ্রার্থী আর তাদের আত্মীয়-স্বজন, মামলার সাক্ষী, গণমাধ্যমকর্মী, কৌতূহলী জনসাধারণে মুখর হয়ে ওঠে আদালতপাড়া। এ দৃশ্য প্রতিদিনের। প্রায় ১৫ হাজার আইনজীবী আদালতপাড়ায় আগত বিচারপ্রার্থীদের আইনি সহায়তা দিতে তৎপর। রয়েছে সরকারি কৌঁসুলি। আদালতের পেশকার-পিয়ন। রয়েছে শখানেক উমেদার, যারা সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত না হয়েও বিশ্বস্ততা বজায় রেখে আদালতে ফাইল টানাহেঁচড়া আর তদারকির কাজ করে। রয়েছে অস্থায়ী ফলের দোকানদার থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের দোকানও।
আদালতপাড়ায় আইনজীবীদের জন্য সুলভ মূল্যে খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিচারপ্রার্থীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ বিচারপ্রার্থীরা চড়া দামে দুপুরের খাবার খেলেও অপেক্ষাকৃত দরিদ্র বিচারপ্রার্থীদের অনেককে না খেয়েই থাকতে হয়। নেই পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধা। চাহিদামতো সেলামি দিতে না পারলে বিচারপ্রার্থীরা আদালত সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তির কাছেই কাক্সিক্ষত সহযোগিতা ও সমাদর পান না। দরিদ্র বিচারপ্রার্থীরা আদালতে হাজিরা দিতে এসে সেদিন আর কোনো কাজ করার সুযোগ না পাওয়ায় অনেকের পরিবারে সেদিন অন্ন জোটে না বলেও শোনা যায়।
বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হলেও বিচারপ্রার্থীরা এ থেকে কতটা সুফল পেয়েছেন তার বিচারের ভার আদালতপাড়ায় আগত বিচারপ্রার্থীদের ওপরই ছেড়ে দিলাম। তবে স্বল্প সময়ে ন্যায়বিচার না পাওয়ায় বিচারপ্রার্থীরা যে হতাশ ও ক্ষুব্ধ তা প্রায়ই শোনা যায়। দেশের আদালতগুলোতে বর্তমানে প্রায় ২৮ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগে ৩ লাখ ২৫ হাজার, জেলা ও দায়রা জজ/মহানগর দায়রা জজের আদালতে ১৪ লাখ ৮২ হাজার এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোয় ৯ লাখ ২৭ হাজার মামলা বিচারাধীন। সম্প্রতি সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ২০১৩-১৪ অর্থবছরের কার্যাবলী সম্পর্কিত আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ২৪। প্রতিবেদনে মামলা নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করতে বিচার বিভাগের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, নতুন আদালত ও ট্রাইব্যুনাল গঠন, প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। দেশের নিু আদালতগুলোয় কর্মরত ১৭০০ বিচারককে দিয়ে এত বিশালসংখ্যক মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন করা যে বেশ কঠিন তা সহজেই অনুমেয়। উচ্চ আদালত ও নিু আদালতগুলোয় প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিচারক নিয়োগ সময়ের দাবি। শুধু বিচারক নিয়োগই যথেষ্ট নয়, পেশাদার ও দায়িত্বশীল বিচারক নিয়োগ দেয়া জরুরি। কারণ নিকট অতীতে কিছু দুর্নীতিপরায়ণ বিচারকের জন্য বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। গণমাধ্যমের বদৌলতে আমরা জানতে পেরেছি, অবৈধ সম্পদ অর্জন, বিদেশে অর্থ পাচার এবং দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত বিচারকের তথ্যানুসন্ধান করছে দুদক।
আদালতে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিচারক ও আইনজীবীদের পাশাপাশি বিচারাধীন মামলার তদন্তকারী পুলিশ অফিসার এবং আদালতে কর্মরত পেশকার, সেরেস্তাদার, পিয়ন, উমেদারদেরও আন্তরিক হতে হবে। নগদ নারায়ণ ছাড়া ফাইল খুঁজে পাওয়া যায় না এবং মামলার নথি এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে যায় না। এই মনোভাব বদলাতে হবে। অনেক চতুর ও মতলববাজ পেশকার এবং সেরেস্তাদারের দৈনিক যা আয়, তা নিু আদালতের একজন বিচারকের পুরো মাসের বেতনের চেয়েও বেশি। নিু আদালতের পেশকার, পিয়নদের কাছে বিচারপ্রার্থীরা জিম্মি। শুধু বিচারপ্রার্থীরা নন, অনেক আইনজীবীও জিম্মি। প্রবীণ আইনজীবীরাও পেশকার, সেরেস্তাদার, পিয়নদের সমীহ করে চলেন কোনো সহযোগিতা না পাওয়ার আশংকায়। আদালতের কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যপনা রোধে সারা দেশের আইনজীবীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া সময়ের দাবি। নতুবা ভবিষ্যতে নবীন আইনজীবীদের চড়া মূল্য গুনতে হবে এবং বিচার বিভাগ তার স্বকীয়তা ও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। বিচারপ্রার্থীরা উকিল সাহেবকে মামলা পরিচালনার জন্য সম্মানী দেন। সেই সম্মানী থেকে পেশকার, পিয়নদের কিছু বকশিশ দিলে আপত্তির কিছু থাকত না। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি, কতিপয় আইনজীবী বিচারপ্রার্থীদের নিয়ে আদালতে যান এবং পেশকার, পিয়নদের বাড়তি সেলামি দেয়ার নির্দেশনা দেন। বিচারপ্রার্থীরা সুবিচারের আশায় আইনজীবীর নির্দেশনামতো পেশকার, পিয়নদের বাড়তি সেলামি দেন। এভাবে সেলামি দেয়ার অনিয়মটাই এখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। যে যত বেশি সেলামি দেয় সেই বিচারপ্রার্থী পেশকার, পিয়নদের কাছে খুব ভালো এবং ভদ্রলোক হিসেবে চিহ্নিত হন। বেচারা বিচারপ্রার্থীর যে পকেট খালি হচ্ছে, সেটা উপলব্ধি করবে কে?
সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রেণীর মানুষকে হয়রান করার জন্য মিথ্যা মামলার আশ্রয় নিয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরে মিথ্যা মামলা দিয়ে একজন অন্যজনকে হয়রান করার মহোৎসব চললেও মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে সরকার আন্তরিক নয় কেন, তার সদুত্তর দিতে পারেননি সংশ্লিষ্ট অনেকেই। মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে আইন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো নয়। আইন কমিশনও ঘুমাচ্ছে। অনেকে মনে করেন, সরকার প্রভাবশালীদের পক্ষাবলম্বন করায় মিথ্যা মামলা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে এবং বিচারপ্রার্থীদের স্বার্থ সংরক্ষণে মিথ্যা মামলা প্রতিরোধ আইন প্রণয়নে বিলম্ব করা হচ্ছে কেন তা বোধগম্য নয়। আমরা নিকট অতীতে দেখেছি, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্মমভাবে নিরীহ মানুষকে বিভিন্ন ফাঁদে ফেলে মিথ্যা মামলা দিয়ে নিজেরা ধোয়া তুলসি পাতা হিসেবে আইন-আদালতের ঊর্ধ্বে থেকেছে। নিয়ম-নীতি ও আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে বারবার নিরপরাধ মানুষকে হেনস্থা করার পরও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যের বিচারহীনতার কারণে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুরের সাতুরিয়া গ্রামের নিজ বাড়ির পাশে মাঠে গরু আনতে গিয়ে কলেজছাত্র লিমন হোসেনকে র্যাবের গুলিতে পা হারাতে হয়। র্যাব বরিশাল অঞ্চলের তৎকালীন উপ-সহকারী পরিচালক বাদী হয়ে লিমনের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে এবং সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা করেন। দেশ-বিদেশে লিমনের পঙ্গুত্ববরণ এবং এই মিথ্যা মামলা বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলে সরকার বাধ্য হয়ে লিমনের নামে বিচারাধীন দুটি মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে লিমনকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তার মা বাদী হয়ে রাজাপুর থানায় র্যাবের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। করিৎকর্মা তদন্তকারী পুলিশ অফিসার র্যাবের দোষ নেই মর্মে আদালতে দ্রুতগতিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। লিমনের মা ওই চূড়ান্ত পুলিশ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করলে আদালত সেটিও খারিজ করে দেন। লিমনের মা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারিক হাকিমের খারিজাদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন করেন। সরকারি কৌঁসুলি বিভিন্ন অজুহাতে বারবার সময়ের আবেদন করলে অদ্যাবধি ১১টি ধার্য তারিখেও রিভিশন শুনানি হয়নি। র্যাব কর্তৃক ঝালকাঠির কলেজ ছাত্র লিমন হোসেনের নামে দায়েরকৃত দুটি মামলা আদালতপাড়ায় মিথ্যা মামলার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। লিমনের মতো হাজার হাজার দরিদ্র বিচারপ্রার্থী রয়েছে, যারা মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে সুবিচার পাওয়ার আশায় বছরের পর বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছে।
আদালতপাড়ার বেহাল দশা স্বচক্ষে দেখলে একজন নির্বোধ ব্যক্তির পক্ষেও সহজে অনুমান করা সহজ হবে যে, বিচার বিভাগ শুধু কাগজে-কলমে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হয়েছে, বাস্তবে নয়। কেননা বিচার বিভাগ এখনও সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। অধিকার বঞ্চিত একজন ব্যক্তি সমাজের কোনো জায়গায় যখন সুবিচার পান না, তখনই তিনি ন্যায়বিচারের আশায় আদালতের দ্বারস্থ হন। সেই বিচারপ্রার্থী আদালতে সুবিচার পাবেন কি-না তা নির্ভর করে বিচারক, আইনজীবী, সরকারি কৌঁসুলি, তদন্তকারী পুলিশ অফিসার, সাক্ষী এবং আদালতের কর্মচারীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। দেশের নিু আদালতগুলোয় বিচার প্রার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ আর অসহায়ত্ব দেখলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত পঙ্ক্তিটি- বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে মনে পড়ে যায়।
বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের দিনটি শুধু যেন গতানুগতিক দিবস উদযাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। বিচারপ্রার্থীরা যাতে স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে সুবিচার পান সেজন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি আমরাও কি যে যার অবস্থান থেকে অসহায়, দরিদ্র ও ক্ষমতাহীন বিচারপ্রার্থীদের পাশে দাঁড়াতে পারি না?
পলাশ কুমার রায় : আইনজীবী; আহ্বায়ক, সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন (সুপ্রা)
palashroy2012@yahoo.com
No comments