জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ যাচ্ছে মানুষ by রোকনুজ্জামান পিয়াস
বৈধভাবে বিদেশে কর্মী নিয়োগ সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। আর এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে এক শ্রেণীর প্রতারক ও দালাল চক্র। তাদের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাড়ছে অবৈধ বিদেশ গমন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈধ পথে বিদেশ যেতে ব্যর্থ হয়ে অনেকে বেছে নিচ্ছেন এ অবৈধ পথ। এজন্য তারা সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতাকেও দায়ী করছেন। এদিকে অবৈধ গমন ঠেকাতে কাজ করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মানব পাচার প্রতিরোধ সেল। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের সমন্বয়হীনতার অভাবে অনেক সময় দালালচক্রটি থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সিআইডি পুলিশের মানব পাচার অপরাধ প্রতিরোধ সেল সূত্রে জানা গেছে বাংলাদেশের ১২টি জেলা দিয়ে অবৈধভাবে বিদেশের উদ্দেশ্যে দালাল ও মানবপাচার চক্রের সহযোগিতায় সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে অনেকে। এসব জেলার মধ্যে রয়েছে- কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট। তবে এর মধ্যে কক্সবাজার, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট সীমান্ত দিয়ে অবৈধ গমনের সংখ্যা খুবই বেশি। অবৈধ গমনের সিংহভাগ সাগরপথে পাড়ি জমাচ্ছেন মালয়েশিয়ায় গমনের উদ্দেশ্যে। অতীতে বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য বৃহৎ শ্রমবাজারের মধ্যে অন্যতম ছিল এ দেশটি। এক্ষেত্রে তারা থাইল্যান্ডকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে উচ্চ আয়ের স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ যাওয়া এসব কর্মীর ভাগ্যে কি ঘটছে অনেক ক্ষেত্রেই তা অজানায় থেকে যাচ্ছে। অনেকে আবার ধরা পড়ছেন বিভিন্ন দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তারা ওই সব দেশে জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন অপরাধ কর্মে। সিআইডি পুলিশের মানব পাচার প্রতিরোধ সেল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে এ সংক্রান্ত মামলা হয়েছিল ৩৭০টি। ওই সব মামলায় আসামি করা হয় ১৫০০ জন। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয় ৪০৭ আসামি। চার্জশিট হয়েছে ২৫৬টি মামলার। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে ৮২টি মামলার। কোর্টে নিষ্পত্তি হয়েছে ৭টি মামলা। এ বছর মামলার সংখ্যা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৫০টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৯৫০ জনকে। যাদের ৫৮৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। চার্জশিট দেয়া হয়েছে ১২৫টি মামলার। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে ২৪টি মামলার। এছাড়া তদন্তাধীন ২৬২টি মামলা। ২০১৩ সালে কোর্টে নিষ্পত্তি হয়েছে ৭টি এবং এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হয়েছে আরও ৫টি মামলা। এ দু’বছরে দণ্ডিত হয়েছে ২৪ আসামি। যাদের ১৪ জন ২০১৩ সালে এবং বাকি ১০ জন এ বছরে দণ্ডিত হয়েছেন। দণ্ডিত ২৪ জনের মধ্যে ১২ জনের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। বাকি ১২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে জের জরিমানা হয়েছে। অন্যদিকে ২০১১ সালে এ সংক্রান্ত দায়েরকৃত মামলায় ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড, ২২৫ জনের যাবজ্জীবন এবং ৭৭ জনের বিভিন্ন মেয়াদে জেল-জরিমানা হয়। সমপ্রতি জনশক্তি রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, আবুধাবী, মালয়েশিয়ায়সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। জি টু জি পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় গত দু’বছরে কর্মী গেছে মাত্র ৬ হাজারের মতো। তবে সে সব দেশে জনশক্তি রপ্তানি থেমে নেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার। বাংলাদেশের শ্রমবাজার অনেকাংশেই দখল করেছে তারা। সরকারের তৈরী ১৯ লাখ ৫০ হাজার ডাটাবেজের মধ্য থেকে কর্মী পাঠানোর নিয়ম রয়েছে। তবে ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ওই ডাটাবেজ তৈরি হলেও এর মধ্য থেকে কতজন কর্মী বিদেশ গেছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায়নি। বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক বেগম শামছুন নাহার জানিয়েছেন, ডাটাবেজের মধ্যে থেকে আনুমানিক ১২ হাজার কর্মী গেছে। এদিকে কর্মী পাঠানোর এ ধীরগতির ফলে সুযোগ নিচ্ছে এক ধরনের দালাল শ্রেণী। তাদের প্রলোভনে পড়ে বিদেশ গমনে অবৈধ পথ বেছে নিচ্ছে সহজ-সরল মানুষ। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৭৬ সাল থেকে জনশক্তি রপ্তানি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে বিদেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মী গেছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে। সরকারি হিসেবে সে সময় কর্মী গেছে ১৭ লাখ ৭ হাজার ৬৬৪ জন। তবে ওই সময় যাওয়া কর্মীদের একটি বড় অংশ বিভিন্নভাবে ভোগান্তিরও স্বীকার হয়েছেন। এরপরের বছর ২০০৯ সালে গেছে প্রায় অর্ধেক। ২০১০ সালে এ সংখ্যা আরও কম, মাত্র ৩ লাখ ৯০ হাজার ৭০২ জন। পরের বছরগুলোতে কর্মী নিয়োগ বাড়লেও ২০১৩ সাল থেকে আবারও ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করেছে। ২০১১ সালে কর্মী গেছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬২ জন এবং ২০১২ সালে গেছে ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৯৮ জন। ২০১৩ সালে বিদেশে কর্মী নিয়োগ হয়েছে ৪ লাখ ৯২৫৩ জন। আর এ বছর ২১শে অক্টোবর পর্যন্ত বহির্গমনের পরিমান ৩ লাখ ২৮ হাজার ১৯৯ জন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, মালয়েশিয়া। ওইসব দেশের বেশ কয়েকটিতে শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে। শ্রমবাজারের বিশাল এ শূন্যতা পূরণ করতে বিকল্প কয়েকটি দেশে বাজার খোঁজা হলেও তা খুবই নগণ্য। তবে নতুনভাবে হংকং, জর্ডান এবং রাশিয়া অঞ্চলে কর্মী নিয়োগের ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু কর্মী নিয়োগও করা হয়েছে। মহিলাকর্মীও পাঠানো হচ্ছে ওই সব দেশে। এদিকে একটি সূত্রের দাবি মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের দেশের পক্ষ থেকেই জিটুজি পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। তবে জনশক্তি রপ্তানিতে ধীরগতির বিষয়টি অস্বীকার করে বিএমইটির মহাপরিচালক বেগম শামছুন নাহার বলেন বর্তমান ইন্ডিভিজ্যুয়ালি প্রায় ৮০ ভাগ লোক যাচ্ছেন। আরব দেশগুলোতে কর্মী নিয়োগে ব্যাপারে সৃষ্ট বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন সেখানে আমাদের প্রায় ১৪ লক্ষ কর্মী আছেন, তাই ওই সব দেশে চাহিদা কম। জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে বিকল্প শ্রমবাজার সৃষ্টি করা হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে ১৫৯টি কর্মী পাঠানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলেও তিনি জানান। তবে ওইসব দেশে কর্মী পাঠানোর হার এখনও দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। এদিকে বৈধ পথে জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ায় সম্পতিক সময়ে কাজের সন্ধানে অবৈধ উপায়ে দেশের সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার হার বেড়ে গেছে। গত দু’বছরে জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সংক্রান্ত মামলার হারও বেড়েছে। এ ব্যাপারে ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বলেন, চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বৈধ উপায়ে কর্মী যেতে না পারায় যাওয়ায় জীবনের ঝুকি নিয়ে মানুষ অবৈধ পথ বেছে নিচ্ছে। সরকার ও বায়রা আলোচনা করে বিষয়টি নিরসনে পদক্ষেপ নিতে পারে। এছাড়া কর্মসংস্থানের বৈধ পথ সঙ্কুচিত হওয়ার জন্য তিনি কূটনীতিকে দায়ী করে তৎপরতার বাড়ানোর পরামর্শ দেন। বাংলাদেশের মানুষ বহুদিন আগে থেকেই মাইগ্রেশনের সঙ্গে পরিচিত উল্লেখ করে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিচার্স ইউনিটের (রামরু) চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিক বলেন, বৈধ পথ না পেয়েই তারা অবৈধ পথের আশ্রয় নিচ্ছে। এছাড়া তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুটিকেও তুলে আনেন। তিনি বলেন, বর্তমান রুটটি তাদের মাধ্যমেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গাদের বিষয়টি যদি ভালভাবে পরিচালনা করা যেতো তবে আজকে এ অবস্থা হতো না। শুরুতে রোহিঙ্গাদের রিফিউজি স্ট্যাটাস দিয়ে যদি এখানে বাস করার সুযোগ দেয়া হতো তাহলে ওই রুটটিও আবিষ্কার হতো না। তিনি বলেন, বর্তমান যারা সাগরপথে যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য মালয়েশিয়া। তবে থাইল্যান্ডের ফিশিং ট্রলারে কাজ করতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। সে দেশের ব্যবসায়ীরা এ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ১৫ জনের কম শ্রমিককে কাজে লাগানোই থাইল্যান্ডের নিয়মানুযায়ী তারা আন্তর্জাতিক শ্রম আইন মানেন না। তাছাড়া এদের বৈধতা না থাকায় তারা ভোগান্তিরও শিকার হন। তিনি বলেন এক সময় কোন কোন রিক্রুটিং এজেন্সি সেদেশ থেকে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে এসেছিল কিন্তু সরকার জিটুজি পদ্ধতি চালু করার জন্য তাদের অনুমতি দেয়নি। তিনি বলেন, যেহেতু সেখানে চাহিদা রয়েছে সেহেতু বৈধ উপায়ে না যেতে পেরে মানুষ অবৈধ উপায়ে যাচ্ছে।
No comments