বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সাত বছর by খন্দকার মাহবুব হোসেন
আমরা দীঘদিন ধরে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের দাবি জানিয়ে আসছিলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো রাজনৈতিক সরকারই বিচার বিভাগের ওপর তারা পরোক্ষভাবে যে কর্তৃত্ব ফলান তা খর্ব হওয়ার ভয়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আমাদের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও এ ব্যাপারে সরকারগুলো গড়িমসি করেছে বা উদাসীন থেকেছে। ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে আমাদের আপিল বিভাগ এ ব্যাপারে নিরবচ্ছিন্ন ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে পৃথকীকরণের কাজটি সম্পন্ন করে। এর ফলে আমরা স্বাভাবিকভাবেই আশা করেছিলাম, বিচার বিভাগ বিশেষ করে নিু আদালতের বিচারকরা নির্বাহী কর্তৃত্ব ও খবরদারি থেকে রক্ষা পাবেন। কারণ পৃথকীকরণের ফলে বিজ্ঞ আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও শৃংখলাবিধি- এককথায় সবকিছু সুপ্রিমকোর্টের আওতায় চলে আসে। কিন্তু এ বিরাট দায়িত্ব পালন করার জন্য যে অবকাঠামো, জনবল ও আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাদি প্রয়োজন, সুপ্রিমকোর্ট থেকে বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও, উপরন্তু সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সমিতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের তরফ থেকে দাবি করা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আলাদা কোনো সচিবালয় গঠন করা হয়নি।
আমাদের দাবি অনুযায়ী আলাদা সচিবালয় গঠিত হলে এখান থেকে মাননীয় প্রধান বিচারপতি তার নিজস্ব জনবল ও অবকাঠামো দ্বারা কর্মরত কয়েকশ’ বিচারকের কার্যাবলী, বিচারিক দক্ষতা ও স্বচ্ছতা পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করতে পারতেন। শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর নিু আদালতগুলোয় বিচারক নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও তত্ত্বাবধানসহ অন্যান্য বিষয় দেখভালের জন্য হাইকোর্টের ওপর একটা বিরাট দায়িত্ব বর্তেছে। এ দায়িত্ব পালনের জন্য যদি তাদের উপযুক্ত সংখ্যক কমকর্তা-কর্মচারী না থাকে, তাহলে সুষ্ঠুভাবে কোনো কাজই করা সম্ভব নয়। পৃথক একটি সচিবালয় থাকলে তবেই সুপ্রিমকোর্ট তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন। এটি না হওয়ায় এখন পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিু আদালতের বিচারকদের বদলি, পদায়ন ও শৃংখলাবিধিসহ সব কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর সুপ্রিমকোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই মাননীয় প্রধান বিচারপতির পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের সেসব সুপারিশের স্বচ্ছতা, এমনকি ন্যায্যতার যথার্থতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা সম্ভব হয় না। ফলে শেষ পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশই কার্যকর থাকে। এমনও শোনা যায়, মাননীয় প্রধান বিচারপতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করলে সেটি আর আলোর মুখ দেখে না। কাজেই দেখা যাচ্ছে, বিচার বিভাগ নামেমাত্র কাগজে-কলমে নির্বহী বিভাগ থেকে পৃথক হয়েছে। কার্যত এখনও নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বই বহাল রয়ে গেছে। এ কারণে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাব নির্বাহী ক্ষমতার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়।
অনেক আগে থেকেই আমি সংবিধানের ১১৬ ধারার আলোকে বলার চেষ্টা করছি- নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগ, বদলি, পদন্নোতিসহ যাবতীয় বিষয় সুপ্রিমকোর্টের আওতায় থাকবে। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এটি প্রশাসনের আওতায় আনা হলেও পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী করার বিধান করেছিলেন। এখনও এটি সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী করার বিধানই বহাল আছে। আমি মনে করি, নিু আদালতকে যদি আমরা স্বাধীন করতে চাই, নিরপেক্ষ করতে চাই, দলীয়করণের ঊর্ধ্বে রাখতে চাই- তাহলে এর সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টকে দিতে হবে।
আমি খুবই মর্মাহত, ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দেশের নিু আদালতগুলো মুক্ত রাখার যে উদ্দেশ্য বা আশা নিয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়েছিল, তা কার্যত বাস্তবে পরিণত হয়নি।
খন্দকার মাহবুব হোসেন : আইনজীবী; সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল
আমাদের দাবি অনুযায়ী আলাদা সচিবালয় গঠিত হলে এখান থেকে মাননীয় প্রধান বিচারপতি তার নিজস্ব জনবল ও অবকাঠামো দ্বারা কর্মরত কয়েকশ’ বিচারকের কার্যাবলী, বিচারিক দক্ষতা ও স্বচ্ছতা পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করতে পারতেন। শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর নিু আদালতগুলোয় বিচারক নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও তত্ত্বাবধানসহ অন্যান্য বিষয় দেখভালের জন্য হাইকোর্টের ওপর একটা বিরাট দায়িত্ব বর্তেছে। এ দায়িত্ব পালনের জন্য যদি তাদের উপযুক্ত সংখ্যক কমকর্তা-কর্মচারী না থাকে, তাহলে সুষ্ঠুভাবে কোনো কাজই করা সম্ভব নয়। পৃথক একটি সচিবালয় থাকলে তবেই সুপ্রিমকোর্ট তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন। এটি না হওয়ায় এখন পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিু আদালতের বিচারকদের বদলি, পদায়ন ও শৃংখলাবিধিসহ সব কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর সুপ্রিমকোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই মাননীয় প্রধান বিচারপতির পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের সেসব সুপারিশের স্বচ্ছতা, এমনকি ন্যায্যতার যথার্থতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা সম্ভব হয় না। ফলে শেষ পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশই কার্যকর থাকে। এমনও শোনা যায়, মাননীয় প্রধান বিচারপতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করলে সেটি আর আলোর মুখ দেখে না। কাজেই দেখা যাচ্ছে, বিচার বিভাগ নামেমাত্র কাগজে-কলমে নির্বহী বিভাগ থেকে পৃথক হয়েছে। কার্যত এখনও নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বই বহাল রয়ে গেছে। এ কারণে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাব নির্বাহী ক্ষমতার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়।
অনেক আগে থেকেই আমি সংবিধানের ১১৬ ধারার আলোকে বলার চেষ্টা করছি- নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগ, বদলি, পদন্নোতিসহ যাবতীয় বিষয় সুপ্রিমকোর্টের আওতায় থাকবে। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এটি প্রশাসনের আওতায় আনা হলেও পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী করার বিধান করেছিলেন। এখনও এটি সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী করার বিধানই বহাল আছে। আমি মনে করি, নিু আদালতকে যদি আমরা স্বাধীন করতে চাই, নিরপেক্ষ করতে চাই, দলীয়করণের ঊর্ধ্বে রাখতে চাই- তাহলে এর সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টকে দিতে হবে।
আমি খুবই মর্মাহত, ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দেশের নিু আদালতগুলো মুক্ত রাখার যে উদ্দেশ্য বা আশা নিয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়েছিল, তা কার্যত বাস্তবে পরিণত হয়নি।
খন্দকার মাহবুব হোসেন : আইনজীবী; সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল
বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও পরিপূর্ণতা পায়নি
শ ম রেজাউল করিম
বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করা হলেও এখনও পরিপূর্ণতা পায়নি। পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য যে জাতীয় আয়োজন, ব্যবস্থাপনা, আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন ছিল তা এখনও হয়ে ওঠেনি। একইরূপে পর্যাপ্তসংখ্যক দক্ষ বিচারক নিয়োগ, দক্ষ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী ও কর্মকর্তা নিয়োগ হয়নি। বিচার ব্যবস্থাপনা এখনও অনেক ক্ষেত্রেই মামুলি অবস্থায় রয়েছে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থার সংযোজন প্রত্যাশিত অবস্থায় পৌঁছেনি। জনবল কাঠামো ও অপরাপর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার তেমন উন্নয়ন না হওয়ায় স্বাধীন বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থার সুফল পরিপূর্ণতা লাভ করেনি। তবে নিু আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ে এখন আর নির্বাহী বিভাগের কোনো কর্মকর্তা বিচারিক দায়িত্ব পালন করছেন না। এর ফলে বিচার ব্যবস্থায় নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ বন্ধ হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নির্ভরশীলতা থাকলেও বিচারকরা এখন সুপ্রিমকোর্টের নিয়ন্ত্রণে আসায় ভয়ভীতি ও প্রশাসনিক চাপের বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে বিচারিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাচ্ছেন।
বিচারক স্বল্পতা, বিচারকদের জন্য বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য দেশের চেয়ে খুবই কম হওয়ায় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাদের প্রতিকূল অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। এ বাস্তবতার আলোকে বলা যায়, বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও পরিপূর্ণ স্বাধীনতা বাস্তব অর্থে এখনও নিশ্চিত হয়নি।
বিপুলসংখ্যক মামলার জট রয়েছে। সে তুলনায় বিচারকের সংখ্যা অপ্রতুল। এর ফলে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি রয়েই গেছে। নিু আদালত থেকে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা এর অন্যতম কারণ। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার বাস্তব সুফল পেতে হলে অবিলম্বে পর্যাপ্তসংখ্যক বিচারক নিয়োগ করা জরুরি।
শ ম রেজাউল করিম : সাবেক সাধারণ সম্পাদক. সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি
No comments