গল্প- নেতা by সাব্বির আহমেদ সুবীর
প্রচারণার
শেষ দিনে এলাকাবাসী এক অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিল। হীরু সরকারকে শান্ত রাখতে
তার গণমিছিলে যোগ দিল প্রায় সবাই। অপরদিকে মতিউরের গণমিছিলে যোগ দিল মাত্র
৫/৭শ’ লোক দূরে গাঁয়ের পড়শিদের বিদ্যুৎ বাতির দিকে তাকিয়ে মাঝে মধ্যেই
মতিউর উদাস হয়ে যায়। বিধবা মায়ের হাত ধরে টেনে অন্ধকার উঠোনে দাঁড়িয়ে পাখির
ভাষার কথা বলে আর ডান হাত তুলে বিদ্যুৎ বাতি দেখায়। তখন তরুণ মতিউরের বুকে
আশা জাগে এ বাড়িতেও বিদ্যুৎ আসুক এবং বিধবা মায়ের সঙ্গে যেন বাবার
স্বপ্নের কথা বলতে পারে মানুষের ভাষায়। জুমেলা বেগমও দূরে গাছগাছালির ফাঁকে
দোদুল্যমান বিদ্যুৎ বাতির ভুতুড়ে কাঁপন দেখতে দেখতে ভাবে এ বাড়িতে আর এ
গ্রামে বিদ্যুতের বাতি জ্বলবে- এ ছিল তার স্বপ্ন।
মতিউরের
বাবা মজিবুর সাহেব ছিলেন কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের পরপর দুবার নির্বাচিত
চেয়ারম্যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করার পর সরকারি চাকরির সুযোগ
পেয়েও যোগদান করেননি। বরং মানুষের সেবা করার বাসনায় ফিরে এসেছিলেন গ্রামে।
প্রতিষ্ঠা করেছেন মসজিদ, মাদ্রাসা আর বিদ্যালয়। গ্রামের সাধারণ মানুষ তাকে
বুজুর্গ ব্যক্তির মতো শ্রদ্ধা করত। আশপাশের দশটি গ্রামকে তিনি আদর্শ গ্রামে
পরিণত করার স্বপ্ন দেখতেন। যে কারণে গ্রামবাসীও তাকে নিজেদের প্রতিনিধি
নির্বাচিত করেছিল পরপর দুবার। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে তিনি
মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। এ লক্ষ্যে সব কাজই তিনি গুছিয়ে এনেছিলেন প্রায়। কিন্তু
কুচক্রী মহল তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। গ্রাম্য এক সালিশ শেষ করে বাড়ি ফেরার
পথে দুর্বৃত্তরা তাকে কুপিয়ে জখম করেছিল। এক সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে তিনি
ইন্তেকাল করেন। একমাত্র পুত্র মতিউরের বয়স তখন মাত্র দশ। মুজিবুর সাহেবকে
কারা খুন করেছিল, কেন খুন করেছিল তা গ্রামের সবারই জানা ছিল। কিন্তু অজানা
এক শংকায় কেউ মুখ খোলেনি। লাখ লাখ টাকা খরচ করে দুবার পরাজিত হওয়া হীরু
সরকারের লোকজনই তাকে খুন করেছিল। ইশারা ছিল হীরু সরকারের। তিনি নিজের পথের
কাঁটা সরিয়ে উপনির্বাচনে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তারপর এলাকায় কায়েম করেছিলেন
ত্রাসের রাজত্ব। নির্বাচনে কেউ ভোট কেন্দ্রে গেলে হীরুর পছন্দের
প্রার্থীকে ভোট দিতে অলিখিত এক নির্দেশ ছিল। তার অপছন্দের কোনো প্রার্থী
কখনও নির্বাচিত হলে শুরু হতো এলাকাবাসীর ওপর নির্মম অত্যাচার। নির্বাচিত
জনপ্রতিনিধিকেও বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হতো। প্রাণ নাশের হুমকি দেয়া হতো।
বলা যায়, প্রায় দুই যুগ কৃষ্ণপুর এলাকা হীরু বাহিনীর হাতে জিম্মি হয়ে
পড়েছিল। কিন্তু হঠাৎ মতিউরের উপস্থিতি কুচক্রী মহলকে নতুন করে ভাবিয়ে
তুলেছে।
শৈশবেই পিতৃহারা মতিউরকে তার বড় মামা নিয়ে গিয়েছিলেন। মামার তত্ত্বাবধানে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেছে। দেখতে-শুনতে যেমন ভালো, আচার-ব্যবহারও অমায়িক। ২ মিনিট তার সঙ্গে কথা বললেই বুঝা যায়- ছেলেটি সুশিক্ষিত এবং ভদ্র পরিবারের সন্তান। কিছুদিন হল গ্রামে এসেছে। বাবার স্বপ্ন পূরণই যেন তার জীবনের ব্রত। কিন্তু গ্রামে আসার পর থেকেই সরকারের লোকজন তাকে নানাভাবে হয়রারি শুরু করেছে। পাশের গ্রামের ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনায় তাকে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি ছিল- নিজের গ্রামে বিদ্যুৎ নেই বলে মতিউর ঈর্ষান্বিত হয়ে কাজটি করিয়েছে। আর মাদক ব্যবসায়ী মুক্তারের মেয়েকে দিয়ে ফাঁসানোর প্রচেষ্টায় যুক্তি ছিল- এটা মতিউরের বয়সের দোষ। হীরু সরকারের মনে হল মতিউরের জীবন যেন অনন্ত-মৃত্যুহীন। সে যেন তার বাবার প্রতিনিধি হয়েই গ্রামে ফিরে এসেছে। শুরুতেই তাকে আটকানো না গেলে নিজের দুই যুগের রাজত্ব তছনছ হয়ে যাবে। গ্রাম থেকে প্রায় দুই যুগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও গ্রামের সাধারণ মানুষ যেন তার ফিরে আসার জন্যই পথ চেয়ে বসেছিল। পথঘাটে সবাই মতিউরের প্রশংসা করে। তাই হঠাৎ বুকের ভেতর প্রতিহিংসার বিষ ছড়াতে থাকে। প্রতিপক্ষের প্রতি ঈর্ষা। প্রতি মুহূর্তে নিজে ক্ষয় হচ্ছেন, হেরে যাচ্ছেন, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন অথচ মতিউর বিনা চেষ্টায় এগিয়ে চলছে সুন্দর আগামীর পথে। এমন প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেঁচে থাকতে দিতে চায় না তিনি। তাই জরুরি এক বৈঠক ডেকেছেন অনুগত কর্মীদের নিয়ে। তার পালিত সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা বৈঠকের স্থানটিকে ঘিরে রাখল।
হঠাৎ একজন জানতে চাইল- ‘মতিউর আপনার ছেলের বয়সী... সমস্যা কী?
: ‘চুপ’ বোকার মতো কথা বলবি না। এমএ পাস একটা ছেলে জজ-ব্যারিস্টার হতে পারবে। এমনকি এলাকার মানুষ তাকে প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নিতে পারে। তাই যা করার শুরুতেই করতে হবে। কথাগুলে বলেই হীরু সরকার এক চুমুকে এক গ্লাস পানি পান করে নিল। বৈঠকে উপস্থিত থাকা বয়োবৃদ্ধ আমিন সাহেবের কথাগুলো ভালো লাগেনি। তবু কৌশলগত কারণে চুপ করে বসে রইলেন। বৈঠকে সর্বশেষ এ মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হল, মতিউরকে এখনই খুন করা হবে না। তাহলে অনেকেই বিষয়টা সহজভাবে মেনে নেবে না। বরং যে কোনো মূল্যেই হোক তার চরিত্রে কালিমালেপন করতে হবে। সমাজে তাকে বাটপাড়, লম্পট ও লোভী হিসেবে পরিচিত করার মিশন শুরুর চূড়ান্ত শপথ নিল হীরু সরকারের অনুগত দুষ্ট লোকেরা।
মতিউর গ্রামের যুবকদের নিয়ে একটি সমিতি গঠন করেছে। সমিতির সদস্যদের নিয়ে সে গ্রামের ভাঙা রাস্তাঘাট মেরামত করে, দরিদ্রদের সহায়তা করে। দিন দিন পাশের গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে মতিউরের সুনাম। জ্বালা বাড়ছে হীরু সরকারের। বৈঠকে থাকা সেই বৃদ্ধ লোকটি লোক মারফত বৈঠকের সিদ্ধান্তটি মতিউরকে জানানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই থেকে মতিউর খুব সাবধানে চলাফেরা করে। কিন্তু বিপদ তো আর আগাম ঘোষণা দিয়ে আসে না। তাছাড়া কোনোভাবেই মতিউরকে ঘায়েল করতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়ছিল হীরু সরকারের বাহিনী।
মতিউরের বাবার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির নির্বাচনে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। দুটি প্যানেল ঘোষণা করা হল। একটি মতিউর সমর্থিত, অপরটি হীরু সরকারের সমর্থিত। নির্বাচনে হীরু সমর্থক প্যানেলের ভরাডুবি ঘটল। এতে হীরু সরকার আরও ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। আর পারা যায় না। আর ছাড় দেয়া যায় না। তাই এবার মতিউরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল তারা। একের পর এক বৈঠক করল তারা। ঘটনা এলাকায় নয়, অন্যত্র কোথাও ঘটাতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় গাড়িচাপা দিতে পারলে।
এলাকার লোকজন স্পষ্টতই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছিল। আতংক বাড়ছিল হীরু সরকারের। হীরুর যে কোনো অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে মতিউর রুখে দাঁড়ায়। এলাকাবাসীকে সচেতন করে তোলে। এলাকার সমস্যা ও সমাধান বিষয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে ও জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করে। স্থানীয় বাজারে মতিউরের পক্ষ নিয়ে জোরালোভাবে কথা বলার দায়ে হীরুর লোকজন মিলনকে বেধরক পিটিয়ে আহত করল। মিলনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। পরদিন মতিউর ৪/৫ জন সঙ্গীসহ মিলনকে দেখতে হাসপাতালে গেল। সেখান থেকে রওনা হতে রাত ১০টা বেজে গেল। পথিমধ্যে মতিউরের জরুরি একটা ফোন এলো। আবার হাসপাতালে যেতে হবে। সিএনজি থামিয়ে সে পথিমধ্যে নেমে গেলে। অন্য এক সিএনজিতে চড়ে পেছনের পথে রওনা দিল আবার। সঙ্গীদের সে বাড়ি চলে যেতে বলল। সঙ্গীদের সিএনজি লক্ষ্মীপুর এলাকার বেইলি ব্রিজের পাশে আসতেই বাঁধার সম্মুখীন হল। পথে গাছের বড় গুঁড়ি ফেলানো। বাধ্য হয়ে চালক সিএনজি থামাল। মুহূর্তেই শুরু হল চতুর্মুখী আক্রমণ। ওরা ভেবেছিল মতিউর ভেতরে আছে। মতিউরকে না পেয়ে ওরা আরও ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। ওরা সিএনজিতে আগুন ধরিয়ে দিল। মতিউরের অনুগতদের বেধরক পেটাল। সিএনজির চালক প্রাণভয়ে পালিয়ে গেল। দৌড়ে সে কৃষ্ণপুর বাজারে গিয়ে সবাইকে ঘটনাটা বলল।
মোবাইলে থানায় জানান হল। ঘটনাস্থলে পুলিশ ছুটে এলো। ততক্ষণে মতিউরও সেখানে হাজির। সঙ্গীদের সে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করল। যথারীতি থানায় মামলা হল। এটি যে নিছক কোনো ডাকাতির উদ্দেশ্যে সংঘটিত ঘটনা নয়, তা ছিল সুস্পষ্ট। কিন্তু হীরু সরকার, সরকার সমর্থক স্থানীয় নেতা হওয়ার কারণে মামলা স্থবির হয়ে পড়ল। এলাকাবাসী এ নিয়ে মিটিং-মিছিল করল। কিন্তু ফলাফল তেমন কিছুই পাওয়া গেল না। এলাকাবাসীর বুঝতে বাকি থাকল না, এটি ছিল মতিউরকে হত্যার উদ্দেশ্যে করা পরিকল্পিত হামলার ঘটনা। সৌভাগ্যক্রমে মতিউর সেই সিএনজিতে না থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে গেছে।
স্থানীয় নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছিল, মতিউরের ওপর এলাকাবাসীর চাপও তত বাড়ছিল। তাদের দাবি একটাই, মতিউরকে দুষ্ট লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। মতিউরের মা এলাকাবাসীর পক্ষ নিয়ে ছেলেকে বুঝাতে লাগলেন। তবুও মতিউরের কথা একটাই, কোনো দুষ্ট লোককে সে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। কিন্তু এলাকাবাসী নাছোড়বান্দার মতো তাকে বুঝাতে লাগল। তাতেও কাজ হল না। শেষ পর্যন্ত তার মা তাকে বাবার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে পা বাড়ানোর তাগিদ দিলেন। তাতে মতিউর সিদ্ধান্ত পাল্টাল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে বলল, ‘আপনারা যা ভালো মনে করেন।’
কৃষ্ণপুরজুড়ে নির্বাচনী আমেজ। চারদিক জুড়ে পোস্টার আর ব্যানারে ছেয়ে গেছে। এদিকে হীরু সরকারের সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও মতিউরের পোস্টার, ব্যানারে ছেয়ে গেছে। কিন্তু সমস্যা হল মতিউরের পোস্টার, ব্যানার রাতের আঁধারে কে বা কারা নষ্ট করে ফেলেছে। এলাকাবাসী এ নিয়ে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করলেও খুব বেশি বাড়াবাড়ি করল না। প্রচারণার শেষ দিনে এলাকাবাসী এক অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিল। হীরু সরকারকে শান্ত রাখতে তার গণমিছিলে যোগ দিল প্রায় সবাই। অপরদিকে মতিউরের গণমিছিলে যোগ দিল মাত্র ৫/৭শ’ লোক। এতে করে হীরু খুবই খুশি হল এবং কেন্দ্র দখল কিংবা ভোট ডাকাতির সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়াল। সে ভাবল এত লোকের সমর্থন থাকতে তার এসবের দরকার নেই।
যথারীতি নির্বাচনের দিন সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হল। শান্ত পরিবেশ। ভোটগ্রহণ শেষ হতেই প্রতি কেন্দ্রের আশপাশে হাজারও জনতা জড়ো হতে থাকল। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন কেন্দ্রের ফলাফল প্রকাশ হতে থাকল। হীরু সরকার পরিস্থিতি আঁচ করতে পারল। তার অনুগত বাহিনী হাঙ্গামা সৃষ্টির চেষ্টা করল। কিন্তু জনতার রোষাণলে পড়ার ভয়ে তারাও পালিয়ে গেল। রাত ৯টায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করলেন। তাতে জানা গেল মতিউর ৫৫ হাজার ভোট আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হীরু সরকার পেয়েছে মাত্র সাড়ে সাত হাজার ভোট। সাধারণ সদস্য এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনেও মতিউর সমর্থক হিসেবে পরিচিতরাই জয়ী হয়েছেন। কৃষ্ণপুরের আকাশে যেন এক নতুন সূর্য উদিত হল। চারদিক জুড়ে উচ্চারিত হতে থাকল। তোমার নেতা আমার নেতা- মতিউর ভাই, মতিউর ভাই।
উন্নয়নের যোগ্য নেতা- মতিউর ভাই, মতিউর ভাই।
শৈশবেই পিতৃহারা মতিউরকে তার বড় মামা নিয়ে গিয়েছিলেন। মামার তত্ত্বাবধানে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেছে। দেখতে-শুনতে যেমন ভালো, আচার-ব্যবহারও অমায়িক। ২ মিনিট তার সঙ্গে কথা বললেই বুঝা যায়- ছেলেটি সুশিক্ষিত এবং ভদ্র পরিবারের সন্তান। কিছুদিন হল গ্রামে এসেছে। বাবার স্বপ্ন পূরণই যেন তার জীবনের ব্রত। কিন্তু গ্রামে আসার পর থেকেই সরকারের লোকজন তাকে নানাভাবে হয়রারি শুরু করেছে। পাশের গ্রামের ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনায় তাকে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি ছিল- নিজের গ্রামে বিদ্যুৎ নেই বলে মতিউর ঈর্ষান্বিত হয়ে কাজটি করিয়েছে। আর মাদক ব্যবসায়ী মুক্তারের মেয়েকে দিয়ে ফাঁসানোর প্রচেষ্টায় যুক্তি ছিল- এটা মতিউরের বয়সের দোষ। হীরু সরকারের মনে হল মতিউরের জীবন যেন অনন্ত-মৃত্যুহীন। সে যেন তার বাবার প্রতিনিধি হয়েই গ্রামে ফিরে এসেছে। শুরুতেই তাকে আটকানো না গেলে নিজের দুই যুগের রাজত্ব তছনছ হয়ে যাবে। গ্রাম থেকে প্রায় দুই যুগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও গ্রামের সাধারণ মানুষ যেন তার ফিরে আসার জন্যই পথ চেয়ে বসেছিল। পথঘাটে সবাই মতিউরের প্রশংসা করে। তাই হঠাৎ বুকের ভেতর প্রতিহিংসার বিষ ছড়াতে থাকে। প্রতিপক্ষের প্রতি ঈর্ষা। প্রতি মুহূর্তে নিজে ক্ষয় হচ্ছেন, হেরে যাচ্ছেন, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন অথচ মতিউর বিনা চেষ্টায় এগিয়ে চলছে সুন্দর আগামীর পথে। এমন প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেঁচে থাকতে দিতে চায় না তিনি। তাই জরুরি এক বৈঠক ডেকেছেন অনুগত কর্মীদের নিয়ে। তার পালিত সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা বৈঠকের স্থানটিকে ঘিরে রাখল।
হঠাৎ একজন জানতে চাইল- ‘মতিউর আপনার ছেলের বয়সী... সমস্যা কী?
: ‘চুপ’ বোকার মতো কথা বলবি না। এমএ পাস একটা ছেলে জজ-ব্যারিস্টার হতে পারবে। এমনকি এলাকার মানুষ তাকে প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নিতে পারে। তাই যা করার শুরুতেই করতে হবে। কথাগুলে বলেই হীরু সরকার এক চুমুকে এক গ্লাস পানি পান করে নিল। বৈঠকে উপস্থিত থাকা বয়োবৃদ্ধ আমিন সাহেবের কথাগুলো ভালো লাগেনি। তবু কৌশলগত কারণে চুপ করে বসে রইলেন। বৈঠকে সর্বশেষ এ মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হল, মতিউরকে এখনই খুন করা হবে না। তাহলে অনেকেই বিষয়টা সহজভাবে মেনে নেবে না। বরং যে কোনো মূল্যেই হোক তার চরিত্রে কালিমালেপন করতে হবে। সমাজে তাকে বাটপাড়, লম্পট ও লোভী হিসেবে পরিচিত করার মিশন শুরুর চূড়ান্ত শপথ নিল হীরু সরকারের অনুগত দুষ্ট লোকেরা।
মতিউর গ্রামের যুবকদের নিয়ে একটি সমিতি গঠন করেছে। সমিতির সদস্যদের নিয়ে সে গ্রামের ভাঙা রাস্তাঘাট মেরামত করে, দরিদ্রদের সহায়তা করে। দিন দিন পাশের গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে মতিউরের সুনাম। জ্বালা বাড়ছে হীরু সরকারের। বৈঠকে থাকা সেই বৃদ্ধ লোকটি লোক মারফত বৈঠকের সিদ্ধান্তটি মতিউরকে জানানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই থেকে মতিউর খুব সাবধানে চলাফেরা করে। কিন্তু বিপদ তো আর আগাম ঘোষণা দিয়ে আসে না। তাছাড়া কোনোভাবেই মতিউরকে ঘায়েল করতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়ছিল হীরু সরকারের বাহিনী।
মতিউরের বাবার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির নির্বাচনে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। দুটি প্যানেল ঘোষণা করা হল। একটি মতিউর সমর্থিত, অপরটি হীরু সরকারের সমর্থিত। নির্বাচনে হীরু সমর্থক প্যানেলের ভরাডুবি ঘটল। এতে হীরু সরকার আরও ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। আর পারা যায় না। আর ছাড় দেয়া যায় না। তাই এবার মতিউরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল তারা। একের পর এক বৈঠক করল তারা। ঘটনা এলাকায় নয়, অন্যত্র কোথাও ঘটাতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় গাড়িচাপা দিতে পারলে।
এলাকার লোকজন স্পষ্টতই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছিল। আতংক বাড়ছিল হীরু সরকারের। হীরুর যে কোনো অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে মতিউর রুখে দাঁড়ায়। এলাকাবাসীকে সচেতন করে তোলে। এলাকার সমস্যা ও সমাধান বিষয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে ও জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করে। স্থানীয় বাজারে মতিউরের পক্ষ নিয়ে জোরালোভাবে কথা বলার দায়ে হীরুর লোকজন মিলনকে বেধরক পিটিয়ে আহত করল। মিলনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। পরদিন মতিউর ৪/৫ জন সঙ্গীসহ মিলনকে দেখতে হাসপাতালে গেল। সেখান থেকে রওনা হতে রাত ১০টা বেজে গেল। পথিমধ্যে মতিউরের জরুরি একটা ফোন এলো। আবার হাসপাতালে যেতে হবে। সিএনজি থামিয়ে সে পথিমধ্যে নেমে গেলে। অন্য এক সিএনজিতে চড়ে পেছনের পথে রওনা দিল আবার। সঙ্গীদের সে বাড়ি চলে যেতে বলল। সঙ্গীদের সিএনজি লক্ষ্মীপুর এলাকার বেইলি ব্রিজের পাশে আসতেই বাঁধার সম্মুখীন হল। পথে গাছের বড় গুঁড়ি ফেলানো। বাধ্য হয়ে চালক সিএনজি থামাল। মুহূর্তেই শুরু হল চতুর্মুখী আক্রমণ। ওরা ভেবেছিল মতিউর ভেতরে আছে। মতিউরকে না পেয়ে ওরা আরও ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। ওরা সিএনজিতে আগুন ধরিয়ে দিল। মতিউরের অনুগতদের বেধরক পেটাল। সিএনজির চালক প্রাণভয়ে পালিয়ে গেল। দৌড়ে সে কৃষ্ণপুর বাজারে গিয়ে সবাইকে ঘটনাটা বলল।
মোবাইলে থানায় জানান হল। ঘটনাস্থলে পুলিশ ছুটে এলো। ততক্ষণে মতিউরও সেখানে হাজির। সঙ্গীদের সে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করল। যথারীতি থানায় মামলা হল। এটি যে নিছক কোনো ডাকাতির উদ্দেশ্যে সংঘটিত ঘটনা নয়, তা ছিল সুস্পষ্ট। কিন্তু হীরু সরকার, সরকার সমর্থক স্থানীয় নেতা হওয়ার কারণে মামলা স্থবির হয়ে পড়ল। এলাকাবাসী এ নিয়ে মিটিং-মিছিল করল। কিন্তু ফলাফল তেমন কিছুই পাওয়া গেল না। এলাকাবাসীর বুঝতে বাকি থাকল না, এটি ছিল মতিউরকে হত্যার উদ্দেশ্যে করা পরিকল্পিত হামলার ঘটনা। সৌভাগ্যক্রমে মতিউর সেই সিএনজিতে না থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে গেছে।
স্থানীয় নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছিল, মতিউরের ওপর এলাকাবাসীর চাপও তত বাড়ছিল। তাদের দাবি একটাই, মতিউরকে দুষ্ট লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। মতিউরের মা এলাকাবাসীর পক্ষ নিয়ে ছেলেকে বুঝাতে লাগলেন। তবুও মতিউরের কথা একটাই, কোনো দুষ্ট লোককে সে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। কিন্তু এলাকাবাসী নাছোড়বান্দার মতো তাকে বুঝাতে লাগল। তাতেও কাজ হল না। শেষ পর্যন্ত তার মা তাকে বাবার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে পা বাড়ানোর তাগিদ দিলেন। তাতে মতিউর সিদ্ধান্ত পাল্টাল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে বলল, ‘আপনারা যা ভালো মনে করেন।’
কৃষ্ণপুরজুড়ে নির্বাচনী আমেজ। চারদিক জুড়ে পোস্টার আর ব্যানারে ছেয়ে গেছে। এদিকে হীরু সরকারের সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও মতিউরের পোস্টার, ব্যানারে ছেয়ে গেছে। কিন্তু সমস্যা হল মতিউরের পোস্টার, ব্যানার রাতের আঁধারে কে বা কারা নষ্ট করে ফেলেছে। এলাকাবাসী এ নিয়ে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করলেও খুব বেশি বাড়াবাড়ি করল না। প্রচারণার শেষ দিনে এলাকাবাসী এক অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিল। হীরু সরকারকে শান্ত রাখতে তার গণমিছিলে যোগ দিল প্রায় সবাই। অপরদিকে মতিউরের গণমিছিলে যোগ দিল মাত্র ৫/৭শ’ লোক। এতে করে হীরু খুবই খুশি হল এবং কেন্দ্র দখল কিংবা ভোট ডাকাতির সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়াল। সে ভাবল এত লোকের সমর্থন থাকতে তার এসবের দরকার নেই।
যথারীতি নির্বাচনের দিন সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হল। শান্ত পরিবেশ। ভোটগ্রহণ শেষ হতেই প্রতি কেন্দ্রের আশপাশে হাজারও জনতা জড়ো হতে থাকল। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন কেন্দ্রের ফলাফল প্রকাশ হতে থাকল। হীরু সরকার পরিস্থিতি আঁচ করতে পারল। তার অনুগত বাহিনী হাঙ্গামা সৃষ্টির চেষ্টা করল। কিন্তু জনতার রোষাণলে পড়ার ভয়ে তারাও পালিয়ে গেল। রাত ৯টায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করলেন। তাতে জানা গেল মতিউর ৫৫ হাজার ভোট আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হীরু সরকার পেয়েছে মাত্র সাড়ে সাত হাজার ভোট। সাধারণ সদস্য এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনেও মতিউর সমর্থক হিসেবে পরিচিতরাই জয়ী হয়েছেন। কৃষ্ণপুরের আকাশে যেন এক নতুন সূর্য উদিত হল। চারদিক জুড়ে উচ্চারিত হতে থাকল। তোমার নেতা আমার নেতা- মতিউর ভাই, মতিউর ভাই।
উন্নয়নের যোগ্য নেতা- মতিউর ভাই, মতিউর ভাই।
No comments