কবিতার ভাষা : সাম্প্রতিক অন্বেষা by হামিদ রায়হান

আদি-বয়নের মাধ্যমে একদিকে ঘটে যে উচ্চারণের কৌণিক বিন্যাস আর অন্যদিকে বহুস্বর সঙ্গতির প্রয়াস আত্মস্থ করে নেয় বিভিন্ন তাৎপর্যের দ্বন্দ্বকে; আর এভাবে বহুস্বরসঙ্গতিময় প্রতিবেদনে পৌঁছানোর তাগিদে কবি নির্মাণ করেন তার কবিতার ভাষা। এতে কবিতার আপাত-সমাপ্তি ঘোষিত হলেও কবির বিশিষ্ট নির্বাচিত উচ্চারণে যে দ্বিবাচনিক অন্বয় গড়ে ওঠে, এর নিবিড় অন্বেষণই আমাদের জায়মান পাঠকৃতির উৎস যে কোনো শিল্প একটি নির্দিষ্ট দেশকালের কাঠামোতেই নির্মিত হয়। সে সমন্বিত করে চারপাশের চেনাজানা সবকিছুকে। বহুমাত্রিক পরিপার্শ্বের ক্রিয়া-বিক্রিয়া যৌগিক প্রকৃতিকে পাঠলব্ধ বোধ ও ব্যঞ্জনায় বিমূর্ত করে তোলে। দু’ভাবে সে তা তুলে ধরে। প্রথমত, ভঙ্গি ও আচরণের মাধ্যমে; দ্বিতীয়ত, ধ্বনি বা শব্দ গঠনের মাধ্যমে।
ধ্বনি বা শব্দসমবায়ের সাহায্যে যত বেশি পরিমাণ মনোভাব সৃষ্টি করা যায়, ভঙ্গি ও আচরণের সাহায্যে ততটা পারা যায় না। ভঙ্গি ও আচরণের সাহায্যে মাত্র গুটিকয়েক আঙ্গিক মুদ্রা সৃষ্টি করা যায়; তবে বেশিদূর এগোনো যায় না; কিন্তু ধ্বনির সহায়তায় মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাব প্রকাশ করা সম্ভব। তাই এ ধ্বনিই হচ্ছে ভাব প্রকাশ করার মাধ্যম। ধ্বনিই হয় এক ধরনের ভাষাচিহ্ন। মানুষ এ চিহ্নকে তার পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে, প্রকৃতি থেকে তুলে এনে ধ্বনি-সমবায়ে কিংবা শব্দের মধ্য দিয়ে শৃংখলাবদ্ধ করে, ফলে শব্দ বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় এর দ্যোতক ও দ্যোতিতের ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় ব্যাপকতা স্পষ্ট করে তোলে; সঙ্গে এ শব্দ নানা বিষয়, নানা উপকরণের Synecdoche (সিনেকডকি) বা অখণ্ডতা নির্দেশ করে এবং তার অন্তর্গত রয়েছে স্থান, কাল, পাত্র, ইতিহাস, বোধ, চেতনা প্রভৃতি। এসব উপাদান বিজারিত হয়ে ঐতিহ্যিক টেক্সটকে জাগিয়ে তোলে- কাব্য শিল্পের অনুসন্ধিৎসার বিমোচনে; এবং এনে দেয় এক ভিন্ন মাত্রিক মেটাফর। এ মেটাফর, বস্তু-চেতনা-সময়, এ সবের ক্রান্তি দর্শনে, সত্যকে ভেঙে রূপকের মাধ্যমে এক ভাষাচিত্র নির্মাণ করে; সঙ্গে নির্মাণ করে নিজকে ভাঙার, চিত্রিত করার শৈল্পিক ভঙ্গি এবং এর জটপাকানো সময়, ইতিহাসবোধ। এ বোধের কাছেই উপলব্ধি চিহ্নায়নের গোপন চাবি থাকে, যা অনুশীলিত চেতনার উত্তরণে বিশেষ সহায়ক শক্তির ভূমিকায় আবির্ভূত হয় এবং এনে দেয় এক নৈর্ব্যক্তিকতার বোধ; সে সঙ্গে বহুস্বর সঙ্গতির আয়তনকে ক্রমশ জোরালো করে তোলে। ফলে শব্দ হয়ে ওঠে চিন্তার ও সংস্কৃতির একরৈখিক আবরণ ভেঙে বহুস্বরা সংস্কৃতির অন্বেষণ ও আর্কিটাইপ; এবং কবিতার ভাষা, এর অখণ্ড ও অনন্তের দ্যোতনা।
যেহেতু কবিতার ভাষা এবং পদান্বয় কিংবা উপলব্ধির চিহ্নায়ন, বাচনিক অভিব্যক্তি ও শাব্দিক উপকরণের প্রয়োগ : সব ক্ষেত্রে কেবল নিয়ম ও অভ্যাস-অতিযায়ী সংকেত ব্যাস্ত হওয়ার উদ্ভাসক নয় কেবল, পরাবাস্তবতারও চিহ্নায়ক; এসব সমান্তরালভাবে বহমান সম্ভাব্যতার এক পরাজগৎ নির্মাণ করে, ভিন্নার্থে যা আমাদের ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক অস্তিত্বেও চেনা আদল, কবিতার পরাভাষায় নির্মিত অন্যতর আর্শিতে তাকে সামগ্রিক অবয়বে মূর্ত করে তোলার প্রয়াস লক্ষণীয়। আর এ-প্রয়াস সচেতন ও অবচেতন, দু’ভাবে হয়ে থাকে। এ-প্রসঙ্গে নর্মান ফ্লেয়ারক্লাত্ত’র মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন : There is struggle over the structuring of texts and orders of discourse. এ-প্রসঙ্গে তার সুচিন্তিত মন্তব্য আমাদের বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারে: ‘Discourse may be stylistically heterogeneous due to contradictions and pressures in the speech situation’.
আমি’র জানালা খুলে বিচিত্র চিত্র দেখার জন্যই সৃষ্টি হয় ফ্রয়েডিয় মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতির, আর লাকাঁর মানবিক চৈতন্যের অস্তিত্ববাদী সমস্যা ও চরিত্রকে উন্মোচন করার প্রয়াস লক্ষযোগ্য; আর সামগ্রিক উপলব্ধির চিত্র ধারণ করে তার মূল ভাষা। কবিতার পরিসরের মধ্যে প্রচ্ছন্ন অন্তর্নাট্যের একাধিক স্তরে স্ব-ভূমিকায় প্রকাশ পেতে থাকে। এ আত্মবিভাজিত সত্তার দর্পণে যুযুধান জগৎ ও জীবনের ফেনিল ও তীব্র অপরতার যে-স্তর উন্মোচিত হয়, তা আসলে কবিতার ভাষার পটভূমি। এ যে আসল গভীরতর উদ্ভাসনের সূচনাবিন্দু মাত্র, এইটে বুঝতে অসুবিধে হয় না। কারণ, কবি যতটুকু জানান, তার সঙ্গে সমান্তরাল এক বৃহত্তর না-জানার পরাজগৎ উন্মুখ হয়ে থাকে। ভিন্নার্থে বলা যায়, শব্দ ও নৈঃশব্দের দ্বিবাচনিকতার, এর ক্রমোন্মোচনের পথ কীভাবে তৈরি হয়, তার কূটাভাস কবির আদি-বয়নে অন্তর্হিত থেকে যায়। এ সম্পর্কে Stanley Burnashaw এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন : 'All verses are composed of sounds and silence' যা শাব্দিক ও পারিভাষিক, উভয় অর্থেই আমাদের ভাবনাকে সমর্থন করে। যে ভাবনা অভিজ্ঞতার অন্তর্গত করে তোলার জন্য ন্যূনতম নিভৃতি চায়, তখনই এর সঙ্গে আরও একটা বিশিষ্ট শব্দের সংঘাত আমাদের মস্তিষ্কে. হাতুড়ির আঘাত হানে। কারণ কবির বাচনে যে উহ্যতা, তাতে তৃপ্ত না হয়ে তিনি শূন্যায়নকে বাক্সময় করে তুলতেও প্রয়াসী। এ প্রসঙ্গে পিয়ের মাশেরের সুচিন্তিত প্রবাদপ্রতিম মন্তব্য লক্ষ্য করা যায়: 'By speech, silence becomes the centre and principle of expression, its vanishing point. Speech eventually has nothing more to tell us; we investigate the silence, for it is the silence that is doing the speaking' এ প্রসঙ্গে সন্জিদা খাতুনের মন্তব্যও বিবেচনার প্রাসঙ্গিকতা স্বীকার করা যায়। তিনি বলেছেন : ‘কবিতার শ্রাব্য ধ্বনি-সমাবেশে শ্রুত আর অশ্র“ত ধ্বনির পরস্পর লীলা বড় ভূমিকা পালন করে। ধ্বনি স্রোত ক্ষণে ক্ষণে আপন বেগ সংবরণ করে আপনার চতুর্দিকে নিঃশব্দের ঘের রচনা করেই ফুটিয়ে তোলে আপন বৈশিষ্ট্য। কবিতার মূলস্বা ধ্বনিত করার কাজে এ অবকাশের যথোচিত মূল্য বুঝে নিতে হবে। ... এই অশ্রুত ধ্বনি হৃদয়গহনে বাজে ...।’
দুই.
কবিতার ভাষিক পরিপ্রেক্ষিতে স্থান-কালিক এক সীমাবদ্ধতার সূচনা। সীমাবদ্ধতা আছে বলেই অতিক্রমণ। এ সীমার বাস্তবতাকে অস্বীকার নিভৃতে, অন্তর্লীনতার প্রক্ষেপণে; নতুন মাত্রার বিস্তার ও ব্যাপ্তিতে। মূলত এ মাত্রা এক প্রতিরূপ নির্মাণের। এ নির্মাণ চেতন-অবচেতন, অদৃষ্ট-অননুভূত বাস্তবতার দেশ-কালিক পঠন এবং তার অন্তঃ ও বহিঃসত্তার ভাব ব্যাকরণও। কিন্তু কবিতার ভাষিক প্রতিরূপ-নির্মাণ প্রক্রিয়া এক বিশৃংখল ভাষিক উপলব্ধির সক্রিয়তাকে রূপ দেয়, যাতে এক মায়াবি জগতের বিপুল রহস্যেও স্বতঃস্ফূর্ত আসা-যাওয়া যা কবির বিষয়ী-সত্তার সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে ঘটে, যা কবির অনিবার্য ফোকাস। কবিতার দেহ বা ফরমেট সৃষ্টিতে কবি যা জানেন না তাই তার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়; কারণ জানাকে তার পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ অজ্ঞতা অনিবার্য অবচেতন ফোকাসের দ্যোতক হিসেবে নির্মাণকে পূর্ণতা দেয়। কেননা নির্বাচন শিল্পের প্রেরণ কোণের বিপ্রতীপে অবস্থান করে সর্বদা। যা হোক, কাব্য নির্মাণের এ অনিবার্য অবচেতন ফোকাস-এ মধ্যেই যেহেতু ব্যাপ্ত ও সংগুপ্ত প্রকৃতির মহত্তম নিচতম শৈল্পিক, সেহেতু এর রয়েছে এক ব্যবহারিক সমস্যা। তবে এ সমস্যার কোনো সৃজনশীল কবির, পাঠকের নয়। এ সমস্যা মূল কাব্যাজ্ঞানের কোনো অতলান্ত রহস্য, কিংবা সার্বিক মানবিক-মাননিক কাব্য উপলব্ধির অনগ্রসরতা, কিংবা হয়তো কাব্যেও কোনো অনির্ধারিত সত্য রয়েছে যা বাস্তবের গতানুগতিকতার অনধিগম্য। কারণ কাব্য সত্য ও বাস্তব সত্য কোনো পূর্ব নির্ধারিত রৈখিকতায় আবদ্ধ নেই আর। শুধু নির্মিতির চাতুর্য, শব্দ-সমবায়ে আবশ্যিকতা কিংবা প্রতিবেদনের দার্শনিকতা দিয়ে কবিতার ভাষা ও তার সত্যের সাম্প্রতিক দিগন্ত বিস্তারকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না; যাবেও না। ব্যবহারিক জগতে দৃশ্যমান অনুষঙ্গগুলো ইদানীং এত দ্রুত বাঁক নিচ্ছে যে তথাকথিত ‘বানস্তবতা’ এক অর্থে কাকতাড়ুয়ার মতো অলীক ও উদ্ভট প্রতিপন্ন হচ্ছে। কারণ পরিক্রমার কোনো নির্দিষ্ট কক্ষপথ নেই, কোনো কেন্দ্র বা লক্ষ্যবিন্দুও নেই; তাই কবিতার মধ্যে নির্মীয়মাণ সন্দর্ভ প্রতিনিয়ত সম্ভাব্য এক প্রতিসন্দর্ভের সঙ্গে সংঘর্ষাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। ফলে বিলীন বা চুরমার হয়ে যাচ্ছে আত্মগত ভাস্কর্য, যত্নে-গড়া প্রতীকায়িত চিত্রকল্পগুলো এবং উপলব্ধির পরিক্রমা। এ শূন্যায়তনকে উপলব্ধির পরা-যুক্তিতে অর্থাৎ বয়নের নিজস্ব পরাভাষায় ভরাট করে নিয়ে কবিকে বুঝে নিতে হয় কীভাবে বাস্তবের অনুপুঙ্খগুলো মূর্ত হয়ে উঠছে কিংবা রূপকের পরাভাষা দ্বিবাচনিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বাস্তবতার আয়তনের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে, যাতে সমান্তরালভাবে প্রবহমান এক দ্বিবাচনিক অপর সত্তার পরা-ভাষাশ্রয়ী প্রতিবেদন নির্মিত হয়। এ প্রতিবেদন পরস্পর অবিচ্ছেদ্য যেসব স্তরের ন্যাসে-প্রতিন্যাসে গড়ে ওঠে, তার প্রতিটি শব্দের সঙ্গে সঙ্গে শব্দবিভাজনও গুরুত্বপূর্ণ, বহমানতার সঙ্গে ছেদের অন্বয় বা অনন্বয়, সংবেদনশীলতা দিয়ে উচ্চারণের বহুরৈখিকতা ও কবির আদি-বয়ন থেকে আহূত হয়েও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করে। এ আদি-বয়নের মাধ্যমে একদিকে ঘটে যে উচ্চারণের কৌণিক বিন্যাস আর অন্যদিকে বহুস্বর সঙ্গতির প্রয়াস আত্মস্থ করে নেয় বিভিন্ন তাৎপর্যের দ্বন্দ্বকে; আর এভাবে বহুস্বরসঙ্গতিময় প্রতিবেদনে পৌঁছানোর তাগিদে কবি নির্মাণ করেন তার কবিতার ভাষা। এতে কবিতার আপাত-সমাপ্তি ঘোষিত হলেও কবির বিশিষ্ট নির্বাচিত উচ্চারণে যে দ্বিবাচনিক অন্বয় গড়ে ওঠে, এর নিবিড় অন্বেষণই আমাদের জায়মান পাঠকৃতির উৎস, যা অপরতার দর্পণে প্রতিফলিত বহুবিভাজিত সত্তার সত্য ও সত্যভ্রম উপলব্ধিতে সহায়তা করবে; অর্থাৎ বাখতিনের মৌল অনুভব, ‘Nothing is anything in itself’-এর প্রাসঙ্গিকতাকে বিশিষ্টতা দান করে।
তিন.
কবিতার ভাষা কৃতি-অতিরিক্ত গ্রন্থন (extra-textual structure)-এর যে জটিলতা তা সম্পূর্ণভাবে আধুনিক ও অতি আধুনিকতাবাদীরই সৃষ্টি। এ জীর্ণ ও ক্লিশে আধুনিকতাবাদী বৃত্তাবদ্ধ কবিতার ভাষা শৈলীর এক রৈখিকতা ভেঙে, তৈরি হচ্ছে আজকের কবিতার বাক এবং তা হয়ে উঠেছে ক্রমশ সংস্কৃতিমুখী বহুস্বরের সাঙ্গীতিক ভাষা। সমাজ ও ঐতিহ্য এবং জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কশূন্যতার প্রেক্ষাপটে কবিতার ভাষায় মাত্রারিক্ত ব্যক্তিক উচ্চারণের একমুখো, আপাতসরল দুর্বোধ্য গ্রন্থনা ও কৃত্রিম অন্তঃসারশূন্য উলম্বচারী জীবনচেতনার ক্ষুদ্রগণ্ডির অভিঘাতে কবিতার ভাষায় একটি প্রান্তিক অবয়ব লক্ষ্যগোচর হয়ে ওঠে। সমাজ-সম্পর্কশূন্য অথচ জটিল ও দুর্বোধ্য অভিজ্ঞতার বৃত্তাবর্তে পড়ে তা উচ্চারিত ও মুখর হতে থাকে অস্বাভাবিক ও বিপর্যয়ের বাক্যবন্ধরূপে; এবং ভাষা সংস্থাপনের ভঙ্গি হয়ে ওঠে একটি বিমূর্ত, অলভ্য ও অন্তঃসারহীন চাকচিক্যময় কাব্যভাষার শব্দ গঠন। এ সময়ের কবিতার ভাষা লক্ষ করলে দেখা যায় তা অধিকাংশ (ব্যতিক্রম আছে, তবে তা খুব ক্ষীণ) আধুনিকতাবাদী কবিরই উগ্র প্রবণতায় পর্যবসিত। প্রত্যেক কবির সাজানো কিন্তু অস্বতঃস্ফূর্ত আর্তি, নিঃসঙ্গতাবোধ, হতাশা এবং ক্লেদাক্ত উপলব্ধি- ভাষাকথনের প্রকাশ একই মাত্রায়, একই বিন্যাসে সাজানো ও গোছানো। সামগ্রিক সামাজিকতার অভাব, সঙ্গে দার্শনিক প্রত্যয়ের পৌরুষেরত্বের অভাবের ফলেই কবিতার ভাষা পরিবর্তনশীল, এর বিপরীতে আধুনিকতাবাদীদের উচ্চারণ একটি স্রোতহীন ভাষাচক্রে সমর্পিত। এ বিপত্তির উৎস অন্তর্নিহিত জীবনবোধে এবং মহৎ উত্তরণের আকাক্সক্ষাহীন অস্থিহীন ব্যক্তিস্বরের উন্মত্ততা ও ভ্রান্তির ভেতর।
যে ভাষার ভিত্তি বিভ্রান্তির মধ্যে ভিন্নার্থে ঔপনিবেশিক শিল্প-সংস্কৃতির মধ্যে শেকড়ায়িত, যা তিরিশের কালচক্রে য়ুরোপের যে অধরাবাহিক ফসল তাকে পাশ কাটিয়েই আজকের কবিতার এ বাক্ পরিবর্তন; সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বহুস্বরা সংস্কৃতির ভাষা, যার স্বরচেতন মায়াবি বিন্যাসে সব মিলিয়ে জীবনের জগতের সব এবং কবিতা হয়ে উঠছে কৃতি। স্বনিম তত্ত্বের (phonemic theory) ধারাবাহিকতায় অর্থিম তত্ত্বে (sememe theory) থেকে যে আকরণমূলক বাগর্থের (structural semantics) সূত্রপাত; এ seme-এর মাধ্যমে সব ধরনের বাগর্থ (verbal meaning)-এ গ্রন্থিত বাক্যগুলো কৃতির (Text) অর্থদ্যোতনার সামগ্রিকতা, যাকে গ্রিমাস Totalite de signification বলে চিহ্নিত করেছেন, তা ব্যাখ্যা করা যায়। গ্রিমাস যে বৈপরীত্যের কথা বলেছেন তা হল Immanence & manipulation-এর বৈপরীত্যের কথা। প্রথমটি হল আমাদের অভিজ্ঞতার পৃথিবীর সব বৈশিষ্ট্যের একটা মানসিক অবধারণ চিহ্ন (conceptual map); দ্বিতীয়টির দ্বারা ভাষা বিশেষে এ অবধারণ চিত্রের semes বা তাদের বৈশিষ্ট্যের কোনগুলো কোন পরিবেশে বা পরিস্থিতিতে কেমন বিন্যাসে ব্যবহৃত হয় সে-বিষয়ে ইঙ্গিত করে। শব্দ যেহেতু বাক্য বিশেষে অর্থ বদলায়, তাই গ্রিমাসের মতে একটি শব্দের একটি অপরিবর্তনীয় মূল (invariant core) থাকে, যাতে এক বা একাধিক seme-এ পরিবেশ নির্ভর seme-এর একটি (series of contextual semes) পর্যায়ক্রম বিদ্যমান থাকে। শব্দের অর্থবোধের বেলায় এগুলোর মধ্য থেকে কোনটিকে বা কোনগুলোকে নেয়া হবে তা নির্ভর করে বাক্যে ব্যবহৃত অন্যান্য seme গুলোর পুনরাবৃত্তি। বাক্যে পুনরাবৃত্ত seme গুলোকে গ্রিমাস বলেছেন classemes, এই classemes যখন বাক্যেও ঊর্ধ্বতন স্তরে (যেমন- কবিতায়, অনুচ্ছেদে) পুনরাবৃত্ত হয় তখনই পাঠ একটি সন্তুলন (coherence) খুঁজে পায়; আর এ ভারসাম্য বা সন্তুলনই হল Isotopy.
কবিতার ভাষা যে সম্পূর্ণ কৃতি একটি সমজনিত অর্থবিজ্ঞানের স্তরে অবস্থিত; কবি চাইলেই এই সন্তুলন ও সমজনিত (homogeneity) ভেঙে ছত্রখান হয়ে যেতে পারে। তাই কবিতার বিশ্লেষণে Isotopy ভেঙে কিংবা এর বিপরীতে অবস্থান করে কীভাবে এর ভাষার জাল বোনা হয় ভাবের সমান্তরালে তাই দেখতে হবে আমাদের। যে কোনো কবিতা যা এই সন্তুলন ও সমজনিত ভেঙে হয় এর ভাষা নৈরাশ্য না এর বিপরীত, তা সামগ্রিক অর্থে নির্ভর করে এর চরিত্রের ওপর। কারণ ভাষার নৈরাশ্য-অনৈরাশ্য বলতে কিছু নেই।
কবিতার ভাষা ক্রমবিকাশমান; স্তর থেকে স্তরান্তরে প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অর্থাৎ কবিতার ভাষায় কোনো মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন নেই। কবিতার ভাষা মানুষের জিহ্বার মতো সক্রিয়। মূলত চেতনা ও উপলব্ধির ভিন্নতর বিস্তৃতিই কবিতার ভাষার উৎসাগার; আর আদিকাল থেকে ভাষার বৃত্তায়ন ঘটেছে তার পটভূমির বিবর্তনে। ভাষা মানুষের চেতনাগত এ বিবিধ রূপান্তরের ইতিবৃত্ত।
ভাষা স্বয়ম্ভরা। এ স্বয়ম্ভরা বলেই এর যেমন একটা নিজস্ব বস্তু-সংসার আছে, তেমনি সৃজনেরও একটা অর্থ-সংসার আছে ব্যাকরণ নিয়ে। তাই একথা বললে একটুও দ্বিরুক্তি হবে না যে ভাষা ও ব্যাকরণের মধ্যেকার সম্বন্ধ সমান্তর রেখা, যা ব্যাকরণ দর্পণে তাকে আর ধারার উপায় নেই। এ প্রসঙ্গে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সুচিন্তিত মন্তব্য বিশেষ অর্থে প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, ‘আমি যে ব্যাকরণের কথা বলিতেছি, তাহার উদ্দেশ্য নিয়ম রচনা নহে; নিয়ম প্রণয়ন নহে; নিয়ম আবিষ্কার। ভাষার মধ্যে অজ্ঞাত অপরিচিত নিয়ম বর্তমান আছে, সেই নিয়ম খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। নিয়ম সকল ভাষাতেই আছে। ... কেননা অনিয়ম, শৃঙ্খলারহিত ভাষা চিন্তার অগোচর। ... নিয়ম সাহিত্যের ভাষাতে আছে, লৌকিক ভাষাতেও আছে। কথাবার্তার ভাষা অনেকটা বন্ধনশূন্য বলিয়া বোধ হয়, কিন্তু বস্তুতই কি তাহা শৃঙ্খলাবর্জিত? অসম্ভব। ... কিন্তু ভূতাত্ত্বিকরা বর্তমান কালের নিয়ম আবিষ্কার করেন বলিয়া ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের রোধ হয় না। ভাষার পক্ষেও সেই এক কথা। পাণিনি ব্যাকরণ রচনা করিয়া সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তন রোধ করিতে পারেন নাই।’
ভাষা যেহেতু সংস্কৃতির বয়ন সে-কারণে কবিতা ও ভাষাতত্ত্বের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই; ফলে কবিতার ভাষার কৃতির আড়ালে যুক্ত থাকে গোষ্ঠী, জাতি, ধর্ম ও শ্রেণীচেতনা। মিথ, বিশ্বাস, লৌকিক-অলৌকিক, বস্তু ও ভাবনার বিভিন্ন আর্কিটাইপ থাকে পরিবেশ পরিস্থিতি। স্থানকালের ভঙ্গি ও বয়ন। এতসব কিছুর মিথষ্ক্রিয়ার ফলে নির্মিতি পায় কবিতার অবয়ব। আর তাকে প্রকাশের মাধ্যম হল শব্দ। কবিতার ভাষা এ শব্দকে জারন প্রক্রিয়ায় বের করে আনে তার ভেতরকার অফুরন্ত কথকতা। শব্দ একটি যতি চিহ্ন; তাই চিহ্ন ও চিহ্নিতের মধ্যেকার যে সম্প্রেষণ (communication) কবিতার ভাষার, ভাষা সেই সম্প্রেষণের আধেয়; ফলে তা অবরোহি বা আরোহী সাধারণীকরণ অতিক্রম করে হয়ে ওঠে মানবভাষা, যা কবিতার ভাষার আধেয়। আর আধেয়ই নির্মাণ করছে আজকের কবিতার ভাষাশৈলী, যা একই সঙ্গে হয়ে উঠছে ত্রিকালের ভাষা; সেই সঙ্গে চিন্তার ও সংস্কৃতির একরৈখিক আবরণ ভেঙে বহুস্বরা সংস্কৃতির অন্বেষণ।

No comments

Powered by Blogger.