আগের দিন বাঘে খাইছে- অঘাট ঘাট হইছে by মোকাম্মেল হোসেন

সিনেমা শুরু হল নায়িকার অপহরণ দৃশ্য দিয়ে। মোটাসোটা, গোলগাল চেহারার নায়িকা হেলেদুলে কলেজে যাচ্ছিল। হঠাৎ সেখানে ভিলেনের আবির্ভাব ঘটল। সে অট্টহাসি দিয়ে বলল-
: সুন্দরী! সেদিন তোমার হাত ধরেছিলাম বলে প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ করেছিলে। আজ শুধু হাত নয়, পুরো বডি তুলে নিয়ে যাব। হাঃ-হাঃ-হাঃ, এসো...
নায়িকাকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলতেই সে চিৎকার দিল-
: বাঁচাও- কে আছ, আমাকে বাঁচাও!
নায়ক মোটরবাইকে চড়ে কলেজে আসছিল। নায়িকার চিৎকার তার কানে পৌঁছতেই সে ভিলেনের পিছু ধাওয়া করল। মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর পেরিয়ে ভিলেনকে হাতের নাগালে পাওয়া গেল। ঢিসুম-ঢাসুম মারধর হল। নায়কের হাতে মার খেয়ে ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত ভিলেন পালিয়ে গেলে নায়িকা দাঁত দিয়ে ওড়না কামড়ে ধরে বলল-
: আমার নাম আঁখি। আজ তুমি না এলে, স্যরি- তুমি বলে ফেললাম!
নায়িকার ভাবভঙ্গি দেখে নায়ক আবেগে অবশ হয়ে গেল। মনে মনে বলল-
: আঁখি! আমার মনের পাখি...
দু’জন দু’জনের চোখে চোখ রাখল। দৃষ্টিতে গভীর প্রেম। এ প্রেম তাদের নিয়ে গেল কল্পনার জগতে। সেই জগতের বাসিন্দা হয়ে তারা নাচতে নাচতে গান গাইতে লগল-
: বন্ধু, এতদিন তুমি কোথায় ছিলা...
হঠাৎ পশ্চাৎদেশে ছারপোকার কামড় খেলাম। মনে হল, পর্দার গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছারপোকাটা আমাকে জিজ্ঞেস করছে-
: ও ভাইজান, এতদিন কই আছিলেন?
আক্রান্ত স্থানে চুলকাতে চুলকাতে উত্তর দিলাম-
: এতদিন দেশেই ছিলাম রে পাগলা!
আবার ছারপোকার কণ্ঠ শোনা গেল। পুটপুট শব্দ তুলে সে বলল-
: দেশে থাকলে দেখা দেন নাই কেন?
দেখা না দেয়ার কারণ একটাই- সিনেমা হলে না আসার ব্যাপারে মনের মধ্যে তৈরি হওয়া প্রবল অনিচ্ছা। এক সময় সিনেমা দেখার খুব নেশা ছিল। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম, সিনেমা হলে আধাঘণ্টার বেশি বসে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোত্থেকে কী হল, রহিমদ্দি-কলিমদ্দি আর কালু-জালুরা এ দেশের সিনেমা জগতের দখল নিয়ে নিল। তাদের মাথা থেকে যেসব জিনিস বের হতে লাগল তা সুস্থ মানসিকতার লক্ষণ নয়। সিনেমার তথাকথিত কারিগররা অশ্লীলতার চর্চা করতে করতে এক সময় দেশীয় ‘ইনস্ট্রুমেন্ট’-এর ওপর ভরসা রাখতে পারলেন না, বিদেশের দিকে ঝুঁকলেন। একবার একটা গবেষণার কাজে নোয়াখালীর বসুরহাট গেছি। সন্ধ্যার পর কোনো কাজ-কর্ম নেই। ভাবলাম- সিনেমা দেখে সময় কাটাই। টিকিট কেটে হলে ঢুকলাম। সিনেমা শুরু হল। কিছুক্ষণ পরই পর্দায় ভেসে ওঠা দৃশ্য দেখে চমকে উঠলাম। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কেউ এ দেশীয় নন। সাদা চামড়ার মানব-মানবী। এসব মানব-মানবীর কারবার দেখে সিনেমা হলের মহিলা দর্শকরা নাকে-মুখে কাপড় চেপে ছিটকে বের হয়ে গেল। তাদের পিছুুপিছু আমিও বের হয়ে এলাম।
এ ঘটনার অনেক বছর পরে আজ আবার সিনেমা হলে প্রবেশ করেছি। এটা ময়মনসিংহ শহরের প্রাচীন সিনেমা হলগুলোর একটি। দর্শকশূন্যতার কারণে ইতিমধ্যে এখানকার ৪টি সিনেমা হলের একটি বহুতল শপিং কমপ্লেক্স ও আবাসিক ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে। অন্য একটিও একই ভাগ্য বরণ করতে চলেছে। বাকি দুটি ধুঁকে ধুঁকে চলছে। ইন্টারভেলের সময় লবণ বেগম বলল-
: পান খাইতে ইচ্ছা করতেছে।
লবণ বেগমের ইচ্ছের কথা শুনে বললাম-
: একটা কিছু খাইয়া তার পরে পান খাও!
- না, আর কিছু খামু না।
: ঠাণ্ডা খাও। ঠাণ্ডা খাওয়ার পর পান মুখে দিয়া দেখ- কী টেস্ট!
- না। ঠাণ্ডা-মাণ্ডায় ভেজাল। তুমি শুধু পানওয়ালারে ডাক দেও।
: এইখানে পানওয়ালা পাবা কই?
- তাইলে!
: নিচে যাওন লাগব।
- ঠিক আছে। এক দৌড়ে যাবা, আরেক দৌড়ে আসবা।
: আইচ্ছা।
সিনেমা হলের সামনেই পান-বিড়ির দোকান। দুই খিলি পানের অর্ডার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি- হঠাৎ কাঁধে স্পর্শ অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখি আবু বকর সাহেব। তিনি টেনে টেনে বললেন-
: একলা-একলা কোনোকিছু খাওয়া ঠিক না। একটু দিয়া-থুইয়া খাইন যে!
দোকানদারকে আরেক খিলি পানের কথা বলতেই আবু বকর সাহেব মাথা নেড়ে বললেন-
: ভাই, অনেক ধন্যবাদ। আমি পান খাই না।
- তাইলে বললেন যে!
: আপনের সঙ্গে মশকরা করলাম। খবর কী বলেন।
- চলছে গাড়ি বাইগন বাড়ি। নতুন কোনো খবর নাই।
: সিনেমা দেখতে আসছেন নাকি?
- জি। ঈদের সময় আপনের ভাবী একটা সিনেমা দেখার আবদার জানাইছিল। তার আবদার উপেক্ষা করতে পারি নাই।
: এতদিন পরে আবদার রক্ষা করতে আসছেন!
- এতদিন তো তেল-চর্বি লইয়াই কাটল। আইজ একটু টাইম পাইছি।
আবু বকর সাহেব হঠাৎ উদাসীন হয়ে গেলেন। সিনেমা হলের চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন-
: এক সময় এই হলে সিনেমা দেখার জন্য খাবার-দাবার সঙ্গে লইয়া টিকিটের জন্য লাইন দিছি। হাঃ! সেই সিনেমা হলে এখন মাছি উড়ে!
দোকানদার পানের পোটলা এগিয়ে দিল। সেগুলো হাতে নিয়ে বললাম-
: বর্তমানে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হইছে। আজকাল অনেক তরুণ নির্মাতা মানসম্পন্ন ছায়াছবি তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিভার সাক্ষর রাখতেছে।
-সেইটা তো হাতেগোনা এক-দুইটা।
: এক-দুইটা করতে করতে এক সময় এই ধারাটাই প্রতিষ্ঠিত হবে। বাতাসে চিটাগুলা উইড়া যাবে। থাকবে শুধু ধান।
আবু বকর সাহেব মাথা নেড়ে বললেন
: আশাবাদী হওয়া ভালো। কিন্তু...
হাতে সময় কম। আলাপ সংক্ষেপ করার জন্য বললাম-
: আপনে কই গেছিলেন?
- গাঙ্গিনারপাড়।
: কী জন্য?
-লাইব্রেরিতে।
: ঠিক আছে, আমি তাইলে যাই।
আবু বকর সাহেব বাঁধা দিলেন। বললেন-
: আরে দাঁড়ান দাঁড়ান। লাইব্রেরিতে কী জন্য গেছিলাম- সেইটা জানতে চাইলেন না!
লাইব্রেরিতে মানুষ যায় বইপত্র কেনার জন্য। এটা নিয়ে রহস্য করার কী আছে- বুঝতে পারছি না। বিরস মুখে বললাম-
: কী জন্য গেছিলেন?
- আরে, কঠিন অবস্থার মধ্যে পইড়া গেছি!
: কী রকম!
- গত শুক্রবার আমার ছোটছেলে আবু তালেবরে সঙ্গে লইয়া জুমার নামাজ আদায় করতে গেছি। মসজিদ থেইক্যা বাইর হওয়ার পর সে আমারে প্রশ্ন কইরা বসল-
: আব্বা, কেয়ামত সম্পর্কে ইমাম সাহেব হুজুর যা বললেন, তা কি সত্য?
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম-
: অবশ্যই সত্য। কোরআন-হাদিস তো আর মিথ্যা বলার জিনিস না।
- কিন্তু কয়েকদিন আগে আমি পত্রিকায় পড়েছি, একজন নেতা বলেছেন- কেয়ামত হলেও তারা নির্বাচন করবেন। ইমাম সাহেব হুজুরের কথা সত্য হলে এটা কীভাবে সম্ভব?
বুঝলেন, ছেলের কথা শুইন্যা আমি থ হইয়া গেলাম। ছোট্ট একটা মানুষ, সেও কথাটা ধইরা ফেলছে। কেয়ামত ও পরকাল সম্পর্কে ছেলের নানারকম প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়া দেখলাম- এই বিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত। ছেলের কাছে যাতে লজ্জা পাইতে না হয়, সেই জন্য এই বইটা কিইন্যা আনলাম।
: কী বই?
- কেয়ামতের পরে হাশরের আগে।
: আপনে এক কাজ করেন। এই বই আরও এক কপি কিইন্যা প্রীতি উপহার হিসেবে ডাকযোগে ওই নেতার কাছে পাঠাইয়া দেন।
আবু বকর সাহেব হো-হো করে হেসে উঠলেন। বললেন-
: ভালো কথা বলছেন তো! আমি এই কাজটা করব। অবশ্যই করব। রাজনীতিকরা যাত্রা-সিনেমার জোকারদের মতো ফজুল কথাবার্তা বলবে কেন? তাদের শিক্ষা হওয়া দরকার।
রাজনীতির প্রসঙ্গ উঠতেই মনের পর্দায় একজন মানুষের মুখ ভেসে উঠল। তার নাম তাজউদ্দীন আহমদ। ঢাকায় নিয়মিত তাজউদ্দীন আহমদ পাঠচক্রের আয়োজন করা হয়। এই পাঠচক্রের সদস্য হয়ে আমি দেখতে পেলাম- মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ তার রাজনৈতিক জীবনে এমন কোনো কথা উচ্চারণ করেননি, যা অপ্রাসঙ্গিক কিংবা বাহুল্য। অথচ আজকাল নেতারা সারাক্ষণ এমন সব ফালতু ও অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে বেড়ান, যা শুনলে মানুষের বমির উদ্রেক হয়। আবু বকর সাহেবের কথার রেশ ধরে বললাম-
: শিক্ষা কীভাবে হবে? বর্তমানে রাজনীতি তো আর রাজনীতির জায়গায় নাই। এখন যারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তাদের দিকে তাকাইলে মনের মধ্যে আশার বদলে হতাশা, নির্ভরতার বদলে ভয়-ভীতির উদ্রেক হয়। আগে এইরকম ছিল না।
আবু বকর সাহেব বিষণ্নকণ্ঠে বললেন-
: আগের দিন বাঘে খাইছে- অঘাট ঘাট হইছে।
তার কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে বললাম-
: একেবারে ঠিক কথা বলছেন।
আবু বকর সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিনেমা হলে ঢুকলাম। ততক্ষণে সিনেমার পরের অংশ শুরু হয়েছে। অন্ধকার হাতড়ে সিটে বসার পর লবণ বেগমের হাতে পানের খিলি তুলে দিতেই ফিসফিস করে সে বলল-
: পান দোকান থেইক্যা আনলা, না চাষ কইরা আনলা?
- দোকান থেইক্যাই আনছি।
: দোকান থেইক্যা আনতে এত সময় লাগে?
- আর বইল্য না! পানের দোকানে বক্কর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা...
: বক্কর ভাই, না কোনো বান্ধবী?
- বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা হইয়া লাভ নাই। তারা অলরেডি মা-খালার স্টেইজে চইল্যা গেছে।
: পুরান চাইল ভাতে বাড়ে।
- দেখি তো কী রকম বাড়ছে!
একপাশে সরে গিয়ে লবণ বেগম বলল-
: তাসিনের আব্বা- চারপাশে লোকজন আছে! ডোন্ট মুভ...
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.