দেবতা না দানব
নিজেকে তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে দাবি
করতেন। ভক্তরাও তাঁকে দেবতার আসনে বসাতে কসুর করেননি। আরাম-আয়েশ, ধন-দৌলত,
নাম-যশ সবকিছুই জুটেছে তাঁর বরাতে। তবুও দেবতার আকাশে আজ কালো মেঘের ঘনঘটা।
রাজার
মুকুট ধুলায় লুটাতে চলেছে। ভারতের রাজস্থান রাজ্যের যোধপুর থেকে যৌননিপীড়ন
মামলায় আটক হয়েছেন দেবত্বের দাবিদার আশারাম বাবু। তাঁর লোকেরা বলছেন, সব
কংগ্রেস সরকারের ষড়যন্ত্রের অংশ।
গুজরাট রাজ্যের আহমেদাবাদ শহরের এক কোনে বসে ৫০ বছর আগে আশারাম যে কাজের সূচনা করেছিলেন, তা আজ ভারতের ১৪টি রাজ্যের ৪৫টি আশ্রমের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে। ইন্ডিয়া টুডে সাময়িকীর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আশারাম কার্যত আশ্রম চালুর মধ্য দিয়ে নিজের ভোগলিপ্সা চরিতার্থ করার চেষ্টা করেছেন।
গত ৩১ আগস্ট আটক করা হয় আশারাম বাপুকে। অভিযোগ রয়েছে তিনি উত্তর প্রদেশের শাজাহানপুর এলাকার ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীকে ধর্ষণ করেছেন। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, ভয়ংকরতান্ত্রিক অনুষ্ঠান, হত্যা, ভীতিপ্রদর্শন, গুম ও ভূমি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রায় চার দশক আগের আসুমাল হারপালানি আজ প্রভু আশারাম বাপুতে পরিণত হয়েছেন। একদিন যিনি টাঙ্গাওয়ালা ছিলেন, আজ তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক। ভারতজুড়ে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা তিন কোটির কাছাকাছি। তাঁদের কাছে তিনি ‘পুজ্য শান্ত শ্রী আশারামজি বাপু’।
আশারাম বাপুর জন্ম ১৯৪১ সালের ১৭ এপ্রিলে। চারকোল ও খড়ি বিক্রেতা থোমল হারপালানি ও তাঁর স্ত্রী মেহাঙ্গিবার সন্তান আশারামের জন্ম হয় তত্কালীন সিন্ধু প্রদেশে, যা বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থিত। মা-বাবা শিশুর নাম দেন আশুমাল।
ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর আশুমালের মা-বাবা ভারতে চলে যান। তৃতীয় শ্রেণীর পর আশুমাল আর লেখাপড়া করতে পারেননি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি টাঙ্গা চালিয়ে, পথে পথে চা বিক্রি করে এবং বুটপালিশ করে জীবন ধারণ করেন। ষাটের দশকের শুরুতে তিনি সাধু লীলাশাহের কাছে ধ্যান ও যোগ শেখেন। এ সময় তিনি নিজে নাম ধারণ করেন আশারাম।
১৯৭৩ সালে তিনি একটি ট্রাস্ট খুলে এর অধীনে আহমেদাবাদের মোতেরা গ্রামে এক আশ্রম খোলেন। এরপর তাঁর বিপুল প্রসার ঘটে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে তাঁর বহু আশ্রম, গুরুকুল ও মহিলা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে।
১৯৯৭ সালে তাঁর আশ্রমের ২০ বছর বয়সী এক সাধিকা (সেবাকারী অনুসারী) আশারামের বিরুদ্ধে যৌননিপীড়নের অভিযোগ আনেন। এ নিয়ে শুরুতে হইচই হয় অনেক, কিন্তু অল্পদিন পরেই সব চুপ হয়ে যায়।
২০০৮ সালের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি ও ব্যক্তি সম্পত্তি দখলের অভিযোগ ওঠে। একই বছরের জুলাই মাসে তাঁর আশ্রমের ১০ বছর বয়সী দুই শিক্ষার্থীর লাশ পাওয়া যায় আশ্রমের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সবরমতি নদীতে। অভিযোগ ওঠে, আশারামের এক শিষ্য ভয়ংকর কোনো তান্ত্রিক কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে অভিষেক ও দীপেশ নামের ওই দুই ছাত্রকে হত্যা করে। এরপর রাজ্য সরকার ওই ঘটনার তদন্ত শুরু করেও বিচার করেনি। ৩১ আগস্ট ২০১৩ সালে তাঁকে আটকের পর ১ সেপ্টেম্বর পুলিশ জানায়, ৭২ বছর বয়সী আশারাম এখনো যৌন সামর্থ্য রাখেন।
আশারাম কার্যত ফোকাসে আসেন ২০০১ সালের অক্টোবরে। সে সময় গুজরাটের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আশারামের আশ্রম থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন। পরে ধীরে ধীরে জানা যায়, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী, বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি, কংগ্রেসের বর্তমান টেলিযোগাযোগমন্ত্রী কপিল সিবাল, ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিং, আকালি দলের মন্ত্রী প্রকাশ সিং বাদল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া, জনতা দলের নেতা ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্দেজসহ অনেক বড় বড় নেতা আশারামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আশারামের কর্মকাণ্ডকে ভারতের বহু মন্ত্রী ও শিক্ষিত লোক প্রভু বলে মেনে নিয়েছেন, তাই অশিক্ষিত বা বোকা লোকদের কাছে তাঁকে ঈশ্বরতুল্য বলে তুলে ধরাতে কোনো সমস্যাই হয়নি। এসবের আড়ালে আশারামের ভয়ংকর ইন্দ্রিয়পরায়ণতা জারি থেকেছে।
আশারামের সাবেক ব্যক্তিগত আয়ুর্বেদিক চিকিত্সক অম্রুত প্রজাপতি জানান, ১৯৯৯ সালে আশারাম ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। অম্রুত তখন আশারামের চিকিত্সা করতে তাঁর শান্তিকুটিরে যান। এ চিকিত্সক বলেন, আশারামের শোবার বিছানাটি বিশাল বড়। পুরো ঘর বিলাসবহুল। তাতে সংযুক্ত বাথরুম আছে, এসি আছে, আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রও বসানো ছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আশারামের আরেক অনুসারী বলেন, আশারাম কেবল এ ভয় পেতেন যে, কেউ আড়ালে তাঁর কার্মকাণ্ড ভিডিও করছে। তিনি এত ভয় পেতেন যে শোবার ঘরে সিলিং ফ্যান পর্যন্ত লাগাতে দিতেন না।
প্রজাপতি জানান, আশারাম কার্যত খুবই ইন্দ্রিয়পরায়ণ ব্যক্তি। দিনে তিন থেকে চার ঘণ্টা তিনি শরীর মালিশ করিয়ে নিতেন, দীর্ঘ সময় নিয়ে বিশেষ সাবান ব্যবহার করে গোলাপের সুগন্ধ যুক্ত জলে গোসল করতেন।
অল্প বয়সী নারীদের প্রতি আশারামের গভীর আসক্তির কারণে তাঁর অনেক ঘনিষ্ঠ অনুচর দূরে সরে গেছেন। তাঁদের অন্যতম হলেন রাজু চন্দ্রক (৫২)। তবে এর মাশুলও গুনতে হয়েছে তাঁকে। আশারাম ও তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার পর তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
আশারামের সাবেক সাধিকা সুধা প্যাটেল জানান, আশ্রম আর আশ্রম নেই, যা আছে তাতে ঈশ্বরের পূজা আর চলে না। তিনি বলেন, যখন কিশোরী বা তরুণীরা পূজার জন্য আশারামের সামনে যেত, তখন তিনি ফুল বা ফলের টুকরা পছন্দের নারীটির দিকে ছুড়ে দিতেন। এতে সাধিকারা বুঝে যেতেন কোন নারীটিকে পটাতে হবে এবং তুলে দিতে হবে আশারামের কাছে। অনেক সময় মেয়েটি রাজি না হলে আশারাম তার জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের (পূজা-অর্চনার) আয়োজন করতেন। মেয়েটির মা-বাবাকে বোঝাতেন যে ওই মেয়ের জন্য বিশেষ কাজ করা দরকার। এভাবে তিনি মেয়েদের ভোলাতেন।
গত বছরের ১৬ ডিসেম্বরে দিল্লিতে এক নারী বাসে করে ঘরে ফেরার পথে ধর্ষিত হন। এ ঘটনার পর ৭ জানুয়ারিতে আশারাম বলেন, ঘটনার জন্য ধর্ষিত নারীটিও দায়ী। আশারাম ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘তার (ধর্ষিতার) উচিত ছিল হামলাকারীদের ভাই বলে সম্বোধন করা এবং তাদের নিরস্ত হতে বলা। যদি সে তা করত, তবে তার প্রাণটিও বাঁচত।’
আশারামের লালসার শিকার নারীরা যদি তাঁকে ভাই বলে সম্বোধন করত, তবে তিনি কি নিরস্ত হতেন—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রজাপতি বলেন, ‘কখনোই না। মেয়েরা তাঁকে কেবল ভাই নয়, বাবা বলে ডাকলেও তিনি তখন থামতেন না। তিনি নিজেকে ঈশ্বর বলে মনে করতেন। তাই তিনি যা করতেন, সেটিকে ঈশ্বরের কাজ বলেই মনে করতেন।’
No comments