জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থার অবসান হোক by বিমল সরকার
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা
নিরসনে উপাচার্য ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন তার পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা
দিয়েছেন। প্রশ্ন হল, উপাচার্য পরিবর্তন হলেই কি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান
সংকটের স্থায়ী সমাধান হবে? এতে অচলাবস্থার সাময়িক নিরসন হতে পারে মাত্র।
স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজন নেতৃত্বের দূরদর্শিতা এবং যে কোনো
অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় সময়োচিত হস্তক্ষেপ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত তিন সপ্তাহ ধরে শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রম, সেই সঙ্গে প্রশাসনিক কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অশান্তি, অস্থিরতা, সমস্যা আমাদের দেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে যে সময়ে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা সবার জন্যই গভীর উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেড় মাস আগে এইচএসসির ফল প্রকাশিত হয়েছে। এ পরীক্ষায় প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষার্থী এ প্লাস পেয়ে পাস করেছে। ভালো ফলাফলধারীদের বরাবরই লক্ষ্য থাকে খ্যাতিমান একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া। ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে আসন সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। ফলে ভর্তির ক্ষেত্রে কেবল হাজার নয়, কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর মূল আগ্রহ বা উৎসাহ ঘুরপাক খেতে থাকে ঐতিহ্যবাহী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কেন্দ্র করে।
এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। দুর্গাপূজা ও ঈদুল আজহার ছুটি শেষে, বিশেষ করে নভেম্বরের শুরু থেকেই শুরু হবে ভর্তি পরীক্ষা। দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাই রয়েছে অন্ধকারে। ঈদের আগে পত্রপত্রিকায় জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা বা জটিলতা সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়েছে। সপ্তাহকাল অবরুদ্ধ থাকার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার শর্তসাপেক্ষে ছাড়া পেয়েছেন। লাঞ্ছিত করা হয়েছে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনকে। পক্ষ-বিপক্ষের অবতারণা না করেও বলা যায়, কয়েকজন সম্মানিত শিক্ষকও লাঞ্ছিত হয়েছেন। এজন্য পরস্পর পরস্পরকে দায়ী করেছেন। পদত্যাগ করেছেন একে একে তিনজন সহকারী প্রক্টর।
এ প্রেক্ষাপটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা নিরসনের যে চেষ্টা চলছে, আমরা আশা করব তা ফলপ্রসূ হবে। একের পর এক ঘটে যাওয়া অনভিপ্রেত ঘটনার পরিধি কোনোভাবেই আর যেন বিস্তৃত না হয়। ভাগ্যবিড়ম্বিত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সবার মন থেকে যাতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূরীভূত হয়। নৈসর্গিক শোভামণ্ডিত চিরচেনা ক্যাম্পাস যেন শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্ট সবার পদচারণা ও কর্মচাঞ্চল্যে মুখর হয়ে ওঠে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মর্যাদা আর যেন ক্ষুণœ না হয়। দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার এ আকুলতা।
দেশের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সময়োচিত পদক্ষেপের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতে পারে। এখানে বঙ্গবন্ধু আমলের একটি ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। ১৯৭২ সালের জুলাই মাস। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে সবাই ব্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স শেষবর্ষ ও মাস্টার্স প্রথমপর্বের কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী দাবি করে বসে, প্রস্তুতি না থাকায় তারা পরীক্ষার আসনে বসতে পারবে না, তাদের অটোপ্রমোশন দিতে হবে। কর্তৃপক্ষ রাজি না হওয়ায় এ দাবিতে তারা আন্দোলন শুরু করে। তাদের যুক্তি, টানা নয় মাসের যুদ্ধের কারণে পড়াশোনা হয়নি। অনেককেই জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। কেউ কেউ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছে। অটোপ্রমোশনের দাবিদাররা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করতে থাকে। এ আন্দোলনে ডাকসুসহ কোনো ছাত্রসংগঠনেরই শীর্ষ স্তরের কোনো নেতার কিংবা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা ছিল না। এ ছিল কেবল অনার্স শেষবর্ষ ও মাস্টার্স প্রথমপর্বের শিক্ষার্থীদের একাংশের আবদার। ১৮ জুলাই ডাকসুর উদ্যোগে টিএসসিতে এক ছাত্রসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ডাকসু নেতারা অটোপ্রমোশনের বিষয়টিকে আত্মঘাতী বলে অভিহিত করে এ ধরনের অযৌক্তিক দাবি থেকে শিক্ষার্থীদের সরে আসার আহ্বান জানান। পরদিন টিএসসিতেই শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অন্য এক সভায় উপাচার্য অধ্যাপক মোজাফফর আহম্মদ চৌধুরীও একই বক্তব্য রাখেন এবং আন্দোলনের পথ পরিহার করে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। এদিকে আন্দোলনকারীরা ক্রমে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ২০ জুলাই বেলা ১১টায় তারা বটতলায় সভা করে। সভাশেষে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে মিছিল সহকারে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে তার কার্যালয়ে যায় এবং কোনোরকম পরীক্ষা ছাড়াই ১ আগস্ট থেকে শেষবর্ষে তাদের ক্লাস শুরু করার দাবি জানায়। উপাচার্য এ সময় বিভাগীয় প্রধান ও প্রভোস্টদের সঙ্গে এ বিষয় নিয়েই বৈঠক করছিলেন। বৈঠকে আন্দোলনকারীদের অযৌক্তিক দাবি না মেনে তাদের পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ছাত্ররা সেখানে গেলে উপাচার্য বের হয়ে আসেন এবং বৈঠকের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। বিষয়টি তিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও অবহিত করেছেন বলে জানান। এ সিদ্ধান্ত শোনার পর ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা স্লোগান দিতে দিতে উপাচার্যের কার্যালয়ের সব দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়। টেলিফোন ও বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়া হয়। উপাচার্যসহ ৩০ জন বিভাগীয় প্রধান ও প্রভোস্টকে সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করে রাখে। দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত প্রায় ৬ ঘণ্টা চলে এ অবরোধ। উপাচার্য এবং সিনিয়র শিক্ষকরা মাঝেমধ্যে অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অবশেষে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসেন। তিনি আকস্মিকভাবে উপাচার্যের কার্যালয়ে এসে উপস্থিত হলে ক্যাম্পাসের সবাই বিস্মিত হয়ে পড়েন। প্রথমেই তিনি অনাকাক্সিক্ষত জিম্মিদশা থেকে শিক্ষকদের উদ্ধার করেন এবং ছাত্রদের অবরোধ তুলে নিতে নির্দেশ দেন। শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের এহেন অশ্রদ্ধা প্রদর্শনে চরম অসন্তোষ ও দুঃখ প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোমাদের মতো আমিও ছাত্র ছিলাম। জীবনে ছাত্র রাজনীতি করেছি। কিন্তু শিক্ষকদের সঙ্গে কখনও এরূপ ব্যবহার করিনি। এভাবেই শেষ হয় আন্দোলনকারীদের সেদিনের কর্মসূচি। পরে শিক্ষকদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিলেবাসের কলেবর কিছুটা কমিয়ে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছিল।
বলে রাখা দরকার, স্বাধীনতা লাভের মাত্র ছয় মাস পরের ঘটনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে বঙ্গবন্ধুর কর্মব্যস্ততা তখন ভাবনার অতীত। মাত্র দুমাস আগে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ও হল সংসদ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে তার প্রিয় ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একেবারে শীর্ষ স্তরের নেতারা প্রতিপক্ষ ছাত্র ইউনিয়ন প্রার্থীদের কাছে বলতে গেলে গোহারা হেরেছেন। এমন পরিস্থিতিতেও শিক্ষাঙ্গনগুলোর প্রতি ছিল তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি ও মনোযোগ। তাই ক্যাম্পাসে কোনো রকম অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেনি। কেবল মানতে হবে, মেনে নাও ধরনের স্লোগান আর থেমে থেমে মিছিল ছাড়া তেমন কিছুই করেনি আন্দোলনকারীরা। তবু উপাচার্য ও সিনিয়র শিক্ষকরা ৫-৬ ঘণ্টা ধরে অবরুদ্ধ আছেন- এ কথা শোনামাত্র সবকিছু ফেলে রেখে বঙ্গবন্ধু ছুটে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বঙ্গবন্ধুর প্রতুৎপন্নমতিত্ব, দূরদর্শিতা এবং সময়োচিত হস্তক্ষেপের ফলে হয়তোবা বড় ধরনের কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়েছিল সেদিন। ৪০ বছর আগের এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ঘন ঘন অচলাবস্থার কবলে পড়া থেকে রক্ষা পেতে পারে।
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত তিন সপ্তাহ ধরে শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রম, সেই সঙ্গে প্রশাসনিক কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অশান্তি, অস্থিরতা, সমস্যা আমাদের দেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে যে সময়ে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা সবার জন্যই গভীর উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেড় মাস আগে এইচএসসির ফল প্রকাশিত হয়েছে। এ পরীক্ষায় প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষার্থী এ প্লাস পেয়ে পাস করেছে। ভালো ফলাফলধারীদের বরাবরই লক্ষ্য থাকে খ্যাতিমান একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া। ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে আসন সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। ফলে ভর্তির ক্ষেত্রে কেবল হাজার নয়, কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর মূল আগ্রহ বা উৎসাহ ঘুরপাক খেতে থাকে ঐতিহ্যবাহী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কেন্দ্র করে।
এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। দুর্গাপূজা ও ঈদুল আজহার ছুটি শেষে, বিশেষ করে নভেম্বরের শুরু থেকেই শুরু হবে ভর্তি পরীক্ষা। দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাই রয়েছে অন্ধকারে। ঈদের আগে পত্রপত্রিকায় জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা বা জটিলতা সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়েছে। সপ্তাহকাল অবরুদ্ধ থাকার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার শর্তসাপেক্ষে ছাড়া পেয়েছেন। লাঞ্ছিত করা হয়েছে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনকে। পক্ষ-বিপক্ষের অবতারণা না করেও বলা যায়, কয়েকজন সম্মানিত শিক্ষকও লাঞ্ছিত হয়েছেন। এজন্য পরস্পর পরস্পরকে দায়ী করেছেন। পদত্যাগ করেছেন একে একে তিনজন সহকারী প্রক্টর।
এ প্রেক্ষাপটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা নিরসনের যে চেষ্টা চলছে, আমরা আশা করব তা ফলপ্রসূ হবে। একের পর এক ঘটে যাওয়া অনভিপ্রেত ঘটনার পরিধি কোনোভাবেই আর যেন বিস্তৃত না হয়। ভাগ্যবিড়ম্বিত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সবার মন থেকে যাতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূরীভূত হয়। নৈসর্গিক শোভামণ্ডিত চিরচেনা ক্যাম্পাস যেন শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্ট সবার পদচারণা ও কর্মচাঞ্চল্যে মুখর হয়ে ওঠে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মর্যাদা আর যেন ক্ষুণœ না হয়। দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার এ আকুলতা।
দেশের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সময়োচিত পদক্ষেপের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতে পারে। এখানে বঙ্গবন্ধু আমলের একটি ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। ১৯৭২ সালের জুলাই মাস। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে সবাই ব্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স শেষবর্ষ ও মাস্টার্স প্রথমপর্বের কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী দাবি করে বসে, প্রস্তুতি না থাকায় তারা পরীক্ষার আসনে বসতে পারবে না, তাদের অটোপ্রমোশন দিতে হবে। কর্তৃপক্ষ রাজি না হওয়ায় এ দাবিতে তারা আন্দোলন শুরু করে। তাদের যুক্তি, টানা নয় মাসের যুদ্ধের কারণে পড়াশোনা হয়নি। অনেককেই জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। কেউ কেউ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছে। অটোপ্রমোশনের দাবিদাররা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করতে থাকে। এ আন্দোলনে ডাকসুসহ কোনো ছাত্রসংগঠনেরই শীর্ষ স্তরের কোনো নেতার কিংবা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা ছিল না। এ ছিল কেবল অনার্স শেষবর্ষ ও মাস্টার্স প্রথমপর্বের শিক্ষার্থীদের একাংশের আবদার। ১৮ জুলাই ডাকসুর উদ্যোগে টিএসসিতে এক ছাত্রসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ডাকসু নেতারা অটোপ্রমোশনের বিষয়টিকে আত্মঘাতী বলে অভিহিত করে এ ধরনের অযৌক্তিক দাবি থেকে শিক্ষার্থীদের সরে আসার আহ্বান জানান। পরদিন টিএসসিতেই শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অন্য এক সভায় উপাচার্য অধ্যাপক মোজাফফর আহম্মদ চৌধুরীও একই বক্তব্য রাখেন এবং আন্দোলনের পথ পরিহার করে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। এদিকে আন্দোলনকারীরা ক্রমে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ২০ জুলাই বেলা ১১টায় তারা বটতলায় সভা করে। সভাশেষে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে মিছিল সহকারে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে তার কার্যালয়ে যায় এবং কোনোরকম পরীক্ষা ছাড়াই ১ আগস্ট থেকে শেষবর্ষে তাদের ক্লাস শুরু করার দাবি জানায়। উপাচার্য এ সময় বিভাগীয় প্রধান ও প্রভোস্টদের সঙ্গে এ বিষয় নিয়েই বৈঠক করছিলেন। বৈঠকে আন্দোলনকারীদের অযৌক্তিক দাবি না মেনে তাদের পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ছাত্ররা সেখানে গেলে উপাচার্য বের হয়ে আসেন এবং বৈঠকের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। বিষয়টি তিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও অবহিত করেছেন বলে জানান। এ সিদ্ধান্ত শোনার পর ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা স্লোগান দিতে দিতে উপাচার্যের কার্যালয়ের সব দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়। টেলিফোন ও বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়া হয়। উপাচার্যসহ ৩০ জন বিভাগীয় প্রধান ও প্রভোস্টকে সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করে রাখে। দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত প্রায় ৬ ঘণ্টা চলে এ অবরোধ। উপাচার্য এবং সিনিয়র শিক্ষকরা মাঝেমধ্যে অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অবশেষে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসেন। তিনি আকস্মিকভাবে উপাচার্যের কার্যালয়ে এসে উপস্থিত হলে ক্যাম্পাসের সবাই বিস্মিত হয়ে পড়েন। প্রথমেই তিনি অনাকাক্সিক্ষত জিম্মিদশা থেকে শিক্ষকদের উদ্ধার করেন এবং ছাত্রদের অবরোধ তুলে নিতে নির্দেশ দেন। শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের এহেন অশ্রদ্ধা প্রদর্শনে চরম অসন্তোষ ও দুঃখ প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোমাদের মতো আমিও ছাত্র ছিলাম। জীবনে ছাত্র রাজনীতি করেছি। কিন্তু শিক্ষকদের সঙ্গে কখনও এরূপ ব্যবহার করিনি। এভাবেই শেষ হয় আন্দোলনকারীদের সেদিনের কর্মসূচি। পরে শিক্ষকদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিলেবাসের কলেবর কিছুটা কমিয়ে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছিল।
বলে রাখা দরকার, স্বাধীনতা লাভের মাত্র ছয় মাস পরের ঘটনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে বঙ্গবন্ধুর কর্মব্যস্ততা তখন ভাবনার অতীত। মাত্র দুমাস আগে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ও হল সংসদ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে তার প্রিয় ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একেবারে শীর্ষ স্তরের নেতারা প্রতিপক্ষ ছাত্র ইউনিয়ন প্রার্থীদের কাছে বলতে গেলে গোহারা হেরেছেন। এমন পরিস্থিতিতেও শিক্ষাঙ্গনগুলোর প্রতি ছিল তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি ও মনোযোগ। তাই ক্যাম্পাসে কোনো রকম অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেনি। কেবল মানতে হবে, মেনে নাও ধরনের স্লোগান আর থেমে থেমে মিছিল ছাড়া তেমন কিছুই করেনি আন্দোলনকারীরা। তবু উপাচার্য ও সিনিয়র শিক্ষকরা ৫-৬ ঘণ্টা ধরে অবরুদ্ধ আছেন- এ কথা শোনামাত্র সবকিছু ফেলে রেখে বঙ্গবন্ধু ছুটে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বঙ্গবন্ধুর প্রতুৎপন্নমতিত্ব, দূরদর্শিতা এবং সময়োচিত হস্তক্ষেপের ফলে হয়তোবা বড় ধরনের কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়েছিল সেদিন। ৪০ বছর আগের এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ঘন ঘন অচলাবস্থার কবলে পড়া থেকে রক্ষা পেতে পারে।
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
No comments