ফিল্মি বাহাস- সিনেমা ফিল্ম মেকারের ব্যক্তিত্বের অনুবাদঃ ফারুকী by গোলাম রাব্বানী
সকালের নাস্তা শেষ করে বনানীর নিজ বাসার অতিথিরুমে আসলেন মোস্তফা সরয়ার
ফারুকী। একটার পর একটা ফোন আসছে। সব আলোচনা আর ফোন আসছে তার নতুন
চলচ্চিত্র ‘টেলিভিশন’কে কেন্দ্র করে।
একটা সময় ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে
বললেন ‘চল ভাই শুরু করি। ছবি মুক্তি দেওয়া আর কন্যার বিয়ে দেওয়া একই বিষয়।
মাথা ঠিক নাই সারাক্ষণ শুধু কথা বলছি। গলা ব্যাথা করছে।’
আপনার বাসায় আসার পর এ রুমটাতে বসার পর রানা নামে একজন আমার হাতে একটা রিমোট ধরিয়ে দিয়ে বললেন ‘টেলিভিশন’ দেখেন। এই টেলিভিশন তো এখন আমাদের জীবনের একটি অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। এবং সেই ‘টেলিভিশন’ নাম দিয়ে আপনি একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। যা ২৫ জানুয়ারি মুক্তি পাবে। এই ‘টেলিভিশন’ সম্পর্কে জানতে চাই...এরকম একটি নাম কেন?
এই ছবিতে টেলিভিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এই টেলিভিশন যন্ত্রটা আমার ছবির গল্পটাকে নানা দিকে প্রভাবিত করে। রঙ্গরস তৈরি করে। নানাবিধ জটিলতা তৈরি করে এই টেলিভিশন। ফলে এই নির্বাক বস্তুটি এই বোকাবাক্সটি আমার সিনেমায় অনেক চালাকের ভূমিকায় অভিনয় করেছে।
আরেকটি কারণ, আমি এছবিতে একটা জিনিস স্টাডি করার চেষ্টা করেছি। আমরা তো দুইটা দুনিয়ায় বাস করে। বাস্তবের দুনিয়া আর একটা হচ্ছে কল্পনার দুনিয়া। কোনটা বেশি শক্তিশালি কল্পনার দুনিয়া না বাস্তবের দুনিয়া। মাঝে মধ্যে কি কল্পনার দুনিয়া বাস্তবের দুনিয়াকে ছাপিয়ে যায় কিনা। টেলিভিশনতো দুই রকমের হয়। একটি টিভি চোখ খোলা রেখে দেখা যায়। আর একটা টিভি চোখ বন্ধ রেখে দেখা যায়। চোখ বন্ধ করে দেখা টেলিভিশনটা চোখ খোলা রেখে দেখার টেলিভিশন থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কিনা। ইহাই হচ্ছে নাম করণের সার্থকতা...
এত দুইটা কারণ পেলাম। এখন কথা হচ্ছে আমরা আপনার প্রথম ছবি ‘ব্যাচলর’ এ দেখি এ শহরের তরুণ যুবকদের নাগরিক জীবন। তারপর ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এ আমরা দেখি রাজনৈতিক স্যাটেয়ারের গল্প। আর ‘থার্ড পার্সন সিংগুলার নাম্বার’ এ দেখি আরবান নর-নারীর সম্পর্কের দিদ্বা দন্ধর জটিলার গল্প। এখন আপনি আপনার ‘টেলিভিশন’ এ কোন গল্পটা দেখাতে চেয়েছেন?
গল্পটা একটা গ্রামের। এবং এ গ্রামটা একটা কাল্পনিক গ্রাম। যেটা চারদিকে পানি দিয়ে ঘেরা। চারদিকে পানি দিয়ে ঘিরেছি কেন? কারণ আমি চেয়েছি এরকম একটি গ্রাম যেখানে এখনো আধুনিকতা পৌঁছায়নি। রাস্তা থাকলে কিন্তু আধুনিকতা সহজেই পৌঁছে যায়। রাস্তা থাকলে তিব্বত বল সাবানের গাড়ির সঙ্গে আধুনিকতাও চলে যায় বা সেভিং ক্রিমের গাড়ির সঙ্গেও আধুনিকতা চলে যায়। আধুনিকতা যেখানে পৌঁছাতে পারে না সেখানেও কিভাবে বাতাসে ভেসে ভেসে আধুনিকতা চলে যায় তা আমরা স্টাডি করার চেষ্টা করেছি। গল্পটার সঙ্গে আমার সঙ্গে আমার বাবার যে প্রেমময় দন্ধের সম্পর্ক।
আমার বাবা হচ্ছে আমার জীবনে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মানুষ সবচেয়ে সৎ মানুষ। এবং সবচেয়ে আদর্শবাদী মানুষ। যেটা বিশ্বাস করে সেটা করতে জীবন দিয়ে দিতে পারে। এই যে তাকে আমি এত ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি তারপরেও তো তার সঙ্গে আমার কিছু দর্শনের দূরত্ব আছে। সে কিছু কিছু জিনিস বিশ্বাস করে ভালো, আমি হয়তো বিশ্বাস করি সেটা ভালো না। আবার সে যেটা বিশ্বাস করে ভালো, আমি হয়তো বিশ্বাস করি ভালো না। এই যে দুইটা সময়ের দূরত্ব। একটা ক্রিটিক্যাল মোমেন্টে এসে দুইটা সময় দুইটা সময়কে মিট করছে। এই ক্রিটিক্যাল মোমেন্টটা কি? আমার বাবা তার টাইপরাইটার সময় থেকে এসে হঠাৎ করে সে ইন্টারনেটের মুখোমুখি পড়েছে। এই যে অদ্ভুত সময়ের মুখে সে পড়লো। এবং আমরা ইন্টারনেটের যুগে থাইকা যে তাকে মোকাবেলা করছি।
আমি গল্পটা চেষ্টা করছি একটা হিউমারাস টোনে বলতে। এই দুই অদ্ভুত সময় যখন মুখোমুখি হয় তখন একটি রঙ্গরসের তৈরি হয়। রঙ্গরস হয়, দন্ধ হয়, ড্রামা হয়। এবং শেষ পর্যন্ত খুবই আবেগময় একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কারণ আমরা তো শেষ পর্যন্ত আমাদের বাবাকে ভালোবাসি। এবং আমার বাবাও আমাকে ভালোবাসে।
এবং দুই সময় মিলে একে অপরের জন্য কাঁদে। শেষ পর্যন্ত আমি বলতে চাই পরিবর্তন আসন্ন। পরিবর্তনের গান হাওয়ায় ভেসে ভেসে আসবে। কিন্তু পরিবর্তন মানেই পুরনোকে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া নয়। তারাও নতুন থেকে কিছু গ্রহণ করে আমিও পুরাতন থেকে কিছু গ্রহণ করি। শেষ পর্যন্ত তো আমাদের গল্পটা মানুষের সম্পর্কের গল্প।
এরই মধ্যে আপনার ছবিটা বেশ কিছু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছে। প্রশংসিত হয়েছে। কয়েক জায়গায় সম্মানিতও হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল এদেশের দর্শকে এ ছবিটা কতটা নাড়াতে পারবে বা মাতাতে পারবে?
প্রথমে একটা কথা বলি। আমাদের এখানে একটা মিথ আছে যে, বাইরের উৎসবে যে ছবিগুলো যায় সেগুলো হয় মেন্দামারা ছবি। কিন্তু রিয়ালিটি ভুল। ফেস্টিভ্যালে মেন্দামারা যায়, আগুনলাগা যায়, কমেডি, অ্যাকশন ছবিও যায়। ফেস্টিভ্যালে কোন বিশেষ ধরণের ছবি যায় না। আমাদের এখানে সবাই মনে করে ফেস্টিভ্যালে যায় ক্ষুদা, দারিদ্রতা, ধর্ম, রাজনীতি বিষয়ের ছবি যায়। এটা ভুল ধারণা। এবার আসি আমার ছবির প্রসঙ্গে। হলিউড রিপোর্টে আমার ছবি নিয়ে অনেক প্রশংসা করে অনেক কথা লিখেছে। তবে একটা জায়গায় লিখেছে , এই ছবি ম্যারম্যারা দক্ষিণ এশিয়ার ছবির যে একটা আর্ট আছে ঐ ভঙ্গি থেকে মুক্ত। এবং এই ছবি ট্রিপিক্যাল দারিদ্র দুঃখ বেদনা, বন্যা, ধর্মকে বিক্রি করতে চায়নি। এই ছবিতে পরিচালক ইউনিক ভঙ্গিতে গল্পটা বলতে চেয়েছেন। আমি আশা করি এই কথা থেকেই বুঝা যাবে আমার ছবি কি হয়েছে।
দ্বিতীয় কথা যেটা বলতে চাই, আমি সব সময় বলি একটা ফিল্ম হচ্ছে পরিচালকের অনুবাদ। একটা কবিতা হচ্ছে কবির ব্যক্তিত্বের অনুবাদ। সিনেমা ফিল্ম মেকারের ব্যক্তিত্বের অনুবাদ। গুন’দার কবিতা আর আল মাহমুদের কবিতার মধ্যে পার্থক্য তাদের ব্যক্তিত্বের পার্থক্য। কাজেই আমার ব্যক্তিত্বে যা আছে তা তো আমার সিনেমায় অনুবাদ হবেই।
আমার ব্যক্তিত্বে তো ম্যারম্যারা কোন বিষয় নাই। আমি অনেক পরিশ্রম করেও ম্যারম্যারা ছবি বানাতে পারবো না। আমার চরিত্রে খুবই শক্তভাবে হিউমার আছে যেটা আমি আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। আমার চরিত্রে খুবই ইমোশনাল ব্যপার আছে যেটা আমার বাবা মা দুজনের কাছ থেকেই এসেছে। আমার ছবিতে মাঝে মধ্যে কিছুটা পোয়েট্রিক বিষয় ঢুকে যায়। এবং তা অবলিলায় ঢুকে আবার অবলিলায় হিউমারে চলে আসে। তাই দর্শকদের কোন ভয় পাওয়ার কারণ নাই। আমি চাইলেও আমার ছবি ম্যারম্যারা করতে পারবো না। এটা বলতে পারি তারা যদি মনযোগ দিয়ে দুই ঘণ্টা ছবিটা দেখে তারা আনন্দ পাবে। তারা চমকাবে। তারা নতুন অনেকগুলো বিষয় দেখবে। আমার সিনেমার নতুন ভঙ্গি দেখবে। এবং অভিনেতা অভিনেত্রীদের দারুণ পারফর্ম দেখবে এবং ছবি শেষ করে তাদের মন আবেগে ভিজে যাবে। সারা ছবিতে হাসবে।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের ছবি প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। আমাদের এখানে এক ধরণের প্রবণতা দীর্ঘ দিন ধরে দেখছি আমরা। আন্তর্জাতিক যে সকল উৎসবে আমাদের দেশের ছবি যাচ্ছে তার কোনটা হয়তো আমাদের ধর্ম নিয়ে, কোনটা আমাদের রাজনীতি, কোনটা দারিদ্রতা, পরিবেশকে কেন্দ্র করে ছবি বানিয়ে তা বিক্রি করা হয়। আপনি এই প্রবণতার বিষয়টা কিভাবে দেখেন...
মজার কথা হচ্ছে এই ছবিগুলো এখন আর সেল হয় না। পৃথিবীর সব দেশেই ঐ দেশের সমাজ ব্যবস্থাকে সমালোচনা করে। ফিল্ম মেকাররা তো আর পর্যটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর না। যে শুধু একটা দেশের সুন্দরের গল্প করবে। সাহিত্যিক, কবি বা ফিল্ম মেকাররা এ দায়িত্ব নেয় নাই। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে জীবনের সাদা কালো ভালো মন্দ সব দিকটা দেখানো। এখন আপনি কোন ছবিগুলোকে ইঙ্গিত করেছেন। যে ছবিগুলো দেখলেই বুঝা যায় তারা অন্য কাউকে খুশি করার জন্য জীবনের বিশেষ কোন একটি দিককে দেখছেন। যখন আপনি বাংলাদেশের ধর্মান্ধদের নিয়ে সিনেমা বানাবেন তখন জীবনের আরেকটি দিককেও তো আপনাকে দেখাতে হবে। যারা ধর্মান্ধ না তারা কতটা মানুষ হিসেবে ভালো এবং তাদের জীবনের দৃষ্টি ভঙ্গি কি। আবার কথা হচ্ছে আপনার ছবিটা দেখে যদি বুঝা যায় যে আপনি আমেরিকার দৃষ্টিকোন থেকে ধর্মান্ধ বলছেন তাহলে তো ঠিক না।
গত তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে এরকম দুইটা ছবি হয়েছে যেটাতে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা হয়েছে। যা খুবই সহজে সেল করা যায় পশ্চিমাদের কাছে। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে এই দুটি ছবি পৃথিবীর বড় ফেস্টিভ্যাল তো নয় কোন ছোট ফেস্টিভ্যালেও জায়গা পায় নাই। ছবির নাম দুইটা বলতে চাই না।
আপনি বা আপনার সমসাময়িক অনেকেই টেলিভিশনে নাটক বানানোর মাধ্যমে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু আপনি একটি সময় পার করার পর আর টেলিভিশন নাটক বানাচ্ছেন না। কিন্তু ছোট পর্দার টেলিভিশন নিয়ে এখন আপনি বড় পর্দায় হাজির হচ্ছেন...
হ্যাঁ, এ বিষয়ে আমি দর্শকদের বলতে চাই এতদিন আপনারা ঘরে বসে টেলিভিশন দেখেছেন এবার সিনেমা হলে গিয়ে টেলিভিশন দেখবেন।
আমাদের এখানে ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রি অনেক বড় হবার কথা ছিল। কিন্তু তা না হয়ে টেলিভিশন মিডিয়া অনেক বেশি বড় হয়ে পড়েছে। এটা কি ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রি এই বেহাল দশার কারণেই হয়েছে?
অস্বাস্থ্যকর ভাবে মোটা হয়েছে আদের টিভি মিডিয়া। ছয়টার বেশি টেলিভিশন চ্যানেল আমাদের দরকার ছিল না। একটা রাজনৈতিক ইচ্ছা থেকে এই এতগুলো চ্যানেল হয়েছে। যারাই সরকারে এসেছে তারাই মনে করেছে দশটা করে আমাদের চ্যানেল থাকা উচিত। তারা তো বাজারের কথা ভাবেনি। তারা ভাবেননি আমাদের বিজ্ঞাপনের বাজারটা কত বড়। এতগুলো চ্যানেল হওয়াতে বিজ্ঞাপনের রেট কমে গেছে।
আর রেট কমাতে চ্যানেলগুলো অনুষ্ঠান বানাতে টাকা কম দেয়। এতে করে অনুষ্ঠানের মান কমছে। আপনারা অবশেষে বলছেন যে, হিন্দি চ্যানেলের চেয়ে আমাদের দেশের অনুষ্ঠানের মান খারাপ হচ্ছে। হিন্দি চ্যানেল কয় টাকা দিয়ে অনুষ্ঠান বানায় আর আমরা কয়টাকা দিয়ে অনুষ্ঠান বানাই? প্রশ্নটা থাকলো। আর কিছু বলতে চাই না।
আবার আপনার ‘টেলিভিশন’ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মোশাররফ, চঞ্চল, তিশা এবং শাহির হুদা রুমি আপনার সিনেমার প্রধান চারটি চরিত্র। আপনার গল্পের চরিত্র অনুযায়ি তারা কি ঠিক ঠাক অভিনয় করেছেন?
আমার বাবার মত চরিত্রর জন্য রুমি ভাই ছাড়া আর কাউকে পাই না। এখন রুমি ভাইকে আমার তৈরি করতে হয়েছে। কারণ আমার বাবার জীবন-যাপন থেকে রুমি ভাইয়ের জীবন-যাপন পুরোই উল্টা। তার ছেলের ভূমিকায় আমি একটা সরল চেহারা খুঁজতে ছিলাম। পেয়ে গেলাম চঞ্চল চৌধুরীকে। সে দারুণ অভিনয় করেছে। আর চঞ্চলের সহকারির চরিত্রে আমার খুব চালাক একটি ছেলে দরকার। সে অসৎ না কিন্তু সে খুবই অবদমিত। এখন এ চরিত্র মোশাররফ ছাড়া আর কে পারবে? সুতরাং গেলাম মোশাররফের কাছে। তাকে তৈরি করা হল।
একই ঘটনা তিশার ক্ষেত্রে। সে শহরের মেয়ে তাকে গ্রামের মেয়ে হিসেবে তৈরি করতে হয়েছে। নাক ফুটা করা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই করতে হয়েছে তাকে। এ ছবিতে এদের সবাইকে নতুন ভাবে দেখা যাবে। তারা খুবই পরিশ্রম করেছে। এবং এর ফলাফল দর্শক হলে গিয়ে দেখতে পাবে।
[মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে ফিল্মি বাহাস আরো কিছুক্ষণ চলতে থাকে। দীর্ঘ বাহাস থেকে চুম্বক অংশ এখানে দেওয়া হল। বাহাসের সব কথা প্রকাশও করা যায় না। কিছু কথা থাক না...]
আপনার বাসায় আসার পর এ রুমটাতে বসার পর রানা নামে একজন আমার হাতে একটা রিমোট ধরিয়ে দিয়ে বললেন ‘টেলিভিশন’ দেখেন। এই টেলিভিশন তো এখন আমাদের জীবনের একটি অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। এবং সেই ‘টেলিভিশন’ নাম দিয়ে আপনি একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। যা ২৫ জানুয়ারি মুক্তি পাবে। এই ‘টেলিভিশন’ সম্পর্কে জানতে চাই...এরকম একটি নাম কেন?
এই ছবিতে টেলিভিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এই টেলিভিশন যন্ত্রটা আমার ছবির গল্পটাকে নানা দিকে প্রভাবিত করে। রঙ্গরস তৈরি করে। নানাবিধ জটিলতা তৈরি করে এই টেলিভিশন। ফলে এই নির্বাক বস্তুটি এই বোকাবাক্সটি আমার সিনেমায় অনেক চালাকের ভূমিকায় অভিনয় করেছে।
আরেকটি কারণ, আমি এছবিতে একটা জিনিস স্টাডি করার চেষ্টা করেছি। আমরা তো দুইটা দুনিয়ায় বাস করে। বাস্তবের দুনিয়া আর একটা হচ্ছে কল্পনার দুনিয়া। কোনটা বেশি শক্তিশালি কল্পনার দুনিয়া না বাস্তবের দুনিয়া। মাঝে মধ্যে কি কল্পনার দুনিয়া বাস্তবের দুনিয়াকে ছাপিয়ে যায় কিনা। টেলিভিশনতো দুই রকমের হয়। একটি টিভি চোখ খোলা রেখে দেখা যায়। আর একটা টিভি চোখ বন্ধ রেখে দেখা যায়। চোখ বন্ধ করে দেখা টেলিভিশনটা চোখ খোলা রেখে দেখার টেলিভিশন থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কিনা। ইহাই হচ্ছে নাম করণের সার্থকতা...
এত দুইটা কারণ পেলাম। এখন কথা হচ্ছে আমরা আপনার প্রথম ছবি ‘ব্যাচলর’ এ দেখি এ শহরের তরুণ যুবকদের নাগরিক জীবন। তারপর ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এ আমরা দেখি রাজনৈতিক স্যাটেয়ারের গল্প। আর ‘থার্ড পার্সন সিংগুলার নাম্বার’ এ দেখি আরবান নর-নারীর সম্পর্কের দিদ্বা দন্ধর জটিলার গল্প। এখন আপনি আপনার ‘টেলিভিশন’ এ কোন গল্পটা দেখাতে চেয়েছেন?
গল্পটা একটা গ্রামের। এবং এ গ্রামটা একটা কাল্পনিক গ্রাম। যেটা চারদিকে পানি দিয়ে ঘেরা। চারদিকে পানি দিয়ে ঘিরেছি কেন? কারণ আমি চেয়েছি এরকম একটি গ্রাম যেখানে এখনো আধুনিকতা পৌঁছায়নি। রাস্তা থাকলে কিন্তু আধুনিকতা সহজেই পৌঁছে যায়। রাস্তা থাকলে তিব্বত বল সাবানের গাড়ির সঙ্গে আধুনিকতাও চলে যায় বা সেভিং ক্রিমের গাড়ির সঙ্গেও আধুনিকতা চলে যায়। আধুনিকতা যেখানে পৌঁছাতে পারে না সেখানেও কিভাবে বাতাসে ভেসে ভেসে আধুনিকতা চলে যায় তা আমরা স্টাডি করার চেষ্টা করেছি। গল্পটার সঙ্গে আমার সঙ্গে আমার বাবার যে প্রেমময় দন্ধের সম্পর্ক।
আমার বাবা হচ্ছে আমার জীবনে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মানুষ সবচেয়ে সৎ মানুষ। এবং সবচেয়ে আদর্শবাদী মানুষ। যেটা বিশ্বাস করে সেটা করতে জীবন দিয়ে দিতে পারে। এই যে তাকে আমি এত ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি তারপরেও তো তার সঙ্গে আমার কিছু দর্শনের দূরত্ব আছে। সে কিছু কিছু জিনিস বিশ্বাস করে ভালো, আমি হয়তো বিশ্বাস করি সেটা ভালো না। আবার সে যেটা বিশ্বাস করে ভালো, আমি হয়তো বিশ্বাস করি ভালো না। এই যে দুইটা সময়ের দূরত্ব। একটা ক্রিটিক্যাল মোমেন্টে এসে দুইটা সময় দুইটা সময়কে মিট করছে। এই ক্রিটিক্যাল মোমেন্টটা কি? আমার বাবা তার টাইপরাইটার সময় থেকে এসে হঠাৎ করে সে ইন্টারনেটের মুখোমুখি পড়েছে। এই যে অদ্ভুত সময়ের মুখে সে পড়লো। এবং আমরা ইন্টারনেটের যুগে থাইকা যে তাকে মোকাবেলা করছি।
আমি গল্পটা চেষ্টা করছি একটা হিউমারাস টোনে বলতে। এই দুই অদ্ভুত সময় যখন মুখোমুখি হয় তখন একটি রঙ্গরসের তৈরি হয়। রঙ্গরস হয়, দন্ধ হয়, ড্রামা হয়। এবং শেষ পর্যন্ত খুবই আবেগময় একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কারণ আমরা তো শেষ পর্যন্ত আমাদের বাবাকে ভালোবাসি। এবং আমার বাবাও আমাকে ভালোবাসে।
এবং দুই সময় মিলে একে অপরের জন্য কাঁদে। শেষ পর্যন্ত আমি বলতে চাই পরিবর্তন আসন্ন। পরিবর্তনের গান হাওয়ায় ভেসে ভেসে আসবে। কিন্তু পরিবর্তন মানেই পুরনোকে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া নয়। তারাও নতুন থেকে কিছু গ্রহণ করে আমিও পুরাতন থেকে কিছু গ্রহণ করি। শেষ পর্যন্ত তো আমাদের গল্পটা মানুষের সম্পর্কের গল্প।
এরই মধ্যে আপনার ছবিটা বেশ কিছু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছে। প্রশংসিত হয়েছে। কয়েক জায়গায় সম্মানিতও হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল এদেশের দর্শকে এ ছবিটা কতটা নাড়াতে পারবে বা মাতাতে পারবে?
প্রথমে একটা কথা বলি। আমাদের এখানে একটা মিথ আছে যে, বাইরের উৎসবে যে ছবিগুলো যায় সেগুলো হয় মেন্দামারা ছবি। কিন্তু রিয়ালিটি ভুল। ফেস্টিভ্যালে মেন্দামারা যায়, আগুনলাগা যায়, কমেডি, অ্যাকশন ছবিও যায়। ফেস্টিভ্যালে কোন বিশেষ ধরণের ছবি যায় না। আমাদের এখানে সবাই মনে করে ফেস্টিভ্যালে যায় ক্ষুদা, দারিদ্রতা, ধর্ম, রাজনীতি বিষয়ের ছবি যায়। এটা ভুল ধারণা। এবার আসি আমার ছবির প্রসঙ্গে। হলিউড রিপোর্টে আমার ছবি নিয়ে অনেক প্রশংসা করে অনেক কথা লিখেছে। তবে একটা জায়গায় লিখেছে , এই ছবি ম্যারম্যারা দক্ষিণ এশিয়ার ছবির যে একটা আর্ট আছে ঐ ভঙ্গি থেকে মুক্ত। এবং এই ছবি ট্রিপিক্যাল দারিদ্র দুঃখ বেদনা, বন্যা, ধর্মকে বিক্রি করতে চায়নি। এই ছবিতে পরিচালক ইউনিক ভঙ্গিতে গল্পটা বলতে চেয়েছেন। আমি আশা করি এই কথা থেকেই বুঝা যাবে আমার ছবি কি হয়েছে।
দ্বিতীয় কথা যেটা বলতে চাই, আমি সব সময় বলি একটা ফিল্ম হচ্ছে পরিচালকের অনুবাদ। একটা কবিতা হচ্ছে কবির ব্যক্তিত্বের অনুবাদ। সিনেমা ফিল্ম মেকারের ব্যক্তিত্বের অনুবাদ। গুন’দার কবিতা আর আল মাহমুদের কবিতার মধ্যে পার্থক্য তাদের ব্যক্তিত্বের পার্থক্য। কাজেই আমার ব্যক্তিত্বে যা আছে তা তো আমার সিনেমায় অনুবাদ হবেই।
আমার ব্যক্তিত্বে তো ম্যারম্যারা কোন বিষয় নাই। আমি অনেক পরিশ্রম করেও ম্যারম্যারা ছবি বানাতে পারবো না। আমার চরিত্রে খুবই শক্তভাবে হিউমার আছে যেটা আমি আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। আমার চরিত্রে খুবই ইমোশনাল ব্যপার আছে যেটা আমার বাবা মা দুজনের কাছ থেকেই এসেছে। আমার ছবিতে মাঝে মধ্যে কিছুটা পোয়েট্রিক বিষয় ঢুকে যায়। এবং তা অবলিলায় ঢুকে আবার অবলিলায় হিউমারে চলে আসে। তাই দর্শকদের কোন ভয় পাওয়ার কারণ নাই। আমি চাইলেও আমার ছবি ম্যারম্যারা করতে পারবো না। এটা বলতে পারি তারা যদি মনযোগ দিয়ে দুই ঘণ্টা ছবিটা দেখে তারা আনন্দ পাবে। তারা চমকাবে। তারা নতুন অনেকগুলো বিষয় দেখবে। আমার সিনেমার নতুন ভঙ্গি দেখবে। এবং অভিনেতা অভিনেত্রীদের দারুণ পারফর্ম দেখবে এবং ছবি শেষ করে তাদের মন আবেগে ভিজে যাবে। সারা ছবিতে হাসবে।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের ছবি প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। আমাদের এখানে এক ধরণের প্রবণতা দীর্ঘ দিন ধরে দেখছি আমরা। আন্তর্জাতিক যে সকল উৎসবে আমাদের দেশের ছবি যাচ্ছে তার কোনটা হয়তো আমাদের ধর্ম নিয়ে, কোনটা আমাদের রাজনীতি, কোনটা দারিদ্রতা, পরিবেশকে কেন্দ্র করে ছবি বানিয়ে তা বিক্রি করা হয়। আপনি এই প্রবণতার বিষয়টা কিভাবে দেখেন...
মজার কথা হচ্ছে এই ছবিগুলো এখন আর সেল হয় না। পৃথিবীর সব দেশেই ঐ দেশের সমাজ ব্যবস্থাকে সমালোচনা করে। ফিল্ম মেকাররা তো আর পর্যটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর না। যে শুধু একটা দেশের সুন্দরের গল্প করবে। সাহিত্যিক, কবি বা ফিল্ম মেকাররা এ দায়িত্ব নেয় নাই। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে জীবনের সাদা কালো ভালো মন্দ সব দিকটা দেখানো। এখন আপনি কোন ছবিগুলোকে ইঙ্গিত করেছেন। যে ছবিগুলো দেখলেই বুঝা যায় তারা অন্য কাউকে খুশি করার জন্য জীবনের বিশেষ কোন একটি দিককে দেখছেন। যখন আপনি বাংলাদেশের ধর্মান্ধদের নিয়ে সিনেমা বানাবেন তখন জীবনের আরেকটি দিককেও তো আপনাকে দেখাতে হবে। যারা ধর্মান্ধ না তারা কতটা মানুষ হিসেবে ভালো এবং তাদের জীবনের দৃষ্টি ভঙ্গি কি। আবার কথা হচ্ছে আপনার ছবিটা দেখে যদি বুঝা যায় যে আপনি আমেরিকার দৃষ্টিকোন থেকে ধর্মান্ধ বলছেন তাহলে তো ঠিক না।
গত তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে এরকম দুইটা ছবি হয়েছে যেটাতে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা হয়েছে। যা খুবই সহজে সেল করা যায় পশ্চিমাদের কাছে। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে এই দুটি ছবি পৃথিবীর বড় ফেস্টিভ্যাল তো নয় কোন ছোট ফেস্টিভ্যালেও জায়গা পায় নাই। ছবির নাম দুইটা বলতে চাই না।
আপনি বা আপনার সমসাময়িক অনেকেই টেলিভিশনে নাটক বানানোর মাধ্যমে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু আপনি একটি সময় পার করার পর আর টেলিভিশন নাটক বানাচ্ছেন না। কিন্তু ছোট পর্দার টেলিভিশন নিয়ে এখন আপনি বড় পর্দায় হাজির হচ্ছেন...
হ্যাঁ, এ বিষয়ে আমি দর্শকদের বলতে চাই এতদিন আপনারা ঘরে বসে টেলিভিশন দেখেছেন এবার সিনেমা হলে গিয়ে টেলিভিশন দেখবেন।
আমাদের এখানে ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রি অনেক বড় হবার কথা ছিল। কিন্তু তা না হয়ে টেলিভিশন মিডিয়া অনেক বেশি বড় হয়ে পড়েছে। এটা কি ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রি এই বেহাল দশার কারণেই হয়েছে?
অস্বাস্থ্যকর ভাবে মোটা হয়েছে আদের টিভি মিডিয়া। ছয়টার বেশি টেলিভিশন চ্যানেল আমাদের দরকার ছিল না। একটা রাজনৈতিক ইচ্ছা থেকে এই এতগুলো চ্যানেল হয়েছে। যারাই সরকারে এসেছে তারাই মনে করেছে দশটা করে আমাদের চ্যানেল থাকা উচিত। তারা তো বাজারের কথা ভাবেনি। তারা ভাবেননি আমাদের বিজ্ঞাপনের বাজারটা কত বড়। এতগুলো চ্যানেল হওয়াতে বিজ্ঞাপনের রেট কমে গেছে।
আর রেট কমাতে চ্যানেলগুলো অনুষ্ঠান বানাতে টাকা কম দেয়। এতে করে অনুষ্ঠানের মান কমছে। আপনারা অবশেষে বলছেন যে, হিন্দি চ্যানেলের চেয়ে আমাদের দেশের অনুষ্ঠানের মান খারাপ হচ্ছে। হিন্দি চ্যানেল কয় টাকা দিয়ে অনুষ্ঠান বানায় আর আমরা কয়টাকা দিয়ে অনুষ্ঠান বানাই? প্রশ্নটা থাকলো। আর কিছু বলতে চাই না।
আবার আপনার ‘টেলিভিশন’ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মোশাররফ, চঞ্চল, তিশা এবং শাহির হুদা রুমি আপনার সিনেমার প্রধান চারটি চরিত্র। আপনার গল্পের চরিত্র অনুযায়ি তারা কি ঠিক ঠাক অভিনয় করেছেন?
আমার বাবার মত চরিত্রর জন্য রুমি ভাই ছাড়া আর কাউকে পাই না। এখন রুমি ভাইকে আমার তৈরি করতে হয়েছে। কারণ আমার বাবার জীবন-যাপন থেকে রুমি ভাইয়ের জীবন-যাপন পুরোই উল্টা। তার ছেলের ভূমিকায় আমি একটা সরল চেহারা খুঁজতে ছিলাম। পেয়ে গেলাম চঞ্চল চৌধুরীকে। সে দারুণ অভিনয় করেছে। আর চঞ্চলের সহকারির চরিত্রে আমার খুব চালাক একটি ছেলে দরকার। সে অসৎ না কিন্তু সে খুবই অবদমিত। এখন এ চরিত্র মোশাররফ ছাড়া আর কে পারবে? সুতরাং গেলাম মোশাররফের কাছে। তাকে তৈরি করা হল।
একই ঘটনা তিশার ক্ষেত্রে। সে শহরের মেয়ে তাকে গ্রামের মেয়ে হিসেবে তৈরি করতে হয়েছে। নাক ফুটা করা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই করতে হয়েছে তাকে। এ ছবিতে এদের সবাইকে নতুন ভাবে দেখা যাবে। তারা খুবই পরিশ্রম করেছে। এবং এর ফলাফল দর্শক হলে গিয়ে দেখতে পাবে।
[মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে ফিল্মি বাহাস আরো কিছুক্ষণ চলতে থাকে। দীর্ঘ বাহাস থেকে চুম্বক অংশ এখানে দেওয়া হল। বাহাসের সব কথা প্রকাশও করা যায় না। কিছু কথা থাক না...]
No comments