বঞ্চনা ও হতাশায় চাকরি ছেড়েছেন ১১৫ বিজ্ঞানী by শরিফুল হাসান
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) ১১৫ জন বিজ্ঞানী গত দুই দশকে প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে চলে গেছেন। যেসব বিজ্ঞানী এখনো সেখানে চাকরি করছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ পদোন্নতি-বঞ্চনার কারণে হতাশ হয়ে পড়ছে।
হতাশার মূল কারণ প্রতিষ্ঠানটিতে চলমান বিভাগীয় পদোন্নতির ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার কারণে অনেকে পাঁচ বছর চাকরি করেই পদোন্নতি পান, অনেকে ২৫ বছরেও পান না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক ও সমন্বিত জ্যেষ্ঠতার তালিকা করে এ বৈষম্য নিরসনের দাবি দীর্ঘদিনের। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমান কৃষিমন্ত্রীসহ সব সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সেই আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা বদলায়নি।
সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বর মাসে আদালতে যান প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন বিজ্ঞানী। তাঁদের আবেদনের শুনানি শেষে আদালত সমন্বিত জ্যেষ্ঠতার তালিকা করে পদোন্নতি দেওয়া এবং আগামী দুই মাস পদোন্নতি কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েকজনের আদালতে যাওয়ার খবরে তাড়াহুড়ো করে ২০ জনকে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা।
একজনের অভিজ্ঞতা: ব্রির ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন ড. শেখ তানভীর হাসান। পদোন্নতি নিয়ে হতাশায় ২০০৮ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে কৃষিবিষয়ক একটি বেসরকারি সংস্থার উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। একটি উদ্ভাবনের জন্য সম্প্রতি তিনি ৭৬টি দেশের দেড় হাজার বিজ্ঞানীর মধ্যে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অর্গানিক ফার্মিং ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড (ওফিয়া) পেয়েছেন।
জানতে চাইলে শেখ তানভীর হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ব্রিতে প্রাতিষ্ঠানিক পদোন্নতির বদলে বিভাগীয় পদোন্নতির পদ্ধতি চালু আছে। অর্থাৎ যত বছরই চাকরি করুক না কেন, ওই বিভাগে কোনো পদ খালি না হলে তিনি পদোন্নতি পাবেন না। ফলে একই যোগ্যতা নিয়ে অন্য বিভাগের সহকর্মীরা যখন ওপরের পদে চলে যাচ্ছেন, তখন অন্যরা নিচে পড়ে থাকছেন। তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে অর্থাৎ যে আগে যোগ দিয়েছেন কিংবা দুটোর সমন্বয়েই যদি পদোন্নতি হতো কিংবা যোগ্যতা অর্জনের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পদোন্নতি হতো, তাহলে এত সংকট হতো না।
চাকরি ছেড়েছেন ১১৫ বিজ্ঞানী: ১৯৯২ সালের পর চাকরি ছাড়া ব্রির ১১৫ জন বিজ্ঞানীর নাম পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের ১৪, মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের ১৩ এবং ধানভিত্তিক খামারবিন্যাস বিভাগের ১২ জন বিজ্ঞানী চাকরি ছেড়েছেন।
এ ছাড়া কৃষিতত্ত্ব, ফলিত গবেষণা এবং উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব—এই তিন বিভাগের আটজন করে ২৪ জন, খামার যন্ত্রপাতি এবং ফলনোত্তর প্রযুক্তি, কীটতত্ত্ব এবং উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগের সাতজন করে ২১ জন ও কৃষি অর্থনীতির ছয়জন চাকরি ছেড়েছেন।
একইভাবে কৌলি সম্পদ ও বীজ, প্রশিক্ষণ, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা, জৈব প্রযুক্তি ও কৃষি পরিসংখ্যান—এই পাঁচ বিভাগের চারজন করে ২০ জন, শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগের তিনজন চাকরি ছেড়েছেন। খামার ব্যবস্থাপনা এবং কারখানা যন্ত্রপাতি ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের দুজন বিজ্ঞানীও চাকরি ছেড়েছেন।
চাকরি ছাড়া এই বিজ্ঞানীদের বেশির ভাগই ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার পর আর কোনো পদোন্নতি পাননি। এর মধ্যে ১৯৯২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৫০ জন এবং ২০০১ থেকে ২০১২—এই সময়ে আরও ৬৫ জন বিজ্ঞানী চাকরি ছেড়েছেন।
২০০৭ সালে ব্রির চাকরি ছেড়ে বেসরকারি একটি সংস্থার পরামর্শক বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেওয়া আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিজ্ঞানীদের বেতনকাঠামো তো দেশে খুব বেশি ভালো নয়। তার পরও দেশের টানে বিজ্ঞানীরা সরকারি প্রতিষ্ঠানে থাকতে চান। কিন্তু যদি তাঁরা যোগ্যতা থাকার পরেও পদোন্নতি না পান, তাহলে কেন থাকবেন? এ কারণেই যেসব বিজ্ঞানী আজ ব্রিকে নেতৃত্ব দিতে পারতেন, তাঁরা এখন চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।’
ব্রির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনোয়ারুল হক বলেন, ‘হতাশা ও বঞ্চনা থেকে গত ২০ বছরে অন্তত ১১৫ জন বিজ্ঞানী চাকরি ছেড়েছেন। আর তাই ব্রিকে বাঁচাতে আমরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।’
কর্মকর্তারা জানান, ২০০৬-০৭ সালে ব্রির বিজ্ঞানী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির চতুর্থ সভায় ভোটাভুটিতে ৬২ ভাগ বিজ্ঞানী প্রাতিষ্ঠানিক জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়ার পক্ষে ভোট দেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ২০১০ সালের ১১ জুলাই কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক সভায়ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মতো এখানেও প্রাতিষ্ঠানিক জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীদের পদোন্নতির নির্দেশনা দেন। কিন্তু আড়াই বছরে তার বাস্তবায়ন হয়নি।
জানতে চাইলে ব্রির পরিচালক (প্রশাসন) জীবন কৃষ্ণ বলেন, ‘৪০ বছর ধরে এভাবে চলছে। এর ফলে যোগ্য অনেক লোক পদোন্নতি পাচ্ছেন না। সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে পর্যায়ক্রমিক পদোন্নতি হয়, এখানেও তাই করা উচিত। এ বিষয়ে কয়েক দফায় সরকারের কাছে প্রস্তাবও গেছে। কিন্তু কিছু হচ্ছে না।
বঞ্চনার কিছু উদাহরণ: বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (এসএসও) বিলাস চন্দ্র রায়। ২০ বছর ধরে একই পদে চাকরি করছেন তিনি। আর তাঁর এক দশক পরে কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগে যোগ দিয়ে সর্বোচ্চ পদ মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিএসও) হয়ে গেছেন শাহজাহান কবীর।
একই দশা গোলাম ওয়াহেদ সরকার ও তৌফিকুল ইসলামের। অনেক পরে যোগ দেওয়া কর্মকর্তাদের তাঁরা প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পিএসও) থেকে সিএসও হতে দেখেছেন। কিন্তু তাঁদের অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। এই তিন বিজ্ঞানীর কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রতিষ্ঠানের কারও মধ্যে কোনো প্রশ্ন নেই। তাঁরা পদোন্নতি না পাওয়ার কারণ, তাঁদের বিভাগে পদ খালি নেই।
১৯৮০ সালে ব্রিতে যোগ দিয়েছিলেন রফিকুল ইসলাম। ১৯৮৩ সালে যোগ দিয়েছিলেন আবদুল জলিল মৃধা, গউছ আলী ও হামিদুর রহমান মোল্লা। দীর্ঘদিন চাকরি করে তাঁরা কেবল পিএসও হয়েছেন। কিন্তু ১৯৯৪ ও ১৯৯৮ সালে যোগ দেওয়া কর্মকর্তারাও সিএসও হয়ে গেছেন। এমন অনেক উদাহরণ আছে প্রতিষ্ঠানটিতে।
সাম্প্রতিক পদোন্নতি এবং আদালতের আদেশ: ব্রির নিয়ম অনুযায়ী, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা থেকে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে যেতে চাকরির বয়স অন্তত পাঁচ বছর হতে হয়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ২০০৭ সালের নভেম্বরে যোগ দেওয়া ৩৩ জন কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁদের পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ একদল বিজ্ঞানী গত ১৮ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট করেন। কিন্তু পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁরা পদোন্নতি পেয়ে যান।
মামলার আইনজীবী গোলাম ফারুক ভুঁইয়া জানান, ২৬ নভেম্বর আদালত সমন্বিত ও প্রাতিষ্ঠানিক জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তালিকা করে বিজ্ঞানীদের পদোন্নতির বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। আদালত দুই মাস সব ধরনের পদোন্নতি বন্ধ রাখারও নির্দেশনা দেন। ২৮ নভেম্বর রায়ের লিখিত অনুলিপি ব্রিতে পৌঁছায়।
কিন্তু কাগজপত্রে দেখা যায়, ১২ নভেম্বর পদোন্নতির জন্য যোগ্য হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ পর ২০ নভেম্বর ২০ জনকে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নিয়োগ ও পদোন্নতি কমিটি। এর মাত্র দুই দিন পর ২২ নভেম্বর পরিচালনা পর্ষদ পদোন্নতি অনুমোদন করে। ওই দিনই অধিকাংশ কর্মকর্তা উচ্চ পদে যোগ দেন। সবার পদোন্নতির স্মারক প্রকাশ করা হয় ২৬ নভেম্বরের আগেই।
অনিয়ম: পদোন্নতি দিয়েই প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক সাইদুল ইসলাম জাপানে যান। ২৬ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত পরিচালক (গবেষণা) মোহাম্মদ শমশের আলী ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। নতুন যোগ দেওয়া কর্মকর্তাদের নথি তাঁর কাছে গেলে তিনি ‘আদালতের রায় থাকায় মহাপরিচালক এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন’—বলে নথিতে নির্দেশনা দেন। কিন্তু মহাপরিচালক দেশে এসে শমশের আলীকে আদালতের রায়ের আগের তারিখে যোগদানপত্র দেওয়ার জন্য চাপ দেন। তবে শমশের আলী রাজি হননি। কিন্তু পরে আটজন কর্মকর্তার পদোন্নতি ও যোগদানের যে অফিস স্মারক প্রকাশ করা হয়, তাতে দেখা যায়, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ২৬ নভেম্বর তা সই করেছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এর মধ্যেও পদোন্নতি-বঞ্চনার ঘটনা ঘটেছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকায় থাকা প্রথম তিনজনের কাউকেই পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। ২০০৭ সালে যোগ দেওয়া কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেলেও ২০০১ সালে যোগ দেওয়া শাহনাজ পারভীন ও ইবনে সৈয়দ হারুনুর রশীদ এবং ২০০৫ সালে যোগ দেওয়া হাবিবুর রহমান পদোন্নতি পাননি। জ্যেষ্ঠতার তালিকায় এঁরা ছিলেন সবার আগে।
নিয়োগে অনিয়ম: কেবল পদোন্নতিতে নয়, নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্রিতে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগের জন্য সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ৩৪ বছর। কিন্তু তাপস কুমার সরকারকে শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগ এবং মোহাম্মদ কামরুজ্জামানকে এফএমপিএইচটি বিভাগে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা করা হয়েছে। তাঁদের দুজনেরই বয়সই ৩৪ পেরিয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ বছরের চাকরিকাল না থাকা সত্ত্বেও সুব্রত বণিককে ২৫ নভেম্বর সরকারি ছুটির দিনে শস্যমান ও পুষ্টিবিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
মহাপরিচালক সাইদুল ইসলাম, জীবন কৃষ্ণ, শাহজাহান কবির—তিনজনেই একই কথা বলেন। তাঁদের দাবি, ২০০৫ সালের একটি নির্দেশনায় বলা আছে, প্রকল্প থেকে কেউ সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আবেদন করলে তাঁর বয়স শিথিল করা যাবে। তবে অপর অংশের অভিযোগ, বিজ্ঞানী নিয়োগে রাষ্ট্রপতি ছাড়া আর কেউই বয়স শিথিল করতে পারেন না।
ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক সাইদুল ইসলাম ব্রিতে বিভাগীয় পদোন্নতির কারণে বঞ্চনার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘অনেকেই এ কারণে চাকরি ছেড়েছেন। সম্প্রতি একটি পক্ষ আদালতে গেছে। এখন আদালত যদি প্রাতিষ্ঠানিক পদোন্নতির সিদ্ধান্ত দেন, তাহলে আমরা সেটি মেনে চলব। আর বিজ্ঞানীরা একমত হলে পরিচালনা পর্ষদও সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’
সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বর মাসে আদালতে যান প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন বিজ্ঞানী। তাঁদের আবেদনের শুনানি শেষে আদালত সমন্বিত জ্যেষ্ঠতার তালিকা করে পদোন্নতি দেওয়া এবং আগামী দুই মাস পদোন্নতি কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েকজনের আদালতে যাওয়ার খবরে তাড়াহুড়ো করে ২০ জনকে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা।
একজনের অভিজ্ঞতা: ব্রির ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন ড. শেখ তানভীর হাসান। পদোন্নতি নিয়ে হতাশায় ২০০৮ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে কৃষিবিষয়ক একটি বেসরকারি সংস্থার উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। একটি উদ্ভাবনের জন্য সম্প্রতি তিনি ৭৬টি দেশের দেড় হাজার বিজ্ঞানীর মধ্যে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অর্গানিক ফার্মিং ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড (ওফিয়া) পেয়েছেন।
জানতে চাইলে শেখ তানভীর হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ব্রিতে প্রাতিষ্ঠানিক পদোন্নতির বদলে বিভাগীয় পদোন্নতির পদ্ধতি চালু আছে। অর্থাৎ যত বছরই চাকরি করুক না কেন, ওই বিভাগে কোনো পদ খালি না হলে তিনি পদোন্নতি পাবেন না। ফলে একই যোগ্যতা নিয়ে অন্য বিভাগের সহকর্মীরা যখন ওপরের পদে চলে যাচ্ছেন, তখন অন্যরা নিচে পড়ে থাকছেন। তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে অর্থাৎ যে আগে যোগ দিয়েছেন কিংবা দুটোর সমন্বয়েই যদি পদোন্নতি হতো কিংবা যোগ্যতা অর্জনের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পদোন্নতি হতো, তাহলে এত সংকট হতো না।
চাকরি ছেড়েছেন ১১৫ বিজ্ঞানী: ১৯৯২ সালের পর চাকরি ছাড়া ব্রির ১১৫ জন বিজ্ঞানীর নাম পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের ১৪, মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের ১৩ এবং ধানভিত্তিক খামারবিন্যাস বিভাগের ১২ জন বিজ্ঞানী চাকরি ছেড়েছেন।
এ ছাড়া কৃষিতত্ত্ব, ফলিত গবেষণা এবং উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব—এই তিন বিভাগের আটজন করে ২৪ জন, খামার যন্ত্রপাতি এবং ফলনোত্তর প্রযুক্তি, কীটতত্ত্ব এবং উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগের সাতজন করে ২১ জন ও কৃষি অর্থনীতির ছয়জন চাকরি ছেড়েছেন।
একইভাবে কৌলি সম্পদ ও বীজ, প্রশিক্ষণ, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা, জৈব প্রযুক্তি ও কৃষি পরিসংখ্যান—এই পাঁচ বিভাগের চারজন করে ২০ জন, শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগের তিনজন চাকরি ছেড়েছেন। খামার ব্যবস্থাপনা এবং কারখানা যন্ত্রপাতি ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের দুজন বিজ্ঞানীও চাকরি ছেড়েছেন।
চাকরি ছাড়া এই বিজ্ঞানীদের বেশির ভাগই ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার পর আর কোনো পদোন্নতি পাননি। এর মধ্যে ১৯৯২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৫০ জন এবং ২০০১ থেকে ২০১২—এই সময়ে আরও ৬৫ জন বিজ্ঞানী চাকরি ছেড়েছেন।
২০০৭ সালে ব্রির চাকরি ছেড়ে বেসরকারি একটি সংস্থার পরামর্শক বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেওয়া আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিজ্ঞানীদের বেতনকাঠামো তো দেশে খুব বেশি ভালো নয়। তার পরও দেশের টানে বিজ্ঞানীরা সরকারি প্রতিষ্ঠানে থাকতে চান। কিন্তু যদি তাঁরা যোগ্যতা থাকার পরেও পদোন্নতি না পান, তাহলে কেন থাকবেন? এ কারণেই যেসব বিজ্ঞানী আজ ব্রিকে নেতৃত্ব দিতে পারতেন, তাঁরা এখন চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।’
ব্রির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনোয়ারুল হক বলেন, ‘হতাশা ও বঞ্চনা থেকে গত ২০ বছরে অন্তত ১১৫ জন বিজ্ঞানী চাকরি ছেড়েছেন। আর তাই ব্রিকে বাঁচাতে আমরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।’
কর্মকর্তারা জানান, ২০০৬-০৭ সালে ব্রির বিজ্ঞানী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির চতুর্থ সভায় ভোটাভুটিতে ৬২ ভাগ বিজ্ঞানী প্রাতিষ্ঠানিক জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়ার পক্ষে ভোট দেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ২০১০ সালের ১১ জুলাই কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক সভায়ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মতো এখানেও প্রাতিষ্ঠানিক জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীদের পদোন্নতির নির্দেশনা দেন। কিন্তু আড়াই বছরে তার বাস্তবায়ন হয়নি।
জানতে চাইলে ব্রির পরিচালক (প্রশাসন) জীবন কৃষ্ণ বলেন, ‘৪০ বছর ধরে এভাবে চলছে। এর ফলে যোগ্য অনেক লোক পদোন্নতি পাচ্ছেন না। সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে পর্যায়ক্রমিক পদোন্নতি হয়, এখানেও তাই করা উচিত। এ বিষয়ে কয়েক দফায় সরকারের কাছে প্রস্তাবও গেছে। কিন্তু কিছু হচ্ছে না।
বঞ্চনার কিছু উদাহরণ: বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (এসএসও) বিলাস চন্দ্র রায়। ২০ বছর ধরে একই পদে চাকরি করছেন তিনি। আর তাঁর এক দশক পরে কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগে যোগ দিয়ে সর্বোচ্চ পদ মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিএসও) হয়ে গেছেন শাহজাহান কবীর।
একই দশা গোলাম ওয়াহেদ সরকার ও তৌফিকুল ইসলামের। অনেক পরে যোগ দেওয়া কর্মকর্তাদের তাঁরা প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পিএসও) থেকে সিএসও হতে দেখেছেন। কিন্তু তাঁদের অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। এই তিন বিজ্ঞানীর কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রতিষ্ঠানের কারও মধ্যে কোনো প্রশ্ন নেই। তাঁরা পদোন্নতি না পাওয়ার কারণ, তাঁদের বিভাগে পদ খালি নেই।
১৯৮০ সালে ব্রিতে যোগ দিয়েছিলেন রফিকুল ইসলাম। ১৯৮৩ সালে যোগ দিয়েছিলেন আবদুল জলিল মৃধা, গউছ আলী ও হামিদুর রহমান মোল্লা। দীর্ঘদিন চাকরি করে তাঁরা কেবল পিএসও হয়েছেন। কিন্তু ১৯৯৪ ও ১৯৯৮ সালে যোগ দেওয়া কর্মকর্তারাও সিএসও হয়ে গেছেন। এমন অনেক উদাহরণ আছে প্রতিষ্ঠানটিতে।
সাম্প্রতিক পদোন্নতি এবং আদালতের আদেশ: ব্রির নিয়ম অনুযায়ী, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা থেকে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে যেতে চাকরির বয়স অন্তত পাঁচ বছর হতে হয়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ২০০৭ সালের নভেম্বরে যোগ দেওয়া ৩৩ জন কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁদের পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ একদল বিজ্ঞানী গত ১৮ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট করেন। কিন্তু পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁরা পদোন্নতি পেয়ে যান।
মামলার আইনজীবী গোলাম ফারুক ভুঁইয়া জানান, ২৬ নভেম্বর আদালত সমন্বিত ও প্রাতিষ্ঠানিক জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তালিকা করে বিজ্ঞানীদের পদোন্নতির বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। আদালত দুই মাস সব ধরনের পদোন্নতি বন্ধ রাখারও নির্দেশনা দেন। ২৮ নভেম্বর রায়ের লিখিত অনুলিপি ব্রিতে পৌঁছায়।
কিন্তু কাগজপত্রে দেখা যায়, ১২ নভেম্বর পদোন্নতির জন্য যোগ্য হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ পর ২০ নভেম্বর ২০ জনকে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নিয়োগ ও পদোন্নতি কমিটি। এর মাত্র দুই দিন পর ২২ নভেম্বর পরিচালনা পর্ষদ পদোন্নতি অনুমোদন করে। ওই দিনই অধিকাংশ কর্মকর্তা উচ্চ পদে যোগ দেন। সবার পদোন্নতির স্মারক প্রকাশ করা হয় ২৬ নভেম্বরের আগেই।
অনিয়ম: পদোন্নতি দিয়েই প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক সাইদুল ইসলাম জাপানে যান। ২৬ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত পরিচালক (গবেষণা) মোহাম্মদ শমশের আলী ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। নতুন যোগ দেওয়া কর্মকর্তাদের নথি তাঁর কাছে গেলে তিনি ‘আদালতের রায় থাকায় মহাপরিচালক এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন’—বলে নথিতে নির্দেশনা দেন। কিন্তু মহাপরিচালক দেশে এসে শমশের আলীকে আদালতের রায়ের আগের তারিখে যোগদানপত্র দেওয়ার জন্য চাপ দেন। তবে শমশের আলী রাজি হননি। কিন্তু পরে আটজন কর্মকর্তার পদোন্নতি ও যোগদানের যে অফিস স্মারক প্রকাশ করা হয়, তাতে দেখা যায়, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ২৬ নভেম্বর তা সই করেছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এর মধ্যেও পদোন্নতি-বঞ্চনার ঘটনা ঘটেছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকায় থাকা প্রথম তিনজনের কাউকেই পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। ২০০৭ সালে যোগ দেওয়া কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেলেও ২০০১ সালে যোগ দেওয়া শাহনাজ পারভীন ও ইবনে সৈয়দ হারুনুর রশীদ এবং ২০০৫ সালে যোগ দেওয়া হাবিবুর রহমান পদোন্নতি পাননি। জ্যেষ্ঠতার তালিকায় এঁরা ছিলেন সবার আগে।
নিয়োগে অনিয়ম: কেবল পদোন্নতিতে নয়, নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্রিতে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগের জন্য সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ৩৪ বছর। কিন্তু তাপস কুমার সরকারকে শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগ এবং মোহাম্মদ কামরুজ্জামানকে এফএমপিএইচটি বিভাগে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা করা হয়েছে। তাঁদের দুজনেরই বয়সই ৩৪ পেরিয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ বছরের চাকরিকাল না থাকা সত্ত্বেও সুব্রত বণিককে ২৫ নভেম্বর সরকারি ছুটির দিনে শস্যমান ও পুষ্টিবিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
মহাপরিচালক সাইদুল ইসলাম, জীবন কৃষ্ণ, শাহজাহান কবির—তিনজনেই একই কথা বলেন। তাঁদের দাবি, ২০০৫ সালের একটি নির্দেশনায় বলা আছে, প্রকল্প থেকে কেউ সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আবেদন করলে তাঁর বয়স শিথিল করা যাবে। তবে অপর অংশের অভিযোগ, বিজ্ঞানী নিয়োগে রাষ্ট্রপতি ছাড়া আর কেউই বয়স শিথিল করতে পারেন না।
ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক সাইদুল ইসলাম ব্রিতে বিভাগীয় পদোন্নতির কারণে বঞ্চনার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘অনেকেই এ কারণে চাকরি ছেড়েছেন। সম্প্রতি একটি পক্ষ আদালতে গেছে। এখন আদালত যদি প্রাতিষ্ঠানিক পদোন্নতির সিদ্ধান্ত দেন, তাহলে আমরা সেটি মেনে চলব। আর বিজ্ঞানীরা একমত হলে পরিচালনা পর্ষদও সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’
No comments