চরাচর-ঘাতকদের ফাঁসি দেখতে চান তাঁরা by হাকিম বাবুল
'আমার স্বামীরে ঘর থেইক্যা টাইন্যা লইয়্যা আইয়্যা উঠানে ফালাইয়্যা পরথমে ছয়ডা গুলি করে। গুলি খাইয়্যা পানি চাইলে আরেকডা গুলি করে। ওই গুলিতে উডানেই তার জীবন যায়। পরে আমার সোনামানিক বুকের ধন হাশেমরে ধইর্যা নিয়্যা বাপের লাশের উপরে ফালাইয়্যা গুলি করে।
এরপর আমার দেওররে ধইর্যা নিয়্যা বন্দুকের নল দিয়্যা কেচাইতে থাহে, পরে মুহের ভিতরে বন্দুক দিয়্যা গুলি করে। তহনি তার পরান বাইরইয়্যা যায়।' শহীদ খেজুর আলীর স্ত্রী জরিতন বেওয়া বলছিলেন তাঁর স্বামী-সন্তান হারানোর কথা। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, 'মরবার আগে আমার স্বামী ও পুলারে যারা মারছে, সেই তাগোরে ফাঁসি দেইখ্যা যাবার চাই।'
১৯৭১ সালের এই দিনে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালায় জেলা শহর শেরপুর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের ছয় ঘণ্টার তাণ্ডবে ওই গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষ শহীদ হন। একাত্তরের ২৫ জুলাই ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী সোহাগপুর গ্রামের ক্ষেতে-খামারে ও ঘরে ঘরে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করে নিরীহ কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষকে। সেই থেকে গ্রামটির নাম পাল্টে হয়ে যায় 'বিধবা পল্লী'।
সেদিনের সেই হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে চাইলে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে কান্নায় ভেঙে পড়েন বিধবা সমলা বেওয়া (৭৮), করফুলি বেওয়া (৭২) ও জরিতন বেওয়া (৭৬)। এক পর্যায়ে নিজেদের বুকচাপা কষ্ট সামলে নিয়ে বিধবারা বলেন, 'যারা আংগর বেডাইনরে (পুরুষ মানুষ) মারছে, ওগরে যুদি বিচারডা অইতো, তাগরে ফাঁসি অইতো, আংগর কইলজাডা তাও ইট্টু জুড়াইতো।' সোহাগপুরের বিধবারা জানান, ওই দিন ছিল শ্রাবণ মাসের ১০ তারিখ। সকাল ৭টার দিকে গ্রামের মানুষ যখন ক্ষেতে-খামারে কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এমন সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রায় ১৫০ জনের একটি দল আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নির্দেশে স্থানীয় রাজাকার কাদির ডাক্তারের নেতৃত্বে গ্রামের প্রফুল্লদিঘী থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত এলাকা ঘিরে ফেলে। এ সময় তারা গ্রামের ছেলে, বুড়ো, শিশু- যাকে যেখানে পেয়েছে, সেখানেই পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে। অনেককেই বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়। মধ্যযুগীয় কায়দায় নরঘাতকের দল স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, মায়ের সামনে সন্তানকে বাড়ির উঠানে ফেলে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। প্রায় ছয় ঘণ্টা তাণ্ডবের পর হায়েনার দল সোহাগপুর ত্যাগ করে চলে যায়। স্বজনদের লাশ দেখে শুরু হয় শোকের মাতম। তাঁদের গগনবিদারী চিৎকারে আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে। আবার হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আসবে বাড়িঘর জ্বালাতে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রিয় স্বজনের লাশ কেউ কলাপাতা, কেউ শাড়ি, গামছা, আবার অনেকেই ঘরের মশারি দিয়ে পেঁচিয়ে কোনোমতে গর্ত করে এক কবরে পাঁচ-সাতজনকে মাটিচাপা দিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান।
এসব বিধবা কেউ বয়স্ক ভাতা, কেউবা বিধবা ভাতা এবং ট্রাস্ট ব্যাংক ও ব্র্যাকের যৎসামান্য মাসিক ভাতার ওপর কোনোমতে দিনাতিপাত করছেন। সোহাগপুর বিধবা পল্লীর শহীদদের গণকবর সংরক্ষণ এবং স্মৃতিফলক নির্মিত হলেও তাঁদের ভাগ্যে এখনো শহীদ পরিবার ভাতা কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্মান কোনোটাই জোটেনি। দিন যত যাচ্ছে, ততই কমে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে আত্মাৎসর্গকারী মানুষের সংখ্যা। যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন, তাঁরা আছেন নানা কষ্টে। খাবার নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, নেই চিকিৎসা। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বর্তমান সরকার এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে- এমন প্রত্যাশা নিয়েই প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন সোহাগপুর বিধবা পল্লীর বিধবারা।
১৯৭১ সালের এই দিনে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালায় জেলা শহর শেরপুর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের ছয় ঘণ্টার তাণ্ডবে ওই গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষ শহীদ হন। একাত্তরের ২৫ জুলাই ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী সোহাগপুর গ্রামের ক্ষেতে-খামারে ও ঘরে ঘরে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করে নিরীহ কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষকে। সেই থেকে গ্রামটির নাম পাল্টে হয়ে যায় 'বিধবা পল্লী'।
সেদিনের সেই হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে চাইলে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে কান্নায় ভেঙে পড়েন বিধবা সমলা বেওয়া (৭৮), করফুলি বেওয়া (৭২) ও জরিতন বেওয়া (৭৬)। এক পর্যায়ে নিজেদের বুকচাপা কষ্ট সামলে নিয়ে বিধবারা বলেন, 'যারা আংগর বেডাইনরে (পুরুষ মানুষ) মারছে, ওগরে যুদি বিচারডা অইতো, তাগরে ফাঁসি অইতো, আংগর কইলজাডা তাও ইট্টু জুড়াইতো।' সোহাগপুরের বিধবারা জানান, ওই দিন ছিল শ্রাবণ মাসের ১০ তারিখ। সকাল ৭টার দিকে গ্রামের মানুষ যখন ক্ষেতে-খামারে কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এমন সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রায় ১৫০ জনের একটি দল আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নির্দেশে স্থানীয় রাজাকার কাদির ডাক্তারের নেতৃত্বে গ্রামের প্রফুল্লদিঘী থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত এলাকা ঘিরে ফেলে। এ সময় তারা গ্রামের ছেলে, বুড়ো, শিশু- যাকে যেখানে পেয়েছে, সেখানেই পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে। অনেককেই বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়। মধ্যযুগীয় কায়দায় নরঘাতকের দল স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, মায়ের সামনে সন্তানকে বাড়ির উঠানে ফেলে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। প্রায় ছয় ঘণ্টা তাণ্ডবের পর হায়েনার দল সোহাগপুর ত্যাগ করে চলে যায়। স্বজনদের লাশ দেখে শুরু হয় শোকের মাতম। তাঁদের গগনবিদারী চিৎকারে আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে। আবার হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আসবে বাড়িঘর জ্বালাতে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রিয় স্বজনের লাশ কেউ কলাপাতা, কেউ শাড়ি, গামছা, আবার অনেকেই ঘরের মশারি দিয়ে পেঁচিয়ে কোনোমতে গর্ত করে এক কবরে পাঁচ-সাতজনকে মাটিচাপা দিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান।
এসব বিধবা কেউ বয়স্ক ভাতা, কেউবা বিধবা ভাতা এবং ট্রাস্ট ব্যাংক ও ব্র্যাকের যৎসামান্য মাসিক ভাতার ওপর কোনোমতে দিনাতিপাত করছেন। সোহাগপুর বিধবা পল্লীর শহীদদের গণকবর সংরক্ষণ এবং স্মৃতিফলক নির্মিত হলেও তাঁদের ভাগ্যে এখনো শহীদ পরিবার ভাতা কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্মান কোনোটাই জোটেনি। দিন যত যাচ্ছে, ততই কমে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে আত্মাৎসর্গকারী মানুষের সংখ্যা। যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন, তাঁরা আছেন নানা কষ্টে। খাবার নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, নেই চিকিৎসা। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বর্তমান সরকার এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে- এমন প্রত্যাশা নিয়েই প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন সোহাগপুর বিধবা পল্লীর বিধবারা।
No comments