আইন হাতে তুলে নেয়ার ভয়ানক প্রবণতা-চার বছরে নিহত ; প্রায় ৬০০ শিকার হচ্ছেন অনেক নিরপরাধ মানুষ ; রেহাই পাচ্ছে না বুদ্ধি প্রতিবন্ধীরাও by আবু সালেহ আকন

আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা দেশে ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। গণপিটুনির শিকার হচ্ছেন অনেক নিরপরাধ মানুষ।
এমনকি মানসিক প্রতিবন্ধীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। নৃশংসতা ও নির্মমতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে  যে, ছেলে ধরা সন্দেহে এক মানসিক প্রতিবন্ধী মহিলাকে পিটিয়ে তার শরীরে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারা  হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ঘটনায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বর্তমান সরকারের সময়ে গত চার বছরে অন্তত ৬০০ মানুষকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে। গত এক বছরে সারা দেশে ১৩২ জন এই নির্মমতার শিকার হয়েছেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকার কারণে এমনটি হচ্ছে।

গত সোমবার গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকায় বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এক যুবককে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। প্রকাশ্যে ছুরি দিয়ে তার গলা কাটা হয়। স্থানীয় সূত্র জানায়, সকালে ওই যুবক ঘোরাফেরা করার সময় স্থানীয় লোকজন ছেলে ধরা ও গলাকাটা দলের সদস্য সন্দেহে তাকে প্রথমে পিটিয়ে আহত করে এবং পরে ছুরি দিয়ে তার গলা কেটে ফেলা হয়। এর আধাঘণ্টা পরে কোনাবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারীকে প্রথমে পিটিয়ে আহত করা হয় এবং পরে তার শরীরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে কিছু পাষণ্ড মানুষ। স্থানীয় সূত্র জানায়, পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনা  সম্পর্কে জানতে পেরেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গত শনিবার মর্জিনা নামে অপর এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় ওই নারীকে বাঁচাতে গিয়ে স্থানীয় কয়েকজন লোক আহত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কয়েক দিন ধরেই গাজীপুর এলাকায় ‘ছেলে ধরা’ এবং ‘গলাকাটা’ গুজব চলছে। এই গুজবের শিকার হচ্ছেন নিরপরাধ মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এর প্রতিকারে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।

গত বছরের অক্টোবর মাসে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছেলে ধরা সন্দেহে তিন মহিলাকে গণধোলাই দেয় স্থানীয় কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক। এর কয়েক দিন আগে যাত্রাবাড়ীর কাশেম রোডে মাকসুদা নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলাকে ছেলে ধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয় লোকজন। সূত্র জানায়, পুলিশের উপস্থিতিতেই এসব ঘটনা ঘটেছে। এর আগেও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সামনে অনেক নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। এমনকি, পুলিশের ভ্যান থেকে নামিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। আবার অনেক সময় পুলিশ গ্রেফতার করে মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে এমন নজিরও রয়েছে।

এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা অপরাধের অভিযোগ এনে অনেক মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। চোর, ডাকাত ও ছিনতাইকারী সন্দেহে প্রায়ই ঘটছে মানুষ হত্যার ঘটনা। গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর মিডিয়া রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (এমআরটি) তথ্য অনুযায়ী গত চার বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ৫৮৮ জন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে নিহত হয়েছেন ১২৭ জন, ২০১০ সালে ১৭৪ জন, ২০১১ সালে ১৬১ জন এবং ২০১২ সালে ১২৬ জন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১৩২ জন। অধিকার এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অধিকার বলেছে, বিচারব্যবস্থা ও পুলিশের প্রতি অনাস্থার কারণে সাধারণ মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে প্রতি মাসে প্রায় ১২ জন মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হচ্ছেন।

মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা না থাকায় এভাবে একের পর এক নৃশংস ঘটনা ঘটছে। মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান নয়া দিগন্তকে বলেন, যখন দেশে সুশাসন থাকে না তখন মানুষ বর্বর হয়ে ওঠে। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনাস্থা থেকে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা-মানবাধিকার-এর নির্বাহী পরিচালক আবুল বাসার নয়া দিগন্তকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর মানুষের আস্থা নেই। পুলিশ অপরাধীদের আইনের কাছে নিয়ে যাবে কি না এবং তাদের বিচার হবে কি না এই নিয়ে মানুষের সন্দেহ রয়েছে। এ জন্যই মানুষ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে। দেশ যারা পরিচালনা করছে তাদের এসব বুঝতে হবে। খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্তদের রাষ্ট্রপতি মাফ করে দিচ্ছেন। কিন্তু যারা স্বজন হারাচ্ছেন তারা খুনিকে মাফ করতে পারছেন না। এ কারণেই মানুষের আস্থার স্থানগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
       

No comments

Powered by Blogger.