বিশ্বজিৎ হতে পারত আমাদের মালালা

সাম্য শরিফ: সেকসপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকে সিজারকে হত্য করার পর মার্ক এ্যান্টনি সিজারের পক্ষে ’ফ্রেন্ডস, রোমানস, কান্ট্রিমেন...’ খ্যাত যে কালজয়ী বক্তব্য দেয় তাতে ব্র“টাস ও তার সমর্থকরা জনগণের কাছে ষড়যন্ত্রকারী ও নিষ্ঠুর হত্যাকারী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যায়
। রোমে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের আগুন। অ্যান্টনি’র অনুগত সিজারের সমর্থকেরা হত্যাকারী ব্র“টাস ও তার সমর্থকদের ’কনসপাইরেটর’ হিসাবে চিহ্নিত করে এবং প্রতিশোধ নিতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে তারা চারিদিকে খুজতে থাকে ব্র“টাস ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের। এই উন্মত্ত অবস্থায় সামনে ’সিনা’ নামের এক ব্যক্তিকে পেয়ে সকলে তাকে একসাথে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে এবং মুলতঃ জানতে চায় সে ব্র“টাসের পক্ষের লোক কিনা। সিনা তাদেরকে তার নাম বলে এবং বলে যে সে ‘কনসপাইরেটর’ না, ব্র“টাসের পক্ষের না এবং সে একজন কবি। অন্যদিকে ‘কনসপাইরেটর’দের মধ্যেও সিনা নামের একজন আছে। তাই তারা সিনা নামের এই কবিকে তখনি এজন্য হত্যা করে যে তার নাম এবং ‘কনসপাইরেটর’দের একজনের নাম এক; ‘ইট’জ নো ম্যাটার, হিজ নেম ইজ সিনা’। প্রতিহিংসার উন্মত্ততা এমনই। দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে নির্বিচারে। আবার প্রতিহিংসা নিজেই সংক্রামক। যতই চরিতার্থ করা হয় ঘুরেফিরে উভয় দিকে ততই তা বাড়তে থাকে পালাক্রমে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ট্রাজেডির পর থেকে আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল পরস্পরকে প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে না- মনে করে শত্র“ পক্ষ। আর শত্র“র সাথে কেউ বন্ধুত্ব করে না, সবাই তাকে নিধন করতে চায়। আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক মনোজগতের এমনই এক প্রতিহিংসাপরায়ন মনোবৃত্তির বন্য নিষ্ঠুর শিকার নিরীহ টগবগে তরূণ বিশ্বজিৎ দাস। চব্বিশ বছরের এই সুদর্শন তরূণ মাসে আট থেকে দশ হাজার টাকা উপার্জনক্ষম হওয়ায় বাবা তার জন্য পাত্রী দেখা শুরু করে। সেও হয়ত তার পছন্দের কোনো মেয়ে কিংবা প্রিয়ার মুখ স্মরণ করে আপন মনে গেয়ে উঠত ‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা সত্যি, এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না’ । এই বসন্তেই হয়ত সে সাত পাকে বাধা পড়ে যেত তার প্রেমিকা কিংবা পছন্দের মানুষটির সাথে। না, তা হয়নি। বিশ্বজিৎ দাসের সবকিছু আটকে গেছে- থেমে গেছে চিরতরে; নিষ্ঠুর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পশু ছোবলে।
সাম্প্রতিককালে আমাদের প্রতিবেশি দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্থানে বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকান্ডের মত দুটি ভয়াবহ জঘন্য ঘটনা ঘটেছে। পাকিস্তানে তের বছরের মালালা ইউসুফ জাইকে বুলেটে বুলেটে হত্যা করতে চেয়েছিল ধর্মান্ধ পশ্চাৎগামী শক্তি। হানাহানি ও সামাজিক অস্থিরতার দেশ হওয়া সত্বেও গোটা পাকিস্তান দাড়িয়ে যায় মালালার পেছনে। নেতিবাচক অনেক কিছুর মাঝে পাকিস্তানে এ এক অন্যরকম ঐক্যবদ্ধ ইতিবাচক সামাজিক শক্তি। ভারতে মাত্র কয়েকদিন আগে চলন্তবাসে গণধর্ষনের শিকার হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে তেইশ বছরের এক ছাত্রী । ফুঁসে উঠে গোটা ভারত। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে গেছে এই জঘন্য ঘটনার বিপক্ষে; রাস্তায় নেমে এসেছে এরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তিরোধে ও প্রতিকারে।
দুটি জঘন্য ঘটনা পাকিস্তান ও ভারতের জনগনকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়েছে। অসামান্য সামাজিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। অথচ বিশ্বজিৎ দাসকে আমরা পাকিস্থানের মালালা কিংবা ভারতের সেই মেযেটির (জ্যোতি) মত বাংলাদেশের বিশ্বজিৎ দাসে পরিণত করতে পারিনি। সে শুধুই একজন দর্জি বিশ্বজিৎ। ব্যক্তিগত হতভাগ্য বিশ্বজিৎ। তাকে ঘিরে আমরা গোটা বাংলাদেশ এক কাতারে এসে  সামাজিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে রুখে দাড়াতে পারিনি বর্তমান এবং আগামী দিনের সকল রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ন নৃশংসতা ও জঘন্যতার বিপক্ষে । মালালা কিংবা জ্যোতির মত একই মাত্রার ঘটনায় পাকিস্তান ও ভারতের তুলনায় আমাদের সামাজিক শক্তি প্রায় অনুপস্থিত, প্রতিক্রিয়া নির্লিপ্ত ও প্রতিরেধের ভাবনা শূন্য।
সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ দলীয় চিন্তায় আমরা এতটায় গন্ডিবদ্ধ বিবেক প্রতিবন্ধি হয়ে থাকি যে ভালবাসার বৈজ্ঞানিক নাম ‘অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅরডার’ (ওসিডি) এর মতই পৃথিবীর সব সত্যমিথ্যা, নিয়ম- অনিয়ম, পাপ-পূন্য, নিষ্ঠুরতা, পশুত্ব আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কঠিন হিমালয় ভেদ করে মানবিকবোধসম্পন্ন মনোজগতে পৌছাতে পারে না। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড জঘন্য দৃশ্যটি ’ডিসকভারি’ বা ’ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল’ বা এই জাতীয় কোনো চ্যানেলে টেলিকাষ্ট হলে ইংরেজ কবি কোল্ডরিজের ’উইলিং সাসপেনশন অব ডিসবিলিফ’ এর মতই বিশ্বের অনেক দর্শকই এদেরকে এই গ্রহের সমাজ জীবনে বসবাসকারী মানুষ বলে বিশ্ব্াস করতো না। অথচ বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডের সাথে সাথেই আমাদের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল এই জঘন্য ঘটনা থেকে কে কতটা বেনিফিশিয়ারী কিংবা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে সেই চিন্তায় ’একশন’ এ নেমে পড়ল । বিএনপি দাবি করে বসল যে বিশ্বজিৎ তাদের সক্রিয় কর্মী; আওয়ামী লীগ থেকে বলা হলো হত্যাকারীরা ছাত্রলীগের কেউ না। আর আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’র বাইরে আমরা শুধু দেখলাম, শুনলাম এবং ’নিশ্চল নিশ্চুপ’ভাবে  থেমে গেলাম।
এরশাদ আমলের সেলিম-দেলোয়ার হত্যাকান্ড থেকে শুরু করে বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ড পর্যন্ত যত প্রকাশ্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এযাবত সংগঠিত হয়েছে কোনোটিতেই জনগণের প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিক গণ্ডির বাইরে দৃশ্যমান হয়নি। সমর্থন করা নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের লাভ লোকসানের হিসাবেই আটকা পড়ে আছে মানবিক চেতনা সম্পন্ন সক্রিয় প্রতিক্রিয়া। জনগণের এই পক্ষপাতদুষ্ট নির্লিপ্ত অবস্থার সুযোগে ২১ আগষ্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পর আবিষ্কৃৃত হয় জজ মিয়া; আর প্রকাশ্য দিবালোকে শ’শ মানুষের সামনে বিশ্বজিতের হত্যাকারীরা পুলিশের মামলায় প্রথমে অজ্ঞাত থাকে এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাদের দলীয় পরিচয় অস্বীকার করা হয়। এরশাদ আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস নিয়ে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পত্রিকায় ড. ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর লেখা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাইশ হাজার নপুংশক’ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ষোল কোটি মানুষের দেশে সন্ত্রাসী কতজন? আওয়ামী লীগ বিএনপিতে অস্ত্রধারী কতজন? এর বাইরে যারা তাদের অস্তিত্ব কোথায়? অস্ত্র ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য দলে যারা রয়েছেন তারা হাতে হাত রেখে এক কাতারে দাড়ালে, কিছু কার্যক্রম হাতে নিলে খুনি ও অবৈধ অস্ত্রবাজদের রুখে দেওয়া সম্ভব। যে কোনও ঘটনায় রাষ্ঠ্রের মদদ যতই থাক অবশ্যই রাষ্ট্রের চেয়ে জনগন ক্ষমতাশীল। কোনো খুন থেকে রাজনৈতিক লাভ লোকসানের হিসাব করে প্রতিক্রিয়া দেখানো বা না দেখানো আর সেই খুনে সমর্থন করার ভিতর কোনও পার্থক্য নেই।
প্রতিটি সমাজের অভ্যন্তরে একটি নিজস্ব দলনিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক সামাজিক শক্তি থাকে যা সেই সমাজের দিকনির্দেশক বা আলোকরশ্মি। কিন্ত যখন রাজনৈতিক শক্তি সামাজিক নৈর্ব্যক্তিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে তখন সামাজিক শক্তি মেরুদণ্ডহীন হয়ে যায়। কোনও দেশে দলনিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক সামাজিক শক্তির অনুপস্থিতি ঘটলে অশুভ প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনৈতিক শক্তি হয়ে যেতে পাওে রুয়ান্ডার হুটু ও টুটসিদের মত উন্মত্ত ও জিঘাংসু। সেই দাবানলে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে সমাজের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও হৃতপিণ্ড।


লেখক: মানবাধিকার কর্মী
email: shammosharif@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.