আগামী জানুয়ারিতে নির্বাচন-বিশ্বব্যাংক সিদ্ধান্ত না জানালে বিকল্প চিন্তাঃ প্রধানমন্ত্রী

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
একই সাথে তিনি বিশ্বব্যাংককে সময় বেঁধে দিয়ে বলেন, চলতি জানুয়ারি মাসের মধ্যে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। না হলে আমরা বিকল্প চিন্তাভাবনা করব। আগামী ফেব্র“য়ারিতে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিকল্প ব্যবস্থা আমরা নেবো। শেখ হাসিনা বলেন, মহাজোট সরকারের শাসনামলে প্রত্যেকটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও ত্রুটিমুক্ত হয়েছে। বিরোধী দল এসব নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এসব নির্বাচনে অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশেও সেভাবে নির্বাচন হবে।

প্রধানমন্ত্রী সদ্য সমাপ্ত রাশিয়া সফরের অভিজ্ঞতা জানাতে গতকাল বুধবার দুপুরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। তারা বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন। রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে ভবিষ্যতে যদি মামলা হয়, কিভাবে তা সামাল দেবেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি রাজনীতিবিদ। রাজনীতি যখন করি তখন মামলাটামলা ফেস করা নিয়ে চিন্তিত নই। মামলা হতেই পারে। আমি মামলা নিয়ে চিন্তা করি না। কারণ আমরা কোনো অন্যায় করিনি। নিজে কতটুকু পরিষ্কার আছি সেটাই আমার কাছে বড় বিষয়। তিনি বলেন, নিজের জন্য কোনো রাজনীতি করি না। আমার রাজনীতি  দেশের মানুষের জন্য। একটা আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করি। অস্ত্র ক্রয় প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে বলেন কী দরকার? আবার যখন মিগ-২৯ আকাশে ওড়ে তখন তো ভালোই লাগে। গর্বে বুকটা ভরে যায়। স্বাধীনতার পর মিগ-২১ আমাদের জন্য আনা হয়। এর আগে মিগ-২৯ এনেছিলাম। সামরিক বাহিনী আধুনিক হোক, শক্তিশালী  হোক, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রায় উপযুক্ত হোকÑ তা তারা চান না। আমার প্রশ্ন হলো আসলে তারা (বিএনপি) কী চায়? রাশিয়ার সাথে অস্ত্র কেনার চুক্তি সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, সামরিক নীতিমালা মেনেই তা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের সামরিক নীতিমালা রয়েছে। এর আলোকেই প্রতিরা সরঞ্জাম কিনছি। রাশিয়া থেকেই মিগ-২৯ কেনা হয়। রাশিয়াই বাংলাদেশের সামরিক  েেত্র বড় জোগানদাতা।

তিনি বলেন, আমাদের অর্থমন্ত্রী পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংককে জানুয়ারির মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাতে বলেছেন। যদি তারা তা না করে তবে আমরা নিজেরাই বিকল্প ব্যবস্থা নেবো। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি হয়নি, বিশ্বব্যাংকের মতে ষড়যন্ত্রের চেষ্টা হয়েছে। ষড়যন্ত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বাংলাদেশে কোনো কিছুই করা যাবে না। তা ছাড়া বিশ্বব্যাংক প্যানেলের একটি কপি আমরা পাওয়ার আগে কিভাবে একটি পত্রিকা হুবহু প্রকাশ করে। আমার মনে হয় এখানেও দুরভিসন্ধি রয়েছে। তিনি বলেন, যদি তারা এ ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না নেয় তাহলে আমরা নিজেরাই শুরু করব।

পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ শুরু করা হবে। এর আগে বাংলাদেশকে বেশ কিছু কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া প্রযুক্তি ও অর্থায়নে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে।

রাশিয়াকে বাংলাদেশের পরমবন্ধু উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ থেকে শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানি করতে সে দেশের প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, রাশিয়ার মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধার সাথে এখনো স্মরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির মধ্যে তারা বাংলাদেশকে দেখেন। রাশিয়ার সাথে আমাদের সম্পর্ক অমরত্ব লাভ করেছে। আমার সফরকালে ওই সম্পর্ক আরো জোরদার হয়েছে। বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে দেশটি থেকে সমরাস্ত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘে আমরা যখনই সেনা পাঠিয়েছি, তখন তাদের সাথে বিভিন্ন যানও পাঠানো হয়েছে। যেগুলো রাশিয়া থেকে কেনা। জাতিসঙ্ঘ থেকে টাকা পেয়ে তা পরিশোধ করা হয়েছে। এ সফরে তিনি অভিভূত বলে প্রধানমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, এ সফরের মাধ্যমে বন্ধুত্বের যে বন্ধন তৈরি হলো, তাতে দীর্ঘমেয়াদি সুফল ভোগ করবেন দেশবাসী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা দেখেছি তা হলো রাশিয়া বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখে। তারা বিশেষ গুরুত্ব দেন তাকে। আমাকে রাশিয়া অভিভূত করেছে। রাশিয়ার সমর্থনের কারণেই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় আরো সহজ হয়েছিল। রাশিয়া আমাদের পরম বন্ধু। দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়ে তারা আমাদের কৃতজ্ঞতায় বেঁধেছে। এ সফরে সেই সম্পর্ক পুনর্জাগরণ ঘটেছে। এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা স্বাধীনতার পে ছিলেন তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনলে অপরাধ হয়, আর যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় করলে অপরাধ হয় না। অস্ত্র ক্রয়সংক্রান্ত কমিটি সম্পর্কে তিনি বলেন, এ কমিটিতে বিমান, সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্য ছিলেন। অস্ত্র কেনার ব্যাপারে ক্যাবিনেটে আলোচনা হয়েছিল কি নাÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অতীতে কোনো দৃষ্টান্ত নেই যে, এ ব্যাপারে ক্যাবিনেটে আলোচনা করা হয়েছে। এতে ক্যাবিনেটের দরকার হয় না। রাশিয়ার পুরনো অস্ত্র বেশি দামে কেনা হচ্ছেÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি সরকার চীন থেকে যে বছর অস্ত্র কিনেছিল, সেই বছর থেকে দাম পরিশোধ করতে হয়েছে। কিন্তু আমরা পাঁচ বছর পর থেকে অর্থ পরিশোধ করা শুরু করব। আমরা কোনোভাবেই বেশি দামে অস্ত্র ক্রয় করিনি। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি সম্পর্কে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি নয় দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। এ বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে কোনো কাজ করা যাবে না। বাংলাদেশে সব কাজেই ষড়যন্ত্র হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুর কাজ থেমে নেই। জমি অধিগ্রহণ হয়েছে ও কাজ চলছে। পদ্মা সেতুর ব্যয়সংক্রান্ত বিষয়ে হাতিরঝিল প্রকল্পের সৌন্দর্যের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর ডিজাইন ভিন্নভাবে করায় এর ব্যয় বেড়ে গেছে।

ড. ইউনূসের রাজনীতিতে ফিরে আসা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশে সবার রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। আমি কি তাকে নিষেধ করেছি? প্রশ্ন করেন প্রধানমন্ত্রী।

রাশিয়া থেকে অস্ত্র কিনে কমিশন পাওয়া যাবেÑ সম্প্রতি মওদুদ আহমদের এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার কমিশন নেয়ার অভ্যাস নেই। মওদুদ কমিশন ভালো বোঝেন। তিনি এ পথ চেনেন। নিজের টাকা কত নামে তিনি রেখেছেন। এসব তার ভালো জানা আছে।

অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিরোধী দল সংসদে আসবে কি না তা তাদের ব্যাপার। তিনি বলেন, বিএনপি সরকারের সময় আমাকে সংসদে ২ মিনিটের বেশি কথা বলতে দেয়া হয়নি। কিন্তু বিরোধী দলের নেত্রী তার ইচ্ছামতো সংসদে কথা বলেছেন।

প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, আমাদের সময় পাঁচ হাজার ৫০০টি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এসব নির্বাচনের সময় প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে ছিল। নির্বাচনী অঙ্গীকার ও ছাত্রলীগের সম্প্রতি কার্যক্রম সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা প্রতিটি অঙ্গীকার পালন করেছি। ত্রেবিশেষে আমরা বেশি করেছি। ইউনিয়নপর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানো এবং সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন তিনি।

ছাত্রলীগ সম্পর্কে তিনি বলেন, যারা সন্ত্রাস করছে তারা ছাত্রলীগের কর্মী নয়। এর পরও এর সাথে যাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ২০০১ সালে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে সরকারে আসতে পারেননি বলে যে মন্তব্য করেছিলেন সে আশঙ্কা রয়েছে কি না জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেন, সে আশঙ্কাও রয়েছে। এ সংবাদ সম্মেলনে সরকার সমর্থক পত্রপত্রিকাগুলোর সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও বিরোধী হিসেবে পরিচিত পত্রিকাগুলোকে দাওয়াত দেয়া হয়নি।
      

No comments

Powered by Blogger.