সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থায় প্রশ্নপদ্ধতি by ড. মো. গোলাম সামদানী ফকির ও ম. মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়া
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বেশকিছু সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা আইন প্রণয়ন, কারিকুলাম সংস্কার, কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন, শিক্ষায় মাল্টিমিডিয়া প্রয়োগের ব্যবস্থা, অটিজম ও অন্যান্য প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি এবং সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির সম্প্রসারণ।
তবে এ পদক্ষেপগুলোর সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করবে প্রায়োগিক দিকের কলাকৌশলের ওপর। তেমন একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির প্রবর্তন। শৈশবে শিশুরা হাজার প্রশ্ন করে; যেমনটি ঘটেছিল আমার কিংবা আপনার শৈশবেও। এখনো খুব করে মনে পড়ে বাবাকে একই প্রশ্ন বারবার করার স্মৃতি। এই প্রশ্ন করা হলো একটি স্বাভাবিক শিখন প্রক্রিয়া। আমরা যারা শিক্ষা প্রদানের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত- তাদের এ ক্ষেত্রে রয়েছে একটি বিশেষ ভূমিকা। কারণ এই শিখন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকাশে প্রশ্ন করার ধরন ও তার প্রয়োগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই চলমান শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীলতা বিকাশে প্রয়োজন প্রশ্নপদ্ধতির সময়োপযোগী সংস্করণ ও তার যথাযথ প্রয়োগ। আমরা জানি প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকাশে একটি প্রচলিত উপায় হলো 'প্রশ্নপদ্ধতি'। এই প্রশ্নপদ্ধতি একজন শিক্ষার্থীকে কতটুকু সৃজনশীল করে গড়ে তুলবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে প্রশ্ন করার ধরনের ওপর। তাই ঘুরেফিরে সক্রেটিসের কথাটিই মনে পড়ে, 'যে ভালো প্রশ্ন করতে পারে, সে ভালো শিক্ষা দিতে পারে।' আজকের এই সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থায় সে-ই ভালো শিক্ষক, যে ভালোভাবে প্রশ্ন করতে পারে। তাই শিক্ষার্থীর জ্ঞানবৃত্তীয় শিখন ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার অঙ্কুরোদগম ঘটাতে ভালো প্রশ্ন হতে পারে একটি কার্যকর মহৌষধ।
তথ্য অনুযায়ী ১৮৬০ সালের দিকে একজন শিক্ষক তাঁর সারা দিনের কর্মপরিসরে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করতেন গড়ে ৮০ শতাংশ সময়; যেখানে প্রশ্নের সংখ্যা দাঁড়াত ৩০০ থেকে ৪০০-এর মতো। কিন্তু গবেষণায় প্রমাণিত, এ ধরনের বেশির ভাগ প্রশ্ন শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তিকে শাণিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালনে অনেকাংশে ছিল ব্যর্থ। কারণ, এসব প্রশ্নের প্রত্যুত্তর দিতে শিক্ষার্থীর গভীরভাবে চিন্তা করার তেমন কোনো অবকাশ ছিল না। তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে অধুনা শিক্ষাব্যবস্থায় বহুল প্রচলিত ও প্রচারিত মাল্টিপল প্রশ্নধারা। ১০০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের আবিষ্কৃত এই মাল্টিপল প্রশ্নধারা শিক্ষাঙ্গনে সফল ও বয়স্ক শিক্ষা ক্ষেত্রে যুগোপযোগী পন্থা হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। কিন্তু ১৯৮১ সালে একটি গবেষণার মাধ্যমে 'লেভেন অ্যান্ড লং' প্রমাণ করে, 'এ ধরনের প্রশ্নপদ্ধতি ছাত্রছাত্রীদের নিম্নস্তরের জ্ঞানবৃত্তীয় মাত্রার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়; কিন্তু চিন্তাশক্তির দৃঢ়তা ও বোধগম্যতার গভীরতার মাত্রা নিশ্চিত করে না।' তাই মাল্টিপল ধাঁচের প্রশ্ন শুধু কোনো তথ্য স্মরণ করতে ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করে, তা বৈ অন্য কিছু নয়। মনে রাখতে হবে, একটি ভালো প্রশ্ন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন আঙ্গিকে চিন্তা করার সুযোগ দেয় এবং সে হয়ে ওঠে সৃজনশীল। তাই এসব সুসংগঠিত ও অনুসন্ধানী প্রশ্নমালার বেদবেদান্তর পাঠকদের বিনম্রচিত্তে অবহিত করতে চায়।
যখন শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করা হয়, 'বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি কে ছিলেন'- এর প্রত্যুত্তরে শিক্ষার্থীর বুদ্ধিমত্তার ওপর নয়, নির্ভর করে জানার ওপর। এ ধরনের প্রশ্ন শুধু কোনো জানা তথ্য পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে সহায়তা করে; কিন্তু শিক্ষার্থীর বুদ্ধিমত্তা বিকশিত করে না। তাই এ জাতীয় প্রশ্নকে ফেকচ্যুয়াল (Factual) বা তথ্যনির্ভর প্রশ্ন বলে। এটাকে গবেষকরা বলেন, ব্লুম লেভেল অব নলেজ। আবার কিছু প্রশ্নের উত্তর হবে একটা, তবে সঠিক উত্তরের জন্য প্রয়োজন হবে সম্পর্কিত অনেক তথ্য। যেমন- কোনো উপন্যাস পাঠের পর শিক্ষার্থীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, 'উপন্যাসে লেখক তখনকার কোন প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন'- এর উত্তর হবে একটা, তবে উপন্যাসের বিভিন্ন জাগায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে সঠিক উত্তর সাজাতে হবে এবং উত্তরের পেছনে যৌক্তিকতা থাকতে হবে। এখানে শিক্ষার্থীর জানার চেয়ে অনেকাংশে নির্ভর করে পঠিত বিষয়ে বোধগম্যতা ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতার ওপর। এ রকম প্রশ্নকে কনভারজেন্ট (Convergent) বলে। এ ধরনের প্রশ্নগুলো শিক্ষার্থীর কোনো বিষয় সম্পর্কে বোধগম্যতার মাত্রা ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
'যদি ঢাকা শহরে বাস চলাচলের রাস্তায় রিকশা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে সেটার অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে।' এখানে শিক্ষার্থীকে অনেক বিকল্প খুঁজতে হবে এবং বিকল্পকে যৌক্তিকতায় দাঁড় করাতে হবে। পরীক্ষায় এরূপ প্রশ্নে শিক্ষার্থীকে কাল্পনিক প্রত্যুত্তরের চিত্রায়ণ, সম্ভাব্য বিকল্প খোঁজা এবং বিচ্ছিন্ন চিন্তার খণ্ডিত অংশের একত্রীকরণ ও সমন্বয় সাধন করে নিজস্ব মতামত তুলে ধরতে হয়। এ ধরনের প্রশ্নকে বলে ডাইভারজেন্ট (Divergent) প্রশ্ন। মূলত কনভারজেন্ট ও ডাইভারজেন্টের মধ্যে পার্থক্য হলো, কনভারজেন্ট প্রশ্নে শিক্ষার্থীর নিজস্ব মতামত প্রদানের সুযোগ থাকে না; কিন্তু ডাইভারজেন্ট প্রশ্নে থাকে। যে শিক্ষকগণ প্রশ্ন করার ধরন বিষয়ে ওয়াকিবহাল, তাঁরা সহজে কনভারজেন্ট ও ডাইভারজেন্ট প্রশ্নের সংমিশ্রণ ঘটাতে পারেন। এতে শিক্ষার্থীর একই সঙ্গে বিশ্লেষণ করার নিপুণতা, নিজস্ব মতামত প্রদানের ক্ষমতা ও বিকল্প বের করার প্রবণতার অপূর্ব সমন্বয় সাধন হয়। অনেক সময় শ্রেণীকক্ষে গল্পের প্রসঙ্গ টেনে শিক্ষার্থীদের যখন প্রশ্ন করি, "পার্কের সব কটি গাছ কাটার পর 'সুজন' মনে মনে কী অনুভব করেছিল? বা তুমি কেন মনে করছ 'সুজন' পার্কের গাছ কাটার পর অনুশোচনায় ভুগছে?" এ ধরনের প্রশ্নমালা কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর বহুমুখী চিন্তা-কৌশলের উদ্ভব করতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে থাকে। এ ধরনের প্রশ্ন মূলত শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক হয় এবং কোনো বিষয়কে নিখুঁতভাবে যৌক্তিকতার মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করতে শিক্ষার্থীর চিন্তার প্রগাঢ়তা ঘটায়। এটাকে বলে ইভালুয়েটিভ (Evaluative) প্রশ্ন। আরেক ধরনের প্রশ্ন আছে, যেখানে ওপরে বর্ণিত চারটি ধরনের প্রশ্নের সমন্বিত রূপের বহিঃপ্রকাশ; সেটাকে বলে কম্বিনেশান (Combination) প্রশ্ন।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকাশে সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষকের সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা এবং প্রশ্নপত্র ধরনের ওপর বিশেষায়িত কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। কারণ প্রশিক্ষণকে বলা হয় বিজ্ঞান ও কলার সমন্বয়ের সৃজনশীল প্রক্রিয়া। সরকার এই সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় প্রশ্নপত্র উন্নয়নের শিল্পকৌশল বা কেউ বলে The art of questioning সম্পর্কিত বিগত দিনে শিক্ষকদের কতটুকু কার্যকর ধারণা প্রদান করেছে, তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। তবে মনে রাখতে হবে, কারিগরের ভেতর সৃজনশীলতার পরিচর্যা হয় না, তার সৃষ্ট কর্মের মধ্যেও সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। তাই শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীলতার প্রক্রিয়াকে আরো বেশি বেগবান ও কার্যকর করার প্রয়াসে 'প্রশ্নপদ্ধতি'-বিষয়ক প্রশিক্ষণের ওপর সরকারের আশু দৃষ্টি কামনা করছি। এই উপলব্ধির মাত্রার গভীরতার ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করবে আগামী দিনের নতুন এক সৃজনশীল প্রজন্ম।
লেখকদ্বয়: উপ-উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ম্যানেজার, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ।
mahbuburrahman77@gmail.com
তথ্য অনুযায়ী ১৮৬০ সালের দিকে একজন শিক্ষক তাঁর সারা দিনের কর্মপরিসরে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করতেন গড়ে ৮০ শতাংশ সময়; যেখানে প্রশ্নের সংখ্যা দাঁড়াত ৩০০ থেকে ৪০০-এর মতো। কিন্তু গবেষণায় প্রমাণিত, এ ধরনের বেশির ভাগ প্রশ্ন শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তিকে শাণিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালনে অনেকাংশে ছিল ব্যর্থ। কারণ, এসব প্রশ্নের প্রত্যুত্তর দিতে শিক্ষার্থীর গভীরভাবে চিন্তা করার তেমন কোনো অবকাশ ছিল না। তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে অধুনা শিক্ষাব্যবস্থায় বহুল প্রচলিত ও প্রচারিত মাল্টিপল প্রশ্নধারা। ১০০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের আবিষ্কৃত এই মাল্টিপল প্রশ্নধারা শিক্ষাঙ্গনে সফল ও বয়স্ক শিক্ষা ক্ষেত্রে যুগোপযোগী পন্থা হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। কিন্তু ১৯৮১ সালে একটি গবেষণার মাধ্যমে 'লেভেন অ্যান্ড লং' প্রমাণ করে, 'এ ধরনের প্রশ্নপদ্ধতি ছাত্রছাত্রীদের নিম্নস্তরের জ্ঞানবৃত্তীয় মাত্রার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়; কিন্তু চিন্তাশক্তির দৃঢ়তা ও বোধগম্যতার গভীরতার মাত্রা নিশ্চিত করে না।' তাই মাল্টিপল ধাঁচের প্রশ্ন শুধু কোনো তথ্য স্মরণ করতে ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করে, তা বৈ অন্য কিছু নয়। মনে রাখতে হবে, একটি ভালো প্রশ্ন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন আঙ্গিকে চিন্তা করার সুযোগ দেয় এবং সে হয়ে ওঠে সৃজনশীল। তাই এসব সুসংগঠিত ও অনুসন্ধানী প্রশ্নমালার বেদবেদান্তর পাঠকদের বিনম্রচিত্তে অবহিত করতে চায়।
যখন শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করা হয়, 'বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি কে ছিলেন'- এর প্রত্যুত্তরে শিক্ষার্থীর বুদ্ধিমত্তার ওপর নয়, নির্ভর করে জানার ওপর। এ ধরনের প্রশ্ন শুধু কোনো জানা তথ্য পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে সহায়তা করে; কিন্তু শিক্ষার্থীর বুদ্ধিমত্তা বিকশিত করে না। তাই এ জাতীয় প্রশ্নকে ফেকচ্যুয়াল (Factual) বা তথ্যনির্ভর প্রশ্ন বলে। এটাকে গবেষকরা বলেন, ব্লুম লেভেল অব নলেজ। আবার কিছু প্রশ্নের উত্তর হবে একটা, তবে সঠিক উত্তরের জন্য প্রয়োজন হবে সম্পর্কিত অনেক তথ্য। যেমন- কোনো উপন্যাস পাঠের পর শিক্ষার্থীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, 'উপন্যাসে লেখক তখনকার কোন প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন'- এর উত্তর হবে একটা, তবে উপন্যাসের বিভিন্ন জাগায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে সঠিক উত্তর সাজাতে হবে এবং উত্তরের পেছনে যৌক্তিকতা থাকতে হবে। এখানে শিক্ষার্থীর জানার চেয়ে অনেকাংশে নির্ভর করে পঠিত বিষয়ে বোধগম্যতা ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতার ওপর। এ রকম প্রশ্নকে কনভারজেন্ট (Convergent) বলে। এ ধরনের প্রশ্নগুলো শিক্ষার্থীর কোনো বিষয় সম্পর্কে বোধগম্যতার মাত্রা ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
'যদি ঢাকা শহরে বাস চলাচলের রাস্তায় রিকশা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে সেটার অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে।' এখানে শিক্ষার্থীকে অনেক বিকল্প খুঁজতে হবে এবং বিকল্পকে যৌক্তিকতায় দাঁড় করাতে হবে। পরীক্ষায় এরূপ প্রশ্নে শিক্ষার্থীকে কাল্পনিক প্রত্যুত্তরের চিত্রায়ণ, সম্ভাব্য বিকল্প খোঁজা এবং বিচ্ছিন্ন চিন্তার খণ্ডিত অংশের একত্রীকরণ ও সমন্বয় সাধন করে নিজস্ব মতামত তুলে ধরতে হয়। এ ধরনের প্রশ্নকে বলে ডাইভারজেন্ট (Divergent) প্রশ্ন। মূলত কনভারজেন্ট ও ডাইভারজেন্টের মধ্যে পার্থক্য হলো, কনভারজেন্ট প্রশ্নে শিক্ষার্থীর নিজস্ব মতামত প্রদানের সুযোগ থাকে না; কিন্তু ডাইভারজেন্ট প্রশ্নে থাকে। যে শিক্ষকগণ প্রশ্ন করার ধরন বিষয়ে ওয়াকিবহাল, তাঁরা সহজে কনভারজেন্ট ও ডাইভারজেন্ট প্রশ্নের সংমিশ্রণ ঘটাতে পারেন। এতে শিক্ষার্থীর একই সঙ্গে বিশ্লেষণ করার নিপুণতা, নিজস্ব মতামত প্রদানের ক্ষমতা ও বিকল্প বের করার প্রবণতার অপূর্ব সমন্বয় সাধন হয়। অনেক সময় শ্রেণীকক্ষে গল্পের প্রসঙ্গ টেনে শিক্ষার্থীদের যখন প্রশ্ন করি, "পার্কের সব কটি গাছ কাটার পর 'সুজন' মনে মনে কী অনুভব করেছিল? বা তুমি কেন মনে করছ 'সুজন' পার্কের গাছ কাটার পর অনুশোচনায় ভুগছে?" এ ধরনের প্রশ্নমালা কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর বহুমুখী চিন্তা-কৌশলের উদ্ভব করতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে থাকে। এ ধরনের প্রশ্ন মূলত শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক হয় এবং কোনো বিষয়কে নিখুঁতভাবে যৌক্তিকতার মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করতে শিক্ষার্থীর চিন্তার প্রগাঢ়তা ঘটায়। এটাকে বলে ইভালুয়েটিভ (Evaluative) প্রশ্ন। আরেক ধরনের প্রশ্ন আছে, যেখানে ওপরে বর্ণিত চারটি ধরনের প্রশ্নের সমন্বিত রূপের বহিঃপ্রকাশ; সেটাকে বলে কম্বিনেশান (Combination) প্রশ্ন।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকাশে সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষকের সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা এবং প্রশ্নপত্র ধরনের ওপর বিশেষায়িত কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। কারণ প্রশিক্ষণকে বলা হয় বিজ্ঞান ও কলার সমন্বয়ের সৃজনশীল প্রক্রিয়া। সরকার এই সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় প্রশ্নপত্র উন্নয়নের শিল্পকৌশল বা কেউ বলে The art of questioning সম্পর্কিত বিগত দিনে শিক্ষকদের কতটুকু কার্যকর ধারণা প্রদান করেছে, তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। তবে মনে রাখতে হবে, কারিগরের ভেতর সৃজনশীলতার পরিচর্যা হয় না, তার সৃষ্ট কর্মের মধ্যেও সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। তাই শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীলতার প্রক্রিয়াকে আরো বেশি বেগবান ও কার্যকর করার প্রয়াসে 'প্রশ্নপদ্ধতি'-বিষয়ক প্রশিক্ষণের ওপর সরকারের আশু দৃষ্টি কামনা করছি। এই উপলব্ধির মাত্রার গভীরতার ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করবে আগামী দিনের নতুন এক সৃজনশীল প্রজন্ম।
লেখকদ্বয়: উপ-উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ম্যানেজার, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ।
mahbuburrahman77@gmail.com
No comments