ধর্মপন্থীদের উপড়ে ফেলার প্রশ্ন by মাসুদ মজুমদার
ধর্ম আগে, না মানুষ আগেÑ সেই বিতর্ক অর্থহীন। সৃষ্টিকর্তা মানুষ সৃষ্টির
আগে মানুষের আচরণ বিধি নিয়ে ভাবেননিÑ এটা যুক্তির ধোপে টেকে না।
প্রথম মানুষ শুধু সাধারণ মানুষ নন, একজন নবীও। সঙ্গত কারণেই মানুষের
উপস্থিতি আর ধর্মের অনুশাসন এক সাথে চলেছে। ষোড়শ শতকের আগ পর্যন্ত
প্রত্যক্ষভাবে ধর্মই মানুষের জগৎ নিয়ন্ত্রণ করেছে। এখনো ধর্ম এককভাবে
অপ্রতিহত কিন্তু রাষ্ট্রাচারে পরোক্ষে চলে গেছে।
যে ধর্মেরই অনুসারী হন, ধার্মিক পরিবারে জন্ম নিয়েই শিশু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সাথে পরিচিত হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক বন্ধন ও রাষ্ট্রাচারের সাথে মানুষের পরিচয় ঘটে। ধীরে ধীরে বিশ্বাস পোক্ত হয়। আবার ধীরে ধীরে বিশ্বাস পাল্টেও যায়। অবশ্য পরিবারের সাথে থেকে বাবা-মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে মানুষ যা শেখে তার প্রভাব কখনো একেবারে মুছে যায় না।
ইসলাম নিজেকে স্বভাব ধর্ম ও প্রাকৃতিক ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করেছে। বলা হয়েছে, প্রত্যেকটি শিশু এই স্বভাব ধর্ম নিয়েই জন্মায়। বাবা-মায়ের কারণে শিশু স্বভাব ধর্মের বাইরে যায়। অন্যান্য ধর্মে এ ধরনের মৌলিক কথা সরাসরি নেই। তবে আহলে কিতাবি বা আসমানি কিতাবের অনুসারীরা ইসলামের এই দাবিকে অস্বীকার করে না। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকেও মৌলিক দাবি করে। একজন জার্মান পণ্ডিত মনে করেন, জীবনের শুরুতে ধর্মবিশ্বাস স্বাভাবিক। কিন্তু যৌবনে একবার নাস্তিক্য ধারায় অবস্থান করা যেন অন্য ধরনের এক স্বাভাবিকতা। তবে চল্লিশ বছর পার হওয়ার পর নাস্তিক্যবাদের ভূত মাথা থেকে সরে যাওয়াও স্বাভাবিক। আবার ধর্মের প্রতি অনুরাগ বেড়ে যাওয়াও যেন বয়সের দাবি। অন্য কথায় যৌবনের উদ্দামের কারণে সবকিছুকে অস্বীকার করাই যেন রোমাঞ্চের ব্যাপার। আবার পরিণত বয়সে শক্তি-সামর্থ্য হারিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে ধরনা দেয়া ছাড়া গত্যন্তরও নেই।
ক্যারেন আর্মস্টং খ্যাতিমান লেখিকা। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ওপর তার অগাধ পাণ্ডিত্য। ‘সৃষ্টিকর্তার ইতিবৃত্ত’ ও ‘স্রষ্টার জন্য লড়াই’ নামে তার দুটো বই রয়েছে। আরো আছে প্রধান ধর্মগুলোর ‘প্রবর্তকের’ বা পথপ্রদর্শকের ওপর পৃথক চারটি বই। বিশেষত হজরত মুহাম্মদ সা:, যিশুখ্রিষ্টের ও বৌদ্ধের ওপর বই তিনটি অসাধারণ। তিনি গির্জায় ‘নান’ হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন। বুদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে গবেষণার দিকে ঝুঁকে পড়েন। উচ্চশিক্ষার সুযোগে কার্যত তিনি তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ওপর বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন এবং প্রধান ধর্মগুলোর ওপর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এই পাণ্ডিত্য তাকে ভারসাম্য করে দিয়েছে, আন্তঃধর্ম বিশ্বাসগুলোকে কাছাকাছি করার উদ্যোগী করেছে।
স্রষ্টার ইতিবৃত্ত বইয়ে তিনি সৃষ্টিকর্তার ওপর মানুষের অতীত, বর্তমান সব ধারণা এক মলাটের ভেতর নিয়ে এসেছেন। সবকালেই মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে সন্ধান করেছে। তা ছাড়া মানুষ স্বভাবগতভাবে আনুগত্যপরায়ণ। আসল সৃষ্টিকর্তার সন্ধানে ব্যর্থ হলেই মানুষ স্রষ্টার বদলে সৃষ্টির পূজা শুরু করে। তখন ইশপের মুসিকের গল্পের মতো পাহাড়-পর্বত-সমুদ্র-বাতাস-আগুন-পানি-সূর্য-চাঁদ-সাপ ও বৃক্ষসহ সব জড়ো পদার্থকেও পূজনীয় মনে হয়। শক্তির পূজা মানুষের ভেতর সতত সক্রিয় থাকে। এক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস অনেকেরই থাকে। তবে তাকে পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে ত্রিত্ববাদ থেকে মূর্তিবাদ সবকিছুর জন্ম নিয়েছে। নবী-রাসূলগণের ইতিহাস পড়ে জানা যায়, তারা সবাই একত্ববাদ প্রচার করেছেন। তাদের মৃত্যুর অল্প দিন পরেই মানুষ অতিভক্তিবাদের কারণে সেই মহামানবদেরই মূর্তির মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। পরবর্তী নবী-রাসূল এসে আবার মূর্তিবাদী মানুষকে একমাত্র সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য করার আহ্বান জানিয়েছেন। ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্ট, এবং পবিত্র কুরআনেও এ তথ্য অত্যন্ত জোরালো ভাষায় উপস্থাপিত অবস্থায় রয়েছে।
ধর্মকে যারা আফিম কিংবা প্রতিক্রিয়াশীলতার অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয়া এক ধরনের এডিকশন ভাবেন, অন্ধত্ব মনে করেনÑ তারা সত্য বলেন না। বরং সত্যকে আড়াল করার জন্য মিথ্যাচারের ওপর যুক্তি খাড়া করতে চান। যৌবনে মাওবাদ-মার্কসবাদ-লেনিনবাদের উদর থেকে জন্ম নেয়া এক ধরনের নাস্তিক সাজার ভান করার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অনেকের রয়েছে। আবার সেই ধারণার ঘোর কেটেও গেছে। সেই ঘোর যে সব যুগে সব মানুষকে পায় সেটাও ইতিহাস স্বীকৃত। যারা ইতিহাসের জড়বাদী ব্যাখ্যা করে প্রগতিশীল সাজেন তাদের বিদ্যার দৌড় সবার জানা। তারা পৃথিবীর কোনো পবিত্র ধর্মগ্রন্থই পড়েন না, কবিতাচর্চা করে কিংবা রাজনীতির উদ্ভট তত্ত্ব কপচিয়ে স্বঘোষিত বস্তুবাদী সাজেন। কার্যত ইতিহাসের জড়বাদী ব্যাখ্যা করা হয় শাসক ও শাসিতের, শোষক ও শোষিতের, জালেম ও মজলুমের ইতিহাস বানানোর জন্য। বস্তুবাদ বুঝবার এ যেন এক চোখা বদখেয়াল। তাই বিশ্বাস উপড়ে ফেলার এক ধরনের বক নাস্তিক সাজেন। শ্রেণী সংগ্রামের অলিক কাহিনী শোনান। অথচ ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য সাক্ষী হচ্ছে, শ্রেণী সঙ্ঘাতের চেয়েও সত্য-মিথ্যার লড়াই চিরন্তন। এ ক্ষেত্রে বিকৃত, অবিকৃত, মানব সৃষ্ট কিংবা ঐশীগ্রন্থ বিধৌত সব ধর্মই কাছাকাছি অবস্থান করে। সঙ্গত কারণেই পৃথিবীর সব যুগের সব ধার্মিক মানুষের শ্রেণী চরিত্রও কাছাকাছি। দিল্লির কাছে নারী ধর্ষিতা হওয়ার পর ভারতীয় ধর্মপন্থীরা ঘটনার নিন্দা করেছেন। আবার অসংযমী নারী যারা ধর্ষণের জন্য প্রলুব্ধ করে তাদের সংযত হতে বলেছেনÑ এই বক্তব্য সব ধর্মপ্রাণ মানুষের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি। শিব সেনা- রাষ্ট্রসভা বলেছে বলে সত্যটা অস্বীকার করা যায় না। ফলে আলেম-ওলামা, পাদ্রি-যাজক, রাবাই, গুরু ও বোদিপ্রাপ্তরা স্বভাবগত পূত-পবিত্র ও সত্যনিষ্ঠ হওয়ার কথা। বাস্তবেও আমরা যেকোনো ধর্মের ধার্মিক মানুষকে সত্যবাদী, ইনসাফের প্রতি অনুরাগী, মানুষের প্রতি মমত্ববোধসম্পন্ন ও জীবে দয়াবান হতে দেখি। বিনয় সদাচার তাদের ভেতর আশ্রয় পায়। তারা সত্য বলতে বলে, আমানত সংরক্ষণ করে, প্রতিশ্রুতি পালনেও তারা অধার্মিক মানুষের চেয়ে হাজার গুণ শ্রেষ্ঠ। বিশ্বাসের ফারাক নিয়েও এই ঐকতানের শ্রেণী চরিত্র কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে মাদার তেরেসার কথা বলা যায়। তার সেবাকর্ম ধর্মীয় প্রেরণার ফসল। তার পোশাক ধর্মীয়, তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা কার নেই!
আমাদের সমাজের ভালো মানুষগুলো চিহ্নিত করলে তারা কোনো না কোনো ধর্মের নিষ্ঠাবান অনুসারী। তার বিশ্বাসের বিচ্যুতি কিংবা ত্রুটি, আমলের ভ্রান্তি আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। এটা তো অস্বীকার করা যাবে না পরিশুদ্ধ আলেম-ওলামার মতো কোনো খ্রিষ্টান ধর্মযাজককে দেখলেও শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে পড়ে। হিন্দুধর্মীয় নেতা, বৌদ্ধ ভিু, ইহুদি রাবাই কিংবা শিখ ধর্ম গুরুদের দেখলে মনে হয় ওরাও সাদা মনের পবিত্র মানুষ। তাদের চেহারার যে সৌম্যভাব তা তো লুকাবার বিষয় নয়। দালাইলামা শ্রদ্ধা পান ধর্মপ্রাণ হওয়ার কারণেই। ধর্মই তাকে সত্যনিষ্ঠ ও প্রতিবাদী হতে উৎসাহী করেছে। যেমনি শেখ ইয়াসিনকে আমরা দেখেছি ফিলিস্তিনে। আজ কাল আলেম-ওলামা পীর মাশায়েখদের বিরুদ্ধে প্রায় বিষোদগার শুনি, আমার দেখা এখনো ভালো মানুষগুলোর মধ্যে তাদের অবস্থান সামনের কাতারে।
হজরত মরিয়ম বা মেরি ও যিশুর কল্পিত ছবি যারা লক্ষ করবেন দেখবেন তাদের পবিত্র মানুষ ভেবেই চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। পৃথিবীর সব বড় বড় মনীষীর ছবি শ্মশ্রুমণ্ডিত, যেন ধর্মাবতার। তলস্তয় পড়ে অনেকেরই নাস্তিক্যবাদী বাম চিন্তার ঘোর কেটেছিল। তা হলে যার যার অবস্থানে ধর্মচিন্তার বাইরে মৌলিক নীতি নৈতিকতার উৎসের আর কোনো বিকল্প আছে কি! হিব্রু আদি বইপুস্তকে, রোমান ভাষার প্রাচীন গ্রন্থে, ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টের নানা সংস্করণে নীতি-নৈতিকতা ও আইন-কানুনের নানা বইয়ে যেসব নীতিকথার সন্ধান মেলে তার সাথে বেদ-বেদান্ত-উপনিষদ ও গুরু নানকজির শিক্ষায় সৃষ্টিকর্তাকে পাবার ধরনের পার্থক্যটাই শুধু চোখে পড়ে। পবিত্র কুরআন যে একত্ববাদের শিক্ষা তুলে ধরে তার সাথে আদি পুস্তকগুলোর মিল রীতিমতো ঔৎসুক্যের সৃষ্টি করে। তা ছাড়া অতীত সব সভ্যতা ধর্মাশ্রয়ী হওয়ার কারণ স্পষ্ট। ইতিহাসের একমাত্র না হলেও মৌলিক উৎস ধর্মগ্রন্থ। হোক তা চৈনিক, বৈদিক, মিসরীয়, রোমানি, গ্রিস, আরবীয়, পারস্য কিংবা বাইজান্টাইন। সৃষ্টির উৎস ও বিশ্ব জগৎ সম্পর্কে ধর্মগ্রন্থের ধারণাগুলোই বিজ্ঞানকেও সমৃদ্ধ করেছে।
অনেক বোদ্ধা মানুষ সক্রেটিসসহ অনেক মনীষীকে সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি মনে করেছেন। এ ভাবনা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া একেবারেই অসম্ভব। অনেক ধর্মাবতার যারা এখন মূর্তির আদলে পূজিত হচ্ছেন, তারা কেউ পূজার কথা বলেননি। তারা যে নবীদের কাতারের কেউ হতে পারেন সেটাইবা আমরা অস্বীকার করতে যাবো কেন?
এক সফরে ইরানের আধ্যাত্মিক নগরী কোমে দুটো ছবি নজর কাড়ল। গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম এ দুটো কার ছবি। তার জবাব ছিল, কিছু ভ্রান্ত চিন্তার মানুষ আলী ও ফাতেমা চিন্তা করে এ ধরনের ছবি ঘরে রাখে। চিন্তাটি যে ভ্রান্ত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া ইমাম খোমেনীসহ মূল ধারার ইরানিরা এ ধরনের ছবি শুধু বিভ্রান্তি নয় ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিকও মনে করেন। তবে ছবি দুটো যে দরদ দিয়ে আঁকা, তাতে যে সৌম্যকান্তি ও পূতপবিত্র ভাব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাতে ধার্মিক মনে অনুরাগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে অসাধারণ এক নৈপুণ্য রয়েছে। একই ভাবে ভারতের কেরালা রাজ্যের কোচিনে যিশুর একটা ছবি চোখে পড়েছিল। বিগত শতকের একাশি সালে দেখা ছবিটি এত দরদ দিয়ে আঁকা যেন পূতপবিত্র এক অসাধারণ মানুষের প্রতিকৃতি প্রত্যক্ষ করছি। তাতে মনের গভীর থেকে মমত্ববোধ এসে যায়। আনমনে শ্রদ্ধাবোধ জেগে ওঠে।
ধার্মিক ও বকধার্মিক এক নয়। ধার্মিক হতে বলা হয়েছে, ধার্মিক সাজতে বারণ করা হয়েছে। আমাদের সমাজে যারা ধার্মিক সাজে তারা বদমানুষ, খলনায়ক। আসলে যারা ধার্মিক তারা ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। পৃথিবীর কোন দেশই কার্যত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। প্রতিবেশী ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার যে দোহাই দেয়া হয় সেটা উদ্ভট। রাষ্ট্রাচারে হিন্দুয়ানি রেখে কিভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হয়। বাইবেল ছুঁয়ে শপথের পরও ধর্মনিরপেক্ষ! পোশাক নিরপেক্ষ হলে মানুষকে কি বলা হবে, উলঙ্গ কিংবা উদোম। ধর্মও মানার বিষয়, নিরপেক্ষ অবস্থানে রাখার বিষয় নয়। হ্যাঁ, তারপরও ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার যে প্রশ্নটি ওঠে, সেটি রাজনৈতিক ধারণাপ্রসূত। পনের শতকের আগে এমন ধারণাও জন্ম হয়নি। সে ধারণাকে যারা টেনে ধর্মহীনতার দিকে নিয়ে যান তারা শঠ, প্রতারক ও প্রবঞ্চক। যে ধর্মেরই লোক হোক ধর্ম ছাড়া আচার অনুষ্ঠানের তারতম্য ব্যতিরেকে নৈতিকতার আলাদা কোনো সবক কোথাও নেই। অধার্মিকও কিছু মৌলিক গুণাবলিসম্পন্ন হতে পারে। কিন্তু তাকে পবিত্র হতে হলে নীতি-নৈতিকতার মূল ধারণায় পৌঁছতে হবে, পরকালীন ভাবনাতাড়িত হতেই হবে। অনেক পোশাকি লোক পাবেন কেতাদূরস্ত। দামি সেন্টের সুবাস বিলিয়ে তিনি পথ চলেন। তার পোশাক-আশাক পরিচ্ছন্ন হতে পারে, পবিত্র কি না জানা সম্ভব নয়। কারণ তিনি প্রস্রাব করে পানি খরচ না করলে কিংবা টিসু ব্যবহার করে পবিত্র না হলে তার পরিচ্ছন্ন পোশাকও অপবিত্র। পবিত্র ও অপবিত্রের এ ধারণা প্রথমে দিয়েছে ধর্ম, পরে স্বাস্থ্যবিজ্ঞান। জবাবদিহিতার একটা জায়গা রাখতে হবেÑ যেখানে পুলিশ যেতে পারে না, রাষ্ট্রীয় আইন পাহারা দিতে পারে না। নিজের বিবেক দিয়ে যেই বিশ্বাস বিধৌত পাহারা বসাতে হবে। ধর্মীয় চিন্তার বাইরে এর কোনো উৎস আজ পর্যন্ত চিহ্নিত হয়নি। পরকালীন ভাবনা ও স্বর্গ-নরক চিন্তার অতীত কোনো ধারণায় তা পাওয়া সম্ভব নয়।
এ আলোচনার বিষয় কোনো বিশেষ ধর্মবিশ্বাসের ভালো-মন্দ বিচার বিবেচনার জন্য নয়। তা ছাড়া প্রত্যেক ধার্মিক মানুষ যার যার ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ভেবেই অনুসরণ করে। সেই অনুভূতিতে আঘাত দেয়া কিংবা ছোট করে দেখা পাপ। অপরাধ। কোনো বিশ্বাসী মানুষ তা করতে পারে না। ধর্মচিন্তা ও ধার্মিক মানুষের সাথে বক ধার্মিক ও সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট মানুষকে এ কারণেই আলাদা করে দেখতে হবে। এ লেখার উপলক্ষ হলো আজকাল ধর্মের বেষ্টনী ও নৈতিক বাঁধন খুলে ফেলার জন্য নানা উপায় অবলম্বন করা হয়। ধর্মীয় অনুশাসনকে বস্তুবাদী ভাবনা থেকে উপড়ে ফেলার চিন্তা থেকে প্রতিক্রিয়াশীলতা, সেকেলে, মধ্যযুগীয় এবং প্রগতিবিরোধী চিহ্নিত করা হয়। এমন ধারণা দেয়া হয় ধর্ম নারীকে অধিকারবঞ্চিত করছে, এটা শোষণের হাতিয়ার, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করছে, মৌলবাদ জন্ম দিচ্ছে, চরমপন্থা উসকে দিচ্ছে। এ সব কথাই কুযুক্তি। এটা নৈতিক বাঁধন খুলে ফেলার ফন্দি।
ধর্ম হিসেবে ব্যতিক্রম ছাড়া সব ধর্মকেই প্রাচীন ভাবা হয়। ইসলামকে বলা হয় মাত্র দেড় হাজার বছরের। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্ম সম্পর্কে বলা হয় মাত্র কয়েক হাজার বছরের। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসও দীর্ঘ। অন্যান্য ধর্মের কয়েকটি আছে মাত্র কয়েক শ’ বছরের আগেকার। এটা সাধারণ ধারণা, যারা একত্ববাদ ও ঐশী ধারায় বিশ্বাসী তাদের কাছে আদি ধর্ম আদম-হাওয়ার ধর্ম। এ ধারার সর্বশেষ রাসূল মোহাম্মদ সা:। ইতিহাস এটাও ধারণা দেয় আদি চিন্তা একেশ্বরবাদ বা একত্ববাদ। একত্ববাদ থেকেই ধীরে ধীরে বিকৃতির পথ ধরে নানা ধর্মের জন্ম নিয়েছে। এ যুক্তি সবাই মানেন না বলেই এক আল্লাহর বান্দারা এক আল্লাহকে পেতেই নানা মতে ও পথে বিভক্ত হয়েছে। এই সুযোগ নিচ্ছে ধর্মবিরোধী গোষ্ঠী। এরাই শয়তান। শয়তান ও অসুর সম্পর্কে ধারণা সব ধর্মেই আছে। কারা শয়তান ও অসুর নয়Ñ সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব যার যার তার তার। আমরা শুধু বলব, ধর্মই সভ্যতা বিনির্মাণ করেছে। ইতিহাসের গ্রন্থি বেঁধে দিয়েছে। ধর্ম আছে বলেই সমাজ সভ্যতা টিকে আছে। ধর্মপন্থীদের একই সমতলে দাঁড়ানোর বোধ করি এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। প্রথমে ধর্ম বিদ্বেষের শিকড় উপড়ে ফেলা উচিত। তারপর সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প উবে যাবে। বকধার্মিকদের ডামাডোলও থেমে যাবে। তারপরই ধর্মের নামে অধর্ম চিহ্নিত করা সহজ হবে। ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, যার যার ধর্ম তার তার। কিন্তু ধার্মিক মানুষের প্রাণের প্রাচুর্য ও ইতিবাচক দিকটির সুফল সবার। ধর্মপন্থীদের উপড়ে ফেলার সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক যড়যন্ত্র রুখতে না পারলে এই জনপদের কেন, পৃথিবীর মানুষ দেউলিয়া হয়ে যাবে। বর্বরতা পৃথিবীকে গ্রাস করবে।
digantaeditorial@gmail.com
যে ধর্মেরই অনুসারী হন, ধার্মিক পরিবারে জন্ম নিয়েই শিশু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সাথে পরিচিত হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক বন্ধন ও রাষ্ট্রাচারের সাথে মানুষের পরিচয় ঘটে। ধীরে ধীরে বিশ্বাস পোক্ত হয়। আবার ধীরে ধীরে বিশ্বাস পাল্টেও যায়। অবশ্য পরিবারের সাথে থেকে বাবা-মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে মানুষ যা শেখে তার প্রভাব কখনো একেবারে মুছে যায় না।
ইসলাম নিজেকে স্বভাব ধর্ম ও প্রাকৃতিক ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করেছে। বলা হয়েছে, প্রত্যেকটি শিশু এই স্বভাব ধর্ম নিয়েই জন্মায়। বাবা-মায়ের কারণে শিশু স্বভাব ধর্মের বাইরে যায়। অন্যান্য ধর্মে এ ধরনের মৌলিক কথা সরাসরি নেই। তবে আহলে কিতাবি বা আসমানি কিতাবের অনুসারীরা ইসলামের এই দাবিকে অস্বীকার করে না। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকেও মৌলিক দাবি করে। একজন জার্মান পণ্ডিত মনে করেন, জীবনের শুরুতে ধর্মবিশ্বাস স্বাভাবিক। কিন্তু যৌবনে একবার নাস্তিক্য ধারায় অবস্থান করা যেন অন্য ধরনের এক স্বাভাবিকতা। তবে চল্লিশ বছর পার হওয়ার পর নাস্তিক্যবাদের ভূত মাথা থেকে সরে যাওয়াও স্বাভাবিক। আবার ধর্মের প্রতি অনুরাগ বেড়ে যাওয়াও যেন বয়সের দাবি। অন্য কথায় যৌবনের উদ্দামের কারণে সবকিছুকে অস্বীকার করাই যেন রোমাঞ্চের ব্যাপার। আবার পরিণত বয়সে শক্তি-সামর্থ্য হারিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে ধরনা দেয়া ছাড়া গত্যন্তরও নেই।
ক্যারেন আর্মস্টং খ্যাতিমান লেখিকা। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ওপর তার অগাধ পাণ্ডিত্য। ‘সৃষ্টিকর্তার ইতিবৃত্ত’ ও ‘স্রষ্টার জন্য লড়াই’ নামে তার দুটো বই রয়েছে। আরো আছে প্রধান ধর্মগুলোর ‘প্রবর্তকের’ বা পথপ্রদর্শকের ওপর পৃথক চারটি বই। বিশেষত হজরত মুহাম্মদ সা:, যিশুখ্রিষ্টের ও বৌদ্ধের ওপর বই তিনটি অসাধারণ। তিনি গির্জায় ‘নান’ হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন। বুদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে গবেষণার দিকে ঝুঁকে পড়েন। উচ্চশিক্ষার সুযোগে কার্যত তিনি তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ওপর বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন এবং প্রধান ধর্মগুলোর ওপর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এই পাণ্ডিত্য তাকে ভারসাম্য করে দিয়েছে, আন্তঃধর্ম বিশ্বাসগুলোকে কাছাকাছি করার উদ্যোগী করেছে।
স্রষ্টার ইতিবৃত্ত বইয়ে তিনি সৃষ্টিকর্তার ওপর মানুষের অতীত, বর্তমান সব ধারণা এক মলাটের ভেতর নিয়ে এসেছেন। সবকালেই মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে সন্ধান করেছে। তা ছাড়া মানুষ স্বভাবগতভাবে আনুগত্যপরায়ণ। আসল সৃষ্টিকর্তার সন্ধানে ব্যর্থ হলেই মানুষ স্রষ্টার বদলে সৃষ্টির পূজা শুরু করে। তখন ইশপের মুসিকের গল্পের মতো পাহাড়-পর্বত-সমুদ্র-বাতাস-আগুন-পানি-সূর্য-চাঁদ-সাপ ও বৃক্ষসহ সব জড়ো পদার্থকেও পূজনীয় মনে হয়। শক্তির পূজা মানুষের ভেতর সতত সক্রিয় থাকে। এক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস অনেকেরই থাকে। তবে তাকে পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে ত্রিত্ববাদ থেকে মূর্তিবাদ সবকিছুর জন্ম নিয়েছে। নবী-রাসূলগণের ইতিহাস পড়ে জানা যায়, তারা সবাই একত্ববাদ প্রচার করেছেন। তাদের মৃত্যুর অল্প দিন পরেই মানুষ অতিভক্তিবাদের কারণে সেই মহামানবদেরই মূর্তির মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। পরবর্তী নবী-রাসূল এসে আবার মূর্তিবাদী মানুষকে একমাত্র সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য করার আহ্বান জানিয়েছেন। ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্ট, এবং পবিত্র কুরআনেও এ তথ্য অত্যন্ত জোরালো ভাষায় উপস্থাপিত অবস্থায় রয়েছে।
ধর্মকে যারা আফিম কিংবা প্রতিক্রিয়াশীলতার অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয়া এক ধরনের এডিকশন ভাবেন, অন্ধত্ব মনে করেনÑ তারা সত্য বলেন না। বরং সত্যকে আড়াল করার জন্য মিথ্যাচারের ওপর যুক্তি খাড়া করতে চান। যৌবনে মাওবাদ-মার্কসবাদ-লেনিনবাদের উদর থেকে জন্ম নেয়া এক ধরনের নাস্তিক সাজার ভান করার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অনেকের রয়েছে। আবার সেই ধারণার ঘোর কেটেও গেছে। সেই ঘোর যে সব যুগে সব মানুষকে পায় সেটাও ইতিহাস স্বীকৃত। যারা ইতিহাসের জড়বাদী ব্যাখ্যা করে প্রগতিশীল সাজেন তাদের বিদ্যার দৌড় সবার জানা। তারা পৃথিবীর কোনো পবিত্র ধর্মগ্রন্থই পড়েন না, কবিতাচর্চা করে কিংবা রাজনীতির উদ্ভট তত্ত্ব কপচিয়ে স্বঘোষিত বস্তুবাদী সাজেন। কার্যত ইতিহাসের জড়বাদী ব্যাখ্যা করা হয় শাসক ও শাসিতের, শোষক ও শোষিতের, জালেম ও মজলুমের ইতিহাস বানানোর জন্য। বস্তুবাদ বুঝবার এ যেন এক চোখা বদখেয়াল। তাই বিশ্বাস উপড়ে ফেলার এক ধরনের বক নাস্তিক সাজেন। শ্রেণী সংগ্রামের অলিক কাহিনী শোনান। অথচ ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য সাক্ষী হচ্ছে, শ্রেণী সঙ্ঘাতের চেয়েও সত্য-মিথ্যার লড়াই চিরন্তন। এ ক্ষেত্রে বিকৃত, অবিকৃত, মানব সৃষ্ট কিংবা ঐশীগ্রন্থ বিধৌত সব ধর্মই কাছাকাছি অবস্থান করে। সঙ্গত কারণেই পৃথিবীর সব যুগের সব ধার্মিক মানুষের শ্রেণী চরিত্রও কাছাকাছি। দিল্লির কাছে নারী ধর্ষিতা হওয়ার পর ভারতীয় ধর্মপন্থীরা ঘটনার নিন্দা করেছেন। আবার অসংযমী নারী যারা ধর্ষণের জন্য প্রলুব্ধ করে তাদের সংযত হতে বলেছেনÑ এই বক্তব্য সব ধর্মপ্রাণ মানুষের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি। শিব সেনা- রাষ্ট্রসভা বলেছে বলে সত্যটা অস্বীকার করা যায় না। ফলে আলেম-ওলামা, পাদ্রি-যাজক, রাবাই, গুরু ও বোদিপ্রাপ্তরা স্বভাবগত পূত-পবিত্র ও সত্যনিষ্ঠ হওয়ার কথা। বাস্তবেও আমরা যেকোনো ধর্মের ধার্মিক মানুষকে সত্যবাদী, ইনসাফের প্রতি অনুরাগী, মানুষের প্রতি মমত্ববোধসম্পন্ন ও জীবে দয়াবান হতে দেখি। বিনয় সদাচার তাদের ভেতর আশ্রয় পায়। তারা সত্য বলতে বলে, আমানত সংরক্ষণ করে, প্রতিশ্রুতি পালনেও তারা অধার্মিক মানুষের চেয়ে হাজার গুণ শ্রেষ্ঠ। বিশ্বাসের ফারাক নিয়েও এই ঐকতানের শ্রেণী চরিত্র কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে মাদার তেরেসার কথা বলা যায়। তার সেবাকর্ম ধর্মীয় প্রেরণার ফসল। তার পোশাক ধর্মীয়, তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা কার নেই!
আমাদের সমাজের ভালো মানুষগুলো চিহ্নিত করলে তারা কোনো না কোনো ধর্মের নিষ্ঠাবান অনুসারী। তার বিশ্বাসের বিচ্যুতি কিংবা ত্রুটি, আমলের ভ্রান্তি আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। এটা তো অস্বীকার করা যাবে না পরিশুদ্ধ আলেম-ওলামার মতো কোনো খ্রিষ্টান ধর্মযাজককে দেখলেও শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে পড়ে। হিন্দুধর্মীয় নেতা, বৌদ্ধ ভিু, ইহুদি রাবাই কিংবা শিখ ধর্ম গুরুদের দেখলে মনে হয় ওরাও সাদা মনের পবিত্র মানুষ। তাদের চেহারার যে সৌম্যভাব তা তো লুকাবার বিষয় নয়। দালাইলামা শ্রদ্ধা পান ধর্মপ্রাণ হওয়ার কারণেই। ধর্মই তাকে সত্যনিষ্ঠ ও প্রতিবাদী হতে উৎসাহী করেছে। যেমনি শেখ ইয়াসিনকে আমরা দেখেছি ফিলিস্তিনে। আজ কাল আলেম-ওলামা পীর মাশায়েখদের বিরুদ্ধে প্রায় বিষোদগার শুনি, আমার দেখা এখনো ভালো মানুষগুলোর মধ্যে তাদের অবস্থান সামনের কাতারে।
হজরত মরিয়ম বা মেরি ও যিশুর কল্পিত ছবি যারা লক্ষ করবেন দেখবেন তাদের পবিত্র মানুষ ভেবেই চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। পৃথিবীর সব বড় বড় মনীষীর ছবি শ্মশ্রুমণ্ডিত, যেন ধর্মাবতার। তলস্তয় পড়ে অনেকেরই নাস্তিক্যবাদী বাম চিন্তার ঘোর কেটেছিল। তা হলে যার যার অবস্থানে ধর্মচিন্তার বাইরে মৌলিক নীতি নৈতিকতার উৎসের আর কোনো বিকল্প আছে কি! হিব্রু আদি বইপুস্তকে, রোমান ভাষার প্রাচীন গ্রন্থে, ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টের নানা সংস্করণে নীতি-নৈতিকতা ও আইন-কানুনের নানা বইয়ে যেসব নীতিকথার সন্ধান মেলে তার সাথে বেদ-বেদান্ত-উপনিষদ ও গুরু নানকজির শিক্ষায় সৃষ্টিকর্তাকে পাবার ধরনের পার্থক্যটাই শুধু চোখে পড়ে। পবিত্র কুরআন যে একত্ববাদের শিক্ষা তুলে ধরে তার সাথে আদি পুস্তকগুলোর মিল রীতিমতো ঔৎসুক্যের সৃষ্টি করে। তা ছাড়া অতীত সব সভ্যতা ধর্মাশ্রয়ী হওয়ার কারণ স্পষ্ট। ইতিহাসের একমাত্র না হলেও মৌলিক উৎস ধর্মগ্রন্থ। হোক তা চৈনিক, বৈদিক, মিসরীয়, রোমানি, গ্রিস, আরবীয়, পারস্য কিংবা বাইজান্টাইন। সৃষ্টির উৎস ও বিশ্ব জগৎ সম্পর্কে ধর্মগ্রন্থের ধারণাগুলোই বিজ্ঞানকেও সমৃদ্ধ করেছে।
অনেক বোদ্ধা মানুষ সক্রেটিসসহ অনেক মনীষীকে সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি মনে করেছেন। এ ভাবনা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া একেবারেই অসম্ভব। অনেক ধর্মাবতার যারা এখন মূর্তির আদলে পূজিত হচ্ছেন, তারা কেউ পূজার কথা বলেননি। তারা যে নবীদের কাতারের কেউ হতে পারেন সেটাইবা আমরা অস্বীকার করতে যাবো কেন?
এক সফরে ইরানের আধ্যাত্মিক নগরী কোমে দুটো ছবি নজর কাড়ল। গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম এ দুটো কার ছবি। তার জবাব ছিল, কিছু ভ্রান্ত চিন্তার মানুষ আলী ও ফাতেমা চিন্তা করে এ ধরনের ছবি ঘরে রাখে। চিন্তাটি যে ভ্রান্ত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া ইমাম খোমেনীসহ মূল ধারার ইরানিরা এ ধরনের ছবি শুধু বিভ্রান্তি নয় ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিকও মনে করেন। তবে ছবি দুটো যে দরদ দিয়ে আঁকা, তাতে যে সৌম্যকান্তি ও পূতপবিত্র ভাব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাতে ধার্মিক মনে অনুরাগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে অসাধারণ এক নৈপুণ্য রয়েছে। একই ভাবে ভারতের কেরালা রাজ্যের কোচিনে যিশুর একটা ছবি চোখে পড়েছিল। বিগত শতকের একাশি সালে দেখা ছবিটি এত দরদ দিয়ে আঁকা যেন পূতপবিত্র এক অসাধারণ মানুষের প্রতিকৃতি প্রত্যক্ষ করছি। তাতে মনের গভীর থেকে মমত্ববোধ এসে যায়। আনমনে শ্রদ্ধাবোধ জেগে ওঠে।
ধার্মিক ও বকধার্মিক এক নয়। ধার্মিক হতে বলা হয়েছে, ধার্মিক সাজতে বারণ করা হয়েছে। আমাদের সমাজে যারা ধার্মিক সাজে তারা বদমানুষ, খলনায়ক। আসলে যারা ধার্মিক তারা ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। পৃথিবীর কোন দেশই কার্যত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। প্রতিবেশী ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার যে দোহাই দেয়া হয় সেটা উদ্ভট। রাষ্ট্রাচারে হিন্দুয়ানি রেখে কিভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হয়। বাইবেল ছুঁয়ে শপথের পরও ধর্মনিরপেক্ষ! পোশাক নিরপেক্ষ হলে মানুষকে কি বলা হবে, উলঙ্গ কিংবা উদোম। ধর্মও মানার বিষয়, নিরপেক্ষ অবস্থানে রাখার বিষয় নয়। হ্যাঁ, তারপরও ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার যে প্রশ্নটি ওঠে, সেটি রাজনৈতিক ধারণাপ্রসূত। পনের শতকের আগে এমন ধারণাও জন্ম হয়নি। সে ধারণাকে যারা টেনে ধর্মহীনতার দিকে নিয়ে যান তারা শঠ, প্রতারক ও প্রবঞ্চক। যে ধর্মেরই লোক হোক ধর্ম ছাড়া আচার অনুষ্ঠানের তারতম্য ব্যতিরেকে নৈতিকতার আলাদা কোনো সবক কোথাও নেই। অধার্মিকও কিছু মৌলিক গুণাবলিসম্পন্ন হতে পারে। কিন্তু তাকে পবিত্র হতে হলে নীতি-নৈতিকতার মূল ধারণায় পৌঁছতে হবে, পরকালীন ভাবনাতাড়িত হতেই হবে। অনেক পোশাকি লোক পাবেন কেতাদূরস্ত। দামি সেন্টের সুবাস বিলিয়ে তিনি পথ চলেন। তার পোশাক-আশাক পরিচ্ছন্ন হতে পারে, পবিত্র কি না জানা সম্ভব নয়। কারণ তিনি প্রস্রাব করে পানি খরচ না করলে কিংবা টিসু ব্যবহার করে পবিত্র না হলে তার পরিচ্ছন্ন পোশাকও অপবিত্র। পবিত্র ও অপবিত্রের এ ধারণা প্রথমে দিয়েছে ধর্ম, পরে স্বাস্থ্যবিজ্ঞান। জবাবদিহিতার একটা জায়গা রাখতে হবেÑ যেখানে পুলিশ যেতে পারে না, রাষ্ট্রীয় আইন পাহারা দিতে পারে না। নিজের বিবেক দিয়ে যেই বিশ্বাস বিধৌত পাহারা বসাতে হবে। ধর্মীয় চিন্তার বাইরে এর কোনো উৎস আজ পর্যন্ত চিহ্নিত হয়নি। পরকালীন ভাবনা ও স্বর্গ-নরক চিন্তার অতীত কোনো ধারণায় তা পাওয়া সম্ভব নয়।
এ আলোচনার বিষয় কোনো বিশেষ ধর্মবিশ্বাসের ভালো-মন্দ বিচার বিবেচনার জন্য নয়। তা ছাড়া প্রত্যেক ধার্মিক মানুষ যার যার ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ভেবেই অনুসরণ করে। সেই অনুভূতিতে আঘাত দেয়া কিংবা ছোট করে দেখা পাপ। অপরাধ। কোনো বিশ্বাসী মানুষ তা করতে পারে না। ধর্মচিন্তা ও ধার্মিক মানুষের সাথে বক ধার্মিক ও সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট মানুষকে এ কারণেই আলাদা করে দেখতে হবে। এ লেখার উপলক্ষ হলো আজকাল ধর্মের বেষ্টনী ও নৈতিক বাঁধন খুলে ফেলার জন্য নানা উপায় অবলম্বন করা হয়। ধর্মীয় অনুশাসনকে বস্তুবাদী ভাবনা থেকে উপড়ে ফেলার চিন্তা থেকে প্রতিক্রিয়াশীলতা, সেকেলে, মধ্যযুগীয় এবং প্রগতিবিরোধী চিহ্নিত করা হয়। এমন ধারণা দেয়া হয় ধর্ম নারীকে অধিকারবঞ্চিত করছে, এটা শোষণের হাতিয়ার, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করছে, মৌলবাদ জন্ম দিচ্ছে, চরমপন্থা উসকে দিচ্ছে। এ সব কথাই কুযুক্তি। এটা নৈতিক বাঁধন খুলে ফেলার ফন্দি।
ধর্ম হিসেবে ব্যতিক্রম ছাড়া সব ধর্মকেই প্রাচীন ভাবা হয়। ইসলামকে বলা হয় মাত্র দেড় হাজার বছরের। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্ম সম্পর্কে বলা হয় মাত্র কয়েক হাজার বছরের। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসও দীর্ঘ। অন্যান্য ধর্মের কয়েকটি আছে মাত্র কয়েক শ’ বছরের আগেকার। এটা সাধারণ ধারণা, যারা একত্ববাদ ও ঐশী ধারায় বিশ্বাসী তাদের কাছে আদি ধর্ম আদম-হাওয়ার ধর্ম। এ ধারার সর্বশেষ রাসূল মোহাম্মদ সা:। ইতিহাস এটাও ধারণা দেয় আদি চিন্তা একেশ্বরবাদ বা একত্ববাদ। একত্ববাদ থেকেই ধীরে ধীরে বিকৃতির পথ ধরে নানা ধর্মের জন্ম নিয়েছে। এ যুক্তি সবাই মানেন না বলেই এক আল্লাহর বান্দারা এক আল্লাহকে পেতেই নানা মতে ও পথে বিভক্ত হয়েছে। এই সুযোগ নিচ্ছে ধর্মবিরোধী গোষ্ঠী। এরাই শয়তান। শয়তান ও অসুর সম্পর্কে ধারণা সব ধর্মেই আছে। কারা শয়তান ও অসুর নয়Ñ সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব যার যার তার তার। আমরা শুধু বলব, ধর্মই সভ্যতা বিনির্মাণ করেছে। ইতিহাসের গ্রন্থি বেঁধে দিয়েছে। ধর্ম আছে বলেই সমাজ সভ্যতা টিকে আছে। ধর্মপন্থীদের একই সমতলে দাঁড়ানোর বোধ করি এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। প্রথমে ধর্ম বিদ্বেষের শিকড় উপড়ে ফেলা উচিত। তারপর সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প উবে যাবে। বকধার্মিকদের ডামাডোলও থেমে যাবে। তারপরই ধর্মের নামে অধর্ম চিহ্নিত করা সহজ হবে। ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, যার যার ধর্ম তার তার। কিন্তু ধার্মিক মানুষের প্রাণের প্রাচুর্য ও ইতিবাচক দিকটির সুফল সবার। ধর্মপন্থীদের উপড়ে ফেলার সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক যড়যন্ত্র রুখতে না পারলে এই জনপদের কেন, পৃথিবীর মানুষ দেউলিয়া হয়ে যাবে। বর্বরতা পৃথিবীকে গ্রাস করবে।
digantaeditorial@gmail.com
No comments