মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ- তুই রাজাকার! by শাহদীন মালিক
বিচার হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হয়ে শাস্তি নির্ধারণ করে রায় হয়েছে। জাতি হিসেবে ৪১ বছর পর আমরা সাবালক হয়েছি। জাতি হিসেবে ছেলেখেলার বয়স শেষ হলো, অনেক দেরিতে হলেও।
যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে অদ্যাবধি প্রথম আলোর পাতায় আমার একমাত্র লেখায় গত ষোলোই ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের বিশেষ সংখ্যায় যা লিখেছিলাম, তার মূল বক্তব্য ছিল যে অন্য কোনো দেশ যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক সাহায্য নিয়েছিল। কারণ, এই বিচার করার মতো সক্ষমতা সেসব দেশের ছিল না। পদ্মা সেতু বানাতে আমাদের বিদেশি সাহায্য লাগবে। কারণ, এ কাজ আমরা আপাতত নিজেরা করতে পারব না। আমাদের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আছে।
কিন্তু দেশ স্বাধীন রাখতে আমাদের সাহায্য লাগে না। যারা এ দেশের লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষকে অকাতরে হত্যা করেছে, সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে মেরেছে, আগুনে পুড়িয়ে বেয়নেটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে, বাবা-ভাই-বোনের সামনে ধর্ষণ করেছে তাদের নিকটাত্মীয়াকে পালাক্রমে, লুট করেছে, ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে, ধরে নিয়ে গিয়ে জ্যান্ত পুঁতে মেরেছে—দাফন করার জন্য লাশ পায়নি প্রায় কেউই। এক কোটিরও বেশি মানুষ বিদেশে রাস্তায়, মাঠে, তাঁবুতে, স্কুলের বারান্দায়, শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশায় কাটিয়েছে নয় মাস।
এসব অপরাধের হোতাদের বিচারও এখন আমরা করতে পেরেছি নিজেরাই, কারও সাহায্য ছাড়াই।
সাহায্যদাতারা তাই কিছুটা হলেও মনঃক্ষুণ্ন। তাই বোধ হয় গত দুই দিনে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বাচ্চু রাজাকারের বিচারের রায়ের খবরের সঙ্গে বিচারের মান সম্পর্কে প্রশ্নবোধক চিহ্ন যোগ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য-উপদেশ-দিকনির্দেশনা ছাড়া যুদ্ধাপরাধের বিচার এই প্রথম। তাই কিছুটা হলেও আঁতে ঘা লাগবে।
দুই.
আমাদের গর্ব ও সক্ষমতা হলো, আমরা নিজেরাই বিচার করতে পেরেছি। এবং এর কৃতিত্ব সরকারের প্রাপ্য। প্রায় সব সময়ই—উঠতে বসতে—সরকারের সমালোচনা করি। কিন্তু বিচারের ব্যাপারে বিচারের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য যে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল, সেটা নিতে পেরেছে বলে সরকারের কাছে আমরা সবাই কৃতজ্ঞ।
বিএনপি ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের গা বাঁচানো প্রতিক্রিয়ায় আমরা হতাশ। যুদ্ধাপরাধের বিচার এ দেশের সব মানুষ চায়। ১৯৭১ সালে প্রথম আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার হয়ে গেছেন, এমনকি পাকিস্তান বাহিনীর দোসর হিসেবে বা নিজেই স্ব-উদ্যোগে বা বাহিনী করে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন, এমন দু-চারজন যুদ্ধাপরাধী নিশ্চয় এ দেশে আছে। তাঁদের বিচারের কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। এবং এই উদ্যোগ সম্ভবত এই সরকার নেবে না, এটা ধরে নিলেও সেই যুক্তিতে বাচ্চু রাজাকারের বিচার করা যাবে না, এ কেমন কথা!
পাঁচটা চোরের সবাইকে ধরা যাচ্ছে না, সে কারণে একজন চোরেরও বিচার করা উচিত হবে না—এমন খোঁড়া যুক্তি দিয়ে বিএনপি জনসমর্থন হারাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার মতো অবকাঠামো দেশে ছিল না। রাস্তাঘাট ছিল না, কলকারখানা সব পুড়ে
ধ্বংস হয়েছিল, অনেক এলাকায় একটা স্কুল-কলেজও অক্ষত ছিল না। প্রশাসন চালানোর মতো অভিজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তা ছিল হাতেগোনা। সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী ইত্যাদি প্রায় শুরু থেকে শুরু করতে হয়েছিল। সৌদি আরব, চীনের মতো দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর পর।
তবু সে অবস্থায় দালাল আইন হয়েছিল ১৯৭২ সালে। গ্রেপ্তার হয়েছিল কয়েক হাজার, মামলা চলছিল শত শত। তবে একই সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত অনেক দালালের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত তদন্ত ও সাক্ষ্য জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছিল না।
১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন পাস হয়েছিল। বিচার শুরু হয়নি, কিন্তু তৎকালীন বিশ্বের জন্য এটা ছিল এ ধরনের নজিরবিহীন প্রথম পূর্ণাঙ্গ জাতীয় যুদ্ধাপরাধ আইন।
যুদ্ধের সময় বা যুদ্ধের নামে নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা, জখম, ধর্ষণ—এগুলো যে অপরাধ হতে পারে, সেটা মানবসভ্যতার মাত্র দেড় শ বছরের ব্যাপার। তাই কোনো দেশেই যুদ্ধাপরাধ-সংক্রান্ত আইন ছিল না বললেই চলে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে কিছু আন্তর্জাতিক আইন হয়েছিল—যেমন যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা যাবে না বা যুদ্ধের সময় যাত্রীবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া যাবে না।
আমাদের দালাল আইন বাতিল হয়ে যায় ১৯৭৫ সলের ৩১ ডিসেম্বর। শেষ পর্যন্ত ওই আইনে গ্রেপ্তারকৃত আর অভিযুক্ত সবাই ছাড়া পেয়ে যায়। কারণ, আইনটাই তো বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
অর্থাৎ, যারা যুদ্ধাপরাধ করে, তারা যুদ্ধে হেরে গেলেও শক্তিধর, ক্ষমতাধর থাকে বহুদিন। তাদের বিচারের জন্য করা আইনও বাতিল করে দিতে পারে। পারে ছাড়া পেয়ে যেতে, পারে বেআইনি ও অবৈধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলকে আবার শুধু রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতেই নয়, ক্ষমতায়ও বসতে, অন্তত মন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতার ভাগীদার হতে।
এরই ধারাবাহিকতায় বাধ্য করছে বিএনপির মতো দলকেও তাদের সঙ্গে রাখতে এবং বিএনপিও প্রকারান্তরে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, বিচারের মান ইত্যাদি কথার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের কিছুটা হলেও সমর্থন করছে।
তিন.
এসব হয়। অন্য যেসব দেশে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেসব দেশেও বিচার করতে গিয়ে এসব বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। যখন বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তখন কম্পুচিয়া (বর্তমানে কম্বোডিয়া), যে দেশে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার মাত্র শুরু করেছে। তিন দশকের পরও তাদের আন্তর্জাতিক সহায়তা লাগছে।
যারা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের বিচার শুরু করে এবং একটা মামলায় রায় দিয়ে আমরা প্রমাণ করেছি যে অন্যরা যেটা পারেনি, আমরা সেটা পেরেছি। শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও আইন ও বিচারে আমরা ভয় পাই না।
বিচার করেছেন আদালত। আরও বিচার শেষ হবে। রায় হবে। আপিল হবে। বিচার ও রায়ের ব্যাপারে, বলা বাহুল্য সরকারের করণীয় কিছুই নেই। এসব আদালতের ব্যাপার।
তবে এই বিচার ও আদালতের মান সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন উঠছে, তার দায়ভার সরকারের। তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবী সরকারের প্রধান মাপকাঠি ছিল দলীয় সম্পৃক্ততা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। দ্বিতীয়ত, আইনে যাঁদের পারদর্শিতা ও দক্ষতা নেই, এমন সব ব্যক্তি অহরহ সরকারের মুখপাত্র হিসেবে কথা বলেছেন। মন্ত্রীরাও মন্তব্য করার সুযোগ হাতছাড়া করেননি। এতে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই সমস্যার সমাধান সম্ভব, কিন্তু এই সরকার তা করতে পারবে না। যেমন পারবে না পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে।
তা সত্ত্বেও, অর্থাৎ সরকারের শত ব্যর্থতা সত্ত্বেও যে রাজাকার যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, সেই রাজাকারের—আপাতত অন্তত একজনের— বিচার হয়েছে।
ধরে নিচ্ছি, সে পালিয়ে থাকবে। সম্ভবত এ দেশের মাটিতে তার মৃত্যু হবে না। রাজাকারের চরম শাস্তি সেটাই।
এই মাটি লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা মাটি। এই মাটিতে রাজাকারের স্থান নেই।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। অধ্যাপক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু দেশ স্বাধীন রাখতে আমাদের সাহায্য লাগে না। যারা এ দেশের লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষকে অকাতরে হত্যা করেছে, সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে মেরেছে, আগুনে পুড়িয়ে বেয়নেটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে, বাবা-ভাই-বোনের সামনে ধর্ষণ করেছে তাদের নিকটাত্মীয়াকে পালাক্রমে, লুট করেছে, ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে, ধরে নিয়ে গিয়ে জ্যান্ত পুঁতে মেরেছে—দাফন করার জন্য লাশ পায়নি প্রায় কেউই। এক কোটিরও বেশি মানুষ বিদেশে রাস্তায়, মাঠে, তাঁবুতে, স্কুলের বারান্দায়, শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশায় কাটিয়েছে নয় মাস।
এসব অপরাধের হোতাদের বিচারও এখন আমরা করতে পেরেছি নিজেরাই, কারও সাহায্য ছাড়াই।
সাহায্যদাতারা তাই কিছুটা হলেও মনঃক্ষুণ্ন। তাই বোধ হয় গত দুই দিনে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বাচ্চু রাজাকারের বিচারের রায়ের খবরের সঙ্গে বিচারের মান সম্পর্কে প্রশ্নবোধক চিহ্ন যোগ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য-উপদেশ-দিকনির্দেশনা ছাড়া যুদ্ধাপরাধের বিচার এই প্রথম। তাই কিছুটা হলেও আঁতে ঘা লাগবে।
দুই.
আমাদের গর্ব ও সক্ষমতা হলো, আমরা নিজেরাই বিচার করতে পেরেছি। এবং এর কৃতিত্ব সরকারের প্রাপ্য। প্রায় সব সময়ই—উঠতে বসতে—সরকারের সমালোচনা করি। কিন্তু বিচারের ব্যাপারে বিচারের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য যে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল, সেটা নিতে পেরেছে বলে সরকারের কাছে আমরা সবাই কৃতজ্ঞ।
বিএনপি ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের গা বাঁচানো প্রতিক্রিয়ায় আমরা হতাশ। যুদ্ধাপরাধের বিচার এ দেশের সব মানুষ চায়। ১৯৭১ সালে প্রথম আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার হয়ে গেছেন, এমনকি পাকিস্তান বাহিনীর দোসর হিসেবে বা নিজেই স্ব-উদ্যোগে বা বাহিনী করে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন, এমন দু-চারজন যুদ্ধাপরাধী নিশ্চয় এ দেশে আছে। তাঁদের বিচারের কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। এবং এই উদ্যোগ সম্ভবত এই সরকার নেবে না, এটা ধরে নিলেও সেই যুক্তিতে বাচ্চু রাজাকারের বিচার করা যাবে না, এ কেমন কথা!
পাঁচটা চোরের সবাইকে ধরা যাচ্ছে না, সে কারণে একজন চোরেরও বিচার করা উচিত হবে না—এমন খোঁড়া যুক্তি দিয়ে বিএনপি জনসমর্থন হারাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার মতো অবকাঠামো দেশে ছিল না। রাস্তাঘাট ছিল না, কলকারখানা সব পুড়ে
ধ্বংস হয়েছিল, অনেক এলাকায় একটা স্কুল-কলেজও অক্ষত ছিল না। প্রশাসন চালানোর মতো অভিজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তা ছিল হাতেগোনা। সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী ইত্যাদি প্রায় শুরু থেকে শুরু করতে হয়েছিল। সৌদি আরব, চীনের মতো দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর পর।
তবু সে অবস্থায় দালাল আইন হয়েছিল ১৯৭২ সালে। গ্রেপ্তার হয়েছিল কয়েক হাজার, মামলা চলছিল শত শত। তবে একই সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত অনেক দালালের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত তদন্ত ও সাক্ষ্য জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছিল না।
১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন পাস হয়েছিল। বিচার শুরু হয়নি, কিন্তু তৎকালীন বিশ্বের জন্য এটা ছিল এ ধরনের নজিরবিহীন প্রথম পূর্ণাঙ্গ জাতীয় যুদ্ধাপরাধ আইন।
যুদ্ধের সময় বা যুদ্ধের নামে নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা, জখম, ধর্ষণ—এগুলো যে অপরাধ হতে পারে, সেটা মানবসভ্যতার মাত্র দেড় শ বছরের ব্যাপার। তাই কোনো দেশেই যুদ্ধাপরাধ-সংক্রান্ত আইন ছিল না বললেই চলে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে কিছু আন্তর্জাতিক আইন হয়েছিল—যেমন যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা যাবে না বা যুদ্ধের সময় যাত্রীবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া যাবে না।
আমাদের দালাল আইন বাতিল হয়ে যায় ১৯৭৫ সলের ৩১ ডিসেম্বর। শেষ পর্যন্ত ওই আইনে গ্রেপ্তারকৃত আর অভিযুক্ত সবাই ছাড়া পেয়ে যায়। কারণ, আইনটাই তো বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
অর্থাৎ, যারা যুদ্ধাপরাধ করে, তারা যুদ্ধে হেরে গেলেও শক্তিধর, ক্ষমতাধর থাকে বহুদিন। তাদের বিচারের জন্য করা আইনও বাতিল করে দিতে পারে। পারে ছাড়া পেয়ে যেতে, পারে বেআইনি ও অবৈধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলকে আবার শুধু রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতেই নয়, ক্ষমতায়ও বসতে, অন্তত মন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতার ভাগীদার হতে।
এরই ধারাবাহিকতায় বাধ্য করছে বিএনপির মতো দলকেও তাদের সঙ্গে রাখতে এবং বিএনপিও প্রকারান্তরে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, বিচারের মান ইত্যাদি কথার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের কিছুটা হলেও সমর্থন করছে।
তিন.
এসব হয়। অন্য যেসব দেশে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেসব দেশেও বিচার করতে গিয়ে এসব বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। যখন বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তখন কম্পুচিয়া (বর্তমানে কম্বোডিয়া), যে দেশে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার মাত্র শুরু করেছে। তিন দশকের পরও তাদের আন্তর্জাতিক সহায়তা লাগছে।
যারা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের বিচার শুরু করে এবং একটা মামলায় রায় দিয়ে আমরা প্রমাণ করেছি যে অন্যরা যেটা পারেনি, আমরা সেটা পেরেছি। শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও আইন ও বিচারে আমরা ভয় পাই না।
বিচার করেছেন আদালত। আরও বিচার শেষ হবে। রায় হবে। আপিল হবে। বিচার ও রায়ের ব্যাপারে, বলা বাহুল্য সরকারের করণীয় কিছুই নেই। এসব আদালতের ব্যাপার।
তবে এই বিচার ও আদালতের মান সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন উঠছে, তার দায়ভার সরকারের। তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবী সরকারের প্রধান মাপকাঠি ছিল দলীয় সম্পৃক্ততা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। দ্বিতীয়ত, আইনে যাঁদের পারদর্শিতা ও দক্ষতা নেই, এমন সব ব্যক্তি অহরহ সরকারের মুখপাত্র হিসেবে কথা বলেছেন। মন্ত্রীরাও মন্তব্য করার সুযোগ হাতছাড়া করেননি। এতে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই সমস্যার সমাধান সম্ভব, কিন্তু এই সরকার তা করতে পারবে না। যেমন পারবে না পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে।
তা সত্ত্বেও, অর্থাৎ সরকারের শত ব্যর্থতা সত্ত্বেও যে রাজাকার যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, সেই রাজাকারের—আপাতত অন্তত একজনের— বিচার হয়েছে।
ধরে নিচ্ছি, সে পালিয়ে থাকবে। সম্ভবত এ দেশের মাটিতে তার মৃত্যু হবে না। রাজাকারের চরম শাস্তি সেটাই।
এই মাটি লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা মাটি। এই মাটিতে রাজাকারের স্থান নেই।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। অধ্যাপক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments