মুক্তিযুদ্ধে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ভূমিকা by আ স ম আবদুর রব
বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের যে বিশাল ভূমিকা ছিল, তা কোনো সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনায় যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, তারই সূত্র ধরে এ দেশের ছাত্রসমাজ স্বাধিকারের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে এই গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়।
মধ্যবর্তী সেসব আন্দোলনকে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, যার মধ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও ১৯৬৯ সালের ১১ দফা আন্দোলন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির ডামাডোলে বাঙালির 'স্বাধিকার' প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কেবল ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়নি, বলতে গেলে কোনো বড় ধরনের সাংগঠনিক উদ্যোগের কথাই জানা যায় না; ব্যতিক্রম হিসেবে দেখা যায়, ১৯৬২ সালে গঠিত 'নিউক্লিয়াস' অথবা 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ'-এর নাম। বাঙালির সুদীর্ঘ কালের শ্রেষ্ঠ অর্জন তার স্বাধীনতা। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক কার্যকলাপের পাশাপাশি গোপন কার্যকলাপের বিবরণ আমাদের ইতিহাসবিদদের লেখায় স্থান পায় না। যেহেতু গোপন কর্মকাণ্ডভিত্তিক সংগঠন গোপনে পরিচালিত হয়ে থাকে, তাই সমসাময়িককালের সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায়ও তা স্থান পায় না। সরকারি উদ্যোগে যখন কোনো দেশের বিপ্লব বা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস লেখা হয়, সেখানেও ওই সব গোপন কর্মকাণ্ডের কোনো কিছু রেকর্ডভুক্ত হয় না। এসব কারণে গোপন কর্মকাণ্ডের বিবরণ প্রথম প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত মনমানসিকতাপূর্ণ সংকীর্ণতা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এসব সীমাবদ্ধতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বহু দেশের ইতিহাসের ক্ষেত্রেই দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আঠারো-উনিশ শতকে ইউরোপ ও আমেরিকার যেসব দেশে স্বাধীনতা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, তাদের ইতিহাসে স্বাধীনতার পেছনের দর্শন বা রাজনৈতিক গোপন কর্মকাণ্ডের বিস্তৃত বিবরণ স্থান পেয়েছে। এমনকি ফরাসি বিপ্লবের সময় রাস্তায় রাস্তায় সেখানে রাজতন্ত্রবিরোধী বৈপ্লবিক শিল্পকর্ম ছিল (আজ যা Street Culture হিসেবে সমাদৃত) তার সব কিছুকে কেন্দ্র করে শুধু দর্শনের বই-ই নয়, এসব নিয়ে সাহিত্য, নাট্যকলা, চিত্রকলা- এমনকি চলচ্চিত্রও সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ১৯৬২ সাল থেকে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ- এ তিনজন ছাত্রলীগ নেতার উদ্যোগে গঠিত স্বাধীনতার পক্ষের গোপন সংগঠনটি 'নিউক্লিয়াস' নামে পরিচিত। আবার এই 'নিউক্লিয়াস'ই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ' নামে অভিহিত। প্রকাশ্যে এই নিউক্লিয়াসের কোনো কর্মকাণ্ড ছিল না ঠিকই; কিন্তু ছাত্র আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফাসহ প্রতিটি গণ-আন্দোলনকে স্বাধীনতার পক্ষে মতামত সৃষ্টির কাজে রূপ দিতে নিউক্লিয়াসের ছাত্র-যুব নেতৃত্ব গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন।
পরবর্তীকালে এই তিন নেতার বাইরে আরো দুজনকে 'নিউক্লিয়াস'-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাঁদের একজন হলেন ছাত্রলীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ (১৯৬৩) ও অপরজন চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ নেতা এম এ মান্নান (১৯৬৫)। নিউক্লিয়াস ১৯৬৮ সাল নাগাদ গোটা বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০০ ইউনিট গঠন করে। প্রতি ইউনিটে ৯ জন করে সদস্য ছিলেন। প্রতি মহকুমায় চার-পাঁচজন সদস্য থাকতেন। মহকুমার অধীনে বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঁচজন সদস্য নিয়ে গোপন কমিটি গঠিত হতো। ১৯৬৮-'৭০ সালে 'নিউক্লিয়াস'-এর সদস্য বৃদ্ধি পেয়ে সাত হাজারে দাঁড়ায় এবং ১১ দফা আন্দোলনকে বেগবান করে শেখ মুজিবের মুক্তি ও আন্দোলনকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কারামুক্তির পর শেখ মুজিবের ইচ্ছায় শেখ ফজলুল হক মনিকে নিউক্লিয়াসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আসাদের জানাজায় পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি না দিলে সারা বাংলায় আগুন জ্বলবে এবং জেলের তালা ভেঙে শেখ মুজিবকে নিয়ে আসার ঘোষণা দেন। তিনি বলেছিলেন, আজ থেকে তোমাদের (পশ্চিম পাকিস্তানকে) তালাক দেওয়া হলো। নিউক্লিয়াসের সবাই ভারতে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। ছাত্রলীগকে স্বাধীনতার পথে পরিচালিত করাই নিউক্লিয়াস সদস্যদের প্রথমদিকের কাজ ছিল। 'নিউক্লিয়াস'-এর মাধ্যমে আদর্শবাদী কর্মী গড়ে তোলার প্রক্রিয়াটি জোরালোভাবেই শুরু হয়েছিল। 'নিউক্লিয়াস'-এর সদস্য সংগ্রহ করা হতো মূলত ছাত্রলীগ থেকে। সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী সংগ্রহ করা হতো বাইরে থেকে। ছাত্রলীগকে গতিশীল ও সুশৃঙ্খল সংগঠনরূপে গড়ে তুলতে 'নিউক্লিয়াস' দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায় ১৯৬৪ সাল থেকে। 'নিউক্লিয়াস'-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনের নাম্বার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটের নামফলক ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় লেখার আন্দোলন সংঘটিত হয়। বাংলায় লেখার এ মৌলিক কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করে ছাত্রলীগ। এ সময়েই প্রথম দেয়াল লিখন (চিকা) ব্যবস্থা চালু হয়। এটা ছিল 'নিউক্লিয়াস'-এর সিদ্ধান্ত। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করত। নিউক্লিয়াসের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বের ফলেই ছাত্রলীগ থেকে ১৯৭০ সালে প্রথম স্বাধীনতার দাবি উত্থাপিত হয়। 'নিউক্লিয়াস' ছাত্রলীগ, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে যেসব ঐতিহাসিক কাজ সম্পন্ন করেছে তার কয়েকটি হলো 'বাংলাদেশ নামকরণ সমর্থন', যা শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম প্রস্তাব আকারে উত্থাপন করেন ১৯৭০ সালে, 'জাতীয় পতাকা তৈরি', যা আনুষ্ঠানিকভাবে আমি উত্তোলন করি, 'জয়বাংলা' স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে নির্ধারণ; 'স্বাধীনতার ইশতেহার তৈরি', যা আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ করেন শাজাহান সিরাজ, 'স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব', যা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন স্বপন কুমার চৌধুরী, শেখ মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি প্রদান, যা আনুষ্ঠানিকভাবে তোফায়েল আহমেদ ঘোষণা করেন, 'কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব দানের জন্য বঙ্গবন্ধুকে সুপারিশ করা', 'তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা', 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর' ইত্যাদি স্লোগান; 'জাতীয় সংগীত নির্ধারণ'; ৬ দফা, ১১ দফা এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার আন্দোলনকে এক দফায় রূপান্তর করে স্বাধীনতার বিষয়কে সামনে নিয়ে আসা, বিভিন্ন আন্দোলন পরিচালনা, রূপরেখা প্রণয়নসহ সব আন্দোলনের মূল দায়িত্ব নিউক্লিয়াসের ছাত্র-যুব নেতারাই পালন করেছিলেন।
১১ দফা আন্দোলন পরিকল্পনা এবং এর সাংগঠনিক বিস্তারে 'নিউক্লিয়াস'-এর নেতৃত্ব ও সংগঠকরা নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন এবং এ আন্দোলন পরিচালনার জন্য সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের রূপ প্রদানে 'নিউক্লিয়াস' নেতাদের ভূমিকাই প্রধান ছিল। ১১ দফায় স্বাক্ষরকারী ছাত্র সংগঠনসমূহ হলো ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (উভয় গ্রুপ), ছাত্র ফেডারেশন (দোলন গ্রুপ) ও ডাকসু। ১১ দফা আন্দোলন চলাকালে গণ-অভ্যুত্থান অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে অবাঙালি অধ্যুষিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। 'নিউক্লিয়াস' সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে বিকল্প সামাজিক শক্তি হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ব্রিগেড সারা দেশে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শহর-পাড়া-মহল্লাসহ প্রত্যেক অঞ্চলে এবং থানা পর্যায় পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি ছিল। নৈশপ্রহরী, ট্রাফিক ব্যবস্থা, মেইল ট্রেন চালু, লঞ্চ, স্টিমার, নৌবন্দর পরিচালনা, এমসিসি-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলা পরিচালনা করা, থানা পর্যায়ে পুলিশ প্রশাসনকে সহায়তা করা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, শিল্প কল-কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখা ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনায়ও ব্রিগেডগুলোর ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ। ছাত্রনেতা আসাদ, কিশোর ছাত্র মতিউর পুলিশের গুলিতে নিহত হলে তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কৌশল নির্ধারণ করে 'নিউক্লিয়াস' এবং তা কার্যকর করে 'ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'। গণ-আন্দোলন ক্রমেই তীব্র হতে থাকে এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিকল হয়ে পড়ে। ফলে আইয়ুব খান পদত্যাগ করে ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন।
ঊনসত্তরে ছাত্ররাজনীতির লক্ষ্য ছিল স্বাধিকারের দাবিকে স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তর করা। স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনার অবসান করা। সে বিবেচনায় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিল :
১. শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ প্রতিষ্ঠা। সব মানুষের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক মুক্তি। আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা;
২. উৎপাদনযন্ত্র ও উৎপাদনব্যবস্থার মালিক হবে জনগণ;
৩। রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব থাকবে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষকে সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি দান;
৪. পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক বিকাশ;
৫. নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমান্বয়ে দূর করা;
৬. সর্বজনীন শিক্ষা ও শিক্ষালাভের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা;
৭. জনগণের ক্ষমতায়ন ও জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং
৮. বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের সংহতি সংগ্রামকে সমর্থন জানানো।
কিন্তু এ স্বপ্ন পূরণে যে ধরনের রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার দরকার, তা আজও আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। দলতন্ত্র-সামরিকতন্ত্র ও ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ব্যবস্থাপনা স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে বড় ধরনের বাধা। এ ধরনের ব্যবস্থা অব্যাহত থাকলে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মাধ্যমে অর্জিত অনেক সুফল বিনষ্ট হয়ে যাবে। রাষ্ট্র গভীরতর সংকটে নিপতিত হবে, যা কারো কাম্য নয়।
লেখক : রাজনীতিবিদ
ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির ডামাডোলে বাঙালির 'স্বাধিকার' প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কেবল ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়নি, বলতে গেলে কোনো বড় ধরনের সাংগঠনিক উদ্যোগের কথাই জানা যায় না; ব্যতিক্রম হিসেবে দেখা যায়, ১৯৬২ সালে গঠিত 'নিউক্লিয়াস' অথবা 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ'-এর নাম। বাঙালির সুদীর্ঘ কালের শ্রেষ্ঠ অর্জন তার স্বাধীনতা। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক কার্যকলাপের পাশাপাশি গোপন কার্যকলাপের বিবরণ আমাদের ইতিহাসবিদদের লেখায় স্থান পায় না। যেহেতু গোপন কর্মকাণ্ডভিত্তিক সংগঠন গোপনে পরিচালিত হয়ে থাকে, তাই সমসাময়িককালের সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায়ও তা স্থান পায় না। সরকারি উদ্যোগে যখন কোনো দেশের বিপ্লব বা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস লেখা হয়, সেখানেও ওই সব গোপন কর্মকাণ্ডের কোনো কিছু রেকর্ডভুক্ত হয় না। এসব কারণে গোপন কর্মকাণ্ডের বিবরণ প্রথম প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত মনমানসিকতাপূর্ণ সংকীর্ণতা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এসব সীমাবদ্ধতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বহু দেশের ইতিহাসের ক্ষেত্রেই দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আঠারো-উনিশ শতকে ইউরোপ ও আমেরিকার যেসব দেশে স্বাধীনতা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, তাদের ইতিহাসে স্বাধীনতার পেছনের দর্শন বা রাজনৈতিক গোপন কর্মকাণ্ডের বিস্তৃত বিবরণ স্থান পেয়েছে। এমনকি ফরাসি বিপ্লবের সময় রাস্তায় রাস্তায় সেখানে রাজতন্ত্রবিরোধী বৈপ্লবিক শিল্পকর্ম ছিল (আজ যা Street Culture হিসেবে সমাদৃত) তার সব কিছুকে কেন্দ্র করে শুধু দর্শনের বই-ই নয়, এসব নিয়ে সাহিত্য, নাট্যকলা, চিত্রকলা- এমনকি চলচ্চিত্রও সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ১৯৬২ সাল থেকে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ- এ তিনজন ছাত্রলীগ নেতার উদ্যোগে গঠিত স্বাধীনতার পক্ষের গোপন সংগঠনটি 'নিউক্লিয়াস' নামে পরিচিত। আবার এই 'নিউক্লিয়াস'ই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ' নামে অভিহিত। প্রকাশ্যে এই নিউক্লিয়াসের কোনো কর্মকাণ্ড ছিল না ঠিকই; কিন্তু ছাত্র আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফাসহ প্রতিটি গণ-আন্দোলনকে স্বাধীনতার পক্ষে মতামত সৃষ্টির কাজে রূপ দিতে নিউক্লিয়াসের ছাত্র-যুব নেতৃত্ব গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন।
পরবর্তীকালে এই তিন নেতার বাইরে আরো দুজনকে 'নিউক্লিয়াস'-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাঁদের একজন হলেন ছাত্রলীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ (১৯৬৩) ও অপরজন চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ নেতা এম এ মান্নান (১৯৬৫)। নিউক্লিয়াস ১৯৬৮ সাল নাগাদ গোটা বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০০ ইউনিট গঠন করে। প্রতি ইউনিটে ৯ জন করে সদস্য ছিলেন। প্রতি মহকুমায় চার-পাঁচজন সদস্য থাকতেন। মহকুমার অধীনে বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঁচজন সদস্য নিয়ে গোপন কমিটি গঠিত হতো। ১৯৬৮-'৭০ সালে 'নিউক্লিয়াস'-এর সদস্য বৃদ্ধি পেয়ে সাত হাজারে দাঁড়ায় এবং ১১ দফা আন্দোলনকে বেগবান করে শেখ মুজিবের মুক্তি ও আন্দোলনকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কারামুক্তির পর শেখ মুজিবের ইচ্ছায় শেখ ফজলুল হক মনিকে নিউক্লিয়াসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আসাদের জানাজায় পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি না দিলে সারা বাংলায় আগুন জ্বলবে এবং জেলের তালা ভেঙে শেখ মুজিবকে নিয়ে আসার ঘোষণা দেন। তিনি বলেছিলেন, আজ থেকে তোমাদের (পশ্চিম পাকিস্তানকে) তালাক দেওয়া হলো। নিউক্লিয়াসের সবাই ভারতে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। ছাত্রলীগকে স্বাধীনতার পথে পরিচালিত করাই নিউক্লিয়াস সদস্যদের প্রথমদিকের কাজ ছিল। 'নিউক্লিয়াস'-এর মাধ্যমে আদর্শবাদী কর্মী গড়ে তোলার প্রক্রিয়াটি জোরালোভাবেই শুরু হয়েছিল। 'নিউক্লিয়াস'-এর সদস্য সংগ্রহ করা হতো মূলত ছাত্রলীগ থেকে। সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী সংগ্রহ করা হতো বাইরে থেকে। ছাত্রলীগকে গতিশীল ও সুশৃঙ্খল সংগঠনরূপে গড়ে তুলতে 'নিউক্লিয়াস' দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায় ১৯৬৪ সাল থেকে। 'নিউক্লিয়াস'-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনের নাম্বার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটের নামফলক ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় লেখার আন্দোলন সংঘটিত হয়। বাংলায় লেখার এ মৌলিক কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করে ছাত্রলীগ। এ সময়েই প্রথম দেয়াল লিখন (চিকা) ব্যবস্থা চালু হয়। এটা ছিল 'নিউক্লিয়াস'-এর সিদ্ধান্ত। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করত। নিউক্লিয়াসের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বের ফলেই ছাত্রলীগ থেকে ১৯৭০ সালে প্রথম স্বাধীনতার দাবি উত্থাপিত হয়। 'নিউক্লিয়াস' ছাত্রলীগ, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে যেসব ঐতিহাসিক কাজ সম্পন্ন করেছে তার কয়েকটি হলো 'বাংলাদেশ নামকরণ সমর্থন', যা শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম প্রস্তাব আকারে উত্থাপন করেন ১৯৭০ সালে, 'জাতীয় পতাকা তৈরি', যা আনুষ্ঠানিকভাবে আমি উত্তোলন করি, 'জয়বাংলা' স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে নির্ধারণ; 'স্বাধীনতার ইশতেহার তৈরি', যা আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ করেন শাজাহান সিরাজ, 'স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব', যা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন স্বপন কুমার চৌধুরী, শেখ মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি প্রদান, যা আনুষ্ঠানিকভাবে তোফায়েল আহমেদ ঘোষণা করেন, 'কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব দানের জন্য বঙ্গবন্ধুকে সুপারিশ করা', 'তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা', 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর' ইত্যাদি স্লোগান; 'জাতীয় সংগীত নির্ধারণ'; ৬ দফা, ১১ দফা এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার আন্দোলনকে এক দফায় রূপান্তর করে স্বাধীনতার বিষয়কে সামনে নিয়ে আসা, বিভিন্ন আন্দোলন পরিচালনা, রূপরেখা প্রণয়নসহ সব আন্দোলনের মূল দায়িত্ব নিউক্লিয়াসের ছাত্র-যুব নেতারাই পালন করেছিলেন।
১১ দফা আন্দোলন পরিকল্পনা এবং এর সাংগঠনিক বিস্তারে 'নিউক্লিয়াস'-এর নেতৃত্ব ও সংগঠকরা নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন এবং এ আন্দোলন পরিচালনার জন্য সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের রূপ প্রদানে 'নিউক্লিয়াস' নেতাদের ভূমিকাই প্রধান ছিল। ১১ দফায় স্বাক্ষরকারী ছাত্র সংগঠনসমূহ হলো ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (উভয় গ্রুপ), ছাত্র ফেডারেশন (দোলন গ্রুপ) ও ডাকসু। ১১ দফা আন্দোলন চলাকালে গণ-অভ্যুত্থান অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে অবাঙালি অধ্যুষিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। 'নিউক্লিয়াস' সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে বিকল্প সামাজিক শক্তি হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ব্রিগেড সারা দেশে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শহর-পাড়া-মহল্লাসহ প্রত্যেক অঞ্চলে এবং থানা পর্যায় পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি ছিল। নৈশপ্রহরী, ট্রাফিক ব্যবস্থা, মেইল ট্রেন চালু, লঞ্চ, স্টিমার, নৌবন্দর পরিচালনা, এমসিসি-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলা পরিচালনা করা, থানা পর্যায়ে পুলিশ প্রশাসনকে সহায়তা করা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, শিল্প কল-কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখা ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনায়ও ব্রিগেডগুলোর ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ। ছাত্রনেতা আসাদ, কিশোর ছাত্র মতিউর পুলিশের গুলিতে নিহত হলে তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কৌশল নির্ধারণ করে 'নিউক্লিয়াস' এবং তা কার্যকর করে 'ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'। গণ-আন্দোলন ক্রমেই তীব্র হতে থাকে এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিকল হয়ে পড়ে। ফলে আইয়ুব খান পদত্যাগ করে ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন।
ঊনসত্তরে ছাত্ররাজনীতির লক্ষ্য ছিল স্বাধিকারের দাবিকে স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তর করা। স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনার অবসান করা। সে বিবেচনায় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিল :
১. শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ প্রতিষ্ঠা। সব মানুষের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক মুক্তি। আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা;
২. উৎপাদনযন্ত্র ও উৎপাদনব্যবস্থার মালিক হবে জনগণ;
৩। রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব থাকবে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষকে সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি দান;
৪. পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক বিকাশ;
৫. নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমান্বয়ে দূর করা;
৬. সর্বজনীন শিক্ষা ও শিক্ষালাভের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা;
৭. জনগণের ক্ষমতায়ন ও জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং
৮. বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের সংহতি সংগ্রামকে সমর্থন জানানো।
কিন্তু এ স্বপ্ন পূরণে যে ধরনের রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার দরকার, তা আজও আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। দলতন্ত্র-সামরিকতন্ত্র ও ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ব্যবস্থাপনা স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে বড় ধরনের বাধা। এ ধরনের ব্যবস্থা অব্যাহত থাকলে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মাধ্যমে অর্জিত অনেক সুফল বিনষ্ট হয়ে যাবে। রাষ্ট্র গভীরতর সংকটে নিপতিত হবে, যা কারো কাম্য নয়।
লেখক : রাজনীতিবিদ
No comments