৫ম ও ৮ম সংশোধনীর কলঙ্কমুক্ত বাহাত্তরের সংবিধান চাই by শাহরিয়ার কবির
বাঙালী জাতির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভু্যদয় নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এর পর সবচেয়ে গৌরবের প্রাপ্তি হচ্ছে '৭২-এর সংবিধান।
যদিও এই সংবিধান প্রণয়ন এবং গ্রহণ করতে এগারো মাসেরও কম সময় লেগেছিল_ এতে মূর্ত হয়েছে বাঙালীর সুদীর্ঘকালের স্বপ্ন ও আকাঙ্গা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন। ৩০ ল শহীদের মহান আত্মোৎসর্গে উজ্জ্বল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরব বৃদ্ধি পেয়েছে '৭২-এর সংবিধানে বর্ণিত মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও চেতনার কারণে। যেসব দেশ রক্তয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক অথবা প্রায় ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলের নিগড় থেকে মুক্তি লাভ করেছে অথবা এখনও মুক্তি সংগ্রামে নিয়োজিত_ অধিকাংশের প্রত্যাশা, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত। এই তিনটি বিষয় হচ্ছে স্বাধীনতার অপরিহার্য শর্ত ও অনুষঙ্গ। তবে এই শর্ত পূরণ হলেই স্বাধীনতা অর্থবহ হয় না, জনগণের সার্বিক মুক্তিও অর্জিত হয় না। স্বাধীনতাকে অর্থবহ এবং জনগণের সার্বিক মুক্তি নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের স্থির করতে হয় রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন। স্বাধীনতা লাভের পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের দর্শন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা মূর্ত হয়েছে '৭২-এর সংবিধানে।পশ্চিমের শিল্পোন্নত, সম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলোর তুলনায় অনেক পশ্চাতে অবস্থানকারী বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেতা। তুলনামূলকভাবে পশ্চাৎপদ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ ধর্মনিরপেতাকে শুধু রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেনি, ধর্মনিরপেতার বোধ সর্বেেত্র নিশ্চিত করার জন্য ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল অথবা যে কোন প্রতিষ্ঠান গঠন সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে গণতন্ত্র, যার মূলকথা জনগণের সার্বভৌমত্ব। সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করা হয়েছে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান দূর করে বৈষম্যহীন, সমতাভিত্তিক সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য। '৭১-এ যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপ ছিল, যারা পাকিসত্মানের মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক দর্শনের অনুসারী ছিল তারা প্রথম সুযোগেই '৭২-এর সংবিধান থেকে মুছে ফেলেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
'৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিসত্মানী দখলদার বাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞের সহযোগী ছিল, যারা পাকিসত্মানের অখ-তা ও ইসলাম রার দোহাই দিয়ে রাজাকার-আলবদর- আলশামস প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী গঠন করে সক্রিয়ভাবে গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেছে তাদের মতে, '৭১-এ কোন মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়নি। এটি ছিল 'গৃহযুদ্ধ', পাকিসত্মানী সামরিক জানত্মার সঙ্গে 'ভারতের এজেন্ট' আওয়ামী লীগের কমর্ী ও সমর্থকদের লড়াই, যার সুযোগ নিয়ে ভারত তাদের 'এজেন্ট'দের সাহায্যে পাকিসত্মান ভেঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। '৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরম্নদ্ধে ছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের মতো রাজনৈতিক দলসমূহ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ছিল। জামায়াতের শীর্ষ নেতারা পাকিসত্মান, সৌদি আরব ও ব্রিটেনে ঘাঁটি গেড়ে 'পূর্ব পাকিসত্মান পুনরম্নদ্ধার কমিটি' গঠন করেছিল। বাকিরা ভোল পাল্টে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কার্যক্রমে সক্রিয় ছিল। এদের অনেকে আওয়ামী লীগেও ঢুকেছিল আত্মীয়তা ও অন্যান্য সম্পর্কের সুবাদে। যার ফলে আওয়ামী লীগের ভেতর মিত্র ও প্রশ্রয়দাতা পেতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক প্রতিপ বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বেগ পেতে হয়নি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ। এর পাশাপাশি মোজাফফর ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ভাসানী ন্যাপের একাংশসহ কয়েকটি বামপন্থী আঞ্চলিক দল মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন কয়েকটি স্থানীয় গেরিলা দলও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। রাজনৈতিক দলের কমর্ী ও সমর্থকরা দলীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তবে মুক্তিবাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁরা মূলত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মুক্তিবাহিনীর শতকরা ৯০ ভাগ সদস্য ছিলেন গ্রামের কৃষক ও শ্রমজীবী পরিবারের সদস্য, যাঁদের বয়স ছিল তিরিশের নিচে। তাঁদের স্বপ্ন ছিল বিজাতীয়দের শাসন-শোষণমুক্ত একটি স্বাধীন সার্বভৌম অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক, কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকরা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ধমর্ীয় দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে দ্বিখ-িত করে পাকিসত্মান সৃষ্টি করেছিল। পাকিসত্মান প্রতিষ্ঠার পেছনে বাংলাদেশের মুসলমানদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ। কারণ সেই সময় গোটা ভারতবর্ষে মুসলিম লীগ মতায় ছিল শুধু বাংলায়। তবে পাকিসত্মান সম্পর্কে বাঙালীর মোহভঙ্গ হতে ছ'মাসের বেশি সময় লাগেনি। ১৯৪৮-এর ফেব্রম্নয়ারিতে আইনসভার অধিবেশনে বাংলাকে পাকিসত্মানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেছিলেন পূর্ব বাংলার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন পাকিসত্মানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রসত্মাবে পাকিসত্মানের প্রধানমন্ত্রী বিচ্ছিন্নতার গন্ধ আবিষ্কার করেছিলেন। এই প্রত্যাখ্যানের ভেতর দিয়েই পাকিসত্মান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রটির মৃতু্যঘণ্টা বেজেছিল এবং সূচিত হয়েছিল ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন।
ভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে বাঙালী জাতির সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামকে পাকিসত্মানী শাসকরা আখ্যায়িত করেছিল পাকিসত্মানের অখ-তা ও ইসলামবিরোধী ভারতীয় চক্রানত্ম হিসেবে। পাকিসত্মানী শাসক এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীরা '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকেও একইভাবে পাকিসত্মান ও ইসলামবিরোধী ভারতীয় চক্রানত্ম বলেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ছিল তাদের বিবেচনায় 'দুষ্কৃতকারী', 'ভারতের চর' ও 'ইসলামের দুশমন'। জামায়াতের নেতা গোলাম আযম তখন বলেছিলেন, পাকিসত্মান না থাকলে দুনিয়ার বুকে ইসলামের নাম-নিশানা থাকবে না। জামায়াত মনে করে, 'পাকিসত্মান আলস্নাহর ঘর', পাকিসত্মান ও ইসলাম সমার্থক শব্দ। গণহত্যাকারী পাকিসত্মানী জেনারেল ইয়াহিয়া, টিক্কা, নিয়াজী, ফরমান আলীরা জামায়াতের বিবেচনায় আলস্নাহর ঘরের রক ইসলামের সিপাহসালার। '৭১-এর জামায়াতীরা ইসলামের নামে সকল প্রকার হত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞকে বৈধতা দিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পরও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বাংলাদেশবিরোধী চক্রানত্ম অব্যাহত ছিল। ১৯৭২-এর ৪ নবেম্বর গণপরিষদে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর সদ্য স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর তা যৌক্তিক কারণেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আক্রমণের প্রধান ল্যে পরিণত হয়। '৭২-এর সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি তাদের বিবেচনায় ছিল ইসলামবিরোধী ভারতীয় চক্রানত্ম। ধর্মনিরপেতাকে এখনও তারা মনে করে ধর্মহীনতা, যার সঙ্গে সত্যের কোন সম্পর্ক নেই। '৭২-এর সংবিধানে ধর্মনিরপেতা অনত্মভর্ুক্ত হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু বলেছেন_
"ধর্মনিরপেতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা আইন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের বাধা দিবার মতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দিবার মতো মতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধমর্ীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে_ আমি বলব, ধমর্ীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধমর্ীয় অধিকার রার ব্যবস্থা করেছি।" (গণপরিষদের ভাষণ, ১২ অক্টোবর ১৯৭২)
ধর্মনিরপেতার পাকিসত্মানপন্থী সমালোচকরা সব সময় বলেন, '৭২-এর সংবিধানে 'ধর্মনিরপেতা' ঢোকানো হয়েছে ভারতের সংবিধানের অনুকরণে। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় কখনও ধর্মনিরপেতার কথা বলা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে '৭০-এর নির্বাচনের আগেই ধর্মনিরপেতা সনি্নবেশিত করা হয়েছে। ষাটের দশকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালিত্বের যে চেতনা প্রবল হয়ে উঠেছিল তার প্রধান উপাদান 'ধর্মনিরপেতা'। পাকিসত্মান সৃষ্টির পর থেকে বাঙালীর সকল আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতিপ হিসেবে পাকিসত্মানী শাসকরা যেহেতু ধর্মকে দাঁড় করিয়েছিল; বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা যৌক্তিক কারণেই ধর্মনিরপেতা অবলম্বন করে বিকশিত হয়েছে। ধর্মের নামে হত্যা, ধর্ষণ, শাসন, শোষণ ও নির্যাতন বন্ধের জন্য '৭২-এর সংবিধানে 'ধর্মনিরপেতা'র অনত্মভর্ুক্তি জরম্নরী ছিল। পৃথিবীর বহু দেশের সংবিধানে 'ধর্মনিরপেতা'কে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্র তুরস্কে ১৯২৫ সালে ধর্মনিরপে সংবিধান গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের '৭২-এর সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিযুক্ত করার জন্য ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যা বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মনিরপে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের সংবিধানেও নেই। প্রকৃতপ েসমাজতান্ত্রিক শিবিরের বাইরে কোথাও সাংবিধানিকভাবে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়নি। ভারতবর্ষের সংবিধানে রাষ্ট্রের অন্যতম নীতি হিসেবে 'ধর্মনিরপেতা' ও 'সমাজতন্ত্র' অনত্মভর্ুক্ত হয়েছে ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংশোধনীর দ্বারা, যা বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হওয়ার চার বছর পর। যাঁরা বলেন, ভারতের সংবিধানের আদলে আমাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেতা সংযুক্ত হয়েছে তাঁরা হয় অজ্ঞ অথবা মতলববাজ।
'৭২-এর ৪ নবেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদে আমাদের ঐতিহাসিক সংবিধান গৃহীত হওয়ার প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অনন্যাসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন। এই ভাষণে তাঁর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মূর্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ শেষ করেছেন এই বলে_ "আজ আবার স্মরণ করি আমার জীবনের বিপদসমূহের কথা যেসব থেকে আমি উদ্ধার পেয়েছি; কিন্তু তা সত্ত্বেও আজকে আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন, সে আনন্দ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এই শাসনতন্ত্রের জন্য কত সংগ্রাম হয়েছে এই দেশে। আজকে আমার দল যে ওয়াদা করেছিল তার এক অংশ পালন করল_ কিন্তু জনতার শাসনতন্ত্রে কোন কিছু লেখা হয় না। তারা এটা গ্রহণ না করলে প্রবর্তন করা হবে না, ব্যবহার না করলে হবে না। ভবিষ্যত বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ গঠন করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থক, শহীদের রক্তদান সার্থক।"
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘাতকরা হত্যা করেছে '৭২-এর সংবিধানে বর্ণিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। জেনারেল জিয়া ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেতাবাদ দিয়ে প্রসত্মাবনার উপরে 'বিসমিলস্নাহ...' এবং ভেতরে 'সর্বশক্তিমান আলস্নাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' সংযোজন করে একটি অনন্যসাধারণ রাষ্ট্রীয় দলিলকে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক দলিলে রূপানত্মর করেছেন। '৭২-এর সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা মুছে ফেলা কোন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল কোন বাঙালীর প েসম্ভব নয়। জিয়া '৭১-এ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, 'জেড' ফোর্সের অধিনায়কও ছিলেন বটে, তবে '৭২-এর সংবিধান থেকে 'ধর্মনিরপেতা' ও 'বাঙালী জাতীয়তাবাদ' মুছে ফেলে নিজেকে তিনি স্থান করে দিয়েছেন স্বাধীনতাবিরোধী পাকিসত্মানপন্থী জামায়াত ও মুসলিম লীগের পঙ্ক্তিতে। '৭২-এর সংবিধানের প্রসত্মাবনা থেকে 'জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম'-এর পরিবর্তে 'জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ' স্থাপন একই রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির অনত্মর্গত। '৭২-এর সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন মুছে ফেলার জন্যই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের শত্রম্নরা যখনই মতায় গিয়েছে কিংবা সুযোগ পেয়েছে তখনই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা বিকৃত ও বিনষ্ট করতে চেয়েছে।
জেনারেল জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির 'পাকিসত্মানীকরণ' ও সাম্প্রদায়িকীকরণ নীতি অব্যাহত রেখেছিলেন তাঁর উত্তরসূরি জেনারেল এরশাদ। মৌলবাদীদের সমর্থন লাভের জন্য তিনি সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে 'রাষ্ট্রধর্ম' বানিয়েছেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিন করেছেন রবিবারের পরিবর্তে শুক্রবার। এ কথা আমরা বহুবার বলেছি_ ধমর্ীয় বিশ্বাস থাকে মানুষের। ইতর প্রাণী বা জড়বস্তুর কোন ধর্ম থাকে না। রাষ্ট্র নামাজ পড়তে পারে না, রোজা রাখতে পারে না, হজে যেতে পারে না, মরার পরে বেহেশতে বা দোযখেও যায় না। রাষ্ট্রের প েইসলাম বা অন্য কোন ধর্ম পালন করা সম্ভব নয়। যে দুই জেনারেল '৭২-এর সংবিধানের 'ইসলামীকরণ' করেছেন তার সঙ্গে ধর্মপ্রীতি কিংবা ইসলামপ্রীতির কোন সম্পর্ক নেই। এ কাজ করা হয়েছে অসাংবিধানিকভাবে দখলকৃত মতা ধরে রাখার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলে বাংলাদেশে পাকিসত্মানী আদর্শ ও মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার মতলবে। দু'টি ব্যতিক্রম ছাড়া যেসব মুসলিমপ্রধান দেশে সামরিক বাহিনী মতায় গিয়েছে তারা মতায় টিকে থাকার জন্য সব সময় ধর্মের দোহাই দিয়ে মৌলবাদী মোলস্নাদের সমর্থন নিয়েছে।
মোলস্নারা আদর্শগতভাবে গণতন্ত্রবিরোধী ও সমরতন্ত্রপ্রিয়। বাংলাদেশ ও পাকিসত্মানে মৌলবাদীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদী গণতন্ত্রকে মনে করেন বিজাতীয় ও কুফরি মতবাদ। তিনি ও তার দল সৌদি আরবের ওহাবীবাদের অনুসারী, রাজনৈতিকভাবে নাৎসীবাদ ও ফ্যাসিবাদের পূজারী। মওদুদী ও তার দল জামায়াতে ইসলামী মনে করে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, খ্রীস্টান প্রভৃতি ধর্মের মতো ইসলাম কোন ধর্ম নয়। মওদুদী এবং তার দলের মতে, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, একটি রাজনৈতিক দল, যে দলের ল্য হচ্ছে সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রমতা দখল। জামায়াত মুক্তচিনত্মা, বিবেকের স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতার কিছুই বিশ্বাস করে না। জামায়াতের এই জিহাদে যারা একবার শামিল হয় তারা আর ফিরে আসতে পারে না। কেউ জামায়াত পরিত্যাগ করতে চাইলে তাকে হত্যা করা হয় 'মুরতাদ' আখ্যা দিয়ে। মওদুদীর ইসলামে যারা বিশ্বাস করে না, জামায়াতের পরিভাষায় তারা মুরতাদ, যার শাসত্মি মৃতু্যদ-_ 'ওয়াজেবুল কোতল।'
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট মতায় এসে যখনই '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং '৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের কথা বলেছে, তখন থেকে জামায়াত এবং তাদের সহযোগীরা একে প্রতিহত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কখনও রাজনীতির নামে, কখনও ধর্মের নামে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে। একইভাবে '৭২-এর সংবিধানের বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা যথারীতি ইসলাম বিপন্নের জিগির তুলেছে। জামায়াত ও তাদের মৌলবাদী দোসরদের আশ্বসত্ম করার জন্য আইনমন্ত্রী যদিও বলেছেন, '৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেলেও সংবিধানের উপরে 'বিসমিলস্নাহ' থাকবে, এবং 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম'ও থাকবে_ তাতে কোন ফল হয়নি। '৭২-এর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকলে কোন্ যুক্তিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে, কোন্ যুক্তিতে রাষ্ট্র ধর্মনিরপে হবে এসব আমাদের বোধগম্যের অতীত। আইনমন্ত্রী বা মহাজোট সরকারের নীতিনির্ধারকরা মৌলবাদীদের তুষ্ট করার জন্য '৭২-এর সংবিধানে 'বিসমিলস্নাহ' কিংবা রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের গোঁজামিল দিতে পারেন, তাতে ভবি ভুলবে না। গত ১৫ জানুয়ারি (২০১০) জামায়াতী এবং আপাত জামায়াতবিরোধী সব মৌলবাদী একজোট হয়ে আইনমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে। কারণ তিনি শুধু বলেছিলেন, ৫ম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চতর আদালত যে রায় দিয়েছে তা কার্যকর হলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
জামায়াত অত্যনত্ম সুপরিকল্পিতভাবেই বাংলাদেশে '৭১-এর কায়দায় হত্যা ও সন্ত্রাস আরম্ভ করেছে। তারা জানে মাথার ওপর 'আইএসআই' ও বিএনপির মতো ছাতা থাকলে এবং প্রশাসনে তাদের লোকজন বহাল থাকলে মহাজোট সরকারের হম্বিতম্বি কোন কাজে আসবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের েেত্র কালপেণের কারণ যাই হোক না কেন, এই বিলম্বের ফলে পায়ের নিচের হারানো জমিন জামায়াত-শিবির আবার দখল করছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রহত্যা এবং ছাত্রদের হাত-পায়ের রগকাটার মাধ্যমে জামায়াত জেহাদী অভিযান পূর্ণোদ্যমে আরম্ভ হয়েছে। জামায়াত এবার আটঘাট বেঁধেই মাঠে নেমেছে। ১৩ ফেব্রম্নয়ারি (২০১০) জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে একানত্ম বৈঠকে তাদের রণনীতি ও কৌশল চূড়ানত্ম করেছেন।
আইনমন্ত্রী যতই ভাবুন না কেন, 'বিসমিলস্নাহ' ও 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম'-এর কথা বলে তিনি মৌলবাদী কাল সাপদের বশ করতে পারবেন না। জামায়াতীরা যাবতীয় নৃশংসতার দ্বারা বার বার প্রমাণ করেছে, তাদের কোনভাবে বশীভূত কিংবা সংশোধন করা যায় না। সুযোগ পেলেই তারা ছোবল মারে। রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ছাত্র হত্যার পর আবারও সকল মহল থেকে জামায়াত-শিবির চক্রের সন্ত্রাসী রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবি উঠেছে। ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সন্ত্রাসীরা যখন ছাত্রমৈত্রীর রীমুকে হত্যা করেছিল তখন জাতীয় সংসদে মতাসীন বিএনপি এবং আওয়ামী লীগসহ সকল বিরোধী দল জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলেছিল। রাষ্ট্র পরিচালনার েেত্র কতগুলো গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যা সরকার ও বিরোধী দলকে একমত হয়েই সিদ্ধানত্ম নিতে হবে। কেউ যদি বাংলাদেশের সংবিধান অগ্রাহ্য করে সে বাংলাদেশের নাগরিক থাকতে পারে কি-না, এটা কোন বিতর্কের বিষয় হতে পারে না। একইভাবে গণতন্ত্রের নামে হত্যা ও রগকাটাকে বৈধতা দেয়া যায় না। বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে, বাংলাদেশের অসত্মিত্বকে চ্যালেঞ্জ করা চলবে না। গণতন্ত্রের নামে নাৎসীবাদ ও ফ্যাসিবাদকে কিংবা ধর্মের নামে হত্যা ও সন্ত্রাসকে বৈধতা দেয়া যাবে না।
বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকতে চাইলে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধ ও সন্ত্রাসের দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে বিএনপির জোট যতদিন টিকে থাকবে ততদিন জামায়াত-শিবিরের যাবতীয় হত্যা, সন্ত্রাস ও দুষ্কর্মের দায় বিএনপিকে বহন করতে হবে। ধর্মের নামে হত্যা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হলে, আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়তে হলে ৫ম ও ৮ম সংশোধনীর কলঙ্কমুক্ত বঙ্গবন্ধুর '৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে। '৭২-এর সংবিধানে আদিবাসীদের অধিকার ও স্বাতন্ত্র্যের মর্যাদার স্বীকৃতিসহ কিছু সংশোধনীর প্রয়োজন আছে বটে। কিন্তু এই অনন্যসাধারণ দলিলের প্রসত্মাবনা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির কোন বিকল্প নেই। এতে কোন রকম গোঁজামিলের সুযোগ নেই। মহাজোট সরকার এই সত্য যত দ্রম্নত উপলব্ধি করবে, দেশ ও জাতির জন্য তা মঙ্গলজনক হবে।
১৫ ফেব্রম্নয়ারি ২০১০ তারিখে অনুষ্ঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটি সেমিনারে পঠিত
No comments