বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের পরই এডিপি সংশোধন- পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন ॥ জানুয়ারির পর আর অপেক্ষা নয়- ও. কাদের by হামিদ-উজ-জামান মামুন
পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের পরই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) সংশোধন করবে সরকার। কেননা দেশীয় অর্থায়নে করতে হলে সে অনুযায়ী বরাদ্দ নির্ধারণ করতে হবে।
অর্থাৎ আরএডিপির আকার বাড়বে। যদি বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে রাজি হয় তাহলে বরাদ্দ অনেকটাই কাটছাঁট করা হবে। আর এ কারণে বর্তমানে সংশোধন প্রক্রিয়াও এগুচ্ছে ধীর গতিতে। এমনই তথ্য পাওয়া গেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, পদ্মা সেতুর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পদ বরাদ্দ দিতে পারছে না। ফলে এডিপি সংশোধন প্রক্রিয়া চলছে খানিকটা ঢিমেতালে। সম্পদ বরাদ্দ না পেলেও আরএডিপিতে নতুন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এ জন্য ২৩ থেকে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত চারদিনের সিরিজ বৈঠক করা হয়েছে। তা ছাড়া নিজস্ব অর্থায়নের একটি রূপরেখাও তৈরি করে রেখেছে পরিকল্পনা কমিশন। অন্যদিকে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিকল্প অর্থায়ন না হলেও জানুয়ারির পর বিশ্বব্যাংকের জন্য আর অপেক্ষা করব না। এ সরকারের মেয়াদে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের মূল কাজ শুরু হবে। বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।যোগাযোগমন্ত্রী আরও বলেন, সম্ভাব্য নির্মাণ কাজ শুরুর সময় আগামী অক্টোবর ধরে প্রস্তুতিমূলক কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা বসে নেই। তবে বিকল্প অর্থায়নের বিষয়ে না করেননি বলেও উল্লেখ করেন তিনি। যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি, এ সরকারের মেয়াদেই পদ্মা সেতুর মূল নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এক প্রশ্নের জবাবে পদ্মা সেতুর বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীও দেখাশোনা করছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে বসেছেন। বৃহস্পতিবার বসার কথা আছে। এখানে অর্থমন্ত্রীও বিচ্ছিন্ন কেউ নন। ফেব্রুয়ারিতেই গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংকের চ্যাপ্টার ক্লোজড। বৃহস্পতিবারই তো ৩১ জানুয়ারি।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের (২০১২-১৩) মোট ৫৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) ঘোষণা করে সরকার। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ৩৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাস্তবায়নের হার শতভাগ করতে এ বছর আগেভাগেই এডিপি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ প্রেক্ষিতে বেশ জোরেশোরেই কাজ শুরু করে পরিকল্পনা কমিশন। ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বৈদেশিক সহায়তার অংশ নির্ধারণ করতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে কী পরিমাণ অর্থ কাটছাঁট হবে তা নির্ধারণ করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক সহায়তা অংশে বাদ দেয়া হতে পারে। অন্যদিকে সরকারী তহবিলের বরাদ্দ কী পরিমাণ কমবে বা বাড়বে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত চেয়ে গত ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে চিঠি পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। আশা করা হয়েছিল দ্রুত সম্পদ কমিটির বৈঠক করে সংশোধিত এডিপির জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া হবে জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যেই। কিন্তু সে রকম কোন উদ্যোগ না দেখে গত সপ্তাহে তাগাদা দিয়ে আবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু জানুয়ারি মাস শেষ হয়ে গেলেও সম্পদ কমিটির বৈঠক ডাকা হয়নি। সংশোধিত এডিপিতে অর্থ বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, এর মূলে রয়েছে পদ্মা সেতু।
সূত্র জানায়, বর্তমানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে পদ্মা সেতুর জন্য মোট বরাদ্দ রয়েছে ৮০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারী নিজস্ব তহবিলের ৫৭২ কোটি এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ২৩২ কোটি টাকা। যদি বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করে আর যদি সরকারী অর্থেই পদ্মা সেতু করতে হয় তাহলে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়তে পারে। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করলে সে ক্ষেত্রে সংশোধিত এডিপি হতে পারে মোট ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক অংশে ৩ হাজার এবং সরকারী অংশে ২ হাজারসহ মোট ৫ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করে বাদ দেয়া হতে পারে। সরকারের নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু করতে হলে সংশোধিত এডিপি করা হতে পারে মোট ৫২ হাজার কোটি টাকার। আর সে কারণেই অপেক্ষা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, যদি নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু করতে হয় সে ক্ষেত্রে এর আগে উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দের ব্যয় না হওয়া অর্থ পদ্মা সেতু প্রকল্পে খরচ করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। আন্তর্জাতিক বা বাইরের উৎস থেকে অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো তৈরির মূল কাজ চলতি অর্থবছরেই শুরু করার একটি রূপরেখাও তৈরি করেছিল পরিকল্পনা কমিশন। ২০১২ সালের ৯ জুলাই মন্ত্রিসভা বৈঠকের সিদ্ধান্ত এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে প্রণীত এ পরিকল্পনায় চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) ৪১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মোট বরাদ্দের ৫ শতাংশ অর্থ কেটে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া অনুন্নয়ন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অর্থ কাটছাঁট করে তা পদ্মা সেতু প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকারের সভাকক্ষে ২০১২ সালের ১৭ জুলাই পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যদের এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয় ওই সভায় শুরুতে আইএমইডি সচিব মোজাম্মেল হক খান নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, আগামী চার বছরে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। চলতি অর্থবছরে প্রকল্পে প্রয়োজন তিন হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এ অর্থ যোগাতে এডিপিতে অব্যয়িত ৫ শতাংশ অর্থ পদ্মা সেতুতে বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। তবে অগ্রাধিকার খাতগুলো কাটছাঁট থেকে বিরত রাখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কৃষি, বিদ্যুত ও যোগাযোগ খাত থেকে কোন অর্থ নেয়া যাবে না। বাকি ৪১ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে ৫ শতাংশ অর্থ কেটে নিলে মোট এক হাজার ৩৯ কোটি টাকায় উঠবে। আর চলতি অর্থবছরে পদ্মা সেতু প্রকল্পে সরকারী কোষাগার থেকে ৫৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা আছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে এ প্রকল্পে মোট এক হাজার ৬১১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। বাকি অর্থ সরকারের অন্য কোন উৎস বা এডিবি, জাইকা ও আইডিবি থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে। সভায় সর্বসম্মতভাবে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে আইএমইডি সচিব মোজাম্মেল হক খান বুধবার জনকণ্ঠকে জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে শুরু করতে পরিকল্পনা কমিশন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। কমিশন সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। তবে এখন পর্যন্ত কোন সরকারী নির্দেশনা পাননি বলে জানান তিনি।
No comments