বীরাঙ্গনা ৭১ by মুনতাসীর মামুন
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে পূর্ব বাঙলার স্বাধীনতাকামী মুক্তিকামী নিরস্ত্র জনগণের ওপর সুপরিকল্পিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
শুরু করে নির্বিচারে গণহত্যা এদেশের শহরে, নগরে, বন্দরে ও গ্রামে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আপামর জনগণ তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। সেই সঙ্গে শুরু করে এদেশের নিরপরাধ মা বোনদের ওপর পাশবিক নির্যাতন। পাকিস্তানীদের সহযোগী জামায়াতে ইসলামের কর্মী যাদের অধিকাংশ ছিল দালাল, রাজাকার, আলবদর ব্যক্তিস্বার্থে বাংলার অসংখ্য নারীকে তুলে দিয়েছিল পাক সেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য। পাশবিক লালসা নিরারণের জন্য। এক হিসেবে বলা হয়েছে অন্তত ৬ লক্ষ বিভিন্ন বয়সের নারী হানাদারদের হাতে চরমভাবে নিগৃহীত হয়েছে; অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছে। তাঁদের নির্মম অত্যাচারে বহু নারীর জীবন প্রদীপ নিভে গেছে, কেউ হয় অন্তঃসত্ত্বা।বাংলাদেশ সরকার এদেশের ‘বীরাঙ্গনা’ অভিধা দেয় এবং স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্যাতিতাদের সব সময় ‘বীরাঙ্গনা’ বলে সম্মানিত করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুন ভুলে যাওয়া সেসব বীরাঙ্গনার মর্মস্পর্শী গাথা তুলে ধরেছেন। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপ্রকাশিত/ প্রকাশিত ৯০ বীরাঙ্গনার বয়ান।
‘বীরাঙ্গনা’ বই আকারে এবারের একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে। উক্ত বইয়ের নির্বাচিত অংশ আজ থেকে ধারাবাহিক চতুরঙ্গ পাতায় ছাপা হচ্ছে।
যুদ্ধে সবচেয়ে বিপন্ন নারী। যখন থেকে পৃথিবীতে যুদ্ধ শুরু হয়েছে তখন থেকেই নারীরা বিপন্ন। পরাজিতদের ওপর আক্রোশ মেটানোর জন্য বিজয়ীরা লুটপাট, হত্যার সঙ্গে ধর্ষণের বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেয়। নারী ধর্ষিত হয়, লুণ্ঠন করা হয়, যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সবশেষে আশ্রয় মিলে হয়ত গণিকালয়ে। আমাদের নবী (দ.) থেকে জেনেভা কনভেনশন সবখানে যুদ্ধের কিছু নিয়মনীতি বেঁধে দেয়া হয়েছিল। নারী এবং শিশু নির্যাতন যাতে না হয় সে বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু কেউ মানেনি। সভ্য বলে যারা নিজেদের দাবি করে তারাও না। আক্রমণকারীরা দমন করার জন্য সাধারণত দুটি অস্ত্র একই সঙ্গে ব্যবহার করে, একটি গণহত্যা, অপরটি ধর্ষণ। ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানী সেনারা যেখানে গিয়েছে। সেখানেই গণহত্যা ও ধর্ষণ চালিয়েছে। জাপানীদের ‘নানকিং ম্যাসাকার’ তো বিখ্যাত। চীন ও কোরিয়ায় জাপানীরা শুধু গণধর্ষণই নয়, নারীদের বন্দী করে রেখেছে যৌনদাসী হিসেবে, আধুনিক ভাষায় যাদের কমফোর্ট উইম্যান হিসেবে অভিধা দেয়া হয়েছে। জাপানীরা শুধু চীন কোরিয়াতেই নয়, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনসেও একই কাজ করেছিল। একই সময় বেলজিয়াম ও ফ্রান্সে জার্মান বাহিনী, একই ধরনের কাজ করেছে। ১৯৭১ সালের আরও পরে বসনিয়ায় সার্বীয় বাহিনী, রুয়ান্ডায় টুটসিদের ওপর হুতুদের হত্যা ও ধর্ষণের কথা সুবিদিত। অন্তিমে, কোন জাতিকেই দমন করা যায়নি, কিন্তু অজস্র নারীর জীবনে নেমে এসেছে হাহাকার।
১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালী মহিলাদের সঙ্গে একই ব্যবহার করেছিল। গণহারে বাঙালী নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছিল। এনিয়ে অনেক তত্ত্বকথা আওড়ানো যেতে পারে। তাত্ত্বিক কাঠামো ও নির্মাণ করা যেতে পারে কিন্তু সব কথার মূল কথা, বাঙালীদের দমনের জন্য হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ও তার সহযোগী রাজাকার, শান্তি কমিটির সদস্য, আলবদর, আলশামস (অধিকাংশ জামায়াতই ইসলামী ও মুসলিম লীগের সদস্য এবং অবাঙালী) দুটি অস্ত্র ব্যবহার করেছেÑ হত্যা, গণহত্যা ও ধর্ষণ। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় এবং অনেক গবেষকও মনে করেন ধর্ষণে পাকিস্তানীদের সমকক্ষ কেউ নয়। ’৭১-এ এদেশের নারীদের ওপর যৌন নির্যাতনের ব্যাপকতা এককযুদ্ধ ও সময়ের হিসেবে পৃথিবীতেও সংঘটিত সকল যৌন নির্যাতনের শীর্ষে পাকিস্তানীরা যে বাঙালীদের দমন করার জন্য পূর্বপরিকল্পিতভাবে গণহত্যা ও ধর্ষণ করেছিল তা তাদের বিভিন্ন অসতর্ক মন্তব্য ও নথিপত্র পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়। কোন পাকিস্তানী জেনারেল বা নীতি-নির্ধারক বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করেননি, তাতে কিছু আসে যায় না বরং তারা যে মিথ্যাবাদী সেটি প্রমাণিত হয়। তবে বিভিন্ন জনের সাক্ষাতকার বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানে ধর্ষণের বিষয়টি পর্যালোচনা করা যাক।
২৫ মার্চ রাতে (১৯৭১) ‘অপারেশন সার্চলাইট’ কার্যকর করেন মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা। অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি ও রাও ফরমান আলী। সম্প্রতি ১৯৭১ সাল নিয়ে লেখা খাদিমের আত্মস্মৃতি প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি দুটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
১০ এপ্রিল একটি সভায় জেনারেল নিয়াজি উপস্থিত। সেখানে তিনি অকথ্য ভাষায় বাঙালীদের গালিগালাজ করতে লাগলেন এবং একপর্যায়ে উর্দুতে বললেন, ‘ম্যায় ইস হারামজাদি কওম কী নাসাল বদল দুন গা। ইয়ে মুঝে কীয়া সামঝতি হ্যায়।’ (তারা আমাকে চেনে না। আমি এ হারামজাদা জাতির চেহারা বদলে দেব।)
পরের দিন খাদিম ঢাকা ছেড়ে যাবেন। নিয়াজিকে ব্রিফ করবেন। নিয়াজি তাকে এসে বললেন, ‘ইয়ার, লড়াই কী ফিকার নাহি করো, উইতো হাম কার লাই গে। আভিতো মুঝে বেংগালি গার্ল ফ্রেন্ডস কা ফোন নাম্বার দে দো’ (দোস্ত, যুদ্ধ নিয়ে মাথা ঘমিয়ো না। এখন বরং তোমার বাঙালী বান্ধবীদের ফোন নাম্বারগুলি আমাকে দাও।)
এর চারদিন পরই নিয়াজি একটি গোপন চিঠি পাঠান সব কমান্ডারদের কাছে। চিঠির মূল বিষয় ছিল সৈন্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, বিভিন্ন জায়গায় লুট ও খুন চলছে কোন কারণ ছাড়া। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন জায়গা থেকে ধর্ষণের খবর আসছে এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানীরা রেহাই পাচ্ছে না। ১২ এপ্রিল, দুজন পশ্চিম পাকিস্তানী মহিলা ধর্ষিত হয়েছেন এবং আরও দুজনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। লুটের মাল পাঠানো হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। নিয়াজি লিখেছেন, তার সন্দেহ অফিসাররাও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত। এসব কার্যকলাপ সৈন্যদের দক্ষতা কমিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, এক সময় তাদের মহিলারাও আক্রান্ত হতে পারেন।
তার ভাষায় : It is not uncommon in history, when a battle has been lost because troops were over indulgent in loot and rape’
সতর্ক করে দিয়ে কমান্ডারদের তিনি জানিয়েছেন, কেউ যদি এ ধরনের কার্যকলাপে লিপ্ত হয় তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।
নিয়াজির চিঠি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে যে, যিনি নিজের ধর্ষণে আগ্রহী তিনি আবার এ চিঠি লিখেছেন কীভাবে? কারণ একটিই। লুট ও ধর্ষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, সৈন্যদের শৃঙ্খলা আর থাকছিল না। সে জন্যই এ চিঠি । কিন্তু তিনি নিজে বাঙালীদের চেহারা বদলে দেয়ার জন্য বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করেছেন। গোপন এক প্রতিবেদনে দেখা যায় তিনি লিখেছিলেন আরও হত্যা চালাতে হবে।
There must be more killing, more mopping up and more witch huntingপাকিস্তানের হায়দ্রাবাদ থেকে মেজর আফজাল খান সকিব যশোরে কর্মরত তার বন্ধু সেনা অফিসার ইকরামকে লিখেছিলেন-
‘প্রিয় বন্ধু ইকরাম
...আমি এ খবরে অবাক হই যে, রশিদ বাঙালী বাঘিনীদের পোষ মানিয়েছে।’ তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অবশ্যই পরিবর্তন করা প্রয়োজন।... হয়ত যেকোন দিন তুমি ফজল বা আমাকে ওখানে খুঁজে পাবে। এ সময়ের মধ্যে তুমি সাবধানে সেখানে কিছু বন্য কুকুরীকে পোষ মানাবার পরিকল্পনা করো। তুমি কি অজানা আতঙ্কের সঙ্গে প্রতিদিন তোমার বিছানা, চেয়ার টেবিল এবং ড্রয়ার পরীক্ষা করো? যদি না করো তাহলে এখন থেকেই তোমার তা করা উচিত। তোমার ভৃত্য ইত্যাদি থেকে সাবধান থেকো যদি তারা ওই এলাকার হয়ে থাকে। খাদ্য গ্রহণের আগে তোমার খাবার বিড়াল ইত্যাদিকে দিয়ে আগে খাইয়ে পরীক্ষা করে নেবে। যখন হোটেল ইত্যাদি পরিদর্শনে যাবে তখন তোমার অবশ্যই সন্দিগ্ধ থাকা উচিত। আমি নিরুৎসাহিত করছি না। স্মারণ করিয়ে দিচ্ছি মাত্র।...
তোমার প্রিয়
সাকিব
১৯৭১ সালে যারা নীতি নির্ধারণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সে রকম অনেক পাকিস্তানীর সঙ্গে আলাপ করেছি। এর বাইরে সাংবাদিক, বামপন্থী রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও আলাপ হয়েছে। এদের মধ্যে একজন হলেন এমএ নকভী। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রখ্যাত কলামিস্ট। তাঁকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে নকভী অকম্পিত স্বরে বললেস, ‘পাকিস্তানী বাহিনী ছিল বিশৃৃঙ্খল, লুটেরা বাহিনী, এরা লুট করেছে। ধর্ষণ থেকে শুরু করে সব রকমের অপরাধ করেছে। এ সেনাবাহিনী কত বোধহীন ছিল তার প্রমাণ জেনারেল টিক্কা খানের ঢাকা থেকে ফেরার পর সাংবাদিকরা যখন লুট ও হত্যা নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন ধর্ষণের সংখ্যাটি অতিরঞ্জিত। মাত্র তিন হাজার মহিলা ধর্ষিত হয়েছে।’ ক্রোধে নকভীর গলার স্বর কাঁপছিল। টিক্কা, ইয়াহিয়া, নিয়াজি, ভুট্টো সবাই এর সঙ্গে যুক্ত।’ তিনি আরও বলেছিলেন, নিজ দেশের সৈন্য যদি নিজ দেশের একজন নারীকেও ধর্ষণ করে তাহলেও সেটি জঘন্য এক অপরাধ।
পাকিস্তানী এ নীতির কথা বলেছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় ঔপন্যাসিক মূলক রাজ আনন্দ। ১৯৭২ সালে তিনি যা বলেছিলেন, তাঁর মূল কথা হলো ‘নতুন একটি জাতি সৃষ্টির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীরা এ নীতি গ্রহণ করেছিল।’
[Rapes were so systematic and pervasive that they had to be conscius Army policy. Planned by the West Pakistanis in a deliberate effort to create a new race or to dilute Bengali nationalism.]
যুদ্ধোত্তর পুনর্বাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ডা. ডেভিস যার কথা পরে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছি। এক সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছিলেনÑ
‘প্রশ্ন : তারা নারী ধর্ষণের ব্যাপারটা কীভাবে জায়েজ করার চেষ্টা করেছে?
জেফ্রি : ওরে বাপস! তাদের ওপর টিক্কা খানের এক প্রকার আদেশ বা নির্দেশই ছিল যে, একজন সাচ্চা মুসলমান তার বাবা ছাড়া আর সবার সঙ্গেই লড়াই করবে। কাজেই তাদের যা করতে হবে তাহলো যতটা পারা যায় বেশিসংখ্যক বাঙালী নারীকে গর্ভবতী করা। এটাই ছিল তাদের কাজের পেছনের তত্ত্ব।’
আমরা যেসব কেস স্টাডিগুলোর বর্ণনা করেছি তাতে এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। দেখা যাবে, ধর্ষণগুলোর একটা প্যাটার্ন আছে। তবে যে বিষয়টি স্পষ্ট, তাহলো পাকিস্তানের দমন নীতির একটি হাতিয়ার ছিল ১. ধর্ষণ ২. ধর্ষণের মাধ্যমে ‘নতুন জাতির সৃষ্টি’ যাতে বাঙালী জাতীয়তাবাদ আর মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে; ৩. কলোনির অধস্তন মানুষ হিসেবে যেনতেন ব্যবহার। যেন মানুষ মানুষ নয়, সামগ্রী মাত্র; ৪. জৈব আকাক্সক্ষা মেটানোর রাস্তা এবং এক রকম প্রতিশোধ স্পৃহা যা প্রথম ও দ্বিতীয়টির সম্পূরক। (চলবে)
No comments