আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন ও বিচার বিশ্বে মানবতাবিরোধী বিচারের মান নির্ধারণ by মুনতাসীর মামুন
রাজশাহীর মতো শিবির-অধ্যুষিত জায়গায় এমন একটি আলোচনাসভা নির্বিঘেœ শেষ হতে পারে, তাও আবার খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ে তা অনেকের কল্পনার বাইরে ছিল। বিষয়টি ছিল গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ। স্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হল।
কানায় কানায় তা প্রায় পূর্ণ। আয়োজক ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ। প্রধান বক্তা ছিলেন মফিদুল হক ও শাহরিয়ার কবির। শ্রোতাদের মধ্যে নবীন শিক্ষক থেকে নবীন কর্মকর্তা, আগ্রহী যুবক, মধ্যবয়সী পেশাজীবী সবাই ছিলেন। আইবিএসের কৃতিত্ব এই যে, এ বিষয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত কোন আলোচনা সভা করেনি। তারা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আর কী বলব! এগুলো এখন আমলাতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। দুয়ার তার বন্ধ। আদর্শের স্থান এখন ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের আদর্শের মতো স্বল্প। একটি উদাহরণ দিই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হটানো থেকে [সব ভিসি যে উত্তম কাজ করছেন তা তো নয়] অন্যান্য আন্দোলনে আওয়ামী-বিএনপি-জামায়াত শিক্ষকরা একজোট হয়ে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের অবদান ছিল প্রভূত। অথচ একটি জরিপ করে দেখুন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবচেয়ে কম গবেষণা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। যুদ্ধাপরাধ বিচার ও তা বানচালের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তাদের গলার স্বর খুব কমই শোনা যায়। ইতিহাস বিভাগগুলিতে বাংলাদেশ বিষয়ক কোর্সে ১৯৭১ সালের পর পড়ানো হয় না, যদিও ৪০ বছর হয়ে গেছে। কারণ, পড়ালে যদি জিয়া-এরশাদের নষ্টামির কথা পড়াতে হয়। আর কাকে কী বলবেন! জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট গত আওয়ামী আমলে খোলা হলো। শেষের দিকে তা বন্ধ করে দেয়া হলো। এই আওয়ামী আমল প্রায় শেষ, কিন্তু সেই ইনস্টিটিউট ইচ্ছে করে আর খোলা হলো না।আলোচনাসভায় মফিদুল হক ও শাহ্রিয়ারের প্রাঞ্জল আলোচনা আমাদের অনেক কিছু বুঝতে সহায়তা করেছে। মফিদুল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনটির ইতিহাস ব্যাখ্যা করছিলেন। কীভাবে বঙ্গবন্ধু আমলে আইনটি হয়েছিল এবং তাকে সাংবিধানিক সুরক্ষা দেয়া হয়েছিল। শাহরিয়ার যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক তার গ্রন্থে অবশ্য বিস্তৃতভাবে তা আলোচনা করেছেন। বিভিন্ন দেশের মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে একটি তুলনামূলক আলোচনা করে মফিদুল দেখালেন, আমাদের ট্রাইব্যুনাল কীভাবে অন্যগুলোর থেকে বৈশিষ্ট্যময় এবং ভাল। অপরাধীর রায় নিয়ে আমরা বিচলিত ও অধৈর্য। মফিদুল জানালেন, কম্বোডিয়ার ট্রাইব্যুনালের ৭ বছর হয়ে গেল, একটি বা দু’টি রায় তারা মাত্র দিতে পেরেছে। রুয়ান্ডার অবস্থা এর থেকে উত্তম নয়। আজ পর্যন্ত সরকারের নীতি নির্ধারকদের কেউ বা মন্ত্রীবর্গÑকেউ এমন প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
বিচারের মান নিয়েও আলোচনা হয়েছে। শাহরিয়ার বললেন, মার্কিন একজন পররাষ্ট্র সচিব কয়েকদিন পর পর জামায়াত লবিংয়ের কারণে এখানে এসে বিচারের স্বচ্ছতা ও মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আমেরিকা তো রোম স্ট্যাচুটরই স্বাক্ষর করেনি। গুয়ানতানামোর বিচার নিয়ে [আটক ও নির্যাতন] কথা তুললে আমেরিকার উত্তর কী হবে? মফিদুল হক একটি মন্তব্য করেছিলেন যা আমাদের ভাল লেগেছে, তা হলো ১৯৭৩ সালের আইনটি পরে অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক আদালত মডেল হিসেবে নিয়েছে। এই আইনে ধর্ষণকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যা আগে কখনও করা হয়নি। এই আইনে আসামি পক্ষকে যে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে তা অন্য কোন দেশের আইনে নেই। এই আইনে দ-প্রাপ্তকে সুপ্রীমকোর্টে আপীলের সুযোগ দেয়া হয়েছে যা যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক কোন আইনে নেই। এত স্বচ্ছতা কোথাও নেই। আমাদের কিছু লেফটি ও মধ্যরাতের বুদ্ধিজীবী ও সুজন প্রায়ই বলেন, বিচারে আপত্তি নেই, বিচার স্বচ্ছ হতে হবে। অবিকল বিএনপির নেতাদের ভাষা। আমরা আগেও বলেছি, বিচার এত স্বচ্ছ হচ্ছে যে, বিচারকরা এত ধৈর্য দেখাচ্ছেন যে, আসামি পক্ষকে এত সুযোগ দেয়া হচ্ছে যে, বিচার প্রক্রিয়া শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। মফিদুল আরও বললেন, এই আইন ও বিচার বিশ্বে একটি মান তৈরি করবে। আমরাও তাই মনে করি। যদি ট্রাইব্যুনালকে পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধা ও নিরাপত্তা দেয়া হতো তা হলে এই খাতে শেখ হাসিনা অনেক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারতেন। কিন্তু তা করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়। নির্মূল কমিটি বার বার দাবি করছে ট্রাইব্যুনালকে স্থায়ী রূপ দিয়ে আইন পাস করে তা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করতে এবং সাক্ষী সুরক্ষা আইন পাস করতে। শ্রোতাদের অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন, জানতে চেয়েছিলেন, জামায়াত বিএনপি বা সামরিক সরকার এলে তো ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়া হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে না। তখন কী হবে? বিভিন্ন সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, সাক্ষীরা এখন সাক্ষী দিতে আসছেন না। আসতে চাচ্ছেন না। কারণ, তারা আশঙ্কা করছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের যেভাবে হুমকি দিচ্ছে জামায়াত-বিএনপির নেতা কর্মীরা, আওয়ামী লীগ না থাকলে অবস্থা কী হবে! ১৯৭১ সালে কোনরকমে জান বাঁচলেও এবার তো আর তা বাঁচবে না। সুরক্ষা আইন করতে সরকারের অসীম উদাসীনতা অনেক প্রশ্ন ও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। মীর কাসেম আলীর ডলার কি এদিক ওদিক দিয়েও সরকারের কারো পকেটে যাচ্ছে? অবস্থা এখন কেমন তার একটি উদাহরণ দিই। এই জনকণ্ঠের রাজশাহী সংবাদদাতা আলোচনাসভায় আমার বক্তব্য উল্লেখ করে জানিয়েছেন, তিনি বলেছেন [মানে আমি] যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ নেই। এটি ছাপা হলে আপনারা নিশ্চয়ই ভাবতেন কাসেম আলীর ডলার আমার পকেটেও গেছে।
আলোচনাসভায় গণহত্যার সংজ্ঞা, সংখ্যা ইত্যাদি নিয়েও অনেক আলোচনা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার ধারা পরীক্ষা করলে দেখব, বেশি লেখা হয়েছে যুদ্ধ নিয়ে। বীরত্ব নিয়ে। গণহত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন, নারী লাঞ্ছনা নিয়ে লেখা হয়েছে কম। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, তা মনস্তাত্ত্বিক। চিরদিন আমরা শুনে এসেছি বাঙালী ভীরু, কাপুরুষ, বুজদিল। সেই বাঙালী দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ একটি সশস্ত্র বাহিনীকে হারিয়ে দিল! এর চেয়ে অসামান্য কাহিনী আর কী হতে পারে? বাঙালী বীরের জাতি। সুতরাং বীরত্ব গাথা অমর করে রাখতে হবে। কিন্তু সময়ের ধারে বীরত্ব গাথা এক সময় ক্ষয় হয়ে যায়। কিন্তু নিপীড়ন, অপমান, লাঞ্ছনা, হত্যার কাহিনী মানুষ মনে রাখে।
ইউরোপে ফ্যাসিবাদ বা নাজিবাদের উত্থান আর হলো না কেন? এর একটি কারণ গণহত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন, সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ নিয়ে অসংখ্য এবং অসাধারণ সব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, গ্রন্থ লেখা হয়েছে। হ্যাঁ, বীরত্বব্যঞ্জক চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। কিন্তু ঐ অপমান-নির্যাতন মানুষকে বার বার মনে করিয়ে দেয় নাজী বা ফ্যাসিস্টরা এলে কী হতে পারে! আমাদের এখানে নিপীড়ন, লাঞ্ছনা বা ধর্ষণের ঘটনা চেপে রাখা হয়েছে-বর্ণিত হয়নি। গণহত্যার কথা ধরুন। বঙ্গবন্ধু ৩০ লাখ শহীদের কথা বলার পর তা ব্যাপক প্রচার পায়। অ্যাপলজিষ্টরা বলেন, বঙ্গবন্ধু তো ইংরেজী খুব একটা বুঝতেন না। কী বলতে কী বলে ফেলেছেন। আমি বলি, পাকিস্তান আমলে আইন পরিষদে বঙ্গবন্ধু ইংরেজী ভাষায় বক্তৃতা করেছেন। বাংলায় আত্মজীবনী লিখেছেন। এরকম ইংরেজী অনেক সার্টিফিকেটধারীও বলতে পারেন না। অনেক শিক্ষক, হ্যাঁ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে বলছি, ও রকম বাংলা লিখতে পারবেন না। থ্রি মিলিয়ন বা ত্রিশ লাখ শহীদের কথা প্রথম লেখে প্রাভদা। আমি গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, এ সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি হবে। ধর্ষিতার সংখ্যা ধরা যাক। এক সময় বলা হতো ৪ লাখ। এখন তা কমে হয়েছে দুই লাখ। নেতাজীর নাতনি পাকিস্তানীদের পোষ্য শর্মিলা নামে এক মহিলার হিসাব-হাজার তিনেক। আমার গবেষণায় দেখেছি এ সংখ্যা ৬ লাখের মতো। কেন গণহত্যা ও ধর্ষণের সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরি বা প্রশ্ন তোলা? এর কারণ, পাকিস্তানী ও তার সংযোগীদের অপরাধটা খাটো করে দেখা। শাহরিয়ার যেমন এক টক শোতে বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধ বিচার এখন এমন একটি পর্যায়ে যখন বিভিন্ন ব্যক্তি বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান উচ্চ স্বরে বলছে, এই সরকারের আমলে যত হত্যা, খুন গুম হয়েছে তা আর কখনও হয়নি। অর্থাৎ ১৯৭১ সালেও এমনটি হয়নি, আওয়ামী লীগ আমলে যা হয়েছে। এসব কিছুর পেছনে একটি রাজনীতি আছে। সেই রাজনীতিটা হলো, মনোজগত থেকে মুক্তিযুদ্ধের আধিপত্যটা হ্রাস করা। জিয়া-গোলাম আযমকে স্থান করে দেয়া।
আমার মনে হয়েছে, গণহত্যার ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন, নারী লাঞ্ছনা নিয়ে ছোট ছোট এলাকা ধরে কাজ করা। আশার বিষয় অনেক তরুণ এ ধরনের কাজ করছেন। এগুলো মুক্তিযুদ্ধকে বোঝার, মুক্তিযুদ্ধের জন্য যে আত্মত্যাগ এসব বিষয় তুলে ধরবে। এবং এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াস একত্রিত করে পরে গণহত্যা ও নির্যাতন নিয়ে বিশাল জাতীয় দলিল প্রস্তুত করা যাবে। অধ্যাপক ফায়েক উজ জামান খুলনার একটি পরিবার নিয়ে এরকম একটি প্রবন্ধ পড়লেন যা আমার ভালো লেগেছে। শুধু তাই নয় আমি তো বটেই, আমাদের অনেকে মনে করি, ১ মার্চ বা ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক। পাকিস্তান বাহিনী ১ মার্চ থেকে হত্যা শুরু করে। ১-২৫ মার্চ পর্যন্ত তারা প্রায় ৩০০ জনকে হত্যা করে। নির্মূল কমিটিও ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের আহ্বান জানিয়েছিল।
আজ বিচার প্রক্রিয়া, বিচার নিয়ে জাতি দু’ভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীর কোন দেশে যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে মানুষ বিভক্ত হয়নি। এবং বিএনপি-জামায়াতের নেতারা, মিডিয়ার মালিকরা সূক্ষ্মভাবে স্থূলভাবে ঢালাওভাবে বিচারের বিরোধিতা এবং যারা বিরোধিতা করছে তাদের সমর্থন করছে। কিন্তু তৃণমূল মানুষ বা লুঙ্গিপরা মানুষরা কী ভাবছে?
আমি দু’একটি উদাহরণ দিই। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের যত ছবি দেখবেন, তাতে দেখবেন মুক্তিযোদ্ধারা সব লুঙ্গি পরা। আমার প্রয়াত ছাত্র তারেক মাসুদ। মুক্তিযুদ্ধের কথা নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিল। সেখানে একটি দৃশ্য আমার মনে গেঁথে আছে। এক ইউনিয়নে এক কৃষককে তারেক মাসুদ মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের উত্থান নিয়ে প্রশ্ন করছিলেন। কৃষকটি একটু স্মিত হেসে বললেন, ‘আমাদের ইউনিয়নে চেয়ারম্যান বানাইছি এক রাজাকারকে যার ভয়ে আমরা পলাইয়া থাকতাম। তো দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যদি আমরা একজন রাজাকারকে চেয়ারম্যান বানাই তা হইলে তো আমরা কুত্তা হইয়া গেছি? কী বলেন?’ ভোট দিয়ে এলাকার লোকেরা এ কাজ করেছে, তিনি নিজে হয়ত এর সঙ্গে যোগ দেননি। কিন্তু এ রকম একটি কাজ যে হলো তাতে তার নিজেকে কুকুরের মতো মনে হচ্ছে। এখন টিভিতে যখন দেখেন বিএনপি-জামায়াত লেফটি সুজন সুশীলরা নানাভাবে বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলে তখন তাদের তৃণমূল কীভাবে দেখে তা হয়ত অনুধাবন করবেন।
বেশ কিছুদিন আগে আমি এক মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথা পড়েছিলাম। এ মুহূর্তে লেখকের নাম মনে পড়ছে না। ছাত্রাবস্থায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন এক সুবাদার। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে ছিলেন। অবসর নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বসবাস করছিলেন, স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ ও এক নাতনিকে নিয়ে। প্রশিক্ষককে সবাই ‘ওস্তাদ’ বা ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে। তো সুবাদার যোদ্ধাদের বলেছিলেন তাকে ‘ওস্তাদ’ বা ‘স্যার’ বলা যাবে না। মুক্তিযোদ্ধারা জিজ্ঞেস করলেন তা হলে কী নামে তাকে সম্বোধন করতে হবে। তিনি বললেন, ‘হারামজাদা’। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ঐভাবে সম্বোধন করতে পারতেন না। ‘ওস্তাদ’ বললে তিনিও সাড়া দিতেন না। তবুও দিন চলছিল। এক বৃষ্টির দিনে লেখক তাকে ভুলে ‘ওস্তাদ’ ডেকে ফেললেন। এই ‘ভুলের’ জন্য তাকে শাস্তি দেয়া হলো। শাস্তি শেষ হওয়ার পর লেখক বললেন, তারা মুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্ছায় যুদ্ধ করতে এসেছেন। তাদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ বিধেয় নয়। সুবাদার যদি ‘হারামজাদা’ বলার রহস্য ভেদ না করেন তা হলে তারা প্রশিক্ষণ নেবেন না।
সুবাদার জানালেন, তাদের গ্রামে তখনও বড়সড় কোন হামলা হয়নি। কিন্তু একদিন গোলাম আযমের অনুচররা পাকিস্তানী সৈন্যদের তার বাড়ি দেখিয়ে দেয়। সুবাদার হিসেবে তখন সে টার্গেট। সেনাবাহিনী এসে তাকে কাঠের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেলে। ছেলে বাধা দিতে গেলে তাকে গুলি করে হত্যা করে। মা তখন এগিয়ে গেলে তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করে। তারপর পুত্রবধূকে ধর্ষণ করে হত্যা করে। কিশোরী নাতি তখন খালি আকুল হয়ে ‘দাদা’ ‘দাদা’ বলছিল। তাকেও ধর্ষণ করা হয়। সুবাদার চোখে পানি নিয়ে বলেছিলেন, আমি কিছু করতে পারি নাই। কিছু করতে পারি নাই। আমি হারামজাদা না কি মানুষের বাচ্চা?
টিভিতে যারা বলে এত বছর পর বিচার কেন, টিভিতে যারা বলে বিচার স্বচ্ছ হতে হবে; মওদুদ বা খোন্দকার মাহবুব বা রাজনৈতিক নেতারা এখন যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনে এগিয়ে যায়, এ প্রজন্মে যে যুবক তরুণী তাদের সমর্থনে মানববন্ধন করে, যে সব এ্যাকাডেমিশিয়ান এ বিষয়ে বলে নিরপেক্ষ থাকতে হবে বা এগুলো রাজনৈতিক ইস্যু, হে পাঠক, তারা কি মানুষের বাচ্চা?
ধর্ষণের কথা বলি। ১৯৭২ সালের বীরাঙ্গনাদের কেসস্টাডিগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। সৌভাগ্যবশত এর ৮০টি আমি পেয়েছি যা নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে একটি বই প্রকাশিত হচ্ছে। সেখানকার একটি কেস স্টাডির কথা বলি।
মেয়েটি থাকত ধানম-িতে বাবা-মার সঙ্গে। মে মাসের দিকে সে নিউমার্কেট গিয়েছিল কিছু কেনাকাটা করতে। তারপর সে ফিরে আসে। কিন্তু গোলাম আযমের অনুচররা তাকে অনুসরণ করে বাসা চিনে যায়।
রাতে পাকি ও গোলামের অনুচররা বাসা ঘিরে ফেলে। কিশোরীটিকে তুলে নিয়ে যায় ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে তাকে প্রতিদিন ৬/৭ জন ধর্ষণ করত। নিয়মিত খাবার দিত না। মেয়েটি মরণাপন্ন হয়ে ওঠে। তখন তারা তাকে তার বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে যায়। কিশোরীটি মাস দুয়েক পর সুস্থ হয়ে ওঠে তখন গোলামের অনুচররা আবার পাকিদের নিয়ে আসে। এবার তারা বলে, প্রতিদিন বিকেলে তারা মেয়েটিকে নিয়ে যাবে এবং সকালে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। বিজয়ের আগ পর্যন্ত এরকমটি চলে।
এখন যারা যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন করে তাদের মা-বোন, স্ত্রী বা কন্যাকে যদি প্রতিদিন বিকেলে নিয়ে সকালে ফেরত দিত তাহলে কি তারা বিচার চাইত? আপনারা ভাববেন এটি রাগের কথা। না, আমার মনে হয় তারা খুশি হতো। কারণ মা বোন স্ত্রী কন্যাকে তো পাকিস্তানীরা ভোগ করছে। তাদের কাছে এটি সম্মানের, গর্বের।
বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে ঠিক এই কাজটিই করবে। মওদুদ, খোন্দকার, মাহবুব, তরিকুলের মতো প্রাক্তন লেফটি টকশোর লেফটি মিডিয়ার লেফটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদাধিকার বলে বুদ্ধিজীবীদের কাছে তা উপভোগ্য? আপনার কাছে? এদের আপনি কী বলে সম্বোধন করবেন? তৃণমূল যেভাবে সম্বোধন করে সেভাবে। সুবেদার তার স্ত্রী, পুত্রবধূর সম্মান বাঁচাতে পারেনি বলে নিজেকে হারামজাদা বলে; আর যারা এটি সমর্থন করে তাদের মতো হার্ডকোর হারামজাদা পাওয়া দুষ্কর।
পুরনো কথায় ফিরে আসি। মফিদুল, শাহরিয়ার যেভাবে আইন-আদালতের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তাতে সবাই উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন। সরকারের কোন মন্ত্রী বা সরকারদলীয় কোন নেতা এত পরিচ্ছন্নভাবে যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেননি। তাদের কথা শুনে যে সবাই হাসাহাসি করে এটি বোঝার ক্ষমতাও তাদের নেই। ট্রাইব্যুনাল করে এ সরকার অভিনন্দনযোগ্য কাজ করেছে বটে, কিন্তু ট্রাইব্যুনালের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি দেখে মনে হয়, মানুষ তেমনভাবে না চাইলে তারা এটি করত না। বিএনপি-জামায়াতের জনসমর্থন মিডিয়ার মতে বাড়তে পারে। তাতে কিছু আসে যায় না। শিবিরÑঅধ্যুষিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শাহরিয়ার, মফিদুল বা যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে যদি এত মানুষ আগ্রহ সহকারে শুনতে আসে তাহলে বুঝতে হবে এই বিচার প্রক্রিয়া চাইলেই বন্ধ করা যাবে না। করলে বাংলাদেশ গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হবে।
No comments